বইটির মনোযোগী পাঠ পাঠকের জ্ঞানকে করবে সমৃদ্ধ, ঈমানকে করবে প্রদীপ্ত, অন্তরকে করবে বিকশিত, আখলাককে করবে আলোকিত।
স্বনামধন্য প্রকাশনা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার' প্রকাশ করেছে বইটি।
বাংলাভাষায় সীরাত ও সাহাবাচরিত চর্চা :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। অনার্সের ক্লাসরুম। ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে ক্লাসরুম ভর্তি। পিনপতন নিরবতা। অধ্যাপক লেকচার শুরু করলেন। মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা। কলম চলছে সমানে, নোট নিচ্ছে সবাই। লেকচার শেষে উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর। ছাত্রদের করা বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা অপ্রাসঙ্গিক উভয় ধরণের প্রশ্নের হাসিমুখে জবাব দিচ্ছেন তিনি। তাফসীর, হাদীস, ফেকাহ, ধর্মতত্ত্ব, আধুনিক চিন্তা- মতবাদ, কালাম, তাসাউফ ইত্যাদির অতুলনীয় অসাধারণ পাঠদান করেন তিনি। কুরআন-হাদীসের রেফারেন্স, আধুনিক তথ্য উপাত্ত, বিশেষজ্ঞ মতামত, চুলচেরা বিশ্লেষণ, অতঃপর ভারসাম্যপূর্ণ মত প্রদান তাঁর লেকচারের বৈশিষ্ট্য। নিজস্ব মত নিয়ে ক্লাসরুমে প্রবেশ করে বের হওয়ার সময় স্যারের মত গ্রহণ না করে বের হওয়া যায় না, অথচ তিনি নিজের মত কখনোই চাপিয়ে দেন না, আবার শেষতক তাঁর মত গ্রহণ না করেও গত্যন্তর থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তাও আবার নানা মত ও পথ থেকে উঠে আসা ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্রদের এক কেন্দ্রে একীভূত করা সহজ না। সেই অসহজ কাজটি ছেলেখেলার মত সহজে করা অসামান্য অসাধারণ এ অধ্যাপকের নাম ড. আহমদ আলী স্যার। প্রতিথযশা পণ্ডিত, গবেষক, আলেম। ইসলামী জীবন বিধানের বিভিন্ন দিকের উপর একের পর এক তিনি লিখে চলেছেন প্রামাণ্য গ্রন্থাবলী।
বাংলাদেশে ইসলাম চর্চা বিশেষত নবী ও সাহাবীদের জীবনী চর্চা কিংবদন্তি ও গল্প নির্ভর অনেকটা। ইদানিং তা কিছুটা কাটতে শুরু করেছে নির্ভরযোগ্য সীরাত গ্রন্থাদির অনুবাদের কারণে, যেমন সীরাতে ইবনে হিশাম, সীরাতে ইবনে কাসীর, রাহীকুল মাখতুম, সীরাতুন্নবী, সীরাতে সরওয়ারে আলম ইত্যাদির বাংলা অনুবাদ সীরাত চর্চার অনবদ্য স্মারক। বাংলায় কল্পকাহিনীমুক্ত সাহাবাচরিত চর্চার প্রধান রূপকার ঢাবির অধ্যাপক ড. আব্দুল মাবুদ স্যার। সাত খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে স্যারের 'আসহাবে রাসূলের জীবনকথা'। সংক্ষিপ্ত অথচ প্রাণবন্ত। অনূদিত হয়েছে তালিবুল হাশেমীর 'সাহাবীদের সংগ্রামী জীবন' ও 'মহিলা সাহাবী', মিশরীয় লেখক উমর তিলমেসানীর কালজয়ী কীর্তি 'শহীদে মেহরাব উমর ইবনুল খাত্তাব রা.'। অভাব ছিল ইসলামের প্রথম খলীফা সাইয়িদিনা আবু বাকর রা. এর জীবনচরিত রচনার। কবি গোলাম মোস্তফা ইতোপূর্বে লিখেছেন 'হযরত আবু বকর রা.', কিন্তু তা প্রামাণ্য ও বিস্তারিত নয়। মাওলানা আব্দুর রহীম 'খেলাফতে রাশেদা' লিখলেও তাতে পূরণ হয়নি সিদ্দীকে আকবরের একক বিস্তৃত জীবনীর প্রয়োজনীয়তা। অথচ তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সার্বক্ষণিক, সবচে কাছের, সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন সাথী, নবী-রাসূলদের পর সৃষ্টির সবচে সেরা মানুষ।
তাঁর জীবনকে না জেনে রাসূলুল্লাহ সা. কে জানা অপূর্ণই থেকে যায়। সেই অপরিহার্য প্রয়োজনটি পূরণে বিদগ্ধ গবেষক, বিশেষজ্ঞ আলেম ড. আহমদ আলী কলম ধরেছেন। তাঁর অনন্য কীর্তি সিদ্দীকে আকবরের প্রামাণ্য, বিস্তারিত, অসামান্য জীবনীগ্রন্থ 'খালীফাতু রাসূলিল্লাহ আবূ বাকর আছছিদ্দীক রা.'।
সাইয়িদিনা আবু বাকার সিদ্দিক রা.। রাসূলুল্লাহর সা. আজীবন সাথী, সহযোগী, আত্নার আত্নীয়। কি সুখে, কি দুখে রাসূলুল্লাহর নিত্য সহচর। নবুওয়াতী জিন্দেগীর প্রারম্ভিকায়, শে'বে আবি তালিবের নিদারুণ কষ্টের সময়, হিজরতের ভয়ানক শঙ্কার রাতে, বদর-ওহুূদ-খন্দক-হুদায়বিয়া-মক্কাবিজয়-তাবুক, পারিবারিক সমস্যা থেকে যুদ্ধক্ষেত্র সর্বদা সবখানে আবু বাকার নামক শীতল ছায়া রাসূলুল্লাহর প্রশান্তির অবলম্বন।
রাসুলুল্লাহর ওফাতের পর জাহেলিয়াতের প্রতিবিপ্লবের প্রবল আগ্রাসী সর্বপ্লাবী জোয়ার রুখে দিতে যখন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও শঙ্কা আর দ্বিধা-- ক্ষণিকের জন্য হলেও, আপোষের প্রস্তাব করেছেন উমরের রা. মত সিংহদীল বীরপুরুষ, তখনও আবু বাকর একা দাঁড়িয়েছেন, বুক টান করে ঘোষণা দিয়েছেন- "আল্লাহর কসম! যদি তারা ফিরে না আসে তরবারি দ্বারাই ফয়সালা হবে তাদের সাথে।"
এ সেই আবু বাকার--- বেলালের 'আহাদ' কাতরানিতে লুটিয়ে দেয় অজস্র সম্পদ। চল্লিশ হাজার দিরহামের মালিক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইসলামের জন্য অকাতরে বিলিয়ে তাবুকের যুদ্ধের সময় মিসকীন প্রায়, যা আছে তা-ই হাজির করেছেন তখনও। নির্মাণ করেছেন ইসলামী বিশ্বের সুবিশাল ভিত্তিপ্রস্তর। নবী না হয়েও মানুষ কত সুন্দর, মজবুত ঈমানধারী, মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ, সম্ভাবনাময়, ত্যাগী হতে পারে তাঁর প্রকৃষ্ট প্রমাণ আবু বাকর রা.। রাসূলের আনুগত্য আর ভালোবাসার সর্বোত্তম আদর্শ আবু বাকর রা.। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে ইসলামের অনুপম উদাহরণ আবু বাকর রা.।
তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে একীভূত করেছেন ৮৪০ পৃষ্ঠায়, অসাধারণ দক্ষতায় ড. আহমদ আলী। ১২টি বিস্তৃত অধ্যায়ে বিন্যস্ত গ্রন্থটি। ১ম অধ্যায়ে পরিচয় ও ইসলামপূর্ব জীবন, ২য় অধ্যায়ে মাক্কী জীবন, ৩য় অধ্যায়ে খেলাফতপূর্ব মাদানী জীবন, ৪র্থ অধ্যায়ে খেলাফতলাভ ও বাইয়াত, ৫ম অধ্যায়ে খেলাফতের পরিচয় ও খেলাফতের যোগ্যতার মানদন্ডে আবু বাকার রা., ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে শাসন ও অর্থব্যবস্থা, ৭ম অধ্যায়ে কার্যাবলি ও অবদান, ৮ম অধ্যায়ে বিদ্রোহ দমন, ৯ম অধ্যায়ে বিজয় অভিযান, ১০ম অধ্যায়ে বিদেশনীতি ও সামরিক ব্যবস্থা, ১১শ অধ্যায়ে মর্যাদা-গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য, ১২শ অধ্যায়ে ওফাত ও পরবর্তী খলীফা নির্বাচন।
আবু বাকর রা. এর জীবনের সকল দিকের উপর সকল প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে পাঠক বইটির পাঠে। বইটির বিশাল কলেবর পাঠের পূর্বে কোন কোন পাঠককে ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু একবার শুরু করার পর শেষ না করা পর্যন্ত অস্থির করে রাখবে পাঠক মনকে। কল্পকাহিনী মুক্ত বইটির সবটাই কুরআন-হাদীস-প্রামাণ্য ইতিহাসের রেফারেন্সের সমষ্টি। প্রামাণ্যতা, বিশুদ্ধতা এবং প্রয়োজনীয় সব তথ্যের সন্নিবেশ গ্রন্থটিকে কয়েকশ বছর বাঁচিয়ে রাখবে বলে আশা করা যায়। বিপুল তথ্যসম্ভারের মজুদ সত্ত্বেও তথ্যের ভারে বইটি জটিল গবেষণা প্রবন্ধের মত রসহীন নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত আকর্ষণ যোগাবে প্রেরণা আর ঈমানের দীপ্তি, ভাষার সৌন্দর্য দেবে উপন্যাসের আস্বাদ, ঘটনার ঘনঘটা দেবে থ্রিলারের রোমাঞ্চ। পাঠক আকণ্ঠ ডুবে যাবে ইতিহাসের মোটা পর্দার ওপারে। নিজেকে মনে হবে ত্যাগে, দ্বীনের জন্য পেরেশানিতে, রাসূলের প্রতি ভালোবাসায়, বীরত্বে, উম্মাহর কল্যাণ চিন্তায় আবু বাকরের শরীকদার; আবূ বাকরের বেদনায় নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে ওঠবে, উৎকণ্ঠায় শঙ্কিত হবে, আনন্দে হবে উদ্বেল; পাঠক নিজেই হয়ে উঠবে ক্ষণিকের আবু বাকর।
বইটির মনোযোগী পাঠ পাঠকের জ্ঞানকে করবে সমৃদ্ধ, ঈমানকে করবে প্রদীপ্ত, অন্তরকে করবে বিকশিত, আখলাককে করবে আলোকিত।
স্বনামধন্য প্রকাশনা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার' প্রকাশ করেছে বইটি।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....