বইঃ চলুন, অন্তত একবার মরি by মেহেদী হাসান তামিম (top review)

Post ID 111498

এক নজরে-

নাম :              চলুন, অন্তত একবার মরি
লেখক :          মেহেদী হাসান তামিম 
ধরণ  :            ছোটগল্প
মুদ্রিত মূল্য :   ২০০৳
পৃষ্ঠা সংখ্যা :   ১১২
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে গ্রন্থমেলা১৮
প্রচ্ছদ শিল্পী  : ধ্রুব এষ
প্রকাশনী :       ঐতিহ্য

বিণীত- 
Komol Thakur
প্রবন্ধিক
প্রকাশিত বই - 
প্রেম প্রকৃতির সমবায়ী স্বর
পুঁজির দুনিয়া ও অন্যান্য কবিতা
কেউ কাউকে এভাবে মরতে বলে বুঝি!কৌতুহল হওয়াটা খুব স্বাভাবিক মরনের এমন উদাত্ত আহ্বান শুনে। যদিও মরণে আমার ভীষন ভয়, "মরিতে চাহিনা এ সুন্দর ভুবনে।" 
কেন আমাকে মরতে বলছেন তার কারণ খুঁজতেই ঐতিহ্য প্রকাশনীতে অনলাইনে অর্ডার করে গাজীপুরে ঘরে বসেই হাতে পেলাম প্রিয় কবি ও কথা সাহিত্যিক মেহেদী হাসান তামীমের গল্প সংকলন- "চলুন অন্তত একবার মরি"। খরচটাও সাধ ও সীমার মধ্যে। বইয়ের মূল্য ১৫০ টাকা আর কুরিয়ারে পাঠানোর খরচ ৩০ টাকা, এই ১৮০ টাকাই।


বইটি যখন পড়া শুরু করলাম, কখন কিভাবে দিনরাত এক হয়ে গেছে সে খবর ছিলনা। ২২টি গল্প প্রতিটিই বিষয়বৈচিত্র্যে ভিন্ন, বক্তব্য স্পষ্ট আর হাস্যরস অসাধারণ। নতুন করে বেঁচে থাকার শক্তি, লড়াই করার মানসিকতা, বিপন্ন মানুষকে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি জোগায় এর গল্পগুলো, আমার নিজের সাথেই ঘটেছে বলে এতো নিশ্চিত করে কথাগুলো বলতে পারছি। গল্পগুলো এতবার এভাবে পড়েছি যে, চোখ বন্ধ করলেও এর প্রতিটি ঘটনা, চরিত্রগুলো চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করে, আর প্রতিনিয়ত বলে চলছে-
"কমল দুঃখ করোনা বাঁচো, বাঁচো কমল বাঁচো।"

বইয়ের প্রথম ফ্লাপে লেখকের এই উচ্চারণই তো ম্যাজিক - " প্রত্যেকে আমরা নিজের জীবনে চাই সমাধান, সংকট কখনো নয়। এজন্য সবার আগে নিজকে, নিজের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ যদি চায় সে তার অন্তরে বাস করা সকল সংকটের অবসান ঘটাবে, মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশের অন্ধকারগুলো হয়ে যাবে আলো, রাত হয়ে যাবে দিন, বর্ষা হয়ে উঠবে বসন্ত।"  

"চলুন তবে অন্তত একবার মরি", ভয় পেলেন আঁতকে উঠলেন অক্কা গেলেন-লেখক শিরোনামেই যখন মৃত্যু আহ্বান করছেন তবে কি করে তাঁর গল্পগুলো মানুষকে বাঁচাবে, বাঁচতে সাহায্য করবে! চলুন এর ভেতরটায় একটু ঢু মেরেই দেখি।

শুরুর গল্প 'পতিত', পতিতার পুং লিঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আমাদের সমাজে পতিতা বলতে যাদের বোঝায়, চেনা যায় খুব সহজে সাজসজ্জা, আচরণ,  উপস্থিতিতে। তারা জীবনের প্রয়োজনেই তা, কিন্তু যার সমাজের অন্যতম সুবিধাভোগী, অথচ পথভ্রষ্ট তাদেরকে কোনভাবেই চিহ্নিত করবার উপায় যে নেই। আবার তার ফাঁকেই লেখক গল্পে সংসারে দুঃখ হতাশা কিভাবে সৃষ্টি হয় বললেন সে কথা। তা থেকে উত্তরণের পথও দিলেন বাতলে- "স্বামী স্ত্রীর ভালবাসা সম্পর্কে মূল শত্রু হলো 'দূরত্ব'। দূরত্ব প্রক্রিয়াটি একদিনে সম্পন্ন হয় তা কিন্তু নয়। এ তৈরী হয় সময় নিয়ে, খুব ধীরে এবং একদিন হুট করেই নিজের জানা বোঝার আগে তা শেষ ধাপে পৌঁছে যায়।........ দূরত্ব মানুষকে বড় ভুলের দিকে ধাবিত করে, ভুল করার পথকে অবারিত করে,উন্মুক্ত করে।" 

দ্বিতীয় গল্প - 
"বিনাশ হোক সকল দুঃখ, কষ্ট আর হতাশা; বাঁচার আনন্দে বাঁচো" নির্মলেন্দু গুনের কবিতার শিরোনাম মাঝেই গল্পের সার্থকতা। একজন লেখকের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি তো পাঠক যখন তাঁর চরিত্রগুলোর সাথে মিশে যেতে পারে। এ গল্পে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ধ্রুপদ হয়ে উঠি, আমি কমল নিজেই। ছাত্রজীবনের ব্যর্থতাকে যদি কেউ জীবনের শেষ ভাবে সে ভুল করে, সে হলো মহাবোকা। লেখক সম্ভবত তার ছাত্র জীবনে ঘটপ যাওয়া বিভিন্ন মজার ঘটনা ধ্রুপদের মাধ্যমে দেখিয়েছেন। যেমন - কখনো জেলখানার কেচকি ফাইলের মতো করে আবাসিক হলের গনরুমে থাকা, জীবনে নিজে একটি পেস্ট কখনো বা ব্রাশ না কিনেও পুরো হলজীবন পার করা, টিউশনীতে নাস্তা, বাড়ীর দারোয়ানকে ছাত্রীর বাবা ভেবে সালাম ইত্যাদি। তবে ব্যর্থতার পর, সমাধানের ক্ষেত্রে লেখক "..... হয় জীবনকে নতুন করে বাঁচার সু্যোগ দাও নতুবা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হও। পছন্দ তোমার।"

তৃতীয় গল্প, "এক ডেক খিঁচুরির গল্প"। উত্তর বঙ্গে বন্যা কবলিত মানুষদের একটা শেষ বিকেলের জ্যান্ত ছবি। গল্পের ব্যাপ্তি মাত্র কয়েক ঘন্টার এবং চরিত্রগুলোর অবস্থান টিনের ঘরের ছাদেই শুধু, তবু ফ্লাশব্যাকে তাদের জীবনের কিছু চিত্র আঞ্চলিক ভাষার বাস্তবিক মিশ্রণে অদ্ভুত শব্দমালায় বাস্তবরুপে ফুটিয়ে তুলেছেন।

বেশ কয়েকটি গল্প আগের গল্পের চরিত্র ধ্রুপদের নামে ধ্রুপদনামা হিসেবে লিখেছেন। এই গল্পগুলোতে সবচেয়ে ভাল লাগার বিষয় হলো প্রতিটি গল্প আলাদা ভিন্নধর্মী বক্তব্য ও তার সাথে বাস্তবিক ঘটনার হুবুহু বর্ণনা। 

হুরমতি ও টেংরামোল্লার গল্পে হাইকোর্ট মাজারের দুজন ভিক্ষুকের খুব ছোট ছোট কিছু আশা, কিছু চাওয়া পাওয়ার সূক্ষ্ম ব্যবচ্ছেদ। লেখকের লিখা ও গল্প বলার ধরনটা পাঠককে অবশ্যই একটা বিরল অনুভূতির অনুভূমিতে নিয়ে যাবে, আমার বিশ্বাস। 

পরাবাস্তব রম্যগল্প, 'ফরমাল মহাশয়ের গপ্পো'তে নতুন মাত্রায় গল্প বলার চেষ্টা ও রাসায়নিক বিষ ফরমালিন কে গল্পের প্রধান চরিত্র হিসেবে তুলে ধরা পাঠককে যে ভিন্নমাত্রিক স্বাদ দিবে, সত্যিকার অর্থেই অনন্য ও প্রশংসার দাবী রাখে। 

স্বাদ, প্রেম পরিভ্রমন, নৈঃশব্দিক কান্না, পুনর্জীবন গল্পগুলো আমাদের সমাজের চলমান ঘটনা প্রবাহই হয়ত। হয়ত বলছি কেন আমাদের সমাজ ও মানুষের পরাণ গভীরের অদ্ভুত সব অনুভূতি। লেখকের সেন্স অব হিউমার, আমাদের হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয় একজন সাহিত্যিক কে মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেবে। 

একটি বিশেষ গল্পের কথ উল্লেখ করা প্রয়োজন 'বিকৃত'। লেখকদের বুঝি এমনই হতে হয়। সম্প্রতি ভারতের হাইকোর্ট সমকামীতাকে বৈধ বলে যে রায় দিল, লেখক মেহেদী হাসান তামিম এই গল্পে সে অধিকারের যৌক্তিক বর্ণনা রায়ের বহু আগেই তাঁর লেখনীতে এনেছিলেন ভাবতেই শিউরে উঠি।

তবে আমি এই গল্পের কিছুটা সমালোচনাও করব। সমকামিতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে এ সম্পর্ক সৃষ্টির আদি থেকে কখনো গ্রহনযোগ্য নয়। ভাববার প্রয়োজন আছে, এমন সমাজ ব্যাবস্থায় বাস করে এ ধরনের গল্পগুলো আমাদেরকে কোন ভুল বার্তা পৌঁছে দিবে না তো! লেখকরা এমন সব বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে গল্প লিখলে তা আরো গভীর ও সচেতন ভাবনায় আগুপিছু বুঝেই লিখা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

এছাড়াও আরো যে গল্পগুলো আছে, আমি বলব একটির থেকে একটি আরো বেশী ইন্টারেস্টিং। সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক ও সমালোচকদের বইটির গল্পগুলো শতকরা ৯০ভাগ সন্তুষ্টি দিবে আমি আশা করছি। আর বাকী দশ ভাগ লেখকের পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় রেখে দিলাম।

'ধ্রুব এষ' এর করা প্রচ্ছদ বরাবরের মতো মানোত্তীর্ণ। ঐতিহ্য প্রকাশনার ঝকঝকে তকতকে প্রিন্ট, তাদের ট্রেডমার্ক সুনিপুণ বাঁধাই, অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ বানান, পাঠসহযোগী কাগজের ব্যবহার ও ক্রয়সীমার মধ্যে যৌক্তিক মূল্য ১৫০/ টাকা-
সবমিলিয়ে মেহেদী হাসান তামিমের, "চলুন, অন্তত একবার মরি" একটি সার্থক ছোটগল্প সংকলন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ