বইঃ শ্বেতপদ্ম লেখক : তাবারক হোসেন

উপন্যাস: শ্বেতপদ্ম
লেখক : তাবারক হোসেন
রিভিউ এবং ছবি : Audity Mehnaz 


শ্বেতপদ্ম। ভূমিকা থেকে জানা যায়, মানবপ্রেম এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। ভূমিকাটা পড়েই লেখকের সম্পর্কে এটুকু ধারণা হবে যে লেখক কতটা ভালোবাসেন এ বইটাকে। হ্যাঁ, প্রত্যেকের কাছেই তার লেখারা দামী। কিন্তু কেউ যখন তার জীবন সংশয়ে থাকা অবস্থায়ও নিজের পরিবারের সাথে নিজের লেখার কথাও ভেবছেন।
অনেকবার পড়েছি ভূমিকাটা। যতবারই পড়ি চোখে কেনো যেনো অশ্রু চলেই আসে।

কাহিনি সংক্ষেপ:

অর্পিতা এবং নাফিস মিলে দুজনের সংসার। আজীম তাদের এমন এক বন্ধু যিনি অনেক উদার এবং পরোপকারী। একদিন দেশের বাইরে থেকে অতিথি হয়ে তাদের সাথে যোগ দেন  ডাক্তার আবীর। পেশায় অর্পিতাও ডাক্তার,  স্বামী নাফিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর আজীম লেখক।  সেই আবীর ভাই ছিলেন অর্পিতা, নাফিস, আজীম, ঝুমুরের মেন্টর।  

নাফিস-অর্পিতার ভালোবাসা পূর্ণতা পেলেও অপূর্ণ রয়ে যায় আবীরের ভালোবাসা, শূণ্য থাকে আজীম।
আজীমের জোছনা সেই শূণ্যতা পূর্ণ করার সুযোগ দেয়নি। আজীমের বুকভরা ভালোবাসা শুধু আজীমের কাছেই রয়ে যায়। কিন্তু যখন জোছনা আসে তখন দুজনে মিলেই এই জীবনের অন্যপ্রান্তে পাড়ি দেয়। 
আবীর আর ঝুমুরের জীবন বহু বছর পরেও সেই কলেজ জীবনের ভালোবাসাতেই আটকে রয়ে যায়। পাড়ার এক বখাটের স্ত্রী হয়েও ভালোবেসে যায় আবীরকেই। 

শুধু এই কয়েকজন নয়, তাদের সাথে আরো অনেক চরিত্রই সামনে আসে। সালমা, জামাল-প্রজাপতি, অর্পতার মা এবং অবশ্যই নাবিলা।

জামাল-প্রজাপতি দম্পতির কথা না বললেই নয়। জামাল একজন খেটে খাওয়া মানুষ, যার মনে রয়েছে স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। তাদের সাথে আজীমের এক বন্ধন গড়ে উঠে যা সচরাচর আমরা দেখতে পাইনা।

আজীমের পরোপকারিতার আরো একটা নমুনা দেখতে পাওয়া যায় রাস্তার পাশে নাচ-গান করে জীবিকানির্বাহ করা এক পরিবারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা থেকে।  

প্রবাসী নাবিলা বাবা-মা'র কাছে দেশের কথা শুনে দেখতে আসে তার দেশকে। সে এমনই এক সময় আসে যখন তার দেশ অসহায়।  ঘটনাচক্রে সেও অর্পিতা-নাফিসের সংসারেই এসে ভীড়ে। সবাই মিলে  নিজেদের উজাড় করে দেয় দেশ মা কে রক্ষা করতে। এভাবেই চলতে থাকে যুদ্ধ... 

উপন্যাসের ধারাবাহিকতায় সোহেল নামক এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের দেখাও পাওয়া যায় যিনি পাঠকদের মনে অনেক প্রশ্ন রেখেও মন ছুঁয়ে যাবেন।  

চরিত্র বিশ্লেষণ:

নাফিস চরিত্রটি যে কারোরই পছন্দ হবার মতো। 
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ যে তার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসে এবং বন্ধু হিসেবেও যার জুড়ি নেই।
আমার সবচেয়ে পছন্দের  চরিত্র হলো নাফিস। যে একই সাথে আজীম এবং তার স্ত্রীর খুব ভালো বন্ধু। অর্পিতার খারাপ সময়ে যে মমতায় আগলে নেয়, অর্পিতাকে সময় দিতে নিজের শত ব্যস্ততায়ও সময় বের করে নেয়, অর্পিতাকে ভরসা দিয়ে বুকে আগলে নেয়..  এমন চরিত্র পছন্দ না হয়ে যায়!

অর্পিতা চরিত্রটিকে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বলা যায়। কখনো সে নীলপদ্ম আবার কখনো সে শ্বেতপদ্ম। স্বামীর ভালোবাসায় আগলে থাকে অর্পিতা। সে এক সাহসী নারী। 
অর্পিতা এমনই এক মেয়ে যে তার মাকে হারিয়ে স্বামীকে আরো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু বিধিবাম!  সেই স্বামীকেও ২৫ শে মার্চ রাতে নিহত হতে হয়।  পরবর্তীতে সে স্বামী হারানোর প্রতিশোধ নিতেই যেনো হয়ে উঠে মুক্তিযোদ্ধা।  

আজীম। নাফিফ-অর্পিতাদের মতো আরেক শক্তিশালী চরিত্র আজীম। সে বড় লেখক এই পরিচয়ের চেয়েও বড় পরিচয় তিনি একজন অসাধারণ মানুষ।  যার হৃদয় পূর্ণ হয়ে আছে জোছনার প্রতি ভালোবাসা দিয়ে। কিন্তু তাই বলে মানবিকতা বা মানবপ্রেম থেকে সে দূরে যায়নি।  জামাল-প্রজাপতি বা সেই নাচুনে মেয়ের পরিবারের জন্যেও তার হৃদয়ে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। বাড়িওয়ালার মেয়ে সালমা তার ছাত্রী এবং তা শুধুমাত্রই ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্কেই আটকে ছিলো। একটা সময় সালমার শূণ্যতাও কষ্ট দেয় আজীমকে। 

আবীর খ্যাতনামা ডাক্তার। জীবনে অনেক এগিয়ে গেলেও ঝুমুরকে সে কখনোই ভুলতে পারেনি। ভালোবাসাগুলো বুঝি এমনি হয়!

নামকরণ: 

নাম দেখে আসলে বুঝতে পারা যায় না কাহিনী ঠিক কি নিয়ে।  শুধুই প্রেম-ভালোবাসা নাকি অন্যকিছু। 
বইটিতে প্রেম-ভালোবাসার সাথে সাথে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ,  এসেছে মানবপ্রেমের এক অসাধারণ চিত্র। 
শ্বেতপদ্ম বলতে এক নারীকেই সংজ্ঞায়িত করা হয়। যে জীবনযুদ্ধের প্রতি ধাপেই ধাক্কা খেয়েছে। হারিয়েছে নিজের সমস্ত কিছু। তাও, তাও সে নিজের  দ্বায়িত্ববোধ থেকে পালিয়ে যায়নি। ভোলেনি তার ক্ষোভ, প্রতিশোধ। 
আমার মতে, 'শ্বেতপদ্ম' নামকরণ যথার্থই ছিলো। পাঠককে মুগ্ধ করতে নামটি যথেষ্ট ভূমিকাই পালন করে। 

মন্তব্য :

বইটির অনেক দিক আছে যেগুলো মুগ্ধ করে রাখবে পাঠককে।  কিছু জায়গায় কাঁদাবেও বেশ। 

নাফিসের এভাবে চলে যাওয়াটা কোনোভাবেই মানা যায়না। 
যখন অর্পিতার স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করার সময় এলো তখন সে হয়ে গেলো নিঃস্ব।  কেয়ারটেকার চাচা আর জামিল-নির্মলা ছাড়া রইলোনা কেউ। 
একটা মেয়ের এভাবে সব হারিয়ে একা হয়ে যাওয়ার যে যন্ত্রণা সেটা ভাবতেও গা শিউড়ে উঠে। 

আজীমের একা জীবন দেখে মায়া লাগে খুব। বেচারা ভালোবাসা দিয়েই গেলো।
এখানে আরেকটা ভালো লাগার দিক হচ্ছে আজীম এবং সালমার মধ্যকার ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্ক। যার মধ্যে কোনো লুকোচুরি বা অন্য চাহিদা নেই। সুন্দর,  সচ্ছ এক সম্পর্ক যা মনে শ্রদ্ধাবোধই জাগায়। 
যখন গাছের ফুলগুলো গাছতলাতেই পড়ে থাকে, কেউ কুড়িয়ে এনে আর আজীমের ঘরের দুয়ারে রেখে যায়না... এ জায়গাটা পড়ার সময়কার শূণ্যতা আজীমের সাথে সাথে পাঠকদেরও ঠিক সে ভাবেই নাড়া দিয়ে যায়। 

জামাল-নির্মলার কাহিনী থেকে আমাদেরও বোধহয় কিছু শিক্ষা নেয়া উচিৎ।  কিভাবে ভালোবাসতে হয় আর কিভাবে ভালোবাসার মানুষকে সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় মূড়ে রাখতে হয়।

আরেকটা ভালোলাগার ব্যপার ছিলো নাবিলার বাবার প্রতি নাবিলার ভালোবাসা। বাবা-মেয়ের ভালোবাসা কি চমৎকারভাবেই না ফুঁটে উঠেছে!

কষ্ট দেয় আজীম আর জোছনার শেষ বিদায়। 'অর্পিতার হাতে আজীমের হাত, আবীরের হাতে জোছনার হাত...'। মৃত্যুর সময় আজীম কাছে পেয়েছে তার ভালোবাসাকে, পাশে ছিলো তার কাছের বন্ধু অর্পিতা। আর অর্পিতা? জীবনে আরো একটা ধাক্কা। কাছের বন্ধুকে হারানোর যন্ত্রণা। যে বন্ধুকে সবসময় পাশে পেয়েছে সে। 

এমন বহু ভালোলাগা, মন্দলাগা নিয়েই 'শ্বেতপদ্ম' এগিয়ে চলেছে। 
ভালোই লাগে যখন ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে দুজনার দুটি পথের সিদ্ধান্ত যখন পাঠকরা নিতে পারেন।

বিঃ দ্রঃ প্রায় বছরখানেক পর রিভিউ লিখেছি।  ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ