অত্যন্ত সরল-সহজ ও সাধাসিধা জীবন যাপন করতেন তিনি-boipaw.com

Post ID 1114530


বাসাটা  ১৫০০ স্কয়ার ফিট।পরিবারের সদস্য  চারজন।কাজের জন্য সবাই দিনভর বাসার বাইরেই থাকে।বাসাটা সারাদিন খালি থাকার পর রাতে সেই বাসায় ফিরে এসে প্ল্যান করতে বসে গেলেন।বাসাটা ছোট হয়ে যায় আমাদের জন্য।আরো বড় বাসা নিতে হবে।ওই যে সেদিন দেখলাম না ২৬০০ স্কয়ার ফিট এর বাসা টা,Interior Design করা।কি যে মারাত্মক সুন্দর।

ফ্রিজ ভর্তি মাসের বাজার থাকার পরও আরো লাগবে বাজার। মিষ্টি,রেডি টু ফ্রাই নাস্তা গুলো আরো কিনতে হবে।নতুন অনেক কিছু এসেছে সেদিন দেখে আসলাম।

আলমারি ভর্তি জামা কাপড় থাকার পরও পরার মত জামা নাই।আরো লাগবে।আড়ং,দেশি দশ,Anjans  এর ই লাগবে। Brand এর জামার কাপড় না পড়লে কি মান সম্মান থাকে?

ইউটিউবে সেদিন এর নতুন রান্নার ভিডিও টার পর সবাই সেটা ট্রাই করেছে। মাই ডে তে দিয়েই যাচ্ছে।আমি না করলে কেমন দেখায়। সেই রান্নাটা করতেই হবে।কেক/চকোলেট ইত্যাদি যে সময়ে যেই রান্নার ট্রেন্ড সেটা করতেই হবে।

গতবার Get Together এ ঔ যে অমুকের ভাইয়ের বউ ওই শাড়ি টা এত দিয়ে কিনেছে। এবার আমার তার থেকেও বেশি দামের কিনতে হবে।অনুষ্ঠান না থাকলে ও লোক দেখানোর জন্য হলেও আমাকে উপলক্ষ প্রয়োজনে ধরে বেধে বানিয়ে এনে হলেও সেটা পালন করতে হবে। Brand এর ড্রেস না হলে তো হবেই না।দামি থেকে আরো দামি ড্রেস জুতা আমার চাই ই চাই।

অমুক ওই পার্লারে গিয়েছে ফেসিয়াল এর জন্য। আমার ও যেতে হবে।অমুক ওই রেস্টুরেন্ট এ খেতে গিয়েছে। আমাকেও যেতে হবে।না গেলে লোকে কি বলবে?একটা Prestige আছে না!

বাসার ফার্নিচার গুলো পরিবর্তন করে Latest design এর সব লাগবে।না হলে লোকে কি বলবে।  
লোকে কিছু বলুক না বলুক আমার লাগবেই।

Latest গাড়ি টা কিনতে পারলে লাইফ সেট।কি সুন্দর লাগে দেখতে।যেভাবেই হোক কিনতেই হবে।

.

খুব পরিচিত না ঘটনা গুলো??একদম ই তাই।আমাদের দুনিয়াবি চাহিদা খুবই বেশি।আমরা আমাদের চাহিদা র দাস।যার চাহিদা যত বেশি তার খরচ তত বেশি।আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে, সেসব চাহিদার যোগান না দিতে পারলেই শুরু হয়ে যায় ধার দেনা,আমাদের নিজস্ব সৃষ্ট অভাব অনটন।

মাসের বাজার খরচ কম?একবেলায় তিনটা আইটেম দিয়ে না খেয়ে একটা আইটেম দিয়ে চালিয়ে নিতে পারলে কম খরচের বিষয় টা গায়ে লাগবে না যতটা না লাগবে ধার দেনা করে সেই তিনটা আইটেম এর যোগান দিতে।

ইদের ড্রেস কিনার টাকা নাই? গত বছরের কিছু ড্রেস নতুনই আছে কিংবা নতুন কোন ড্রেস না থাকলেও পরার মত অনেক ড্রেসই আছে।তাহলে নতুন কেনার জন্য অভাব বোধের প্রয়োজন নাই।

এরকম আরো অনেক ভাবেই অনেক কিছু ম্যানেজ করে নেয়া যায়।হয়ত আমরা দিনশেষে নিজেরা খালি থাকলাম,অন্যদের মত এত শত জামা কাপড় বাড়ি গাড়ি থাকল না কিন্তু মানসিক শান্তি, তৃপ্তি বলে একটা বিষয় অাছে না?সেটা থাকবে।

আমার এই চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে যেতে হবে না,অমুক ব্যক্তি আমার কাছে এত হাজার টাকা পাবে।যেভাবেই হোক সেটা পরিশোধ করতে হবে।কিংবা এই একটা চাকরি করে হচ্ছে না,বড় গাড়ি টা কিনার জন্য পার্ট টাইম জব/ব্যবসা করতেই হবে।

আমরা সব সময় আমাদের উপরে যারা আছে তাদের সাথে তুলনা দেই।যার বেশি আছে তার সাথে তুলনা দিতে গেলে নিজেকে আরো বেশি ছোট মনে  হবে,আরো বেশি খালি লাগবে।নিজের নফস কে যদি কন্ট্রোল করা কঠিন হয়ে পড়ে প্রয়োজনে সেসব মানুষদের সাথে চলাফেরা সীমিত করুন যাদের দেখলে আপনার অভাব বোধ জাগ্রত হয়।সেসব মানুষের সাথে চলাফেরা শুরু করুন যারা দুনিয়াবি দিক দিয়ে আপনার চেয়ে পিছিয়ে আছেন কিন্তু আখিরাতে র দিক দিয়ে আপনার চেয়ে অগ্রগামী। 

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ), তার পরিবার,সাহাবী  রা দিনের পর দিন না খেয়ে ছিলেন,দ্বীনের খেদমত করেছেন।কোনদিন নিজেদের মধ্যে Competition করেন নি কার কত আছে, কি আছে এসব নিয়ে।অথচ আমরা কি করছি?

আমাদের একটা খাবারের আইটেম না থাকলে, একবার শপিং না করতে পারলে,একটা সামান্য জিনিস নিজের করে না পেলে নিজের উপর, নিজের পরিবার পরিজন এর উপর সামর্থ্যের বাইরে হওয়ার পরও জুলুম করতে থাকি।

কেমন ছিল রাসূল সঃ এর জীবন যাপন? রাসূলুল্লাহ (সঃ) অত্যন্ত সরল-সহজ ও সাধাসিধা জীবন যাপন করতেন। তিনি স্বেচ্ছায় দরিদ্রতা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি বলতেন, 

اللَّهُمَّ أَحْيِنِىْ مِسْكِيْنًا وَأَمِتْنِىْ مِسْكِيْنًا وَاحْشُرْنِىْ فِىْ زُمْرَةِ الْمَسَاكِيْنِ 

‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীনী হালে বাঁচিয়ে রাখো ও মিসকীনী হালে মৃত্যু দান কর এবং আমাকে মিসকীনদের সাথে পুনরুত্থিত কর’।

তিনি বলতেন, اللَّهُمَّ ارْزُقْ آلَ مُحَمَّدٍ قُوتًا ‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারকে পরিমিত আহার দান কর। যা ক্ষুধা নিবৃত্ত করে’ (বুখারী হা/৬৪৬০)।

অভাবে-অনটনে, দুঃখে-বেদনায়, সর্বাবস্থায় তিনি কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করতেন। এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য তিনি কখনো কখনো পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন’ (ছহীহাহ হা/১৬১৫)। তিনদিন না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে সৈন্যদের সাথে অবর্ণনীয় কষ্টে খন্দক খোঁড়ার কাজে তিনি অংশ নিয়েছেন (বুখারী হা/৪১০১)। 

রাসূল (সঃ)-এর খাদেম হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, فَمَا أَعْلَمُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَغِيْفًا مُرَقَّقًا حَتَّى لَحِقَ بِاللهِ، وَلاَ رَأَى شَاةً سَمِيْطًا بِعَيْنِهِ قَطُّ ‘আমি জানি না, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কখনো কোন পাতলা নরম রুটি দেখেছেন কিংবা কোন আস্ত ভুনা বকরী দেখেছেন’।আয়েশা (রাঃ) বলেন, মদীনায় আসার পর থেকে রাসূল (সঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর পরিবার কখনো তিনদিন একটানা রুটি খেতে পায়নি।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘পরপর দু’মাস অতিবাহিত হয়ে তৃতীয় মাসের চাঁদ উদিত হ’ত, অথচ নবীগৃহে কোন (চুলায়) আগুন জ্বলতো না’ (অর্থাৎ মাসভর চুলা জ্বলতো না)। ভগিনীপুত্র উরওয়া বিন যুবায়ের (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, খালাম্মা! مَا كَانَ يُعِيشُكُمْ ‘তাহ’লে কি খেয়ে আপনারা জীবন ধারণ করতেন? 

তিনি বলেন, الْأَسْوَدَانِ التَّمْرُ وَالْمَاءُ ‘দু’টি কালো বস্ত্ত দিয়ে- খেজুর ও পানি’।রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ أَسْلَمَ وَرُزِقَ كَفَافًا وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا آتَاهُ ‘ঐ ব্যক্তি সফলকাম, যে মুসলমান হ’ল। যে পরিমিত আহার পেল এবং তাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকল’।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। অথচ কখনো একটি যবের রুটি দিয়েও পরিতৃপ্ত হননি’। আনাস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (সঃ)-এর পরিবারের নিকট কোন সন্ধ্যাতেই এক ছা‘ গম বা কোন খাদ্য দানা (&আগামীকালের জন্য) অবশিষ্ট থাকত না। 

অথচ তাঁর স্ত্রী ছিলেন নয় জন’ (অর্থাৎ যা পেতেন সবই দান করে দিতেন। জমা রাখতেন না)।মৃত্যুর সময় রাসূল (সঃ)-এর লৌহ বর্মটি এক ইহূদীর নিকটে ৩০ ছা‘ (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিল।নবী জীবনের সর্বশেষ রাতেও স্ত্রী আয়েশাকে চেরাগ জ্বালাতে তার সতীনদের নিকট থেকে তেল চেয়ে নিতে হয়েছিল।

উমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‘আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলাম, তিনি একটা খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। যাতে কোন ফরাশ বা চাদর নেই। তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিল। তাঁর মাথার নীচে খেজুর গাছের ছোবড়া ভর্তি একটি চামড়ার বালিশ। তাঁর দেহে চাটাইয়ের দাগ দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম। তিনি বললেন, তুমি কেন কাঁদছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পারসিক ও রোমকরা কোন অবস্থায় আছে। আর আপনি কোন অবস্থায়? 

তখন তিনি বললেন, أَمَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ لَهُمُ الدُّنْيَا وَلَنَا الآخِرَةُ ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আমাদের জন্য আখেরাত? (বুখারী হা/৪৯১৩)।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি চাটাইয়ের উপরে শুতেন। অতঃপর যখন দাঁড়াতেন, তখন তাঁর পার্শ্বদেশে ঐ চাটাইয়ের দাগ পড়ে যেত। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি আপনার জন্য একটি তোষক বানিয়ে দেব না? 

জবাবে তিনি বললেন, مَا لِى وَمَا لِلدُّنْيَا مَا أَنَا فِى الدُّنْيَا إِلاَّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا ‘আমার জন্য বা দুনিয়ার জন্য কি প্রয়োজন? দুনিয়াতে আমি একজন সওয়ারীর ন্যায়। যে একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছে। অতঃপর রওয়ানা হবে এবং ঐ গাছটিকে ছেড়ে যাবে’ (তিরমিযী হা/২৩৭৭)। মূলত এসবই ছিল তাঁর যুহ্দ বা দুনিয়াত্যাগী চরিত্রের অনন্য পরিচয়।

দারিদ্রতা, প্রাচুর্যতা এবং কুফর খুবই বিপদজনক।আমরা যেন আবার কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে স্বজ্ঞানে দারিদ্রতা কে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি না নেই।আবার প্রাচুর্যতার মোহে সব ভুলে না যাই। 

আল্লাহ আমাদের দারিদ্রতার ফিতনা,প্রাচুর্যতার ফিতনা থেকে রক্ষা করুন,কুফরের ফিতনা থেকে রক্ষা করুন।আল্লাহ আমাদের নিজেদের কবল থেকে নিজেদের হেফাজত করুন।আমিন।

(কোন ভুল ত্রুটি থাকলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই জানাবেন।জাযাকুমুল্লাহু খাইরন)

বারাকাল্লাহু ফীকুম।

======================================

|| প্রাচুর্যের মোহ||
||লিখাঃ ইফাত জাহান ||

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ