বইঃ নবিজি সা. যাঁর আদর্শে বিমোহিত পৃথিবী লেখকঃ ড. রাগিব সারজানি বই রিভিউ

Post ID 111418

বইঃ নবিজি সা. যাঁর আদর্শে বিমোহিত পৃথিবী 
লেখকঃ ড. রাগিব সারজানি
অনুবাদকঃ আবদুন নুর সিরাজি, আম্মার মাহমুদ, মুহাম্মাদ রোকন উদ্দিন 
প্রকাশনীঃ মুহাম্মাদ পাবলিকেশন।
প্রচ্ছদ মূল্যঃ ৭২০ ৳ 
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৬০৮ 


#পাঠ_পূর্ব_প্রতিক্রিয়াঃ 
চারিদিকে বইটির এত আলোচনা দেখে না পড়ে আর রেখে দিতে ইচ্ছে হয়নি। তাই দেরি না করে শুরু করে দিয়েছি।

#সংক্ষিপ্ত_লেখক_পরিচিতিঃ
ড. রাগিব আস-সারজানি আল-হানাফী। পেশায় মূলত তিনি একজন ডাক্তার। তবে বিশ্বদরবারে তিনি ডাক্তারের তুলনায় একজন মুসলিম ইতিহাসবিদ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তার জন্ম ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে, মিশরের গারবিয়্যাহ প্রদেশের মাহাল্লাহ আল-কুবরা'য়। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টি থেকে ইউরো সার্জারি বিষয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ইসলামের মহান এই দাঈ ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র কুরআন হিফজ করেন। এরপর ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে মাস্টার্স এবং ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। 

#বই_সম্পর্কে_আলোচনাঃ
বইটি লেখা হয়েছে মোট তিনটি অধ্যায়ে। প্রতিটি অধ্যায়ের আলাদা পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদের রয়েছে ভিন্নি ভিন্ন শিরোনাম। 

#প্রথম_অধ্যায়ঃ
নবিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ ছিলেন যেমন।

#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদঃ
স্ত্রীদের সাথে নবিজির আচার-আচরণঃ স্ত্রীর সাথে স্বামীর সম্পর্কের ব্যাপারে নবিজি সা. সর্বোৎকৃষ্ট উপমা পেশ করেছেন। তিনি স্ত্রীদের সান্ত্বনা দিতেন। তাদের অনুভূতির মূল্যায়ন করতেন। চোখের অশ্রু মুছে দিতেন। তাদের চিন্তা প্রশমিত করার চেষ্টা করতেন। স্ত্রীদের সাথে মায়া-মমতা ও ভালোবাসার আবহ ধরে রেখে চলাফেরা করতেন। তিনি স্ত্রীদের সাথে পানাহারে শরিক হতেন। স্ত্রীদের প্রশংসা করতেন। একবার হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রা. এর প্রশংসা করে তিনি বললেনঃ
"সমগ্র নারী জাতির মধ্যে আয়িশার মার্গ অমন মর্যাদাপূর্ণ, সমস্ত খাবারের ভেতর যেমন সারিদের কদর"। [সহিহুল বুখারি, হাদিস:৫২১১]

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং অসুস্থ ও প্রতিবন্ধিদের অধিকারঃ অসুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ইসলামে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। নবিজি সা. যখনই কোন ব্যক্তির অসুস্থ হওয়ার কথা শুনতেন শুশ্রূষা করার জন্য দ্রুত তার বাড়িতে গমন করতেন। রোগীর চাপ হ্রাস করতে নির্দেশ দিতেন। রোগের বিনিময়ে তাদের নেকি ও উপহারের সুসংবাদ দিতেন। উম্মুল আলা রা. বর্ণনা করেছেন,, আমি অসুস্থ থাকাকালীন রাসুলুল্লাহ সা. আমার শুশ্রূষার জন্য এসে বললেনঃ 
" উম্মুল আলা, সুসংবাদ গ্রহণ করো। মুসলিমের রোগ তার গুনাহগুলো এমনভাবে পরিস্কার করে, যেভাবে আগুন স্বর্ণ ও রুপার ময়লা দূর করে"। [সুনানু আবি দাউদ, হাদিস: ৩০৯২] 

#দ্বিতীয়_অধ্যায়ঃ
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়্যাতের দলিলসমূহ।

#তৃতীয়_পরিচ্ছেদঃ
দরিদ্র ও বেকারত্বের সমাধানে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামঃ নবিজি সা. যেভাবে কাজে কর্মে লিপ্ত থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন, তেমন ওইসব পেশা ও শিল্পের প্রতিও উৎসাহ জুগিয়েছেন, যেগুলা অন্য নবিগণ করতেন। তিনি পরিশ্রম করে জিবিকা নির্বাহের বিষয়টিকে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন। মানুষের কাছে হাত পাতার চেয়ে এইটা অনেক উত্তম। তিনি বকরি চড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কৃষি কাজ করতে বলেছেন।
 রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ " তোমাদের কেউ যদি কাঠের বোঝা রশি দিয়ে বেঁধে পিঠে বহন করে বিক্রি করে ( ফলে আল্লাহ তার চেহারাকে লাঞ্চনা হতে রক্ষা করেন ), তা মানুষের কাছে চাওয়ার চেয়ে উত্তম- লোকজন তাকে দান করুক বা না করুক। [সহিহুল বুখারি, হাদিস: ১৪৭০, ১৪৭১] 

#ষষ্ঠ_পরিচ্ছেদঃ
রাব্বুল আলামিনের সাক্ষ্যঃ নবিজির সত্যতার পক্ষে সাহাবা কিরাম, তার সম্মানিত স্ত্রীগণ আরও অনেক সাক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু নবিজি সা. এর জন্য আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন- তিনি সর্বশেষ নবি ও রাসুল। ইরশাদ হয়েছে-
"মুহাম্মদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন; তিনি আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবি। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত"। [সুরা আহজাব, আয়াত: ৪০]

#তৃতীয়_অধ্যায় 
অমুসলিমদের সাথে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ।

#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদঃ
মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে নবিজির সদ্ব্যাবহারঃ নবিজি সা. মক্কাবাসীদের হিদায়াতের জন্য প্রচুর দুআ করতেন। এমনি রাসুল সা. মুশরিকদের নাম নিয়েও দুআ করতেন। তিনি মুশরিকদের সুসংবাদ প্রদান করতেন। মুশরিকদের নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও বিরূপ কোন মন্তব্য তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়নি। 
রবিআ ইবনু ইবাদ আদ-দাইল রা. বলেন (যিনি একজন মুশরিক ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি মুসলিম হয়েছিলেন), রাসুল সা. এর সাথে জিল মাজাজ নামক বাজারে আমার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল৷ তখন আমি নবিজি সা. কে বলতে শুনেছিঃ 
" হে লোকসকল, তোমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো। সফলকাম হবে। 

#চতুর্থ_পরিচ্ছেদঃ
যুদ্ধবন্দিদের সাথে নবিজির আচরণঃ বন্দীদের সাথে নবিজির আচরণের চিরন্তন দৃষ্টান্ত ছিল সুমামাহ উসালের সাথে। তিনি মদিনায় এসেছিল নবিজিকে হত্যা করতে। সাহাবাগণ তাকে বন্দি করে মসজিদে নববিতে নিয়ে আসেন। 

তার ব্যাপারে নবিজির আচরণ ছিলঃ "তোমরা বন্দিদের প্রতি উত্তম আচরণ করো"। [সিরাতে ইবনে হিশাম: ৬/৫১]
 
"তোমাদের নিকট যে খাবার রয়েছে, তা একত্রিত করে তার নিকট পাঠিয়ে দাও"। [ ফাতহুল বারি, ইবনু হাজার: ৮/৮৮] 

#পাঠ_প্রতিক্রিয়াঃ
বইটিতে মসলিমদের নবির পরিচয় নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তার নবুওয়্যাতের সত্যতা প্রমাণিত করা হলে, তার উপকার ও সুফল কেবল মুসলিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা গোটা মানবজাতিকে পরিব্যাপ্ত করবে৷ কারণ তার সিরাত সমগ্র জগতের পবিত্রতা ও পূর্ণতার উপযোগী করা সাজানো হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না বইটিতে শুধু নবিজি সা. এর সিরাত বর্ণনা নয়, বরং নবিজি সা. এর জীবনের মহৎ কিছু দিক সম্পর্কে অবগত হওয়া, রহমত ও বদান্যতার চিত্র ফুটিয়ে তোলা, তার নবুওয়্যাতের ওপর যৌক্তিক ও প্রাকৃতিক প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। বইটি দর্শন ও হাদিস উল্লেখ করার পর সেগুলোর সূত্রে বিভিন্ন মন্তব্য ও টীকা সংযুক্ত করে বিভিন্ন শিক্ষণীয় বিষয় ও রাসুল সা. এর জীবনী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বইটিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বরেণ্য ও অমুসলিমবর্গের মতামত বা মন্তব্য করেছেন সেগুলো মূল্যায়ন করা হয়েছে। 

বইটি প্রতিটি মুসলিমদের পড়া উচিৎ। বিশেষ করে তাদের পড়া উচিৎ যারা রাসুল সা. সম্পর্কে জানতে ভালোবাসে। তাকে তাদের জীবনের আদর্শ হিসেবে পেতে চায়। বিভিন্ন সমস্যায় জড়িয়ে পড়া মানুষদের বইটি পড়া উচিৎ। হতাশায় শেষ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির বইটি পড়া উচিৎ। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি রাসুল সা. সীরাত মানেই আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। সীরাত পাঠের মাধ্যমে নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলা। যে জীবনে থাকবে না কোন দুঃখ-দূর্দশা, হতাশা-সমস্যা। সুন্দর একটি জীবন পেতে হলে রাসুল সা. সম্পর্কে বেশি বেশি জানতে হবে। তাকে নিজের জীবনের মডের হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। 

#ভালোলাগাঃ 
বইটির প্রচ্ছদটা বেশ চমৎকার। পৃষ্ঠা এবং বাঁধায়ও ভালো লেগেছে। আর অনুবাদকের অনুবাদও এত সুন্দর ছিল যে পড়ে বেশ তৃপ্তি পেয়েছি।

#মন্দলাগাঃ 
মন্দলাগার মতো তেমন কিছুই চোখ পড়েনি।

#বইটি_কেন_পড়বেনঃ
রাসুল সা. কেমন মানুষ ছিলেন। স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে, আত্মীয়তা রক্ষাকারী হিসেবে, প্রতিবেশী হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি। সাহাবীদের সাথে তার আচরণ, মুনাফিক-মুশরিদের সাথে তার আচরণ, চেনা-অচেনাদের তার আচরণ, যুদ্ধবন্দিদের সাথে তার আরচণ, রাসুল সা. সম্পর্কে অমুসলিমদের মতামত এবং আরও এমন সব বিষয় সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই বইটি পড়তে হবে।

#প্রিয়_বাক্যঃ
বইটির প্রতিটি বাক্যতেই যেন অন্যরকম ভালোলাগা আছে। তারমধ্যে একটি উল্লেখ করিঃ

"সত্য নেকির পথে পরিচালিত করে, আর নেকি জান্নাতের পথে পরিচালিত করে। মিথ্যা পাপাচারের পথে পরিচালিত করে, আর পাপাচার জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়"।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ