বিভেদকামী শক্তির সম্মুখে ঐক্যের আরশি
অনেক ফুল দিয়ে গাঁথা মালাকে একটানে ছিঁড়ে ফেলা গেলেও,গাছের পুষ্প প্রস্ফুটনকে যেমন স্তব্ধ করা যায় না।তেমনই ফুল ফুটলেই মালা গাঁথার মানুষগুলিও থাকবে।একই রকমভাবে হঠাৎ কোন হীনস্বার্থবুদ্ধি নিয়ে সমাজের নানা বৈচিত্র্য বিভিন্ন পার্থক্যের রঙ রূপ রস নিয়ে গ্রন্থিত মালা ছিঁড়ে ফেলার অপচেষ্টা প্রচন্ড রকম সক্রিয় থাকলে তার বিরুদ্ধে চোরা স্রোতের মত বয়ে চলে মিলনের গতিধারা।শত শত বছর ধরে খাদ্য ধর্মাচরণ পোষাক আচার-বিচারে কত শত বিভিন্নতা নিয়েও ব্যাথা বেদনা আনন্দ হাসি কান্নার অংশীদারিত্বের ভাগ নিতে নিতে এক হয়ে থাকাটা এক স্বাভাবিকত্বে পর্যবসিত হয়ে গেছে।আর এই ঐক্যবন্ধনের জন্য কোন বই পড়া তত্ত্বের প্রয়োজন নেই।আজকের এই প্রযুক্তি বিস্ফোরণের যুগে মিথ্যাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সত্য বলে হাতের মুঠোতে মুঠোতে পৌঁছে দিয়ে বিচ্ছেদের দাবানল তৈরি করে স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টায় রত একশ্রেণী,তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একদল শুধুই তত্ত্ব কথা আউড়ে ঐক্যের আহ্বানে বাজার সরগরম করছেন। বিচ্ছেদ-ঐক্যের এই কোলাহলকে পাশ কাটিয়ে শুকিয়ে যাওয়া নদীর বালি খুঁড়ে সন্ধানী যেমন জল খুঁজে আনে ঠিক তেমনি করেই চন্দ্রপ্রকাশ সরকার ঐক্যের এক অন্তসলিলা স্রোতকে সামনে এনেছেন তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত পুস্তক 'সম্প্রীতির বীজতলা' নামক গ্রন্থে।
মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে প্রকাশিত সংবাদ সাহিত্য সাপ্তাহিক 'ঝড়' পত্রিকায় 'আবছার মামা,আমার দিদিমা ও সাম্প্রদায়িকতা' শীর্ষক ধারাবাহিক হিসাবে ৭১টি কিস্তিতে প্রকাশিত হয় আলোচ্য গ্রন্থের নিবন্ধ গুলি।ঝড় পত্রিকায় প্রকাশ কালেই বিষয়বস্তু দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের নতুনত্বে তা সংবেদনশীল পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।
বর্তমান সময়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদ এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে একথা অনস্বীকার্য।ধর্ম বর্ন খাদ্যাভ্যাস ভাষা পোষাক বিচ্ছেদের সব আয়োজন নিয়ে কালনাগিনী যেন দংশন করতে উদ্যত।বিভেদের বিষ অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মত মনকে জীর্ণ অবশ করে তোলে,যুক্তি মানলেও বিশ্বাসটা ঠিক আসে না।তাই তত্ত্ব কথা তখন অনেকটা 'চোরা না শোনে ধর্মকথা' হয়ে যায়।অপরদিকে এহেন পরিস্থিতিতে অনেক সাধারণ মানুষ ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলাটিকেই কাম্য বলে বোধ করেন।কিন্তু কোনটিই বিভেদকামী শক্তিকে শক্তিহীন করতে প্রমানিত পন্থা নয়।তখন প্রয়োজন রোগ প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধির।সমাজের অন্তর্নিহিত সেই প্রতিরোধক শক্তিকেই তুলে এনে অতি যত্নে এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন চন্দ্রপ্রকাশ বাবু।তত্ত্বের কচকাচানি নেই।নিজের দেখাশোনা চারপাশের প্রতিদিনের স্বাভাবিকতায় সহজ সরল করে তুলে ধরেছেন।ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর জমিতে অন্য ধর্মালম্বীর উপাসনা গৃহ নির্মানের কথা যেমন এসেছে ঠিক তেমনই ভালোবেসে এক ধর্মের নারী অন্য ধর্মাবলম্বীর ঘর করার কথাও উঠে এসেছে।তার সাথেই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্নতার প্রতিবন্ধকতা এবং সাহসী সমর্থনের জীবন্ত দৃষ্টান্ত।এমন প্রাঞ্জলতায় উঠে এসেছে গভীর তত্ত্ব কথা যা প্রাণের সুর হয়েই ভেসে এসেছে,লেখকের দিদিমার গভীর বিশ্বাস,"মানুষ হয়ে মানুষকে ঘেন্না করতে হয় না" ঘটনা পরম্পরায় এমন ভাবে এসেছে যেখানে পাঠকের মনের গভীর গহীনে থাকা সামান্যতম বিদ্বেষও ধাক্কা খাবে।একই সাথে প্রকাশিত হয়েছে ভালোবেসে সমাজের আচার বিচারকে উপেক্ষা করে নতুন মূল্যবোধের আধার তৈরির দৃষ্টান্ত।বদলে যাওয়া মানুষ,চোখের জল,হাসি কান্না আনন্দ সব মিলে যেন সমাজের এক জীবন্ত চলমান ছবি হয়ে উঠেছে এ গ্রন্থ।এসেছে রাহাতউদ্দিন বাবুর চা খেয়ে রোজা করার দৃষ্টান্ত।
আলো ছায়া রাগ ক্ষোভ আনন্দ হাসি সব মিলিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজের দলিল সামনে রেখে লেখক বিভাদকামীদের সম্মুখে এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন।বিভেদকামীরা হাওয়ায় বিদ্বেষের বিষ ভাসিয়ে দেয় আর 'সম্প্রীতির বীজতলা' গ্রন্থে লেখক শক্ত মাটি থেকে আজন্ম লালিত রোপিত মিলনের বৃক্ষ তুলে এনে মহীরুহের কামনা করেছেন।
পড়তে পড়তে এসে গ্রন্থের একদম শেষে একটু হলেও থমকে যেতে হল।যেখানে লেখক বিশেষ এক রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে অন্যদেরও তেমন দেখতে চেয়েছেন(যা চেয়েছেন তেমন হলে হয়ত ভালো হত)।যে গতিতে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল ঘটনার গতিধারায়,সেই প্রবাহেই তাকে প্রবাহিত হতে দিলে পাঠক হয়ত ঠিক উৎসমুখ খুঁজে নিত ।
কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের প্রচ্ছদ বইয়ের বিষয়বস্তুর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ,গৌরগোপাল ভৌমিকের অলঙ্করণ,অংশুমান রায়ের অক্ষর বিন্যাস সর্বোপরি মুদ্রণ এবং কাগজের গুনগত মান বইটিকে আরও সুখপাঠ্য করে তুলেছে।ছাপাখানার ভূতের প্রভাবে মুদ্রণজনিত প্রমাদ তেমন নজরে পড়েনি।শিল্পনগরী প্রকাশনার এই বই উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে সেরা গ্রন্থ হয়েই থাকবে বলে আমার মনে হয়।
--- আবুল খায়ের
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....