বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে আত্মিক ও ঈমানের সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতে হবে -boipaw.com

Post ID 1114528


আদিবা আর ইলমা দুই বান্ধবী। ছোটবেলা থেকেই কাছাকাছি বাসা হওয়ায় স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রাইভেট, কোচিং সব একসাথেই করে আসছে। আদিবা আর ইলমা অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। তারা দুজনেই প্র্যাকটিসিং মুসলিমাহ! আদিবা দুই বোন ,এক ভাইয়ের মধ্যে বড়, আর ইলমা চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট। দুজনেই কলেজে পরিপূর্ণ পর্দা সহকারে যায়। এতে আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে টিটকারি শুনেনি এমন কোনো দিন ছিল না! এতে তাদের মনে কোনো দুঃখ নেই। রবকে সন্তুষ্ট করার অদম্য স্পৃহা তাদেরকে পর্দা থেকে কোনোভাবে গাফিল করতে পারেনি।

হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে দেয় [১]।  এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না [২]। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
 সূরা আহযাবঃ৫৯

তারা দুজনে রবকে সন্তুষ্ট করার যে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, এই প্রতিযোগিতায় নেই ক্ষতির আশংকা বরং লাভের অংশটাই বেশি, তাই তারা কারো কটু কথাকে খুব একটা গায়ে মাখে না। এখন এসব উপহাস দুজনেরই গা সওয়া হয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে সবাই গল্প- গুজবে মেতে থাকলেও আদিবা-ইলমা এসবের ধারে কাছেও নেই! তারা অন্য সবার মতো ফ্রি টাইমে ক্যাম্পাসে আড্ডাবাজিতে মেতে না উঠে ধর্মীয় ও নৈতিকতার বই পড়ে কাটিয়ে দেয়। 

আজ আদিবা একা বসে আছে, সাথে বইও আনেনি। এদিকে ইলমাও আসছে না ৩/৪ দিন যাবত! ইলমাদের বাসায় যাবে যাবে করে আর যাওয়া হলো না। বাসায় না গেলেও মেসেঞ্জারে টুকটাক কথা হয়েছে ইলমার সাথে। কলেজে যায়নি কেন জানতে চাইলে ইলমা জানাল দেখা হলে বিস্তারিত বলবে। আদিবাও আর কিছু জানতে চায়নি। আদিবার আজ ভালো লাগছে না। একা একা তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে যোহরের সালাত ও খাওয়া-দাওয়া সেরে ইলমাকে নক দিল। ইলমার সাথে কিছুক্ষণ চ্যাট করার পর জানা গেল আগামী দিন কলেজে দেখা হচ্ছে। 

৩/৪ দিন পর প্রিয় বান্ধবীর সান্নিধ্য পাওয়ায় আদিবার আজ খুব ভালো লাগছে। আদিবা খেয়াল করল অন্যদিনের চেয়ে আজ ইলমাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। আদিবা সব সইতে পারলেও ইলমা মন খারাপ করলে সেটা মেনে নিতে পারে না! ইলমা তুমি কি কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করছো? ইলমা বললো, হ্যাঁ তোমাকে না সেদিন বলেছিলাম কলেজে এলে বিস্তারিত বলবো! শুনো তাহলে আমার মন খারাপের কারণ। সেদিন ভাইয়ার ফ্রেন্ড একটা প্রপোজাল এনেছিল, পাত্রও খুব ভালো, সবদিক মিলিয়ে আমাদের পরিবারের সাথে মানানসই। পাত্রপক্ষ পরশুদিন আমাকে দেখতে এসেছিল, দেখে যাওয়ার পর আর কিছুই জানাননি। হয়তো পছন্দ হয়নি! এটা যে নতুন ঘটেছে তাও না! এর আগেও বেশ অনেকবার এমন ঘটনা ঘটেছে। পাত্রপক্ষ দেখে চলে যায়, যাওয়ার পর হ্যাঁ বা না কিছুই আর জানায় না! আর কতবার রিজেক্ট হতে হবে? আদিবা তুমিই বলো! এভাবে রিজেক্ট হতেই থাকব? সেটা ভেবে আমার খুব মন খারাপ গত কয়েকদিন যাবত। কিন্তু বারবার এমন হচ্ছে কেন? প্রথমে পাত্রপক্ষ খুব আগ্রহ দেখালেও এরপর আর কিছুই বলে না।

 সব শুনে আদিবা বলল, ইলমা তোমাদের কি পারিবারিক কোনো শত্রু আছে? আজকাল তো কিছু হতে না হতেই সবাই জাদুর আশ্রয় নেয় তাই বললাম। ইলমা বলল, আমাদের কি শত্রুর অভাব আছে নাকি? আশেপাশে তো সব শত্রু। আদিবা বললো আমার মনে হচ্ছে তোমাকে কেউ জাদু করেছে। এটা শোনার পর ইলমা বললো, এটা অনেকেই বলেছে এবং কতজন কত কবিরাজ দেখিয়ে দিয়েছে, গিয়েছিও এবং মোটা অংকের লসও খেয়েছি জানো! আর্থিকভাবে ও ঈমানের দিক দিয়ে! এই কবিরাজগুলো সব ভন্ড, মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অনেক নতুন নতুন কৌশল তারা বেছে নেয়। অথচ মানুষ তাদের ভন্ডামীগুলো বুঝতেও পারে না! আমি কত কবিরাজের কাছে গিয়েছি ,তাদের বলা অনেক কাজ করেছি, তাবীজ ঝুলিয়েছি যখন আমার এসব সম্পর্কে ধর্মীয় কোনো জ্ঞান ছিলো না তখন। আমার পরিবারের লোকদেরকে কত বোঝাচ্ছি তাদের একটাই কথা এসব না করলে বিয়ে হবে? আগে আমিও কোনো কিছু না বুঝে যে যেটা বলেছে তার ভালো মন্দ না খুঁজে সেটা করেছি।  যেদিন থেকে আমি জানতে পারলাম এসব শিরকী কাজ সেদিন থেকে তাওবার নামাজ পড়ে আর ওমুখো হইনি। যখন আমি এসব কবিরাজের কাছে যেতাম তখন আমি কোনো কিছুতে শান্তি পেতাম না, ইবাদাতে তো টোটালি না। কেন এসব কাজ করছি সেটা ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে যায়, রবের সামনে দাঁড়াতে লজ্জাবোধ হয়! আমার রব তো গাফুরুন তাইতো সব লজ্জাকে ছুঁড়ে ফেলে বারবার তাঁর কাছে ছুটে যাই। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে, নিজের ভুলের মাশুল দিতে। জানি না এই ভুলের মাশুল কি হবে। মহান রব না চাইলে কখনো কি জান্নাতের সুখ উপকরণগুলো উপভোগ করতে পারবো? পরকালের কথা ভাবলে খুব ভয় হয়। 

এতোক্ষণ মনোযোগ সহকারে ইলমার কথা শুনছিলো আদিবা। এবার আদিবা বলা শুরু করলো, ইলমা তুমি খালেস নিয়্যতে তাওবা করেছো নিশ্চয়ই মহান রব তাওবাকারীকে খুব ভালোবাসেন এবং খুশি হয়ে তার তাওবা কবুল করেন। আচ্ছা ইলমা তুমি কি কখনো রুকাইয়াহ করেছ? ইলমা বলে, করিনি। অনেকের কাছ থেকে রুকইয়াহর কথা শুনেছি, সঠিক নিয়ম জানি না তাই করা হয়নি। আদিবা বলল, কোনো ব্যক্তি যখন কুরআনের আয়াত, দুআ কিংবা আল্লাহ তাআলার কোনো নাম সিফাত বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে - যেমনঃ নিজের সুস্থতার জন্য, কিংবা অন্য কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য একমাত্র আল্লাহর সাহায্য চেয়ে পাঠ করে পরিভাষায় সেটাকে“রুকইয়াহ”বলে।

তাছাড়া যাদুতে আক্রান্ত হওয়ার কিছু লক্ষণ আছে। আমার কাছে রুকইয়াহ বইটা আছে। বই দেখে লক্ষণগুলো মিলিয়ে নিও। ইলমা সম্মতি জানিয়ে বলল, ঠিক আছে বইটা তাহলে তোমার ছোটভাই ইউশাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিও। পরদিন আদিবা যথারীতি ইউশাকে দিয়ে বই পাঠিয়ে দিলো। ইলমাও দেরি না করে বই নিয়ে যাদুর লক্ষণগুলো মিলাতে বসে গেল। ইলমা যাদুর লক্ষণ দেখে এতোটাই অবাক হয়েছে দেখে অধিকাংশই তার সাথে মিলে যাচ্ছে! দেরি না করে মেসেঞ্জারে নক করল আদিবাকে। আদিবা বলল, টেনশন করো না, যেহেতু রুকইয়াহই যাদুর একমাত্র সলিউশন, সুতরাং ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তোমার লক্ষণগুলো শুনে মনে হচ্ছে তুমি ব্ল্যাক ম্যাজিকে আক্রান্ত! আর হ্যাঁ তোমাকে প্রাথমিক কিছু সলিউশন দিচ্ছি, ইনশা আল্লাহ ফলো করবে। সকাল-সন্ধ্যায় তিন কুল পড়ে হাতে ফুঁ দিয়ে তিনবার সারা শরীরে মালিশ করবে, আয়াতুল কুরসীসহ সব মাসনুন আমল করবে। ঘুমানোর আগের মাসনুন আমলগুলো করবে, জাদু থেকে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ কবুলের প্রতিটা মুহূর্তে দুআ করবে, তিনিই একমাত্র সাহায্যকারী। তুমি কাউকে সন্দেহ করে থাকলে সন্দেহজনক কারো কাছ থেকে কোনো খাবার দিলে আপাতত খাবে না। ইলমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। 

ইলমা টেনশনে পড়ে গেল, কে করতে পারে এমন জঘন্য কাজ? রাতে খাওয়ার পর পারিবারিক আলাপে ইলমা জাদু আক্রান্তের কথা সবাইকে জানাল। শুনে সবাই বললো, আমরা তো আগেও বলেছি এসবের কথা। বড় ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে জানালেন ইলমা ইস্তিখারা করে দেখিস তো কে করতে পারে এমন জঘন্য কাজ? যাতে সতর্ক হওয়া‌ যায় সেজন্য ইস্তিখারা করতে বলেছি। ইলমা ইস্তিখারা করে দেখেছে। ঘুমানোর আগে ২ রাকাত ইস্তিখারার সালাত পড়ে ঘুমিয়েছে (যদিও ইস্তেখারার জন্য ঘুমানো জরুরি নয়) এবং স্বপ্নে  খুব ঘনিষ্ট দুজন রিলেটিভকে দেখেছে।

ইস্তেখারা করে যা দেখেছে ইলমা বড় ভাইয়াকে সব জানিয়েছে। ভাইয়া শুনে বলেছেন ,টেনশন করিস না, আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই দুআটা পড়িস বেশি বেশি।

اللّٰهُمَّ إِنَّا نَجْعَلُكَ فِيْ نُحُوْرِهِم، وَنَعُوْذُ بِكَ مِنْ شُرُوْرِهِمْ 

হে আল্লাহ! আমরা আপনাকে তাদের গলদেশে রাখছি এবং তাদের অনিষ্ট থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

বড় ভাইয়া ইলমাকে সান্ত্বনা দিলেও কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারছে না কেন ঐ রিলেটিভরা বোনের এত বড় ক্ষতি করছে?  ইলমা বা ইলমার পরিবারের কেউ তো আজ পর্যন্ত তাদের উপকার ছাড়া অপকার করেনি। তাহলে এমনটা করছে কেন? ইলমাকে তার বড় ভাইয়া ধৈর্য সহকারে রুকাইয়াহ চালিয়ে যেতে বলল। তাহাজ্জুদসহ দুআ কবুলের সব মুহূর্তে দুআ করতে বলল যাতে ব্ল্যাক ম্যাজিক থেকে অতিদ্রুত মুক্তি মেলে এবং সেই সাথে প্রতিদিন ৭ টা করে আজওয়া খেজুর খেতে বললো। আদিবা প্রিয় নবীর মুখ নিঃসৃত সেই হাদীসটি ইলমাকে পড়ে শুনলোঃ 

"সা'দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সকাল বেলায় সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন তাকে কোনো বিষ বা জাদু ক্ষতি করবে না।"

ইলমা মেয়ে হিসেবে যেমন ভদ্র তেমনি ধার্মিকও। নফল নামাজসহ সব ধরনের নফল ইবাদাত করে। মাহরাম, নন মাহরাম মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। ইলমা ধৈর্য সহকারে রুকাইয়াহ চালিয়ে যেতে লাগল, আস্তে আস্তে বুঝতে পারলো তার প্রবলেম সলভড হচ্ছে। 
রুকাইয়াহ করার চার মাসের মাথায় খুব ভালো একটা প্রপোজাল আনলো ইলমার ভাইয়ার ফ্রেন্ড আজিজ। আজিজ ভাইয়া জানিয়েছেন পাত্র একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করে। কোনো চাহিদা নেই, পাত্রী ইসলামী বিধি-নিষেধ মেনে চললেই হবে। তাই তিনি ইলমার কথা তাদেরকে বলেছেন। বড় ভাইয়ের সম্মতি পেয়ে আজিজ ভাইয়া তাদের একদিন দেখতে আসার জন্য বললেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে আত্মিক ও ঈমানের সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন।

তিনি বলেন, ‘নারীদের চারটি গুণ দেখে বিয়ে করো : তার সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার রূপ-সৌন্দর্য ও তার দ্বীনদারী। তবে তুমি দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দেবে। নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৯০)।

যথারীতি ইলমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এলো মা, বোন এবং পাত্র নিজেই। ইলমাকে দেখে তাদের বেশ মনে ধরল। পাত্রের মা তো মুগ্ধ নয়নে ইলমাকে দেখেই যাচ্ছে। এতে ইলমা লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। পাত্রের মা বসা থেকে উঠে ইলমাকে গলায় চেন পরিয়ে দিয়ে ইলমার আম্মুকে জানিয়ে গেল আপনাদের আপত্তি না থাকলে আগামী সপ্তাহে আপনার মেয়েকে আমার মেয়ে করে নিতে চাই। ইলমার মা-ও সম্মতি জানিয়ে বলল, অবশ্যই, আমি ইলমার বাবার সাথে কথা বলে আপনাদের সাথে কথা ফাইনাল করব।
এই বিয়েতে ইলমারও কোনো আপত্তি নেই কারণ সে ইস্তিখারা করেছে প্রপোজাল যেদিন এসেছে সেদিনই। তার কাছে বেশ পজেটিভ মনে হলো এবং বার বার রবের কাছে এটাই চেয়ে যাচ্ছে যাতে তার জন্য যা কল্যাণ নিহিত আছে তাই যেন হয়। পাত্রপক্ষের সম্মতির কথা শুনে ইলমা খুব খুশি হলো। মনে মনে সেই আয়াতটা আওড়াতে আওড়াতে অযু করার জন্য ওয়াশরুমের দিকে ছুটে চলল!

“আমি তো তোমাকে ডেকে কখনো নিরাশ হইনি।"
সূরা মারয়াম:
লিখেছেন:- হুমায়রা হক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ