বইয়ের নাম:তাতারীদের ইতিহাস মূল বইয়ের নাম:কিসসাতুত তাতার

Post ID 111495

বইয়ের নাম:তাতারীদের ইতিহাস
মূল বইয়ের নাম:কিসসাতুত তাতার
লেখক:ড. রাগেব সারজানী
অনুবাদ:মাওলানা আব্দুল আলীম।
সম্পাদনা:উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন হাফি.
মুদ্রিত মূল‍্য:৪৪০ টাকা।
পৃষ্ঠা:৪০০
প্রকাশনায়:আলিফ বুকস্
পরিবেশক:মাকতাবাতুল হাসান।
ক‍্যাটাগরি:ইতিহাস।


বুক রিভিউ:
হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দী।মুসলিমরা তখন বিশ্ব পরাশক্তি।অর্ধ পৃথিবী তখন মুসলিমদের আয়ত্বাধীন।
বাগদাদে শক্তিশালী আব্বাসী খিলাফত,
মিশর,সিরিয়া,হেজাজ,ইয়েমেন মহান সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবী রহ. এর বংশধরদের শাসনাধীন,
উত্তর আফ্রিকা থেকে স্পেন পর্যন্ত শক্তিশালী উমাইয়া সুলতানদের আয়ত্বাধীন,
দিগন্ত বিস্তৃত খাওয়ারেজম সাম্রাজ্যও মুসলিম শাসকদের দ্বারা শাসিত,
রোমান বংশোদ্ভূত মুসলিম শাসকরা তুরস্কের শাসন ক্ষমতায়,
হিন্দুস্তানও মুসলমানদের করতলগত।
সব মিলিয়ে চারদিকে মুসলমানদেরই জয়জয়কার।
ঠিক তখনই তাতারী নামক  অসভ‍্য,বর্বর,অশিক্ষিত,মূর্খ,হিংস্র ও জংলী এক জাতির আবির্ভাব ঘটে।তারা ছিল মঙ্গোলিয়া নামক চীনের উত্তর দিকের এক দেশের অধিবাসী।তাতারীরা 
পূর্বে কোরিয়া থেকে পশ্চিমে খাওয়ারেজম পর্যন্ত,উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণে চীন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এক ভুখন্ডের শাসক ছিল।
তারা শিক্ষিত ছিল না,ফলে মনুষ্য কোনো গুনই তাদের মধ‍্যে পরিলক্ষিত হতো না।তারা নির্মমভাবে মানুষ হত‍্যা করতো।এমনকি নারী,বৃদ্ধ,শিশুদেরকেও ছাড় দিত না।
কোনো জাতি শিক্ষিত হবে,তা তারা চাইতো না।ফলে তারা যেই ভুখন্ডে হামলা করতো,সেই ভুখন্ডের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,পাঠাগার,লেখকদের ধ্বংস করে দিত।মুসলিম ভুখন্ডে তাদের কার্যক্রম দেখলেই তা বুঝা যায়।
তারা সন্ধিচুক্তি করে তা রক্ষা করতো না।
এজন‍্যই তাদেরকে মানুষ না ভেবে ইয়াজুজ-মাজুজ ভেবে মুসলিম ভুখন্ডে তাদের হামলা ঠেকানোর জন‍্য মুসলমান শাসক বা জনগনেরা এগিয়ে আসতে ভয় পেত।
তারা ছিল খুবই হিংস্র এবং অসভ্য এক জাতি।

তাতারীদের উত্থান:
৬১৬ হিজরীতে তাতারীরা প্রথম মুসলিম ভুখন্ড খাওয়ারেজম সাম্রাজ্যে আক্রমণ করে।খাওয়ারেজম শাহের সাথে শত্রুতা থাকায় কোনো মুসলিম শাসক খাওয়ারিজমীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নি।সুলতান মুহাম্মদ ইবনে খাওয়ারেজম একাই তাদের প্রতিহত করতে চেষ্টা চালান।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে না পেরে তিনি কাপুরুষের মতো পালিয়ে যান।সুলতানপুত্র জালালউদ্দীন একটা মিত্রজোট গঠন করে তাতারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করেন,এবং সাফল্যও পান।কিন্তু মুসলিম শাসকদের অভ‍্যন্তরীন কোন্দলের কারনে তিনি সেই জোট ধরে রাখতে পারেন নি।

তাতারীরা পুরো খাওয়ারেজম সাম্রাজ্য দখল করে।তারপর তারা বাগদাদের খিলাফতের রাজধানীতে আক্রমণ করে।খলিফার অদূরদর্শীতা এবং প্রধানমন্ত্রী কট্টরপন্থী শিয়া কাফির ইবনে আলকামার বিশ্বাসঘাতকতায় তাতারীরা বাগদাদ দখল করে সেখানে গনহত্যা চালায়।
সিরিয়ায় তখন আইয়ূবীদের শাসন চলছিল।তারা ছিল শতধাবিভক্ত।ফলে তাতারীদের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাড়ানোর সাহস দেখায়নি।উপরন্তু,তারা তাদের দাসে পরিনত হয়‌।
এভাবে তাতারীরা সিরিয়াও দখল করে ফেলে।

তাতারীদের পতন:
মিশরে আইয়ুবী সালতানাতের পর ক্ষমতায় আসে মামলুকরা।তারা ছিল খুবই সাহসী এবং শক্তিশালী।মামলুক সালতানাতের চতুর্থ সুলতান সাইফুদ্দিন কুতজ রহ. তাতারীদের সাথে হীন সন্ধিচুক্তি না করে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
তাতারীদের মুসলিম ভুখন্ডের শাসক হালাকু খান বারবার চিঠি পাঠিয়ে ভয় দেখালেও সুলতান কুতজ বিন্দুমাত্র নড়ে যাননি।
৬৫৮ হিজরীতে ঐতিহাসিক আইনে জালুত ময়দানে তাতারী আর মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি হয়।
যুদ্ধে মুসলমানরা অভাবনীয় বিজয় অর্জন করে।
যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকল তাতারীসৈন‍্য নিহত হয়,তাতারীদের সেনাপতি কিতবুগাও এই যুদ্ধে নিহত হয়।
এই যুদ্ধের পর থেকে তাতারীদের শক্তি দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে।এই যুদ্ধ জয়ের কিছুদিনের মধ‍্যেই মুসলমানরা সিরিয়া পুনর্দখল করে।
এই যুদ্ধে পরাজয় তাতারীদের ধ্বংসের সবচেয়ে বড় কারন ছিল।

বইটি কেন পড়া উচিত:
তাতারীদের ইতিহাস বইটি বর্বর তাতারীদের বর্বরতা হিংস্রতা,তাদের উত্থান-পতন ইত‍্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছে।বইটিতে  বিশ্বসন্ত্রাসী চেঙ্গিস খান,হালাকু খানদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ,ওই সময়ের মুসলিম শাসকদের ইসলামের প্রতি অবহেলা,মুসলমানদের ধ্বংসের কারন,ইত‍্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।বইটি পাঠ করে আমরা ওই সময়কার মুসলমানদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারব।
মুসলমানদের শক্তির প্রতীক আইনে জালুত নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারব‌।
বইটি থেকে ইতিহাসের পাশাপাশি পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত,হাদিসের বানী,ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার লাভ-ক্ষতি,মুসলমানদের ধ্বংসের কারণ,কিভাবে মুসলমানরা পুনরায় বিশ্ব শাসনের জন‍্য প্রস্তুত হতে পারে ইত‍্যাদি সম্পর্কে জানতে পারব।যা জানা আমাদের কর্তব‍্য।
বইটির শেষদিকে "উম্মাহর ব‍্যাধি ও আল্লাহর মদদ লাভের উপায়" নামক শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ লেখা হয়েছে,লেখাটি পড়া আমাদের সবার জন‍্যই জরুরী বলে আমি মনে করি।

পাঠ প্রতিক্রিয়া:
আগে চেঙ্গিস খানকে নিয়ে অনেক কিছু শুনতাম।যেমন,সম্রাট বাবর চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন,তাই চেঙ্গিস খানকে মুসলমান মনে করতাম।আবার শুনতাম সে ইরাকে দশ লক্ষ মুসলমানকে হত‍্যা করেছে,এটা জানার পর সে মুসলমান ছিল কিনা সন্দেহ হতো।
আলহামদুলিল্লাহ,তাতারীদের ইতিহাস বইটি আমার এসব সন্দেহের সমাধান দিয়েছে।
এছাড়াও বইটি পড়ে আমি তাতারী গোষ্ঠী,খাওয়ারেজম সাম্রাজ্য,আব্বাসী খিলাফতের শেষ অবস্থা,মিশরের আইয়ুবী সালতানাত এবং মামলুক সালতানাত ইত‍্যাদি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি।যার কিছুই আমি জানতাম না।
তাতারীদের ইতিহাস বইটি আমাকে ইতিহাস পাঠে নতুনভাবে প্রস্তুত করেছে।
আমার খুবই ভালো লাগা একটি বই।
আমার ব‍্যাক্তিগত র‍্যাটিং:১০/১০।

লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
ড.রাগেব সারজানী মিশরের আল মুহাল্লা কুবরায় ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি মূলত একজন ডাক্তার হলেও ইসলাম প্রচারক এবং ইতিহাসবিদ হিসেবেও সুপরিচিত।তিনি ১৯৮৮ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউরোসার্জারি বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করেন।১৯৯২ সালে মাস্টার্স এবং ১৯৯৮ সালে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।১৯৯১ সালে তিনি পবিত্র কুরআন মাজিদ হিফজ করেন।কর্মক্ষেত্রে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন অনুষদে অধ‍্যাপক হিসেবে,ইদারাতুল মারকাযিল হাজারা,মিশর এর ইতিহাস বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।এছাড়াও তিনি ইন্টারন‍্যাশনাল মুসলিম উলামা পরিষদ,মিশর মানবাধিকার শরয়ী বোর্ড এবং আমেরিকান ট্রাস্ট সোসাইটির সদস‍্য ছিলেন।

তিনি ইতিহাস ও ইসলামি গবেষণা বিষয়ে প্রায় ৫৬ টি পুস্তক রচনা করেন।এর মধ‍্যে কিসসাতুত তাতার (তাতারীদের ইতিহাস),কিসসাতু উন্দুলুস (স্পেনের ইতিহাস),কিসসাতু তিউনুস (তিউনিসিয়ার ইতিহাস) অন‍্যতম।
আল্লাহ ওনাকে নেক হায়াত দান করুন এবং ইসলামের খেদমত করে যাওয়ার তওফিক দান করুন।আমিন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ