বই : কেউ কেউ পুরনো হয় না
লেখক : শফিকুর রহমান শান্তনু
প্রকাশনায় : শোভা প্রকাশ
প্রচ্ছদ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি
পৃষ্টা সংখ্যা : ১৯২
মুদ্রিত মূল্য : ৩৭৫ টাকা
রিভিউ। : Harun ar Rashid
টেলিভিশনের পর্দায় ব্রেকিং নিউজ, দিনের আলোয় উপুর্যুপুরি কোপানো হয়েছে শায়ান আহমেদকে। রাজধানীর ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এই যুবক। টিভি অন করতেই একটা বেসরকারি চ্যানেলে শায়ান আহমেদকে কোপানোর লাইভ টেলিকাস্ট দেখে গায়ে কম্বল জড়িয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে ফেটে পড়ছে এক তরুণী। কিন্তু কেন? মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা একজন মানুষের এহেন দুর্দশায় কেন এতো উচ্ছ্বাস এই তরুণীর মাঝে? যে মানুষটাকে বুকের পাঁজরে জড়িয়ে ধরার ব্যাকুলতায় একটা সময় কেটে যেত বিনিদ্র রজনী, আজ তার জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কেন এই অট্টহাসি?
লেখক শফিকুর রহমান শান্তনুর 'কেউ কেউ পুরনো হয় না' উপন্যাসটির শুরুটা এরকমই। একটা খুনের দৃশ্যপট দিয়ে উপন্যাসটির পথচলা শুরু হলেও সময়ের প্রয়োজনে এর ডাল-পালা গজিয়েছে বহু দূর অবধি। এরই মধ্যে ঘটেছে অনেক চরিত্রের সন্নিবেশ। 'কেউ কেউ পুরনো হয় না' মূলত জীবনঘনিষ্ঠ জীবনের গল্প। কিন্তু উপন্যাসটির আবহ, লেখকের বর্ণনাশৈলী এবং গল্পের প্রয়োজনে দৃশ্যায়নের নতুন মাত্রা উপন্যাসটিকে দিয়েছে রহস্যোপন্যাসের মর্যাদা। একদিকে যেমন বইটিতে রয়েছে সমকালীন উপন্যাসের স্বাদ, অপরদিকে ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প সাজানোর কারণে বইটিতে রয়েছে থ্রিলারের স্বাদ।
মিটি মিটি তারা খ্যাত মিতা চরিত্রটি পুরো উপন্যাসটিকে দিয়ে আলাদা স্বকীয়তা। বুকের ভেতর দীর্ঘদিনের জমানো পাথরখন্ড চাপা দিয়ে মাহিনের মতো একটা অমানুষের সাথে সে সংসার নামক চিরন্তন নিয়তির আঁচলে নিজেকে বেঁধে রেখেছে বিয়ের পর থেকেই। দিনের পর দিন মুখ বুজে সহ্য করেছে শারীরিক নির্যাতন। মিতা যখন প্রতিবাদের ভাষাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে, শায়ানের প্রতিবাদী অগ্নিমূর্তির কাছে ক্ষণকালের জন্য পরাস্ত হয়ে যায় অমানুষ মাহিনের পশুত্ব। নিয়তি একটা সময় মিতাকে দাঁড় করিয়ে দেয় সময়ের কাছে পরাজিত ভালোবাসা শুভ্র অরন্যর নিথর দেহের মুখোমুখি।
ড্রাইভার শম্ভুর জীবন হঠাৎ করেই মোড় নেয় আচমকা আসা এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসা শম্ভু তখন স্ত্রী ছন্দাকে ঠেলে দেয় বিকৃত রুচিবোধ সম্পন্ন অমানুষ মহাজনের চিলোকোঠায়। ছন্দা নির্বাক, স্তব্ধ হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলে ন্বাভাবিক জীবনের গতিপথ। উপন্যাসে ছন্দার শেষ পরিণতি মানতে খুব কষ্ট হয় আমার।
এছাড়াও ফরহাদ হোসেন, অভিক চৌধুরী, রিতা এবং শায়লা আহমেদের মতো চরিত্রের সংযোজন উপন্যাসটিকে দিয়েছে আলাদা নতুনত্ব। প্রত্যেকটি চরিত্রকে লেখক দারুণ মুন্সিয়ানার সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। সর্বোপরি প্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা, ক্ষোভ, লালসা উপন্যাসটিতে লেখক নিজস্ব ভঙিমায় রূপদান করেছেন দারুণ বর্ণনাশৈলীর মাধ্যমে। উপন্যাসের সচরাচর গন্ডির বাইরে গিয়ে লেখক এই উপন্যাসটিতে প্রত্যেকটি চরিত্র নিয়ে আলাদা আলাদা পর্ব সৃষ্টি করে এক অভিনব ধারা সৃষ্টি করেছেন।
কিছু দৃশ্যপটে লেখক রেখেছেন পাঠকের ভাবনার ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বাধীনতা। পাঠক এগুলো নিজের মতো করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাবেন। এই বিষয়টা আমাকে দারুণভাবে বিমোহিত করেছে। বিশেষ করে মন যমুনা চরিত্রটিতে লেখক সৃষ্টি করেছেন পাঠকের জন্য আলাদা করে ভাবনার জায়গা।
লেখক শফিকুর রহমান শান্তনু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক লিখেছেন ৪০০ উপরে। গান লিখেছেন স্বনামধন্য বিখ্যাত অনেক শিল্পীর জন্য। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে লেখকের পথচলা অল্প দিনের হলেও 'কেউ কেউ পুরনো হয় না' উপন্যাসটির মাধ্যমে তিনি পাঠকের জন্য নিয়ে এসেছেন দারুণ চমক। অসাধারণ গল্প বলেছেন তিনি।
শোভা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ ছিল মনোমুগ্ধকর। বাঁধাই, প্রিন্টিং আর কাগজের মান ছিল প্রশংসার দাবীদার। সবচেয়ে বড় কথা হলো একটাও ভুল বানান পুরো উপন্যাসে আমি খুঁজে পাইনি।
প্রিয় পাঠক, রহস্য, রোমাঞ্চ, ভালোবাসা আর লোভ-লালাসার অন্তরালে জীবনঘনিষ্ঠ জীবনের গল্প পড়তে চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন শফিকুর রহমান শান্তনুর 'কেউ কেউ পুরনো হয় না' উপন্যাসটি। আমার বিশ্বাস আশাহত হবেন না।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....