আমাদের দেশে নারীরা খুব কমই ইতিকাফ করেন। অথচ ইতিকাফ অত্যন্ত সওয়াব ও ফজিলতের কাজ এবং নারীদের জন্য তা খুব সহজও বটে। কারণ তারা ঘরেই ইতিকাফ করবেন। ফলে নিয়ম মেনে সংসারের খোঁজখবরও নিতে পারবেন। সংসার ঠিক রেখে তাদের ইতিকাফও হয়ে যাবে। সুতরাং এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই উচিত নয়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইতিকাফের ফজিলত বর্ণণা করতে ইরশাদ করেন, আল্লাহ সন্তুষ্টির নিয়তে যে ব্যক্তি মাত্র একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহতায়ালা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিনটি পরিখার সমান দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। যে পরিখাগুলোর প্রতিটির দূরত্বই আসমান-জমিনের মধবর্তী দূরত্বের সমান।
ইতিকাফ শুধু পুরুষের জন্য নয়। নারীরাও কিন্তু ইতিকাফ করতে পারেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সহধর্মিণীরা ইতিকাফ করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত নবী করিম (সা.) তার ওফাত পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ করতেন। তার ওফাতের পর তার স্ত্রীরা ইতিকাফ করেছেন।
-(সহিহ বোখারি: ২০২৬ ও সহিহ মুসলিম: ১১৭২)
নারীদের ইতিকাফের বিধান: রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ পুরুষের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। অর্থাৎ মহল্লার মসজিদে পুরুষদের মধ্যে একজনও যদি ইতিকাফ করে তাহলে পুরো মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এর বিধান পুরুষদের জন্য, নারীদের জন্য নয়। নারীদের জন্য ইতিকাফ করা মুস্তাহাব। সুতরাং মহিলারা চাই ঘরে ইতিকাফ করুক কিংবা মসজিদে পুরুষদের দায়িত্ব আদায় হবে না।
এজন্য মহল্লার মসজিদে পুরুষদের মধ্য হতে একজনও যদি ইতিকাফ না করে তাহলে পুরো মহল্লাবাসী সুন্নতে মুআক্কাদা তরক করার কারণে গুনাহগার হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ২/১১৩; ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ১৩/১৪৫)
নারীদের ইতিকাফের স্থান: মহিলাদের নামাজের স্থান তাদের ঘরের অন্দরমহল; মসজিদ নয়। মহিলাদের জন্য মাসজিদে যেয়ে নামাজ আদায় করার থেকে নিজ গৃহে নামাজ আদায় করাই বেশি উত্তম। আর তাই মহিলারা যেন বেশি বেশি মাসজিদে গমন না করে, তাই পুরুষরা মাসজিদে ইবাদাত করলে যে সাওয়াব পাবে মহিলারাও ঘরে ইবাদাত করলে সেই একই পরিমাণ সোওয়াব পাবে বলে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। মহিলাদের নিজ কক্ষের ইবাদাতের স্থানটুকুই তার জন্য মাসজিদের সমান। তাই পুরুষরা মাসজিদে ইতিকাফে বসলেও মহিলাদের জন্য মাসজিদ নয় বরং ঘরে ইতিকাফ উত্তম।
নারীরা তাদের ইতিকাফের স্থান পর্দা দিয়ে ঢেকে নিবেন। যেন ঘরে কোনো বেগানা পুরুষ লোক আসলে তাদের স্থান পরিবর্তন করতে না হয়।
মাসয়ালা: মহিলাদের জন্য যদি মাসজিদে ইতিকাফের ব্যবস্থা থাকে, এবং পরিবারের কর্তার অনুমতি থাকলে সেখানে ইতিকাফ করতে পারে। অনেক সময় এক এলাকার মহিলাদের ইতিকাফের জন্য কোনো এক ঘরে ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে এলাকার সব মহিলারা জমায়েত হয়ে ইতিকাফে বসেন, কর্তার অনুমতি থাকলে সেখানে যেয়েও ইতিকাফ করতে পারেন। তবে আগে থেকে দেখে নিবেন সেই ঘরের পুরুষদের জন্য কোনো রকম পর্দার সমস্যা বা ফিতনার আশংকা আছে কিনা। তবে অন্যের ঘরে ইতিকাফে বসার চেয়ে উত্তম হচ্ছে নিজ ঘরে ইতিকাফে বসা।
ইতিকাফের স্থানে অবস্থান করার সময়ঃ রমজানের শেষ ১০ দিন সুন্নত ইতেকাফ করতে চাইলে সুন্নত ইতেকাফের নিয়ত করে ২০ রমজান সূর্য অস্তমিত হওয়ার পূর্বে অর্থাৎ মাগরীব হবার পূর্বেই ইতেকাফের স্থানে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে এবং ঈদের চাঁদ উঠলে ইতেকাফ শেষ হবে। (মাগরীব হয়ে গেলে তারপর নির্ধারিত স্থানে প্রবেশ করলে সুন্নত ইতিকাফ হবেনা)
যদি ১০ দিন সুন্নত ইতিকাফ করার সুযোগ না থাকে বরং একদিন বা অল্প কয়েকদিন নফল ই'তিকাফ করতে চান তাহলে সেটাও করতে পারেন। কোন বাধাধরা নেই, যেহেতু ইতিকাফ নারীদের জন্যে মুস্তাহাব। সেক্ষেত্রে যেদিন থেকে ইতিকাফ করতে চান সেদিন ই'তিকাফের নিয়ত করে সূর্যাস্তের আগেই ই'তিকাফের স্থানে অবস্থান শুরু করবেন এবং যেদিন শেষ করতে চান সেদিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত ই'তিকাফ করবেন।
ইতিকাফের স্থান থেকে বের হওয়া: মহিলারা ঘরের যে স্থানটিকে ইতিকাফের জন্য নির্ধারিত করবেন তা তাদের ক্ষেত্রে মসজিদের মতোই গণ্য হবে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া তারা সেখান থেকে বের হতে পারবেন না। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া সে স্থানের বাইরে ঘরের অন্যত্র গেলেও ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১১; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮২)
মাসয়ালা: প্রাকৃতিক প্রয়োজন বলতে বুঝায়, পেশাব-পায়খানা। সুতরাং ইতিকাফ অবস্থায় মহিলারা পেশাব-পায়খানার জন্য ইতিকাফের স্থান থেকে বের হতে পারবেন। ওজুর জন্য বাইরে যেতে পারবেন। আর যদি এসবের জন্য ইতিকাফ-কক্ষের ভিতরেই রুচিসম্মত সংযুক্ত বাথরুম থাকে তাহলে এর জন্য বাইরে যেতে পারবেন না।
অনুমতি গ্রহণ: অবিবাহিত মেয়েরা পরিবারের মুরুব্বী অর্থাৎ মা-বাবাকে জানিয়ে নিবে, যাতে তারা জেনে থাকেন শেষ দশকে তারা প্রয়োজনে মেয়েকে কাছে পাবেন না। না হয় প্রয়োজনে কাছে না পেয়ে অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
বিবাহিতা নারীদের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে অবশ্যই। স্বামী অনুমতি না দিলে, এরপরেও ইতিকাফে বসলে তা অনুচিত হবে, এবং কঠিন গুনাহের কারণও হতে পারে। কারণ ইতিকাফ থেকে স্বামীর আনুগত্য করা বেশি জরুরী।
স্বামীদের জন্য উত্তম হবে এমন একটা মহৎ ইবাদাতে স্ত্রীকে সাহায্য করা, তাহলেই এতে উভয়েই সমান নেকী পাবে, তিনি চাইলেই মানা করতে পারেন, তবে যদি যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ থাকে তবে নিষেধ করতে পারেন।
মাসয়ালা: স্বামী স্ত্রীকে ইতিকাফের অনুমতি দেওয়ার পর আর বাধা দিতে পারবেন না। বাধা দিলেও সে বাধা গ্রহণযোগ্য নয় এবং স্ত্রীর জন্য তা মানাও জরুরি নয়। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৪১; ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১১)
স্বামী ও সন্তানের দেখাশোনার প্রয়োজন হলে: যে নারীর স্বামী বৃদ্ধ বা অসুস্থ কিংবা তার ছোটছোট ছেলে-মেয়ে রয়েছে এবং তাদের সেবা-শুশ্রূষা করার কেউ নেই, সে মহিলার জন্য ইতিকাফ করার চেয়ে তাদের সেবাযত্ন করা উত্তম।
ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী-সম্ভোগ: ইতিকাফ অবস্থায় রাতেও স্ত্রী-সহবাস করা যাবে না। করলে ইতিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে। ইতিকাফ কক্ষটি যদি শয়নকক্ষ হয় এবং একই কক্ষে বা একই বিছানায় অন্য যে কোনো কেউ অবস্থান করেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই; এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবেন, তবে স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণ ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ; যদি এসবের কারণে বীর্যপাত ঘটে তাহলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। (সুরা বাকারা: ১৮৭; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮৫, আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৫০; ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১৩)
হায়েজ/নিফাস অবস্থায় ইতিকাফ: মহিলাদের হায়েজ/নিফাস অবস্থায় ইতিকাফ করা সহিহ নয়। কেননা এ অবস্থায় রোজা রাখা যায় না। আর সুন্নত ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৭৪; ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১১)
মাসয়ালা: নারীদের ইতিকাফে বসার আগেই তাদের হায়েজের (পিরিয়ড) দিন-তারিখ হিসাব করে বসা উচিত। যাতে ইতিকাফ শুরু করার পর হায়েজ শুরু হয়ে না যায়। তবে কারও রমজানের শেষ দশকে হায়েজ হওয়ার নিয়ম থাকলে তিনি হায়েজ শুরু হওয়া পর্যন্ত নফল ইতিকাফ করতে পারবেন।
ওষুধের মাধ্যমে হায়েজ বন্ধ রেখে ইতিকাফ করা: মহিলারা ওষুধ-বড়ি খেয়ে হায়েজ বন্ধ রেখে রোজা রাখলে এবং ইতিকাফ করলে রোজা ও ইতিকাফ সহিহ হবে। তবে এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বিধায় অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ইতিকাফ অবস্থায় হায়েজ শুরু হলে: ইতিকাফ শুরু করার পর হায়েজ শুরু হয়ে গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। পরে শুধু একদিনের ইতিকাফ রোজাসহ কাজা করতে হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫০২)
মহিলাদের ইতিকাফের সুযোগ না হলে: মহিলাদের ইতিকাফের কারণে যদি সন্তান প্রতিপালন, ঘর-সংসারের নিরাপত্তা এবং তার উপর অর্পিত অপরিহার্য কাজ পালনে ব্যাঘাত না ঘটে তবেই তারা স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে ইতিকাফ করতে পারবেন।
অন্যথায় তাদের জন্য ইতিকাফ না করে নিজ দায়িত্ব যাথাযথভাবে পালন, সংসার দেখা-শোনা, স্বামীর সেবা ইত্যাদিতেই অগণিত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তারা কাজের ফাঁকে যথাসাধ্য দুআ-জিকির, তাসবীহ, কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ, দ্বীনী বইপত্র পাঠ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করবেন।
আল্লাহতায়ালা সবাইকে তার ইবাদত বন্দেগিতে সময় ব্যয় করার তাওফীক দান করুন।
রমাদানের এই শেষ দশকে কোন কোন বোনেরা ইতিকাফের নিয়্যাত করেছেন???
(পোষ্টটি শেয়ার, কপি, মেনশন কিংবা ট্যাগ করে অন্যদেরকেও দ্বীন শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করা যাচ্ছে। আপনার ফলে কেউ যদি এই বিশেষ আমলটির ব্যাপারে জানেন বা আমল করেন তবে আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই আপনাকে তার নেকির সমপরিমাণ নেকি দিবেন ইনশাআল্লাহ।)
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....