১.
তারা হুট করে একজন আরেকজনকে ভালোবেসে ফেললো। মাস কয়েক আগে মেয়েটাই একদিন নক দিয়ে জানতে চেয়েছিল, 'অমুক বইটা কেমন? আরবি শেখার জন্য কী কী বই ভালো হবে?' এমন হাজারো সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে বড়সড় একটা ম্যাসেজ লিখে ফেলেছিল। দু'দিন গেল, তিনদিন গেল রিপ্লাই এলো না। আবার ম্যাসেজ দিলো, 'আপনি দয়া করে উত্তর দিন। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানাটা খুব দরকার।' এবার ওপ্রান্ত থেকে কয়েক লাইনে সাজানো-গোছানো জবাব এলো। এইটুকু ম্যাসেজও কী সুন্দর পরিপাটি! কী অসাধারণ ব্যক্তিত্ব মানুষটার! 'You can now call each other and see information...' বাক্যটার দিকে মেয়েটা তাকিয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ।
কয়েকদিন বাদে এক্টিভ থাকতে দেখে মেয়েটা আবার ম্যাসেজ দেয়, 'আপনার লেখা আমার অসাধারণ লাগে। অসম্ভব সুন্দর লিখেন আপনি। আল্লাহ লেখায় আরো বারাকাহ দিন।' রিপ্লাই আসে 'আমিন'। এবার কথা বাড়ে। 'কিসে পড়েন আপনি? কোথায় থাকেন? আপনার বাবা-মা কেমন আছে?' হাজার চেষ্টা করেও কেন যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ছেলেটা৷ ম্যাসেজের উত্তর দেবে না দেবে না করেও কী এক অদ্ভুত আকর্ষণে দিয়ে দেয়। গাইরে মাহরাম নিয়ে লেখালেখি করা ছেলেটা হারিয়ে যায় মায়াবী কথার মিষ্টতায়।
নিয়মিত রিয়্যেক্ট, কমেন্ট করা ছিল মেয়েটার অন্যতম কাজ। মনের শান্তি ছাড়াও দৃষ্টি আকর্ষণ ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। সে সফলও হয়েছিল। কোন একসময় ছেলেটা মেয়েটার রিয়্যেক্ট না পেলে উৎকন্ঠিত হতো। 'আশ্চর্য তো আজ মেয়েটা গেল কোথায়?' সেই সাথে গেলো কোথায় তার লেখার সেই সূকুন? সেই ইখলাস? এখন তো সে শুধুমাত্র লিখে মেয়েটার জন্য, মেয়েটার রিয়্যেক্টের জন্য।
সম্পর্ক গভীর হয়, আপনি থেকে তুমিতে আসে। ফর্মাল আলাপ ছেড়ে ব্যক্তিগত কথাও হয়। ধীরে ধীরে অনিয়ন্ত্রিত কথাবার্তা, বিয়ের আশ্বাস, ছবি আদান-প্রদান সবকিছু মিলিয়ে তারা ডুবে যেতে থাকে গুনাহের চোরাবালিতে। 'ভুল হচ্ছে, এটা হারাম, আমাদের গুনাহ হচ্ছে' এতসব ভাবনা মাথায় এলেও কোথাও যেন একটা 'কিন্তু' থেকে যায়। সেই কিন্তুর ফাঁদ থেকে হাজারবার বেরোতে চাইলেও দু'জনের কেউ একজন ম্যাসেজ দেয়, 'বিশ্বাস করো আমি তোমাকে মিস করছি। একটু কথা বলি?'
তারপর? তারপর কী হয়? দু'জনের কেউ একজনও কি নিজেকে বদলে ফেলে পরিসমাপ্তি ঘটায় এই হারাম সম্পর্কের? নাকি কারোর নতুন জীবনের সূচনা হওয়ায় অপরপ্রান্তের মানুষ গুমরে গুমরে মরে ধ্বংস করে দেয় নিজের দ্বীন-দুনিয়া সবকিছুকেই? অথবা কোন একদিন বোধদয় হলেও নিজের অতীত গুনাহের স্বাক্ষী হওয়া হৃদয় তাওবাহ করতে অস্বীকৃতি জানায়?
গল্পটা কাল্পনিক। কিন্তু অনেকের জীবনেই হয়তো এর সত্যতা রয়েছে। কারোর গল্পে হয়তো ফিতনা মেয়ের বদলে ছেলে শুরু করে, কারোর প্রেক্ষাপট অনলাইন না হয়ে অফলাইন হয়। তবে এই ফিতনার অতল গহব্বরে হারিয়ে যায় হাজারো দ্বীনদার ছেলে-মেয়ে। 'গাইরে মাহরাম' ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজন শক্ত ঈমানী দূর্গের, প্রয়োজন পবিত্র অন্তরের, প্রয়োজন শিকলবন্দী নাফস আর রব্বের সাহায্যের।
আচ্ছা, এসব কি আমার আছে?
২.
আরেফীন নামক সেই ছেলের কুকর্ম মাঝে আলোচনায় এসেছিল। মেয়েটাকে বউ বানানোর কী অদম্য চেষ্টা ছিল! তার জন্য মিথ্যা, ভণ্ডামি, বিভিন্ন দ্বীনি চরিত্রে অবতীর্ণ হয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া থেকে শুরু করে কিছুই বাদ রাখেনি। মেয়েটার মন গলানোর জন্য অভিনয় দেখে প্রথমে একটা কথাই মাথায় এসেছিল, 'মেয়েটা এতো বোকা কেন? কেন এই মিথ্যেবাদীকে প্রথমেই ধরে ফেলেনি? কেনই বা এত গভীরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে?'
'বোকা কেন' এর উত্তর এখন পাই। মূলত এটা স্বভাবগত বোকামি নয় বরং ফিতনায় নিপতিত হবার পর বোধবুদ্ধিহীন হয়ে যাবার কারণ। একজন মানুষ যখন ধীরে ধীরে হারাম কাজকর্মে ডুবে যায় তখন তার কাছে গাইরে মাহরাম নারীর সাথে সময় কাটানো বৈধ মনে হয়, মদকে হালাল ভাবতে ভালো লাগে। পূর্বযুগে ইলমের মাজলিস থেকে বহু তাকওয়াবান যুবক ছিটকে গেছে মদের আসরে, যুহদ ভুলে হারিয়ে গেছে চাকচিক্যময় দুনিয়ার মিথ্যে হাতছানিতে, ডুবে গেছে নারীর মায়াবী চোখ, রহস্যময় হাসি আর তিরতির করে কাঁপতে থাকা গোলাপরঙা ঠোঁটের সৌন্দর্যে। 'আহ! জীবন আর কটা দিনই তো। ভোগ করে নাও!' এই নীতি মেনে জীবনকে নিয়ে গেছে ধ্বংসের সম্মুখে।
বার্সিসার ধ্বংস হওয়া, ইয়াসারের ফিতনায় নিপতিত হওয়া, হাবিব, হাসসানদের ইলমের মজলিস থেকে মদের আসরে পাড়ি জমানো আরো কতশত তাকওয়াবান যুবকের পদস্থলনের উদাহরণ টানা যায়। কিন্তু এরকম হাজারো মানুষদের পথভ্রষ্টতার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইবনে মাহমুদের মতো অসৎ সঙ্গীর প্রভাব রয়েছে। যারা হতাশার সময় বোধবুদ্ধিহীনতার সুযোগ নিয়ে হাতে মদের পেয়ালা তুলে দিয়ে উপদেশ দেয়, 'দুনিয়া ভুলে যাও। মজা উপভোগ করে নেও। কালকেই তো আমরা মারা যাব।'
আচ্ছা, আমাদের জীবনেও কি এই ধরণের অসৎ বন্ধুর প্রভাব আছে? বা আছে কি এমন মানুষের অস্তিত্ব যিনি বটবৃক্ষের মতো সারাজীবন ছায়া দিয়ে যান? ফিতনার দুর্দিনে শক্ত হাতে হাত ধরে নিয়ে চলেন সত্যের পথে? গুনাহের ভারে নুয়ে পড়ার পরও কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বলেন, 'আল্লাহ তাওবাকারীকে ভালোবাসেন। তুমি তাওবাকারীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও।' আছে কি এমন কেউ?
৩.
বাগদাদের এক আল্লাহওয়ালা তাকওয়াবান যুবক। নাম ইয়াসার। তিনি তাকওয়ার কারণে ঈর্ষনীয় ছিলেন, ছোটবেলা থেকেই ইলমের লাইনে ছিলেন সবচেয়ে অগ্রগামী, যার প্রতিটি কথাই ছিল অন্তর্ভেদী, মর্মস্পর্শী। বন্ধুদের কাছে তিনি ছিলেন 'আল্লাহওয়ালা' হিসেবে পরিচিত, তাকে ডাকা হতো 'মাসজিদের কবুতর' বলে। বলা হতো, ইয়াসার তো সে-ই যার দিকে একবার তাকালেই দুনিয়াবিমুখদের জীবনী চোখে ভেসে ওঠে, যিনি তার সফেদ অন্তর সামান্য মলিনও হতে দেন না, যিনি নেমে আসেন ওপরে ওঠার জন্যই, যার অন্তরের প্রবেশ করতে হলে পার হতে হয় সাত তালার সাত দরজা। দ্বীনদারিতা, সম্পদ, শক্তি, সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও নবী ইউসুফ আ. এর শিক্ষা নেওয়া সেই যুবকের পবিত্র অন্তরে কোন মেয়ের আগমন ঘটেনা।
কিন্তু এক অসম্ভব রূপবতী নারী ইয়াসারকে ধাবিত করে ফিতনার দিকে। দুনিয়াবিমুখ পবিত্র ইয়াসার আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে ফিতনার সাথে। যে আবেদের জীবনের আঙিনা ইবাদতে পূর্ণ ছিল সে আঙিনায় জায়গা করে নেয় রুটির দোকানের শেষে যে বাড়িটা রয়েছে সেই বাড়িটা। তারপর? তারপর কী হয়েছিল? ইয়াসার কি কোনদিন বেলাশেষে মাসজিদের কবুতর হয়ে মাসজিদে ফিরেছিল? শেষ অবধি তার আল্লাহওয়ালা লকব কি সত্যিই থেকে গেছিল তার সাথে? নাকি শয়তানের অব্যর্থ তিরে হৃদয়ের সাতটি দরজা খুলে যাবার পর তলিয়ে গিয়েছিল ফিতনার অতল গহব্বরে?
'শেষের অশ্রু' আমাকে শিখিয়েছে অনেককিছু। শাইখের হৃদয়ছোঁয়া আলোচনা, গাইরে মাহরাম ফিতনার ভয়াবহতা, একজন তাকওয়াবান যুবকের পর্যদুস্ত হওয়ার করুণ কাহিনি, আবু মাহমুদের মতো অসৎ সঙ্গের প্রভাব, মুরিদের প্রত্যাবর্তন সবকিছুই মূল্যবান শিক্ষার খোরাক। আমরা খালি চোখে নিজেদের পদস্থলন দেখতে পাই না কিন্তু ইয়াসারের পদস্থলন যেকোন পাঠককে শেখাবে, 'ফিৎনার শুরুটা কত সাদামাটা হলেও শেষের পরিণতি কী ভয়াবহ হয়। একজন তাকওয়াবান লোককে শয়তান কত নিচে নামাতে পারে। এবার তুমিই ঠিক করে নেও তোমার শেষের অশ্রু কেমন হবে? গাইরে মাহরাম ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য তোমার ঈমান কতটুকু?'
আমাদের ভাইয়েরা গাইরাতহীন হয়ে নিজেরাই ফিতনার দিকে পা বাড়ানোর পায়তারা করে। ফেইক আইডির মাধ্যমে হলেও বোনেদের সাথে কথা বলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। আমাদের বোনেরাও অফলাইনে পর্দার ব্যাপারে কঠোর হলেও অনলাইনে কেমন যেন শিথিল হয়ে যায়। অথচ ফিতনার সূচনা হতে পারে চোখাচোখি থেকে বা ছোট্ট চিরকুট আদানপ্রদানের মধ্য দিয়েই। 'শেষের অশ্রু' পাঠককে গাইরে মাহরাম মেইনটেইনের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং ফ্রী মিক্সিং এর ভয়াবহতা শিক্ষা দিতে সক্ষম বলেই মনে করি। আমি বলব, শেষের অশ্রুকে পাঠ্য তালিকায় যতো দ্রুত সম্ভব অন্তর্ভুক্ত করে নিন। যেন পরবর্তীতে আফসোস না হয়, 'এই বই কেন আগে পড়িনি?'
বইয়ের অনুবাদও বেশ ঝরঝরে, বানান ভুল নেই বললেই চলে৷ আর শিক্ষা? সে নাহয় আপনি নিজেই পড়ে বুঝলেন।
আল্লাহ লেখক, অনুবাদক, সম্পাদকের উপর রহম করুন। তাদের জাজাখায়ের দান করুন।
শেষ করছি ইয়াসারের প্রতি শাইখের একটি নাসীহাহ দিয়েই–
'আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি : শয়তান তোমার কাছে বিভিন্ন দরজা দিয়ে ঢুকবে। তবে প্রধানত নারীর মাধ্যমে ঢুকবে। তুমি তার থেকে দায়েমি যিকির—দৃষ্টি সংযত করা ও কুরআন তিলাওয়াত করার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও।
নিজেকে মনে করিয়ে দাও,এই সুন্দরী মেয়ের চেহারা কিছুদিন পর একটা মৃতদেহে পরিণত হবে; যে দেহ কীটপতঙ্গ খেয়ে ফেলবে। আর জান্নাতে এমন হুর আছে, যাদের উদীয়মান সূর্য দেখলেও লজ্জা পায়।'
রিভিউ লিখেছেনঃ জুয়াইরিয়া
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....