বইঃ কুফর ও তাকফির review with pdf download

Post ID 111577
বই সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু তথ্য : 
বইয়ের নাম : কুফর ও তাকফির
লেখক : আলী হাসান উসামা
প্রকাশনী : কালান্তর প্রকাশনী 
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৩২০
মুদ্রিত মূল্য : ৩৮০৳
review credit:- 💞Kalamtor

শায়খ আলী হাসান উসামা হাফিজাহুল্লাহ রচিত 'কুফর ও তাকফির' বইটি কাদের জন্য ও কেন ?
বইটির একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে কিছু কথা আপনাদের খেদমতে পেশ করছি। এরমধ্যে যা কিছু সঠিক ও মুফিদ, তা নিঃসন্দেহে আমার রব আল্লাহ তাআলার মেহেরবানি বৈ কিছু নয় ; পক্ষান্তরে কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে তা আমার কমজোর পর্যবেক্ষণের নতিজা ও শয়তানের ধোঁকা বৈ কিছু নয়। 

কিছু সোজাসাপ্টা কথা (আদ্যোপান্ত পড়ার নিবেদন রইল) :
১. শায়খ আলী হাসান উসামা হাফিজাহুল্লাহ রচিত 'কুফর ও তাকফির' বইটি মৌলিক হলেও এটি মূলত মুফতি উবায়দুর রহমান হাফিজাহুল্লাহ রচিত ও আল্লামা সামি[উ]ল হক হ[ক্কা]নি রাহ.-এর ভূমিকাসংবলিত ইবকারুল আফকার ফি উসুলিল ইকফার  – বইয়ের সারনির্যাস।

অনেক তালিবুল ইলমই বই পড়ার সময় লেখক কর্তৃক লিখিত ভূমিকা ভালোভাবে পড়েন না। আবার পরবর্তীতে একে-ওকে বলে বেড়ান, অমুক এটা পেল কোত্থেকে ? কোনো আকাবির কি এমন কিছু কোথাও বলেছেন ? সেসব শাবাবদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, মুফতি উবায়দুর রহমান হাফিজাহুল্লাহর উপরউক্ত বইটি কওমি মাদ্রাসায় উসুলুত তাকফির বিষয়ে অন্যতম পাঠ্য।


তাই বলাই বাহুল্য যে, শায়খ আলী হাসান উসামা হাফিজাহুল্লাহ আকাবিরে দেওবন্দের নকশে কদম থেকে হটে যাননি বরং আকাবিরের একাডেমিক তাসনিফাত সাধারণ তালিবুল ইলমের বুঝোপযোগী করে পেশ করতে সিদ্ধহস্ত। ইতোপূর্বে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকাইদের বিশদ ও বিশ্লেষণাত্মক বিবরণসংবলিত আল্লামা ইদরিস কান্ধলবি রাহ.-এর ইসলামি আকিদা [প্রথম খণ্ড : তাওহিদ ] (কালান্তর প্রকাশনী) বইয়ের ক্ষেত্রে আপনারা অনেকেই সেটা দেখেছেন। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।


আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আহলুস সুন্নাহর আকাবিরের নকশে কদমে সিরাতে রাসুলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর আমৃত্যু চলার তাওফিক দিন। আমিন।

২. 'তাকফির' প্রসঙ্গে এর আগে আমি ইমাম আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি রাহ.-এর 'ইকফারুল মুলহিদিন' ও মুফতি তারেকুজ্জামান হাফিজাহুল্লাহ রচিত রুহামা পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত 'তাকফিরের মূলনীতি' বই দুটি পড়েছিলাম। 'উসুলুত তাকফির' বিষয়ে বাজারে বিদ্যমান বইগুলোর মধ্যে এগুলো সবচেয়ে অনবদ্য ও মৌলিক ধাঁচে রচিত (কেবল সংকলন নয়)।
আকিদা বিষয়ক রচনা ও বিশুদ্ধ ফিকর বিবেচনায় মুফতি তারেকুজ্জামান হাফি. আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ, তবে তাঁর 'তাকফিরের মূলনীতি' গ্রন্থটি কিছু ব্যাপারে আমার কাছে ভাসাভাসা আলোচনাসমৃদ্ধ মনে হয়েছে। বিশেষ করে লুজুম ও ইলতিজামের মধ্যে পার্থক্যকরণ আমার চোখে পড়েনি।

যারা জানেননা 'লুজুম' ও 'ইলতিজাম' কী, তাদের জন্য সহজ ভাষায় বিষয়টা ব্যাখ্যা করছি। 'লুজুম' অর্থ – কোনো কিছু নিজে নিজে আবশ্যক হওয়া। আর যা আবশ্যক ও অপরিহার্য হয়, তাকে বলা হয় 'লাজিম'। যেমন : কাউকে আঘাত করলে সে ব্যথা পাবে। এই 'ব্যথা পাওয়া'টা আঘাতের লুজুম, 'ব্যথা' হলো লাজিম। আর 'ইলতিজাম' অর্থ – নিজেই কোনো কিছু অবলম্বন, আবশ্যক ও অবধারিত করে নেওয়া।

কেউ এমন কোনো কথা বলল না এমন কোনো কাজ করল, যা সত্তাগতভাবে কুফর নয় ; তবে তার দ্বারা কুফর লাজিম হয়, তাহলে এর কারণে কি সেই ব্যক্তিকে তাকফির করা যাবে ? কারণ, ফিকহের একটি স্বীকৃত মূলনীতি হলো, 'কোনো কিছু সাব্যস্ত হলে তার যত লাজিম আছে, তা-সহ সাব্যস্ত হয়।'

এক্ষেত্রে মুহাক্কিক ফকিহ ও উসুলশাস্ত্র বিশেষজ্ঞগণের মত হলো, কেউ যতক্ষণ না নিজে কুফর 'ইলতিজাম' করে নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্রেফ 'লুজুম'-এর কারণে তাকে তাকফির করা হবে না। বিষয়টা আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে উদাহরণটি দেখা যেতে পারে।
মুতাজিলা অভিমত হলো, আল্লাহর সত্তার সঙ্গে ইলম গুণ প্রতিষ্ঠিত নয়। অথচ অসংখ্য আয়াত ও হাদিস দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, আল্লাহর 'ইলম' গুণ রয়েছে। তিনি আলিম, সর্বজ্ঞ। সবকিছু নিজ ইলম দ্বারা পরিব্যাপ্ত করে রেখেছেন। সৃষ্টি করা যেমন তাঁর একটি গুণ, ইলমও (জ্ঞান) তেমনই তাঁর একটি গুণ। তিনি যেমন অনাদি ও অনন্ত, তাঁর গুণসমূহও তেমনই অনাদি ও অনন্ত।


আল্লাহর 'ইলম গুণ' অস্বীকার করার 'লাজিম' হলো, আল্লাহর অস্তিত্বই অস্বীকার করা। কারণ, আল্লাহ হচ্ছেন সেই সত্তা, যিনি পূর্ণতার অন্যান্য গুণের (সিফাতে কামালের) পাশাপাশি ইলমের দ্বারাও গুণান্বিত। জ্ঞানহীন কোনো সত্তা, রব হওয়ার উপযুক্ততাই রাখে না। সুতরাং যখন কেউ আল্লাহর সত্তার সঙ্গে এই গুণ প্রতিষ্ঠিত মনে করবে না, তখন কেমন যেন সে রবের অস্তিত্বই স্বীকার করল না, যা সুস্পষ্ট কুফর।

এরূপ 'লাজিম' সামনে থাকা সত্ত্বেও উম্মাহর নির্ভরযোগ্য আলিমগণ মুতাজিলাদের সুনির্দিষ্টভাবে তাকফির করেননি। এর মূল কারণ হলো, যদিও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের কারণে কুফর 'লাজিম' আসে ; কিন্তু তারা তা 'ইলতিজাম' না করে বরং স্পষ্ট ভাষায় সেসব 'লাজিম'কে অস্বীকার করে। তাদের সামনে কেউ লাজিমগুলো তুলে ধরলে তারা দৃঢ়ভাবে সেগুলোর সঙ্গে সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করে।

যেমন, কোনো মুতাজিলিকে যদি বলা হয়, তুমি তো আল্লাহর ইলম গুণকে অস্বীকার করো, সুতরাং এর 'লাজিম' হলো তুমি আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করো। তাহলে তৎক্ষনাৎ সে এই 'লাজিম'কে অস্বীকার করে এবং এর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে নিজের সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করে।
সুতরাং বোঝা গেল, আহলুস সুন্নাহর জুমহুর ফুকাহা তাকফিরের ক্ষেত্রে ইলতিজামকে বিবেচনা করেছেন ; লুজুমকে বিবেচনা করেননি। কারণ, লুজুম হচ্ছে সন্দেহ ও সম্ভাবনাপূর্ণ ; সুনিশ্চিত ও অকাট্য কিছু নয়। অথচ তাকফিরের জন্য সুনিশ্চিত, দ্ব্যর্থহীন ও অকাট্য ভিত্তি প্রয়োজন। যেহেতু ব্যক্তির ইসলাম সুনিশ্চিত, তাই সুনিশ্চিত কুফরের ভিত্তিতেই কেবল তা নষ্ট হওয়ার ফাতওয়া দেওয়া যাবে ; ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে নয়। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন, কুফর ও তাকফির )।


শায়খ তারেকুজ্জামান হাফি.-এর 'তাকফিরের মূলনীতি' বইটি পড়ে আমার এমন মনে হয়েছে যে, শায়খ হাফি. চাইলে এব্যাপারে আরও গভীরে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি যাননি ; তাছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে জুমহুর আলিমদের মানহাজ থেকে হটে বিশেষ মানহাজ অবলম্বনপূর্বক আলোচনা করেছেন, এতে সাধারণ পাঠকের ভুল বোঝার সম্ভাবনা কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সেজন্যই আপনাকে শায়খ আলী হাসান উসামা হাফিজাহুল্লাহ রচিত 'কুফর ও তাকফির' বইটি পড়তে হবে। তাকফিরের ক্ষেত্রে জুমহুর ফুকাহা ও মুতাকাল্লিমিনের মানহাজ বুঝতে এর কোনো উত্তম বিকল্প বাংলা ভাষায় আমি এখনো অব্দি দেখিনি।


৩. তাকফির সংক্রান্ত চর্চিত (মুতাওয়াতির অথবা কমপক্ষে সহিহ ইসনাদবিশিষ্ট) বিখ্যাত হাদিসগুলো থেকে প্রাপ্ত বুঝ ও তা থেকে নিঃসৃত ফিকহের গভীরতা সম্পর্কে যাদের আলোচনা অসম্পূর্ণ (অর্থাৎ, বিশদ নয়) ও সম্পূর্ণ বাহ্যিক বুঝের ওপর নির্ভরশীল, তাদের পক্ষে পরিপূর্ণ ভারসাম্য বজায় রেখে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর জুমহুর আলিমদের মানহাজ অনুযায়ী তাকফিরের উসুল বর্ণনা করা সম্ভব না। অথচ বাজারে বিদ্যমান বেশিরভাগ 'উসুলুত তাকফির' কেন্দ্রিক বইগুলোর হাল-তবিয়ত এমনই !

যদিও সব আহলে ইলম ও তালিবুল ইলমদের জেনে রাখা উচিত, বর্তমান সময়েও তাকফিরের উসুল বর্ণনায় ইমাম আবু জা'ফর আহমাদ তহাবি রাহ., শামসুল আইম্মা সারাখসি রাহ., ইমাম আবু হামিদ গাজালি রাহ., ইমাম নববি রাহ., ইমাম ইবনু নুজায়ম হানাফি রাহ., ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ., ইমাম কামালুদ্দিন মাকদিসি রাহ., ইমাম সা'দ তাফতাজানি রাহ., ইমাম মোল্লা আলি কারি রাহ., ইমাম শাহ আবদুল আজিজ রাহ., আল্লামা ইবনু আবিদিন শামি রাহ., আল্লামা মুসতফা সাবরি রাহ., আল্লামা জাহিদ কাউসারি রাহ., ইমাম আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি রাহ., আল্লামা ইউসুফ বানুরি রাহ. প্রমুখদের এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। বিশেষ করে ফিকহে হানাফির উসুলুল ফিকহের সাথে যে বা যারা পরিচিত তাদের কাছে নুসুসের সম্পূর্ণ বাহ্যিক বুঝের ওপর নির্ভরশীল তাকফিরনীতি খাপছাড়া ও প্রান্তিকতাপূর্ণ বৈ কিছু মনে হবে না !

এসব বিবেচনায় 'কুফর ও তাকফির' বইটি অনন্য।
৪. 'কুফর ও তাকফির' বইয়ে কুফরের দুনিয়াবি ও আখিরাতের বিধানের বিস্তারিত ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে আহলুস সুন্নাহর ইমামগণ বিশেষত ফিকহে হানাফির ইমামগণ ও যাদের অবদানে 'বাররে সাগির' তথা উপমহাদেশে দীন ইসলামের প্রদীপ আজও জাজ্জ্বল্যমান, সেই উলামায়ে দেওবন্দের ঊদ্ধৃতিতে। ফলে, ইসলামের অকাট্য বিধান 'আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা' সংশ্লিষ্ট ফিকহি বিধিবিধান জানতে বইটি একটি রেফারেন্স বুক হিসেবে কাজ করবে বলে অধমের ধারণা।

যারা ইসলামের অকাট্য বিধান আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা সংক্রান্ত বিষয়াদি সালাফিদের নব-আবিষ্কৃত টার্ম বলে একে একপ্রকার অস্বীকারের প্রয়াস পান, তাদের জন্য উলামায়ে দেওবন্দের বরেণ্য আকাবির বিশেষ করে হাকিমুল উম্মাহ মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রাহ., আল্লামা ইদরিস কান্ধলবি রাহ.-এর ঊদ্ধৃতিতে উক্ত বিধানটির ফিকহি দৃষ্টিকোণের প্রামাণিকতা দেখানো হয়েছে। শিরোনাম নতুন হলেও 'এতে আলোচ্য মূল বিষয়বস্তু' পুরোনো ও ইসলামের মূল ভাষ্যের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৫. অনেকেই অমুক কাজ কুফর  – এজাতীয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদিসসমূহকে 'এর দ্বারা তাকফির উদ্দেশ্য' অর্থে নিয়ে তাকফিরের মেশিনগান থেকে অনবরত গুলি ছোঁড়েন ! তাকফিরের মতো অতি সংবেদনশীল বিষয়ে তাদের জবান হয়ে পড়ে বড়ই অসংযত। সামান্য মতের অমিল কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে তাকফিরের পসরা সাজানো আজ যেন খুবই সস্তা বিষয়।

অথচ কোনো মুসলিমকে তাকফির করার অর্থ হলো, তার ব্যাপারে এ সিদ্ধান্ত দেওয়া যে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। এখন দুনিয়া ও আখিরাতে তার ওপর কাফির ও মুরতাদের বিধান প্রয়োগ হবে। যেমন, তার বিয়ে ভেঙে যাবে, পূর্বের সকল নেক আমল নষ্ট হয়ে যাবে, তাওবা করে পুনরায় ইসলামে ফিরে না এলে হত্যা করে ফেলা হবে, সে শাসক হলে তাকে অবশ্যই অপসারণ করতে হবে, সংঘবদ্ধ দল হলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। এ অবস্থায় মারা গেলে তাদের জানাযা পড়া যাবে না, মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না, পরকালে চিরস্থায়ী জাহান্নামি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাই কাউকে তাকফির করা সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এর সাথে অনেক হুকুম-আহকাম ও মাসআলা-মাসায়েল জড়িত। দুনিয়াতে তার জান-মালের নিরাপত্তা, জানাযা, কাফন-দাফন ইত্যাদি এবং আখিরাতে তার চিরস্থায়ী সফলতা কিংবা ব্যর্থতা, জান্নাতি বা জাহান্নামি হওয়ার ফায়সালাসহ অনেক কিছু এর সাথে জড়িত।

কাউকে তাকফির করার বিষয়টি যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর তাই শরিয়ত এ ব্যাপারে আমাদেরকে খুব সাবধানতা অবলম্বন করার নির্দেশ দিয়েছে। সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল প্রমাণ ছাড়া কাউকেই তাকফির করা যাবে না।
উম্মাতে মুসলিমার মাঝে সর্বপ্রথম যে ফিতনা দেখা দিয়েছে তা হলো এই খারেজি ফিতনা বা তাকফিরি ফিতনা। এ ফিতনার দ্বারাই উম্মাহর মাঝে ফিতনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। খলিফায়ে রাশিদ উসমান ইবনু আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাকফির ও হত্যার মাধ্যমে এ ফিতনার সূত্রপাত। সেই যে ফিতনা শুরু হয়েছে, এরপর তা আর শেষ হয়নি।

ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন,
يجب الاحتراز من تكفير المسلمين بالذنوب والخطايا فإنه أول بدعة ظهرت في الإسلام فكفر أهلها المسلمين واستحلوا دماءهم وأموالهم –مجموع الفتاوى، ج: 13، ص: 31، ط. مجمع الملك فهد 
'গুনাহ ও নাফরমানির ভিত্তিতে মুসলিমদের তাকফির করা থেকে সাবধান থাকা জরুরি। কারণ, এটিই ইসলামের ইতিহাসে দেখা দেয়া সর্বপ্রথম বিদআত। ফলশ্রুতিতে তারা মুসলিমদের তাকফির করেছে এবং জান-মাল বৈধ বলে গণ্য করেছে।' (মাজমুউল ফাতাওয়া : ১৩/৩১) 
তাকফিরের ক্ষেত্রে উগ্রপন্থা অবলম্বন করা খারিজি সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। ছোটখাটো কারণে মুসলিমদের তাকফির করে তাদের জান–মাল বৈধ করে নেয়া এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা খারিজি শ্রেণীর কাজ। মুসলিম উম্মাহ দীর্ঘদিন এ শ্রেণীর ফিতনা থেকে নিরাপদ ছিল। এ যুগে আবার এদের উদ্ভব ঘটেছে। 

'কুফর ও তাকফির' বইটি আপনাকে ইসলামের দুটো সবচেয়ে সংবেদনশীল বিধান 'কুফর' ও 'তাকফির'-এর মধ্যে পার্থক্যকরণ যে কতটা জরুরি, সেটা শেখাবে ; খেলাচ্ছলে বা মশকরা করে কারও প্রতি তাকফিরের আলফাজ উচ্চারণ করা কতটা ভয়াবহ ও মারাত্মক বিষয়, সে সম্পর্কে বিশদ ধারণা দেবে ; ব্যক্তিবিশেষকে তাকফির ও দলগত তাকফিরের মধ্যে যে কত বড় তফাত ও সংবেদনশীল বিষয়াদি রয়েছে সেটা শেখাবে ; তাউইলের (উপযুক্ত শারয়ি ব্যাখ্যার) প্রয়োজনীতা ও প্রায়োগিক রূপ শেখাবে ; সর্বোপরি 'তাকফির' নিয়ে আপনার অসংযত জবানকে সংযত করতে বইটি আপনাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে।

৬. বস্তুত, তাকফিরের মেশিনগান চালানোর আগে আমাদের দেখা উচিত, আমি কি মুকাফফির (যে তাকফির করে) হওয়ার উপযুক্ত ? কার দিকে অস্ত্র তাক করছি আমরা ; সে কি আদৌ মুকাফফার (তাকফিরকৃত হওয়ার) উপযুক্ত ? নাকি সে ওজরগ্রস্থ ? নাকি তার কাজের শরয়ি ব্যাখ্যা (তাউইল) সম্ভব ? নাকি সে তাকফিরের উপযুক্ত সাব্যস্ত হওয়ার মতোই নয় ? ইত্যাদি।

এরকম অনেক বাঁধা এড়িয়ে যেখানে একান্ত প্রয়োজনেই কেবলমাত্র কারও ওপর তাকফিরের বিধান আরোপ করা হয় ; সেখানে একজন আওয়াম/তালিবুল ইলম হয়ে এব্যাপারে উদ্ধতস্বভাবের সুযোগ কোথায় ? 

বলে রাখা ভালো, আহলুস সুন্নাহর আলিমগণ কর্তৃক কোনো ব্যক্তির ওপর তাকফিরের বিধান আরোপের পেছনে অনেক শর্ত ও বাঁধা বর্ণনার মানে এ-ও না যে, যে বিষয়ে কুফর করার দরুন শরিয়ত সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কোনো ব্যাখ্যার অবকাশই রাখেনি, তাতেও তাউইলের নামে অপব্যাখ্যা করে (যেমন, কাদিয়ানি ফির্কা কর্তৃক খাতমে নবুওয়াতের মতো জরুরিয়াতে দীনের আকিদাকে অপব্যাখ্যা করা), এটা-ওটা ভেবে তাকফির রোধ করা হবে ; সেটার সুযোগও নেই। সেখানে তো কাফিরকে কাফির মনে না করলেও কুফর হবে এবং তাকে তাকফির করা হবে (যেমন, কাদিয়ানিদের কাফির মনে করা ফরজ ; যে কাফির মনে করবে না, সেও কাফির হয়ে যাবে)।

একজন মুসলিমকে 'কাফির' আখ্যা দেওয়া যেমন মারাত্মক অপরাধ ; তেমনি একজন কাফির-মুরতাদকে তার শত কুফর-রিদ্দাহ সত্ত্বেও সোশ্যাল স্ট্যাটাসের কারণে বা ক্ষমতা-কর্তৃত্বের কারণে 'মুসলিম' বলে গণ্য করা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ (কেননা, এতে সাধারণ মুসলিমদের চোখে কুফর-শির্ক-রিদ্দাহর মতো জঘন্যতম অপরাধ আর 'অপরাধ' থাকে না, 'সাধারণ গুনাহ' হিসেবে পর্যবসিত হয়)।

সেজন্যেই কুফর ও তাকফিরের সীমা ও শরয়ি উসুল সম্পর্কে বিশদ জানতে শায়খ আলী হাসান উসামা হাফিজাহুল্লাহ রচিত 'কুফর ও তাকফির' বইটি সংগ্রহ করা একজন পাঠক হিসেবে বাকি পাঠকদের জন্যও জরুরি মনে করছি।

ফিতনাকালীন সময়ে ইলমের বর্মে নিজেদের আচ্ছাদিত করার চেয়ে উত্তম আর কী আছে ? 
৭. বর্তমান বিশ্বে আল্লাহ তাআলার সাহায্যপ্রাপ্ত জামাআত, যাদের ব্যাপারে হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সুসংবাদ দিয়েছেন এই বলে যে – কোনো নিন্দুকের নিন্দা কিংবা কোনো অসহযোগিতাকারীর অসহযোগিতা তাদের দমাতে পারবে না, সেই আল্লাহর রাস্তার মু[জা]হিদদের গ্লোবাল মানহাজ সম্পর্কে যে বা যারা ধারণা বা সম্পৃক্ততা রাখেন, তাদের জন্য 'কুফর ও তাকফির' বইটি এককথায় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ রহমতস্বরূপ
কেননা, গ্লোবাল মানহাজের বিখ্যাত আলিম ও যুদ্ধের ময়দানের ফকিহ শায়খ আবু মুস[আ]ব [সু]রি (ফাক্কাল্লাহু আসরাহ) প্রণীত গ্লোবাল মানহাজ বিশ্বকোষ দাওয়াতুল মুকাওয়ামা আলামিয়্যাহ-তে বিবৃত বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনাকারী আল্লাহর রাস্তার মু[জা]হিদদের গ্লোবাল মানহাজের তাকফিরনীতি 'কুফর ও তাকফির' বইয়ে উল্লেখিত হয়েছে। 


তাই নিজেকে 'তালিবুল ইলম' মনে করা প্রত্যেকের জন্য এই বইটি অনন্য খোরাক হবে বলে আমি আশাবাদী। 
বস্তুত বর্তমানে নব্য-খারিজিদের উগ্রতা আর বাড়াবাড়ির কারণে কাফির, মুরতাদ এবং তাদের পোষ্য দরবারি আলিমরা সুযোগ পেয়ে গেছে। তারা ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম এবং জি[হা]দ মানেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও রক্তপাত প্রমাণের অপচেষ্টার নতুন পথ পেয়েছে। এদের চরমপন্থার কারণে একদিকে যেমন দীর্ঘদিন ধরে চলমান জি[হা]দের সুফল বহুলাংশে বিনষ্ট হচ্ছে, অপরদিকে সাধারণ মুসলমানদের কাছে জি[হা]দের চেহারা বিকৃত হয়ে এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।


জি[হা]দপ্রিয় অতি জযবাতি কিছু যুবক যাদের ইলমের পরিধি সীমিত, ধৈর্যও কম এবং দীনের বুঝও অল্প, এরাই এ শ্রেণীর ফাঁদে সবচেয়ে বেশি পড়েছে। বর্তমানে হক-বাতিল অস্পষ্ট হয়ে পরিবেশ বেশ ঘোলাটে হয়ে গেছে। অনেকের মনেই এখন জি[হা]দ ও মু[জা]হিদদের ব্যাপারে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে। এ সবের জন্য নব্য-খারিজিরাই অনেকাংশে দায়ী।

নটর ডেম কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমান ভূঁইয়া স্যার আমাদের এক মুজাকারায় বলেছিলেন, ইলমহীন আমল বিদআত ছড়ায় ; আমলহীন ইলম ফিতনা ছড়ায়।

তাই বর্তমান সময়ের আল্লাহর রাস্তার মু[জা]হিদদের গ্লোবাল মানহাজ সম্পর্কে বিশদ ইলমও হাসিল করতে হবে এবং আমলও করতে হবে। প্রচলিত দীনি তাহরিকে সাধ্যমতো শরিক হওয়া, পাশাপাশি ই'দাদের ফরজ আদায় করা জরুরি।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী মু[জা]হিদদের অনুসৃত গ্লোবাল মানহাজ কী ও এসম্পর্কে বিশদ জানতে পড়ুন,
ক. রাত পোহাবার কত দেরি : মুফতি আবু জান্দাল জালালাবাদী (রেনেসাঁ)
খ. ইন সার্চ অফ অ্যা সিক্রেট হিস্ট্রি : আবদুল বারি আতওয়ান (রেডলাইন পাবলিকেশন)
কাজের কাজ কিছুই না করে কল্পনার ফ্যান্টাসিতে বিশ্ববিজয় তো এক অলীক বিষয় ! সকল তালিবুল ইলমের উচিত ফ্যান্টাসির দুনিয়া থেকে বের হয়ে আহলে ইলমের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া, তাঁদের কাছ থেকে সাধ্যমতো ইস্তিফাদা হাসিলের চেষ্টা করা এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দা বা অসহযোগিতাকারীর অসহযোগিতার পরোয়া না করে আহলে ইলমের তত্ত্বাবধানে দীন ইসলামের দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়া।


দীন ইসলামকে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র-বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে আমাদের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চেষ্টার মধ্যে আল্লাহ তাআলা বরকত দিবেন, ইনশাআল্লাহ।
৮. 'কুফর ও তাকফির' বইটির প্রথম দিককার আলোচনা বেশ তাত্ত্বিক ও ইলমি আন্দাজে রচিত। তাই বইটিকে কোনো হুমায়ূনীয় উপন্যাস মনে না করে ধীরেসুস্থে পড়ার নিবেদন রইল। দু'পাতা পড়ে যদি 'জটিল বিষয়, মাথায় ঢুকছে না কোনোমতে !' ভেবে রেখে দেন, তাহলে আপনার কখনোই কুফর ও তাকফিরের শারয়ি বিধান ও তাকফিরের উসুল সংক্রান্ত ইলম শেখা হবে না। 

তাই আদ্যোপান্ত বইটি পড়ে আপনার কোনো দোস্ত-আহবাবের সাথে তাকরার (পাঠ পুনরাবৃত্ত করা) করলে আশানুরূপ ফায়দা হাসিল করতে পারবেন বলে আমরা আশাবাদী।
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলাই তাওফিকদাতা। 

বইয়ের সূচিসহ প্রথম কয়েক পৃষ্ঠার PDF : 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ