বিকট গন্ধে সবার প্রাণ যাই-যাই অবস্থা। নাকে কাপড় চেপে লাভ হচ্ছে না। কারো গলায় বমি আটকে আছে, কারো মাথা ঘোরাচ্ছে। রুপন্তির গা গোলাচ্ছিল। সে দৌড়ে চলে গেল ভেতরে। ওয়াশরুমে গিয়ে হড়হড় করে বমি করল। রুবিনা হাতমুখ ধুইয়ে দোতলায় নিয়ে গেলেন ওকে। কিছুদিন ধরে ওর কাহিল চেহারা লক্ষ করছেন। তুহিনের শোক ভুলতে সময় লাগবে ভেবে ঘাটাননি। এখন মনে হচ্ছে ঘটনা অন্যকিছু। সে কথা বলতেই রুপন্তি মাথা নেড়ে সায় দিল। জানাল, প্রেগন্যান্সি কীটের ফলাফল ইতিবাচক। রুবিনা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কেবল।
পুলিশ কাউকে লাশ দেখতে দিল না। দেখার কিছু নেই অবশ্য। পচে-গলে একাকার হয়ে গেছে। পুলিশের একটা দল সেটাকে ময়নাতদন্ত করতে নিয়ে গেল। আরেকটা দল রয়ে গেল সরেজমিনে তদন্ত করতে। লাশ যেখানে পাওয়া গেছে, সেই জায়গাটা ভালোভাবে অনুসন্ধান করল। পেছনের গেট সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। দেড় মাস আগে হামলা হবার পর তালা ভাঙ্গা ছিল। তখন জঙ্গলের ভেতর খুঁজে দেখলেও লাশ যেখানে পাওয়া গেছে, সেদিকে যাওয়া হয়নি। জায়গাটা ভেতরের দিকে।
চারদিকে গাছের ঘন সারি থাকায় দিনের বেলায় তেমন আলো নেই। কিছু পায়ের ছাপ পাওয়া গেল। হামলাকারীরা কোন পথে এসেছিল, নিশ্চিত জানা গেল। রক্তের দাগ দোতলা থেকে নেমে এলেও নিচতলার লাউঞ্জে এসে কোনো চিহ্ন ছিল না। পুলিশ ধরে নিয়েছিল, মেইন গেট দিয়ে বেরিয়েছে হামলাকারীরা। সকাল থেকে মানুষজনের চলাচলের কারণে পায়ের ছাপ মুছে গেছে। এখন পরিস্কার হলো। বসার রুমের কার্পেটে কালোর মধ্যে কারুকাজ করা। সেকারণে রক্তের দাগ লক্ষ করা যায়নি। পরীক্ষা করলে কার্পেটেও রক্তের দাগ পাওয়া যাবে।
খবর শুনে অনেকেই ভিড় করল বাড়িতে। আশরাফ সাহেব আর নাসরিন এলেন। রুপন্তির অভিব্যক্তি জানতে উদগ্রীব সবাই। বরাবরের মতোই রুবিনা কাউকে দেখা করতে দিলেন না ওর সাথে।
পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেই ওকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুমুতে পাঠিয়েছেন। তুর্যকে নিয়ে তুহিনের বেডরুমে ঘুমুচ্ছে সে। লাশ দেখে তার মনে নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। লাশটা তুহিনের হতে পারে, এমন সম্ভাবনা-ই মাথায় আসেনি। ফাহিম বাইরে বেরিয়েছিলেন আবার। রাতে ফিরতেই রুবিনা চেপে ধরলেন,
- সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি?
- থানায় গিয়েছিলাম। এরপর ভাইজানকে লাশ পাবার খবরটা জানিয়ে এলাম।
- ফোনে বললেই পারতে। এদিকে বাড়িভর্তি মানুষ। নানাজনের নানা প্রশ্ন। পত্রিকা অফিস থেকেও এসেছিল। এত ঝামেলার মধ্যে আমাকে একা ফেলে যেতে পারলে?
ফাহিম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
- ফোনে বেশি কথা না বলাই ভালো, রুবি। তাছাড়া শুধু খবরটা দিতে যাইনি। ভাইজানের মুখ থেকে পজিটিভ কিছু শোনার আশায়ও গিয়েছিলাম।
- কী বললেন ভাইজান?
- যা অনুমান করেছি, তাই। ওকে কিডন্যাপ করতে এসে জখম করেছিল। বাড়ি থেকে বের করতে না করতেই জান বেরিয়ে গেছে। তাই লাশটা ওখানেই......
- ফাহিম! কী বলছ এসব? ভাইজানও এমন কথা বলতে পারলেন?
- কী জানি। মনে হলো জোর করে বললেন কথাগুলো। এদিকের কী খবর?
- এদিকের অবস্থা গরম। তুহিনের চাচি অসম্ভব পরিমাণে বেয়াদব মহিলা। এত ঠাটবাট আর টাকার অহংকার! মাটিতে পা-ই পড়তে চায় না তার। নিচতলায় বসে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছে রুপন্তি আর আমাকে। অন্যসময় রয়ে-সয়ে বলে।
আজ সবার সামনেই বলেছে, রুপন্তি খুন করে জঙ্গলে লাশ লুকিয়েছে। সহযোগী ছিলাম আমরা। প্ল্যান করে আমাদেরকে এই বাড়িতে ঢুকিয়েছে। আমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। ওই মহিলাকে আর একবারও এই বাড়িতে দেখতে চাই না, ফাহিম। নেক্সট টাইম কিছু বলতে এলে আমি তাকে আমার পরিচয়টা দিয়ে দিব। বড় মুখ করে বলতে আসে, আমি তুহিনের মায়ের মতো। আরে, এই মহিলার গল্প ভাইজানের কাছে, তোমার কাছে অনেক শুনেছি। মহিলা সারাজীবন স্বামীসংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কখনো মা-মরা এতিম বাচ্চাদের মাথায় হাত রেখেছে কি না সন্দেহ। আবার মুখ নেড়ে বলতে আসে। তুহিনের মা হতে গেলে ওই মহিলাকে আরও সাতবার জন্ম নিতে হবে। তাও কোনোদিন তানিয়াপার সমকক্ষ হতে পারবে না। নিজের ছেলেমেয়েদের তো মানুষ করতে পারেনি। দুটোই পরের বউ, পরের স্বামীর দিকে হাত বাড়ায়। আবার জাহিন-তুহিনের ক্যারেকটার নিয়ে কথা বলতে আসে।
রুবিনার ক্রোধের কারণ বুঝতে পারছেন ফাহিম। কম সহজে ক্ষেপে যাবার মানুষ নয় সে। তবু বললেন,
- ধৈর্য ধরো, রুবি। আজকে পরিচয় গোপন রেখেছ বলেই এসব মানুষদের আসল চেহারা দেখতে পাচ্ছ। এজন্যই ভাইজান আমাদেরকে কাজে লাগিয়েছেন। তুহিনের কেসে আমরা অফিশিয়ালি কাজ করতে পারব না। কিন্তু ইনফরমালি অনেক ক্লু দিতে পারব।
- আমার মনে হচ্ছে, তুহিনের গুম হবার পেছনে এদের হাত আছে। জাহিন-প্রিয়ন্তিকে এরাই প্ল্যান করে মেরেছে। আর দোষ চেপেছে তুহিনের উপর। এই মহিলা তুহিন নিখোঁজ হবার পর থেকে বারবার বলছে, তুহিন মরে গেছে। এতটা কনফার্মড সে হয় কীভাবে?
ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ফাহিম।
সেই অবস্থাতেই বললেন,
- আমারও তাই মনে হয়। তবে আশরাফ ভাইয়ের ব্যাপারে ভাইজান কনফিউজড। আশরাফ ভাই জাহিন-তুহিনকে অনেক ভালোবাসতেন। স্ত্রীর নাকউঁচু স্বভাবের কারণে কখনো তেমন করে কাছে টানতে পারেননি।
- মানুষ পাল্টাতে সময় লাগে না। সম্পত্তির লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়।
- তা ঠিক। তুহিন আর তুর্যকে সরাতে পারলে সব তাদের হাতেই যাবার কথা।
- উহু, আল্লাহর হিসেব অন্যরকম। রুপন্তি মা হচ্ছে।
ফাহিম অবাক সুরে বললেন,
- কী বলো? সত্যি?
-
- হ্যাঁ, আজ দুপুরে জানলাম। আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। কিন্তু রুপন্তিকে কীভাবে সামাল দেব? আজ লাশ পাওয়া গেল আর আজই এমন সুখবর পেলাম।
- দেখা যাক কী হয়। পোস্টমর্টেম হবে, স্যাম্পল কালেক্ট করবে লাশ থেকে। সেগুলো তুহিনের সাথে ম্যাচ করতে হবে। পরনের জামাকাপড় বা সাথে যদি কিছু থাকে, তুহিনের লাশ হলে তো তুহিনের কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই।
সারারাত ঘুম হলো না ফাহিমের। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে উঠে পড়লেন। লিভিঙরুমে গিয়ে টিভি অন করলেন। এত রাতে দেখার মতো কিছু নেই। তবু ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ভেতরটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। পুরনো কথা মনে পড়ছে। ছোট্ট তুহিনকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াবার কথা, ভাত মেখে খাইয়ে দেবার কথা। তুহিন তার ন্যাওটা ছিল। সারাক্ষণ মামা-মামা করত। ইমতিয়াজ সাহেব পছন্দ করতেন না। মামার সাথে ছেলের ঘেঁষাঘেঁষি নিয়ে প্রায়ই স্ত্রীকে কথা শোনাতেন।
ছেলেরা যাতে মামাভক্ত না হয়, সেদিকে সতর্ক নজর রাখতেন। তারপরও তুহিন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলা তার রুমে চলে যেত। মামার কোলে গুটিসুটি মেরে ঘুমুত। স্কুলের সময়টা বাদ দিয়ে বাকি সময় আশপাশে ঘুরঘুর করত দু’ভাই; অবশ্যই ইমতিয়াজ সাহেবের অগোচরে। তিনি যতক্ষণ বাসায় থাকতেন, ততক্ষণ তারা মামাকে চিনতই না।
বিশেষ করে ছোট্ট তুহিন সহজেই বুঝে নিয়েছিল আব্বুর সামনে মামার সাথে আদিখ্যেতা দেখালে আম্মুকে কাঁদতে হবে। দুটো পুতুলের একজন আজ মৃত, অন্যজন নিখোঁজ। এই বাড়ি জুড়ে এদেরই স্মৃতি। টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও ফাহিমের মনে হলো, ঠিক পেছনেই ওরা দুই ভাই দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষুণি বুঝি কানের কাছে মামা বলে চিৎকার করবে! ঘাড়ের কাছটায় শিরশিরও করছে। ইচ্ছে করেই ঘাড় ঘুরালেন না তিনি। এত কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নেই তার।
Review by naima islam
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....