গল্প: আজকের চাওয়া। লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।

Post ID 111444
বিকেলে ঘুম ভাঙ্গলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে উঠতেই দৌড়ে রান্নাঘরে এসে দেখি শাশুড়ি মা রান্না করছেন। 
আমাকে দেখতেই তিনি বললেন, 'বউমা, উঠে গিয়েছো?'

আমি থেমে থেমে বললাম, 'আসলে মা জোহরের নামাজ পড়ে বিছানায় একটু গা এলাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম আর এদিকে এতটা সময় চলে গেলো টেরই পেলাম না।'

'তোমাকে ঘুমাতে দেখে আমি আর ডাকলাম না। ভাবলাম আজকে তাহলে রান্নাবান্নাগুলো আমিই সারি।'

আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, 'এখন তো আমি উঠে গিয়েছি। এখন না হয় আমিই করি রান্নাগুলো। আপনি বরং বিশ্রাম নিন।'

তিনি হেসে বললেন, 'তুমি ফ্রেশ হয়ে আছরের নামাজটা পড়ে নাও। রান্নার আর বেশি নেই। এটুকু আমিই করতে পারব।'

আমি 'আচ্ছা' বলে চলে এলাম। মানুষটার এই বয়সে রান্নাঘর ছেড়ে এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু তিনি প্রায়ই রান্নাঘরে চলে আসেন আমাকে বিশ্রামের সুযোগ করে দিতে। মুখে না বললেও আমি বুঝতে পারি তিনি ভেতরে কতটা খেয়াল রাখেন আমার।

নামাজ শেষ করে আবার রান্নাঘরে যেতেই শাশুড়ি মা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। 
আমি থতমত গলায় বললাম, 'আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি মা৷ আমি আপনার সঙ্গে থাকি?'

তিনি হেসে বললেন, 'আচ্ছা থাকো।'

আমার মা থাকলে বোধহয় এমনই করতেন৷ মা কেমন জিনিস জানি না৷ স্মৃতিতে নেই৷ এতিমখানার স্মৃতিতেই ভরপুর জীবন। সেখানেই বড় হওয়া আমার। এক ভদ্রমহিলা মাঝেমধ্যেই যেতেন আমাদের এতিমখানায়। ঈদে নতুন পোশাক নিয়ে, তার ছেলে মেয়েদের জন্মদিন উপলক্ষে ভালো খাবার নিয়ে তিনি আসতেন। তাকে দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। চুপিচুপি দেখতে থাকা আমার এই দৃষ্টি তার দৃষ্টিতে পড়ে গেলো একদিন। সেখান থেকেই পরিচয়। তারপর তিনি আমাকে দেখতেই ওখানে যেতেন প্রায়ই। 

বড় হলাম। পড়াশোনা শেষ হলো। তিনি এসে একদিন বললেন, 'আমার বাসায় যাবে তুমি আমার মেয়ে হয়েে?'

আমি সেদিন চুপ করে তাকিয়ে ছিলাম। তার ছেলে নাবিলের সঙ্গে আলাপ হলো। এত ভালো পরিবারের জন্য নিজেকে অযোগ্য মনে হতো ভেতরে। তিনি পাশে এসে দাঁড়ালে সাহস পেয়েছিলাম ভেতরে। 

আমার শ্বশুরও আমাকে যথেষ্ট সমর্থন করেছিলেন৷ তারা আমাকে ভালোবাসলেও আমার দুই ননদ এখনো আমাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না। কথার ছলে এবং আড়ালে আবডালে কোনো জায়গায়ই আমাকে ছোট করে কথা বলতে বাদ রাখেন না৷ তাদের আচারণ আমাকে ভুলতে দেয় না আমার পরিচয়৷ নিজেকে তখন অযোগ্য মনে হয় ভেতরে৷ হীনমন্যতায় ভুগি আড়ালে। শাশুড়ি মা জানলে কষ্ট পাবেন ভেবেও তাড়াতে পারি না ভেতরের দুঃখবোধকে।

ইফতারির সময় এখনো বেশ বাকি৷ খাবারগুলো সব একে একে টেবিলে সাজিয়ে দিয়েছি। বাসায় আজ দুই ননদ আসার কথা। কাজে সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই৷ লকডাউনের এই সময়ে খুব বিপাকে পড়তে হয়েছে। সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই কাজের মেয়েটাকে তিনমাসের বেতন দিয়ে বিদায় দিয়েছেন শাশুড়ি মা৷ বাসার কাজে এখন তিনিই আমাকে সাহায্য করেন। 

কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখি নাবিল এসেছে। সঙ্গে দুই ননদ এবং তাদের সন্তান। আমি সালাম দিলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা উত্তর দিলেন। তাদের আচারণ আমার মন খারাপ করায়। জোরপূর্বক হাসি দিয়ে সে মন খারাপ ঢেকে রাখার চেষ্টা করি সবার সামনে। 

ডায়নিংরুমে সকলে বসে আছেন 
বড় ননদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমার একটা সাহায্য লাগবে।'

আমি হেসে বললাম, 'জ্বী আপা বলেন'

'আমার শ্বশুরের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় তার ভাতিজীকে এতিমখানায় দিতে চাচ্ছে। তুমি তো ওখানের সম্পর্কে ভালো জানো। কীভাবে কী করতে হয় বলতে পারবে? নাকি এ বাড়িতে এসে সব ভুলে গিয়েছো?'

আমার হাসিমুখটা নিমিষেই পানসে হয়ে গেলো। তিনি সহযোগিতা চাওয়ার নাম করে আমাকে আঘাত দিতে চেয়েছেন বুঝতে বাকি রইলো না৷ শাশুড়ি মা আমার দিকে সান্ত্বনার দৃষ্টিতে তাকালেন।

শ্বশুর বলে উঠলেন, 'ও কিন্তু এ বাড়ির বউমা। ভুলে যেও না। বউমাকে কিন্তু আমরা মেয়ের চোখেই দেখি। মাথায় রেখো কথাটা।'

ছোট ননদ এবার ঝাঁঝালো গলায় বললেন, 'শেষমেষ এতিমখানা থেকে তোমাদের মেয়ে সংগ্রহ করতে হলো। দুনিয়াতে মেয়ের এতই অভাব ছিলো বাবা?'

আমার চোখে ছলছল করছে জল।

শাশুড়ি মা হতাশ গলায় বললেন, 'আফসোস হচ্ছে, তোমাদেরকে আমি মানুষের মতো মানুষ করতে পারিনি। কাউকে ছোট করে কথা বললে নিজে বড় হওয়া যায় না, এটা তোমাদের শেখাতে পারিনি।'

ছোট ননদ তবুও থামলেন না। একের পর এক কথা শোনাতে থাকলেন৷ 

নাবিল শান্ত গলায় বললো, 'আপা আমি তো ওই এতিমখানার মেয়েটাকে নিয়ে সুখী। তাহলে আর কী চাই!'

ছোট ননদ তাকিয়ে রইলেন। তিনি কিছু একটা বলতে যাবেন এমন সময় পাশ থেকে তার ছোট্ট ছেলেটা বলে উঠলো, 'আম্মু তুমি তো বলেছো, রোজা রেখে ভালো কাজ করতে হয়৷ কারো মনে কষ্ট দিতে হয় না, কাউকে আঘাত করে কথা বলতে হয় না। তাহলে তুমি কেন বলছো? তাহলে তুমি কী আমাকে মিথ্যা বলেছো?'

এবার তিনি চুপ করে রইলেন। তার ভেতরে এখন কী অনুভূতি হচ্ছে আমার জানা নেই৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আজানের খুব বেশি বাকি নেই৷ কয়েক মিনিট মাত্র। ইফতার সামনে নিয়ে দু'হাত তুলে আল্লাহ তায়ালার কাছে কিছু চাইলে তিনি তা কবুল করেন৷ 

আমি দু'হাত তুললাম। আমার আজকের চাওয়া, পৃথিবীর সমস্ত ভালো মনের মানুষগুলো সবসময় ভালো থাকুক। আর বাকি মানুষগুলোর মনে আল্লাহ তায়ালা সঠিক বুঝ দান করুন৷ মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বাড়ুক। একে অপরকে সম্মান করতে জানুক, ছোট করতে নয়৷ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ