বই : হাঁসুলী বাঁকের উপকথা৷ লেখক : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ book review with upcoming pdf

বই : হাঁসুলী বাঁকের উপকথা৷ 

লেখক : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ 

গায়ের দাম : ৩৫০৳

প্রকাশনী : সূচয়নী পাবলিশার্স। 


কোপাই নদীর ধারের বাঁশিবাঁদি গ্রাম৷ সব মিলিয়ে তিরিশ ঘর কাহার উপজাতির বাস৷ কাহারেরা দুটি পাড়ায় বিভক্ত ছিল। বেহারা পাড়া এবং আটপৌরে পাড়া। দুই পাড়ার কাহাররাই ব্রহ্মদৈত্যতলার 'কর্তাবাবাকে' খুব মানে৷ তাদের আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-শোক, কাজ-কর্ম, হাসি-কান্না সব কিছু সেই জায়গাকে ঘিরে৷ কাহার সমাজে নারী পুরুষের অঙ খেলা (প্রেমলীলা), বিয়ে-সাঙা, মদের আসর, মনিবের অবিচার, কৃষিকাজ, একে অপরকে গালাগালি-শাপান্ত সবই নিত্য, সবই সনাতন। পৃথিবীতে যুদ্ধ লাগলে কাহারদেরও ভাগ্য পোড়ে৷ এসব কাহারদের সবাই মেনে নিলেও মানে না করালী৷ 


সে এসব কৃষিকাজ করে না দূরের চন্দনপুরে রেললাইনে মজুর খাটে। সে দৃঢ়চেতা কাউকে মানে না। বনওয়ারী কাহারপাড়ার মাতব্বর। সনাতন কাহার নীতি মেনেই চলে। এই রীতি মানা রীতি ভাঙা নিয়ে বনওয়ারী আর করালীর দ্বন্দ্ব দেখা যায়। করালী ধীরে ধীরে কাহার পড়ার পুরানো বিশ্বাসে ভাঙন ধরায়। সে কত্তা বাবার বাহন সাপটিকে পুড়িয়ে মারে, তার পর বেলতলা ও শ্যাওড়া গাছের বন পরিষ্কার করে। 


ধীরে ধীরে কাহার দের পুরানো বিশ্বাস ও সংস্কারের পরিবর্তন সাধিত হয়। করালী এজন্য পুরো পাড়ার চক্ষুশূল হয়। আবার বনওয়ারী আর অন্য পাড়ার পরম মাতব্বরের বৌয়ের প্রেমলীলা পানা দেখতে পেয়ে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে দেয়৷ পরম আর বনওয়ারীর সেই নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়, কালোশশী ঘটনাচক্রে পরমের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়াতে গিয়ে সাপে কেটে দহে পরে জীবন দেয়। পরম নিরুদ্দেশ হলে অন্য পাড়ার কাহাররা একসাথে বনওয়ারীর মাতব্বরি মেনে একসাথে আসে৷ 


সেই জন্য আটপৌরে পাড়ার সুবাসীর সাথে বনওয়ারীর দ্বিতীয় বিয়ে হয়৷ এরপর আসে যুদ্ধ আর সুবাসীর সাথে রং লাগায় করালী। সেই নিয়ে করালী বনওয়ারীর দ্বন্দ্ব হলে করালী বনওয়ারীকে পরাজিত করে। অসুস্থ অচেতন বনওয়ারী দুই মাস পরে প্রকৃতস্থ হলে দেখতে পায় কর্তাবাবার স্থান তুলে দিয়ে সেখানে মোটর রাখার জায়গা করা হয়েছে। 

বাঁশবাঁদির সব বাঁশ বিক্রি করে দিয়েছে করালী। কাহারেরা সবাই কারখানায় গিয়ে জুটেছে। সুবাসী চলে গিয়েছে করালীর হাত ধরে। কাহারপাড়ার আত্মা বনওয়ারী এসব আর সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। এরপর কোপাই জুড়ে ভীষণ বান আসে। সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷ নির্জন বাঁশবাঁদি লোকাভাবে শূণ্য পরে থাকে৷ কাহাররা সবাই যে যার মতো ভিক্ষা বৃত্তি করে, কারখানায় খাটে। করালী ফিরে আসে বাঁশবাঁদিতে। নতুন ঘর তোলার জন্য কোপাতে থাকে পলি ঢাকা মাটি৷ 


"দাঁড়াও গিয়ে কোপাইয়ের কূলে৷ দেখবে, আজ যেখানে দহ, কাল সেখানে চর দেখা দেয়, শক্ত পাথুরে নদীর পাড় ধসে সেখানে দহ হয়।" এই দুটো লাইন দিয়েই পুরো উপন্যাসটির মূল উদঘাটন করা যায়। কাহার মূলত উপজাতি। উপন্যাসে দেখা যায় এদের সমাজের নিচুতলার স্থান দেওয়া হয়েছে। বনওয়ারী কাহার সনাতনপ্রথা অনুসারে বাপ দাদার দেখানো পথেই চলতে চেয়েছে পুরো পাড়াকে সাথে নিয়ে। পরিবর্তনে তার ভীষণ ভয়৷ কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। 

সময় বয় কোপাইয়ের জলের মতো নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। করালীর মতো কোন যুবক এসে সেই আদ্যিকালের কু বা সু সংষ্কার, আচার ভাঙতে চায়। জীবনের গতিতে গা ভাষাতে চায়৷ বনওয়ারী যেখানে সমাজের কথিত বড় জাতের সব অত্যাচার সহ্য করে, পূণ্য হিসেবে ধরে। করালী সেইখানে রুখে দাঁড়ায়, প্রতিবাদ করে৷ আবার দুয়েরই উদ্দেশ্যও কখনো এক হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের গায়ে যখন আঁচ লাগে তখন পুরো কাহার পাড়া সেই আঁচে রাঙিয়ে ওঠে। তারা পরিবর্তন চায়, পরিবর্তন আসে। 

এই উপন্যাসে শুধু একটি চরিত্রই প্রধান হয়ে ওঠেনি, বরং সব চরিত্রই সমান গুরুত্বপূর্ণ৷ কাহার সমাজের মধ্য দিয়ে নিজের দর্শনবোধের পসরা খুলে বসা যাবে আনায়াসে। পাপ-পূন্যের বাটখারায় ওজন সব সময় বাড়তে কমতে থাকবে। 


তারাশঙ্করের লেখনী নিয়ে বলার মতো কিছু নেই। থাকলেও সেই স্পর্ধা আমার হয়ে ওঠেনি। তাই ওসব রেটিং দিয়ে পাঠকের ভালো মন্দের ভার নিতে আমি অপারগ। তবে এটুকু বলতে পারি বইটি দারুণ কিছু শেখাবে।

অক্ষর প্রকৃত জ্ঞান বাড়াক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ