আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে, সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে আমাদের আকীদা ও নীতি কেমন হওয়া উচিত?

Post ID 111573


আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সকল ইমাম এ ব্যাপারে একমত যে, 

১- সকল সাহাবায়ে কিরামের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে। 
২- তাদের সকলকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। 
৩- তাদেরকে ভালোবাসতে হবে, তাদেরকে তাদের প্রাপ্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। 
৪- তাদের জন্য সন্তুষ্টির দোয়া করতে হবে। 
৫- আর এটা বলতে হবে যে, তারা সকলেই নির্ভরযোগ্য, ন্যায়পরায়ণ, কারণ আল্লাহ তাদেরকে নির্ভরযোগ্য ঘোষণা করেছেন। 
৬- তাদের মাঝে যা ঘটেছে এ ব্যাপারে আলোচনা করা বা কোনো মন্তব্য করা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। 

৭- তবে এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে, সাহাবায়ে কিরাম মা‘সূম নন। তাদের থেকে ভুল হতে পারে ও হয়েছে। 

৮- তাদের মধ্যে যারা ইজতিহাদ করে কিছু করে থাকবেন, যদি তারা সঠিক মতটিতে পৌঁছুতে সক্ষম হয় তবে তাতে তাদের জন্য দু’টি সাওয়াব রয়েছে। আর যদি ভুলও করে তাদের জন্য তাতে ইজতিহাদের একটি সাওয়াব রয়েছে। 

৯- তাদের ভুলগুলো তাদের নেকের সাগরে সেটা একেবারেই হারিয়ে গেছে। সুতরাং সেগুলোর আলোচনা আলাদা করে তুলে ধরে যাবে না, যদি কুরআনের শানে নুযুল বা হাদীসের শানে ওরুদ এর মাঝে এসে যায় তবে সেটাকে নিয়ে বড় আলোচনার সূত্রপাত না করে যতটুকু না হলে আয়াত বা হাদীস বুঝতে অসুবিধা হবে ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।  
১০- আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তাদের ব্যাপারে নেক নিয়ত রাখে। তাদের কারো বিরুদ্ধে এতের অন্তরে বিদ্বেষ রাখে না। 
১১- তারা এটাও বলে যে পরবর্তী সময়ে সিফফীন ও জামাল নামক যেসব যুদ্ধ হয়েছে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু হকের অধিক নিকটবর্তী ছিলেন।  

এর মাধ্যমে তারা শিয়া, খারেজী ও নাসেবীদের মতবাদকে বাতিল বলে বিশ্বাস করে যারা সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করে। 
শিয়া রাফেযী সম্প্রদায়ের লোকেরা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু ও আহলে বাইত নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ও সীমালঙ্ঘন করে। অপর দিকে তারা হাতে গোনা কয়েকজন বাদে সকল সাহাবায়ে কিরামের সাথে শত্রুতা পোষণ করে, তাদের গালি গালাজ করে। তারা এ ব্যাপারে এতই বাড়াবাড়ি করেছে যে, এটাকে দীনের অংশ মনে করে বসেছে। বরং তারা সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে মুরতাদ ও কাফির হওয়ার অপবাদ চাপায়। নাউযুবিল্লাহ। 
ঠিক তাদের বিপরীতে নাসেবীরা, তারা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু ও আলে বাইতের ব্যাপারে অত্যন্ত খারাপ ধারণা পোষণ করে। উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু ও মু‘আওয়িয়াহ রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুর মহব্বতের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি তাদেরকে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু ও আলে বাইতের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত করে। বিশেষ করে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুর ব্যাপারে। 

আর খারেজী সম্প্রদায়, মতবাদ বর্ণনাকারী গ্রন্থকারগণ তাদের থেকে যা বর্ণনা করেছে তা হচ্ছে, তারা উসমান, আলী, বিচারকদ্বয়, ত্বালহা, যুবাইর, আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) এদের সকলকে কাফের বলার ব্যাপারে একমত পোষণ করে। 

বস্তুত সাহাবায়ে কিরামের উপর যে কোনো প্রকার আক্রমন করা হলে তা পর্যায়ক্রমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালতের বর্ণনা, বুঝ, অনুসরণ ইত্যাদিতে ত্রুটি দেখা দিবে। বরং তার মাধ্যমে কুরআনের ব্যাপারেও সন্দেহ দেখা দিবে। এমনকি শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার আনীত দীনের ব্যাপারেও সংশয় তৈরী হবে। দেখুন, শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৪/১০২, ১০৩, ১৫৫, ৪২৯; মিনহাজুস সুন্নাহ ৭/৯। ইসলামের শত্রুরা এ জন্য এ অংশটুকুকে আক্রমনের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছে। আর মুসলিমদের মাঝে যারা এ অংশে অকারণে কথা বলেছে তারাই অন্যদের জন্য পথভ্রষ্টতার পথ রচনা করেছে। 

এ জন্য শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, সালাফে সালেহীন তারা এসব ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন, তারা সাহাবায়ে কিরামের মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর আলোচনা করা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতেন। 
তারা বলেন, ‘সাহাাবগণের দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করে যে সব বর্ণনা এসেছে সেগুলোর অবস্থা হচ্ছে, 
ক) কোনো কোনোটি একেবারেই মিথ্যা। 
খ) কোনো কোনোটিতে বাড়তি কথা ও বক্তব্য সংযোজন করা হয়েছে।
গ) কোনো কোনোটিতে কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমস্যাপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। 
ঘ) কোনো কোনোটিতে কথা তার স্থানচ্যুত করে অন্য রকম করে বর্ণনা দিয়ে দোষে পরিণত করা হয়েছে।
ঙ) আর সে সব বর্ণনার মধ্য হতে যা বিশুদ্ধ, তাতে তাদের ওযর রয়েছে। কারণ হয় তারা তাতে, 
১- ইজতিহাদকারী ছিলেন, আর সে ইজতিহাদে তারা সঠিক মত ও পথটি গ্রহণ করেছেন। অথবা 
২- তারা ইজতিহাদকারী ছিলেন, কিন্তু ইজতিহাদে ভুল করেছেন। 
চ) তবে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, তারা সাহাবায়ে কিরামের কাউকে সগীরা কিংবা কবীরা গুনাহ থেকে মা’সূম বা মুক্ত ও পবিত্র মনে করে না। বরং আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বিশ্বাস করে যে, মোটের ওপর তাদের থেকে গুনাহ সংঘটতি হতে পারে (অর্থাৎ এককভাবে কোনো ব্যক্তিকে নির্ধারণ করে কিছু দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে না)। বরং তারা মনে করে যে সাহাবায়ে কিরামের এমনসব পূর্ব সাওয়াব ও আমল রয়েছে, এমনসব ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাদের থেকে যদি এসব গুনাহের কোনো অনুষ্ঠিতও হয়ে থাকে, তবে তাদের সেসব পূর্ব সাওয়াব ও ফযীলত সেসব গুনাহকে পুরোপুরি ক্ষমা হয়ে যাওয়া আবশ্যক করে তোলে। এমনকি তাদের যেসব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে যা পরবর্তীতে আসা অন্যদের বেলায় ক্ষমা করা হবে না। কারণ তাদের এমনসব নেক আমল রয়েছে যা পরবর্তীরা কখনো অর্জন করতে পারবে না। কারণ সাহাবায়ে কিরামের এমনসব নেক আমল জমা রয়েছে তা তাদের সেসব দোষ-ত্রুটি মিটিয়ে দিবে, পরবর্তীদের কাছে এমন কিছু নেই। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে এসেছে, তিনি বলেছেন, সাহাবীগণ সর্বোত্তম প্রজন্ম, [বুখারী, আল-জামে‘উস সহীহ, হাদীস নং ৩৬৫০, মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ২৫৩৩] (আরও এসেছে,) তাদের কারও এক মুদ্দ (দু হাতের সমন্বিত অংশে যতটুকু জায়গা হয় সে পরিমাণ) সাদাকা হিসেবে ব্যয় করা পরবর্তীদের পক্ষ থেকে উহুদ পাহাড়ের মত ব্যয় করার চেয়েও উত্তম ও উৎকৃষ্ট। [আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ২৩৮৩৫]  
তারপর তাদের যদি কোনো ভুল-ত্রুটি হয়েও থাকে, তবে (তাঁদের প্রতি সুধারণা হচ্ছে), 
ক) তাঁরা তা থেকে তারা তাওবা করেছেন। 
খ) তাঁরা এমন সব নেক আমল করেছেন তা তাদের সেসব ভুল-ত্রুটি মিটিয়ে দিয়েছে। 
গ) তাঁদের পূর্ব কৃত নেক আমলের বিনিময়ে তা ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। 
ঘ) অথবা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশের কারণে তা ক্ষমা হয়ে যাবে, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হক্বদার। 
ঙ) অথবা দুনিয়ার বুকে এমন কোনো বালা-মুসিবত তারা পেয়েছেন যা তাদের সব কিছুর কাফফারা হয়ে গেছে। 
এ যদি হয়, তাদের থেকে অনুষ্ঠিত হওয়া বাস্তবে অনুষ্ঠিত (ধরে নেয়া) গুনাহের অবস্থা, তাহলে যেসব ব্যাপারে তাঁরা গুনাহ করেননি, বরং ইজতিহাদ করেছেন (আর তাঁরা প্রকৃতপক্ষেই ইজতিহাদের যোগ্য), সেটার অবস্থা তো আরো স্বাভাবিক। কারণ,
ক) তাঁরা যদি সে ইজতিহাদে সঠিক মতে উপনীত হতে পারে তবে দু’টি সাওয়াব।
খ) যদি সে ইজতিহাদে তাঁরা ভুল করে আর সঠিক মতটিতে যেতে না পারেন, তবে একটি সাওয়াব, ভুল-ত্রুটি ক্ষমার্হ্য।
গ) তাছাড়া তাদের কারও পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত যে পরিমাণ কাজের ব্যাপারে দৃষ্টিকটু মনে হয় তা একেবারেই নগণ্য, তা ক্ষমা প্রাপ্ত, তাদের আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান, আল্লাহর পথে জিহাদ, হিজরত, নুসরত (সাহায্য), উপকারী ইলম ও সৎ আমলের যেসব বিশাল ফযীলত ও মর্যাদা রয়েছে তার তুলনায় খুবই সামান্য...।” শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ, আল-আকীদাতুল ওয়াসেতিয়্যাহ পৃ. ১২৯-১৩১। 
এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, 
১- লালেকাঈ, শারহু উসূলি ই‘তিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ ৪/১২৪১-১২৭০। 
২- আশ‘আরী, আল-ইবানাহ পৃ. ১৮, ১০৪-১০৫। 
৩- সাবূনী, আকীদাতুল সালাফ, পৃ. ৯৩। 
৪- বাইহাক্বী, আল-ই‘তিক্বাদ পৃ. ১৫৯-১৬৬। 
৫- ইবন কুদামাহ, লুম‘আতুল ই‘তিক্বাদ পৃ. ৩২। 
৬- শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩/১৫২-১৫৬, ৩৭৫, ৪০৫-৪১৪, ৪/৪৩১-। 
৭- ইবন তাইমিয়্যাহ, মিনহাজুস সুন্নাহ ৫/৮১-৮৩। 
৮- ইবন আবিল ইয্য আল-হানাফী, শারহুল আকীদাতিত ত্বাহাওয়িয়্যাহ ২/৬৮৯-৬৯৮। 
৯- বাগদাদী, উসুলুদ্দীন, পৃ. ২৮৬-২৯৩। 
১০- বাগদাদী, আল-ফারক্বু বাইনাল ফিরাক্ব পৃ. ৫৫। 
১১- ইবন হাযম, আল-ফাসলু ফিল মিলালি ওয়াল আহওয়ায়ি ওয়ান নিহাল ৪/১৩৩-। 
১২- আল-মাক্বদেসী, আর-রাদ্দু আলার রাফেদ্বাহ পৃ. ৮৭-৮৯। 
১৩- রাযী, ই‘তিক্বাদাতু ফিরাকুল মুসলিমীন ওয়াল মুশরিকীন পৃ. ৪৬। 
১৪- দেহলাওয়ী, মুখতাসার আত-তুহফাতুল ইসনা আশারিয়্যাহ পৃ. ২৩৭। 
১৫- আহমাদ ফরীদ, আল-ফাওয়ায়িদিল বাদী‘আহ ফী ফাদ্বায়িলিস সাহাবাতে ওয়া যাম্মিস শী‘আহ।

All of credit 📝 Abu Bakar Md, Jakariya

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ