নফসের ধোঁকা - ইফাত জাহান -boipaw.com

Post ID 1114531
শয়তান কখনোই ফেরেশতাদের মধ্য থেকে ছিল না।ফেরেশতারা কখনো আল্লাহর কথা অমান্য করেন না।তারা আল্লাহ তায়ালার প্রতিটা আদেশ নিষেধ মান্য করে চলেন।শয়তান কে আমরা এক্স ফেরেশতা ভেবে যেন ভুল করে না বসি।


শয়তান ছিল জ্বিন দের মধ্য থেকে একজন।সে আল্লাহর আনুগত্য করতে করতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।আল্লাহ তায়ালা খুশি হয়ে তাকে ফেরেশতা দের সাথে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন।

আমরা কোন খারাপ কাজ করার পর শয়তান কে দোষ দিয়ে নিজেরা মুক্ত হয়ে যেতে চেষ্টা করি।একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে,শয়তানের কোন কিছু করানোর ক্ষমতা নেই।সে শুধু ফিসফিস করতে পারে,অর্থাৎ কুমন্ত্রণা দিতে পারে। সিদ্ধান্ত আমাদের আমরা কি শয়তানের ফিসফিসে সাড়া দিব কি না।

প্রশ্ন আসতে পারে, আল্লাহ তায়ালা শয়তান কেন সৃষ্টি করেছেন?শয়তানের আগে কি কোন শয়তান ছিল?শয়তান কেন আল্লাহর অবাধ্য হয়ে আদম (আঃ) কে সিজদাহ করল না?

উত্তর হচ্ছে ; আল্লাহ তায়ালা শয়তানকে সৃষ্টি করেন নি।শয়তান জ্বিন জাতির মধ্যে থেকেই একজন ছিল।সে তার নাফসের ধোঁকায় পড়ে নিজের অহংকার কে আল্লাহ তায়ালা র নির্দেশের উপর প্রাধান্য দিয়ে নিজেই শয়তান হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে।

আমরা আদম (আঃ) এর ভুলের ঘটনার সাথে শয়তানের ভুলের ঘটনার একটা তুলনা করলে বুঝতে পারব যে শয়তানের মধ্যে কতটা ইগো,অহংকার ছিল।

আদম (আঃ) যখন ভুল করে সেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিলেন,তিনি Immediately আল্লাহর কাছে মাফ চেয়েছেন,তওবা করেছেন,লজ্জিত হয়েছেন।

আর শয়তান কি করেছিল মনে আছে?আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের আদম (আঃ) কে সিজদাহ্ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, একমাত্র  শয়তান ছাড়া সবাই সিজদাহ করেছেন।কারন হিসেবে সে বলেছে,"আমি আগুনের তৈরি আর আদম মাটির তৈরি।আমি কেন তাকে সিজদাহ করব?"

তারপর তাকে যখন তার ভুল ধরিয়ে দেয়া হল(ভুল ধরিয়ে দেয়া বলতে বুঝাচ্ছি যে,আল্লাহ তায়ালা তার উত্তরে /কর্মকান্ডে রাগান্বিত হয়েছেন এটা জানার পর তখন সে বুঝতে পেরেছে যে সে ভুল করেছে)তখনও সে স্বীকার করল না।এবং সে নিজে আল্লাহর কাছে চেয়ে নিল তাকে যেন কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হয়, সে যেন আদম সন্তানকে পথ ভ্রষ্ট করে জাহান্নাম পর্যন্ত টেনে তার সাথে করে নিয়ে যেতে পারে। নিজের জন্য নিজে জাহান্নাম চেয়ে নেয়া কোন লেভেলের ইগো,অহংকার, গোড়ামি কে রিপ্রেজেন্ট করে সেটা আমরা একবার ও কি ভেবে দেখেছি?

ভুল করার পর সেটা স্বীকার করে মাফ চেয়ে তওবা করে নিলেই সব শেষ হয়ে যেত।কিন্তু সে কি করেছে?

শয়তানের ভুল গুলোর ছোট্ট একটা লিস্ট খেয়াল করা যাকঃ 

ভুল ১ঃ আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্তের উপর প্রশ্ন করেছে?

ভুল ২ঃ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অহংকার প্রকাশ করেছে?

ভুল ৩ঃ আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত /আদেশের আমান্য করা একটা গুনাহ/পাপ/সঠিক কাজ না এটা জানার পরও সে তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে নিজের গোড়ামিকে প্রাধান্য দিয়েছে। 

ভুল ৪ঃ আল্লাহ তায়ালার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছে।আমি কেন তাকে সিজদাহ করব?"সে মাটির তৈরি, আমি আগুনের তৈরি?"

ভুল ৫ঃ নিজের জন্য জাহান্নাম চেয়ে নিয়েছে। "আমাকে অবকাশ দিন কিয়ামত দিবস পর্যন্ত,আমি যেন আদম সন্তানকে পথ ভ্রষ্ট করে আমার সাথে জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারি।"

ভুল ৬ঃ এত কথা না বলে মাফ চেয়ে তওবা করে সব শেষ করতে পারত।কিন্তু সেটা সে করে নি।

ভুল ৭ঃ নাফসের চাহিদা পূরন করতে সদা ব্যস্ত থেকেছে।সে আগুনের তৈরি হয়েও মাটির তৈরি মানুষকে সিজদাহ্ করবে কেন?প্রশ্নটা নাফস এর পক্ষ থেকেই ছিল। নিজের নাফসের এই অহেতুক প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যস্ত না হলে এত কিছু ঘটে যেত না।

আমরা আমাদের নিজেদের জীবনে এই বিষয় টা নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করতে পারি।নিজেদের জন্য লিটমাস টেস্ট এর মত কিছু প্রশ্নঃ

প্রশ্ন ১ঃ আমরা কি আল্লাহর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছি?

কেন আল্লাহ তায়ালা কে ই একমাত্র ইলাহ মেনে নিতে হবে?কেন সালাত আদায় করতে হবে?কেন সুদ/ঘুষ খেতে পারব না?কেন অবৈধ সম্পর্কে যাওয়া যাবে না?কেন পর্দা করতে হবে? কেন চোখ সংযত রাখতে হবে? কেন রোজা রাখতে হবে?কেন যাকাত দিতে হবে?কেন গীবত করা যাবে না?কেন গালাগালি করা যাবে না?এই যে এত কেন কেন এসব বন্ধ করতে হবে।তর্ক করার প্রবনতা,আল্লাহর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ করতে হবে। 

আল্লাহ বলেছেন এটা করতে হবে,আল্লাহ বলেছেন এটা করা যাবে না।কথা শেষ।রেফারেন্স হিসেবে কুরআন, হাদিস আছে।বুঝতে না পারলে সাহায্যের জন্য বিজ্ঞ আলেম গন রয়েছেন।নিজেদের এত অহেতুক কথার প্যাঁচ,প্রশ্নের প্যাঁচে পড়ে যাচ্ছি কি না সেটা দেখতে হবে?

প্রশ্ন ২ঃ নাফসের খায়েশ কে মিটানোর জন্য আমরা কি  যাচ্ছে তাই করে যাচ্ছি? 

আলমারি ভর্তি পোষাক থাকার পরও হাজার হাজার টাকা দিয়ে পোষাক না কিনলে মানুষ কি বলবে।গত বার এটাই পরেছি।এবার নতুন না হলে মান সম্মান থাকবে না।

নিজেদের জন্য কিংবা অন্যদের জন্য দুটা খাবারের আইটেম দিয়েই যদি অনায়াসে সব শেষ করা যায় তাহলে কে কি বলবে সেটা চিন্তা করে বাড়তি দশটা আইটেম কেন করতে হবে?

বাড়তি কাজ গুলো আমরা সময় থাকতেই করা ছেড়ে দেই। অপ্রয়োজনীয় প্রতিটা বিষয় নাফসের ধোঁকা ছাড়া কিছুই না।

প্রশ্ন ৩ঃ  কোন বিষয় নিয়ে অহংকার /হিংসা করছি?

অমুক বায়তুল মোকাররম মসজিদে এ নামায পড়তে যায়,এজন্য বাসার পাশের মসজিদ ছেড়ে আমারও হয়রানির স্বীকার হয়ে সেখানেই যেতে হবে।অমুকের সন্তান ভিকারুননিসা তে পড়ছে, আমাদের সামর্থ্য সুযোগ সুবিধা থাকুক না থাকুক সেখানেই পড়াতে হবে। 

আরে,ওরা তো নতুন বাসা নিয়ে নিল। বাসাটা কোন কারনে নষ্ট হয়ে যাক তো।উফ আর সহ্য হচ্ছে না।কিভাবে নিল বাসা টা?অমুকের এত টাকা বেতন?কেন কেন?এটা মানতেই পারছি না।

এই ওদের বাসায় সোফা নেই,ডাইনিং টেবিল নেই।ওদের বাসায় যাওয়া যাবে না।ওরা টিনশেড বাসায় থাকে।ওদের সাথে মিশা যাবে না।ছি ছি!!! এসব বাসায় মানুষ থাকে নাকি? ছি!!! 

প্রশ্ন ৪ঃ সত্যি জানার পর ও নিজেদের মধ্যকার ইগো কে প্রাধান্য দিচ্ছি? 

ছোট হয়ে জ্ঞান দিতে এসো না তো।তুমি আমার আগে দুনিয়াতে এসেছ নাকি আমি এসেছি?

না না। ইসলাম ধর্ম মানা যাবে না। আমার বাবা দাদার ধর্ম কিভাবে ছেড়ে দেই।সম্ভব না।সত্যি হলেও সম্ভব না।
পরিবারের মানুষ কি বলবে? মুখ দেখাব কিভাবে? 

সারাজীবন পা ধরে সালাম করে আসার পর এখন এসব কি অভদ্রতা শুরু করেছ?আমরা বুঝি ইসলাম জানি না?
কিসব মহররম টরহররম(মাহরাম গায়ের মাহরাম)  শুরু করেছ?এসব ভন্ডামি বাদ দেও তো।পর্দা করার নামে দুষ্টামি শুরু করেছ।দেখব না কতদিন চলে এসব।হেহ!!

প্রশ্ন ৫ঃ নিজেদের মধ্যে গোড়ামি আছে?সত্যি জানার সুযোগ যেখান থেকেই আসুক সেটাকে কি নির্দিধায় গ্রহন  করে নিতে পারছি নাকি নিজের গোড়ামির জন্য সব  ধূলিসাৎ  করে দিচ্ছি? 

কথা বললেই গীবত কেন হবে?সে তো করেছে এটা।এগুলা গীবত না।আরো শুনো এত কিছু এসব বানানো কথা।কুরআন তো একপিস ই।কিন্তু কেউ কি দেখেছ এটা কে কোথা থেকে লিখেছে?এত কিছু বিশ্বাস করার কি দরকার।কে বলেছে মৃত্যুর পর জীবন আছে।মারা যাওয়ার পর শুধু ঘুমাব আমরা।শান্তির ঘুম।

স্মার্ট মানুষ জন ধর্ম নিয়ে কথা বলে না।কি সব হুজুরদের মত শুরু করেছ।বাদ দেও তো।স্মার্ট হতে হলে মদ খেতে হবে,পার্টি করতে হবে,সবার সাথে গ্রুপ ছবি তুলতে হবে,সবার সামনে সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে হবে।দুদিনের দুনিয়া এত কিছু মেনে চললে হয় নাকি?

তাহলে কুরআনে আল্লাহ যেসব বলেছেন সেসব কি?আরে কুরআন মানুষ ই কেউ লিখেছে।(নাউজুবিল্লাহ) 

প্রশ্ন ৬ঃ ভুল করার পর মাফ চেয়ে নিতে পারছি? নাকি আমাদের মধ্যে এমন মনোভাব কাজ করে যে আমরা কোন ভুল করতেই পারি না, সব ভুল অপরপক্ষের?

কত বড় সাহস আমার নাকি ভুল হয়েছে বলতে আসে।আমি ফেরেশতার মত মানুষ আমি কি ভুল করব নাকি।সব ভুল তারা করেছে।এজন্য তাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে এসেছি।

প্রশ্ন ৭ঃ নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পেরেছি? গুনাহের পর তওবা করতে পেরেছি? 

ওর এত আছে।বাড়ি, গাড়ি সব আছে।অথচ আমাদের কিছু নেই।ফার্নিচার গুলো পুরাতন হয়ে গেল।বছর খানেক আগের গাড়িটা পুরাতন হয়ে গেল।আল্লাহ আমাদের কেন দিলেন না।কেন কেন?

প্রশ্নগুলোর সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু কর্মকান্ড সংযুক্ত করা হয়েছে আমরা যেন সহজে নিজেদের সাথে রিলেট করতে পারি এজন্য। 

প্রশ্নের উত্তর গুলোর মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারনা পেয়ে যাব যে আমরা কি আসলেই মানুষ হয়েই টিকে আছি যে মানুষকে আল্লাহ তায়ালা এত ভালবাসা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন,আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদা দিয়েছেন।নাকি নিজেরাই নিজেদের জন্য  স্বেচ্ছায় শয়তান হয়ে যাওয়াকে পছন্দ করে নিয়েছি? 

=====================================

রেফারেন্সঃ 
----------------------------------------------------------------------

১]শয়তান এর উক্তি বিষয়ক রেফারেন্সঃ

৩৬. ইবলিস বলল, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।

৩৭. আল্লাহ বলেন, তুমি অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।

৩৮. (এই অবকাশ) অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। (সুরা : হিজর, আয়াত : ৩৬-৩৮)
.
.

২]শয়তান তর্ক করে যা বলেছে সে বিষয়ক রেফারেন্সঃ

৬১. স্মরণ করো, যখন আমি ফেরেশতাদের বলেছি, আদমকে সিজদা করো। তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সিজদা করেছে। ইবলিস বলল, আমি কি এমন ব্যক্তিকে সিজদা করব, যাকে আপনি কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৬১)

সে (শয়তান) বলল, আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১২)
.
.

৩] শয়তান কোন ফেরেশতা ছিল না, সে ছিল জ্বিনদের মধ্য থেকে একজন।এ বিষয়ে রেফারেন্সঃ

ইবলিস ফেরেশতা ছিল না- এর একটা প্রমাণ হল সে যদি ফেরেশতা হত, তাহলে আল্লাহ্‌র নির্দেশ অমান্য করতো না। কারণ কুরআনেই ফেরেশতাদের প্রাথমিক গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে- “তারা আল্লাহ্‌র আদেশ অমান্য করে না, এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।” [সূরা আত-তাহরীম ৬৬:৬]

ইবলিস যে জিন ছিল এ ব্যাপারে কুরআনে পরিষ্কার আয়াত রয়েছে-

“‘আমি’ যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম, “আদমের প্রতি সিজদা করো’, তারা সবাই করেছিল, ইবলিস ছাড়া—সে ছিল জ্বিনদের একজন।” [সূরা আল-কাহফ ১৮:৫০]

(কোন ভুল ত্রুটি থাকলে সংশোধনের উদ্দেশ্যে অবশ্যই জানাবেন।জাযাকুমুল্লাহু খাইরন)

বারাকাল্লাহু ফীকুম।

======================================
||নাফসের ধোঁকা||

||লেখাঃইফাত জাহান||

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ