মিশরের রাজনৈতিক দল (বর্তমানে নিষিদ্ধ) মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিন শাখা দল হিসেবে ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনের গাজা শহরে 'ফিলিস্তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড' নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়।
শেখ আহমেদ ইয়াসিন, আব্দুল আজিজ রানতিস্সি, মাহমুদ জহর, ইব্রাহিম কুকা, মোহাম্মদ তা'হা সহ আরো পাঁচজন মিলে সংগঠনটি তৈরি করেন, তখন যার প্রধান করা হয় শেখ ইয়াসিন কে।
(শেখ ইয়াসিন বাল্যকাল থেকেই শারিরীক ভাবে পাঙ্গু ছিলেন, হাত পা দিয়ে কোন কাজ করতে পারতেন না, হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতেন। তবে তিনি কথাবার্তা বলতে পারতেন এবং তিনি ছিলেন অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত এবং মেধাবী ছাত্র। তিনি মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্কুলে পড়ার সময় প্রতিবেশী সহপাঠী বন্ধুর সাথে খেলতে গিয়ে ধস্তাধস্তি/ মারামারি করতে গিয়ে ঘাড়ে (স্পাইনাল কর্ড) ব্যথা পেয়ে আহত হন। অনেক চিকিৎসার পরও তিনি আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। তার ঐ বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ও সন্মানার্থে তার পরিবারকে তিনি কখনোই তার ব্যথা পাওয়ার ঘটনাটি বলেননি। তার শংঙ্কা ছিল ঘটনা জানাজানি হলে তার পরিবার- বন্ধুর প্রতি বা তার পরিবারের প্রতি নাখোশ হতে পারে এজন্য তিনি বিষয়টি চেপে যান, তবে ৩০ বছর পর কে বা কারা বিষয়টি প্রকাশ করে দেয়। ২২ মার্চ ২০০৪ সালে গাজায় দখলদার ইসরাইলী সন্ত্রাসীদের 'টার্গেট কিলিং' হামলায় নিহত হন)
পরবর্তীতে দলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় - حركة المقاومة الاسلامية (Harakat Al-Muqawamah Al-Islamiyyah - হরকাতুল মুক্বাওয়ামাহ্ আল ইসলামিয়া, ইংরেজিতে এর অর্থ- Islamic Resistance Movement। বাংলায় যার সরল অর্থ দাড়ায়- দখলদার ইসরাইলী ইহুদিদের বিরুদ্ধে ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন।
এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হলো- স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা, ইসরাইল নামক কথিত রাষ্ট্রের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো, ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করা এবং দখলকৃত সমস্ত ভূমি উদ্ধার করে পুরো এলাকা নিয়ে একটি ইসলাম রাষ্ট্র গঠন করা। দলটির তিনটি বিভাগ রয়েছে- যথা- রাজনৈতিক, সমাজসেবা এবং সামরিক বিভাগ।
১৯৯৩ সালে দলটি (Izz ad Dinn Al Qassam Brigade- ইজ আদ্ দীন আল কাসাম ব্রিগেড বা সংক্ষেপে আল কাসাম নামে একটি নিজস্ব মিলিটারি সংগঠন বা সামরিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। যেখানে বর্তমানে নিবন্ধিত ২০ হাজার সেচ্ছাসেবী যোদ্ধা রয়েছে, যারা কোন বেতন নেন না। বর্তমানে আল কাসাম ব্রিগেডের প্রধান- মোহাম্মদ দিয়েফ এবং উপপ্রধান মারওয়ান ঈশা।
শতভাগ সুন্নি মতাবলম্বী এই দলটির আয়ের প্রধান উৎস হলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছায় দেওয়া অনুদান, আন্তর্জাতিক (অমুসলিম/ মুসলিম) সংস্থার আর্থিক অনুদান, ইরান এবং লেবাননের সামরিক খাতে অনুদান ইত্যাদি।
দলটি তাদের বৈদেশিক অনুদান গুলো কঠোর ভাবে খাত অনুযায়ী খরচ করে থাকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক খাতে পাওয়া একটি টাকাও সামরিক খাতে ব্যয় করেনা এবং তদ্রূপ সব খাতেও একই নীতি অবলম্বন করে। গাজা অঞ্চলের শিক্ষা খাত, নারী শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অবকাঠামো নির্মাণে ফিলিস্তিন সরকারের মোট বার্ষিক অনুদানের কয়েকগুণ বেশি অর্থ নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করে এই রাজনৈতিক দলটি।
দলটির বার্ষিক বাজেট প্রায় ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৭০০ কোটি টাকা)। যার প্রায় ৮৫% আসে দেশের বাইরে থেকে।
Hamas logo |
এছাড়াও বাহরাইন কাতার সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি আরব কুয়েত জার্মানি রাশিয়া ফ্রান্স থেকে বিভিন্ন খাতে আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকে। গাজা অঞ্চলে প্রায় ২০০০ একর ওয়াকফ কৃত কৃষি জমি রয়েছে এই দলটির মালিকানায়। তাছাড়া আল আকসা ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকের ২০% শেয়ার, রিয়েলস্টেট ব্যবসা, এপার্টমেন্ট ও মার্কেট ভাড়ার ইত্যাদি ব্যবসা থেকে দলটি আয় করে থাকে।
সবুজ রংয়ের উপর সাদা কালিতে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্' লেখা সম্বলিত একটি নিজস্ব পতাকা রয়েছে এই দলটির। একটি স্বীকৃত নিজস্ব প্রতীক এবং একজন মুখপাত্র রয়েছে।
২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে জিতার পর দলটির বর্তমান নেতা ইসমাইল হানিয়া'র নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। তথাপি আন্তর্জাতিক চাপ এবং 'অর্থনৈতিক অবরোধের' ফলে এক বছরের মধ্যেই হামাস সরকার ভেঙে যায়। নির্বাচিত সরকারি দল হলেও হামাসের তখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাড়ায়- পৃথিবীর অনেক দেশ এই রাজনৈতিক সংগঠনটিকে "সন্ত্রাসী সংগঠন" হিসেবে কালো তালিকাভূক্ত করেছে ফলে ফিলিস্তিন সরকারের হয়ে বৈদেশিক অনুদান, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য আর্থিক সহায়তা পেতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান ফিলিস্তিন সংসদে ৭৪ টি আসন রয়েছে ( মোট আসন ২৩২ টি)।
★ হামাস কে যেসব দেশ 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে অবহিত করে- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ টি সদস্য দেশ, কানাডা এবং দখলদার ইসরাইল।
★ অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড প্যারাগুয়ে এবং যুক্তরাজ্য (UK) হামাস কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অবহিত করেনা তবে শুধু এর সামরিক শাখা আল কাসাম ব্রিগেডকে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে অবহিত করে।
★ ব্রাজিল চীন নরওয়ে রাশিয়া সিরিয়া ইরান তুর্কি মিশর কাতার- এই দেশ গুলো অফিসিয়ালি ঘোষণা দিয়েছে যে তারা কোন ভাবেই মনে করেনা যে হামাস একটি 'সন্ত্রাসী সংগঠন'।
★ ২০১৮ সালে জাতিসংঘ হামাস কে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। (যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে হামাস কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করলে সাধারণ পরিষদ তা বাতিল করে দেয়)
★ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া সহ অনেক দেশ হামাস কে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং অস্বীকৃতিও জানায়নি। অর্থাৎ অফিসিয়ালি বিষয়টি ঘোষিত হয়নি।
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে হামাসের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং সবচেয়ে বড় সমর্থক দেশ ইরান হামাসকে সিরিয়ার শিয়া পন্থী প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত হয়ে তারপক্ষে কাজ করার আহ্বান জানায়। হামাস তা করতে অস্বীকৃতি জানায়, ফলে ইরানের সাথে সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে। ইরান বিষয়টি ভালো ভাবে নেয়নি এবং ইরান তাদের অনুগত লেবাননের হিজবুল্লাহ্ কে নির্দেশ দেয় যেন লেবানন থেকে হামাসের সকল সদস্যকে বিতাড়িত করে। হিজবুল্লাহ্ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।
তথাপি ২০১৫ সালে ইয়েমেন যুদ্ধে ইরানের অন্যায় ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে হামাস। এতে ইরান ক্ষুব্ধ হয় এবং সকল প্রকারের সহায়তা বন্ধ করে দেয়।
ফলে হামাস সামরিক দিক থেকে অনেকটা দূর্বল হয়ে পরে এবং খুবই ঘনিষ্ঠ দুটি মিত্রকে হারায়!
তবে ন্যায়ের পক্ষে হামাসের এমন দৃঢ় নীতির কারণে আন্তজার্তিক অঙ্গনে হামাসের সমালোচকরা হামাসকে 'চিনতে' শুরু করে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশের রাজনৈতিক দল হামাসের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে।
তথাপি, পূর্বে এবং পরে আজ পর্যন্ত হামাস দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধে (ইন্তিফাদা) অবতীর্ণ হয়ে তাদের অঙ্গীকার বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং আল আকসা'র সন্মান রক্ষার্থে অবিচল রয়েছে। হামাস প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন যুদ্ধে পরাজিত হয়নি এবং আত্মসমর্পণ করেনি, এমনকি নিজ থেকে প্রথমে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবও দেয়নি!
ধন্যবাদ
মাসুদ আলম
৮-০৫-২০২১
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....