গল্পঃ গ্রীস্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া। ©মারুফ হুসাইন। ৩য় পর্ব।
'ধন্যবাদ'
'কী জন্য?'
'কালকে আমাকে এমন একটা বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য।' আকাশি রঙা ড্রেস পরা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে শরিফুল বলে।
মেয়েটা কিছু বলে না। ধীর পায়ে সামনের দিকে কদম ফেলে মুচকি হাসে৷
শরিফুল মেয়েটাকে যতটা ছেলে মানুষ ভেবেছিল, এখন ততটা ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে না। বয়সের তুলনায় কথা-বার্তা, চাল-চলনে বেশ পরিপক্ব মনে হয়।
সে যখন গাড়িতে উঠেছে, তখন মেয়েটা তার হাতের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিল৷ হাসপাতালে পৌছানো অবধি শরিফুলকে খেয়াল করেনি৷ একবারের জন্যও দেখেনি, সামনের সিটে কে বসেছে। সে নিজের মতো করে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিল৷
শরিফুল ভেবেছিল, মেয়েটা তাকে দেখে খুব এক্সাইটমেন্ট দেখাবে। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে যখন তাকে দেখল মুখে হাসি ফুটে উঠলেও কোনো এক্সাইটমেন্ট প্রকাশ পায়নি৷ খুব নরমালি হ্যালো বলে হাসপাতালে ঢুকে গেছে। তবে রক্ত দেয়ার আগের ফর্মালিটিজ থেকে শুরু করে রক্ত দেয়া অবধি সে তার সাথেই ছিল৷ রক্ত দেয়ার সময় সে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে ডাবের পানি, জুস, আইসক্রিম ইত্যাদি আনিয়ে রেখেছে। শরিফুল ডাবের পানি ছাড়া আর কিছুই খায়নি।
রক্ত দেয়া শেষে মেয়েটার বাবার সাথে দেখা করে শরিফুল হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়৷ মেয়েটার বাবাও বেশ আন্তরিক মানুষ। ড্রাইভারকে ডেকে তাকে নামিয়ে দিয়ে আসতে বলল। তখন মেয়েটা এসে বলল, 'বাবা! আমিও চলে যাচ্ছি৷'
'শহিদ ভাই! আপনি চলে যান। আমরা গাড়ি ছাড়া যাব৷ বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই।' হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়ির সামনে আসতেই মেয়েটা ড্রাইভারকে বলে।
শরিফুল ভ্রু কুচকে মেয়েটার দিকে তাকায়।
'কী হলো এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?'
শরিফুল কিছু বলে না। মেয়েটা কী করতে চাচ্ছে, বুঝার চেষ্টা করে।
'অনেক দিন হয়েছে গাড়ি ছাড়া কোথাও যাওয়া হয় না।' বলে শরিফুলের দিকে তাকায়, 'আপনি আমাকে বাসা অবধি এগিয়ে দিয়ে আসবেন।'
ততক্ষণে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলে গেছে, 'গাড়ি তো পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ এখন আমি যদি না যেতে চাই।'
'একা একাই যাব।' বলে মেয়েটা পা বাড়ায়।
শরিফুল আর কথা বাড়ায় না৷ মেয়েটার সাথে পা মেলায়। বেশ কিছুটা রাস্তা এগিয়ে কালকের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য মেয়েটাকে ধন্যবাদ জানায়৷
তারা হাঁটতে হাঁটতে সাইন্সল্যাবের কাছাকাছি চলে এসেছে৷ মেয়েটা একটা রিকশা ডাক দেয়, টিএসসিতে যাবে৷ তার বাসা ধানমন্ডি।
'বাসায় যাবেন না?' শরিফুল জিজ্ঞাসা করে। ততক্ষণে সে রিকশায় উঠে বসেছে৷
'যাব না৷ উঠে বসুন৷'
শরিফুল উঠে বসে৷ অনেক দিন পর সে কোনো মেয়ের সাথে রিকশায় উঠেছে৷ তার অস্বস্তি হচ্ছে৷ তবুও এক পাশে গুটিয়ে বসে আছে৷ রিকশা সাইন্সল্যাব থেকে নিলখেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এরিয়ায় ঢুকে পড়েছে৷ তার মুনার কথা মনে পড়ে৷ কত শত দিন তারা দুই জন এক সাথে এই পথে হেঁটে বেরিয়েছে। অথবা রিকশায় করে ঘুরে বেরিয়েছে। তখন মুনার বাসা আজিমপুর ছিল। এই পথ দিয়েই তারা যেত৷ মুনাকে বাসা অবধি এগিয়ে দিয়ে সে ব্যাক করত৷
'কী ভাবছেন?' শরিফুলকে অন্য মনস্ক হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করে।
'না, কিছু না।'
মেয়েটা আর কিছু জিজ্ঞাসা করে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করে, 'জানেন, কত দিন পর আমি এমন মন খুলে ঘুরে বেড়াচ্ছি!'
'এই পিচ্চি মেয়ে তোমার বয়স কত? তোমার এভাবে ঘুরে ফেরার বয়স হয়েছে নাকি! এই বয়সে এমন কথা বলছ কিভাবে?' শরিফুল মনে মনে ভাবে। কিন্তু সে এমন কিছু বলে না। মেয়েটারর চোখ কেমন জ্বলজ্বল করছে, চোখে মুখে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে৷ ঠিক যেমনটা প্রেমে পড়লে হয়। উঠতি বয়সের মেয়েগুলা খুব অল্পতে যেকারো প্রেমে পড়ে যায়৷ এসব প্রেম বাড়তে দিলেই বিপদ, 'আপনার আম্মুর কী হয়েছে?' সে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে।
মেয়েটার উচ্ছ্বসিত চেহারায় কেমন কালো হয়ে আসে। কয়েক মুহুর্ত ভেবে উত্তর দেয়, 'অনেক ছোটবেলা থেকেই আম্মুকে বিছানায় দেখছি৷ কী হয়েছে আমি ঠিক বলতে পারব না৷ আমাকে কখনো ক্লিয়ারলি কেউ কিছু বলেনি৷'
শরিফুল বুঝতে পারে, মেয়েটা কিছু লুকোচ্ছে৷ এই ব্যপারে কিছু বলতে চাচ্ছে না।
তারা ধানমন্ডি চলে এসেছে৷ মেয়েটা জানাল, সামনেই তার বাসা৷ মায়ের কথা উঠতেই মেয়েটার চেহারা কেমন কালো হয়ে উঠেছিল। এরপর তারা টিএসসি, শহীদ মিনার, সহরোওয়ার্দি উদ্যানে ঘুরে বেড়ালেও অনেকটা সময় মেয়েটা কেমন অন্য মনস্ক ছিল। শরিফুলও তাকে ঘেটে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। নিজে থেকে কিছু বলেনি৷ মেয়েটাকে শুধু সঙ্গ দিয়ে গেছে৷
অবশ্য শেষ দিকে এসে আবার মেয়েটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে৷ কথার ফুল ঝুড়ি ফুটিয়েছে৷ মনে হয়েছে, মেয়েটা অনেক দিন কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে পারে না। আজ সুযোগ পেয়ে বলতে শুরু করেছে৷ তবে তার কথাগুলা কোনো কাজের কথা নয়, তার স্কুলের বিভিন্ন কাহিনি, কোন বান্ধুবী কী করেছে, কোন স্যার কী করেছে, স্কুলে কবে কী ঘটেছে ইত্যাদি ইত্যাদি৷ শরিফুল মেয়েটার সব কথা ভালো শ্রোতা হয়ে শুনে গিয়েছে শুধু৷
'আপনি আমার নাম জানেন?' মেয়েটা তার বাসার সামনে এসে রিকশা থেকে নামতে নামতে বলে উঠল।
শরিফুল তার নাম মনে করার চেষ্টা করে৷ কিন্তু কোনোভাবেই মনে করতে পারল না।
'এতোটা সময় আমার সাথে ঘুরে বেড়ালেন৷ কিন্তু আমার নামটাই জানার চেষ্টা করলেন না৷'
আসলেই তো৷ সে মেয়েটার নাম জানতে চায়নি। মেয়েটাও তার নাম বলেনি। সেও জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনবোধ করেনি।
'নূহা আমার নাম৷' বলে মেয়েটা তার বাসার গেটের দিকে পা বাড়ায়, 'নাম আবার ভুলে যাইয়েন না কিন্তু৷' গেটের ভিতর চলে যায়। শরিফুল রিকশাওয়ালাকে আগাতে বলে৷ ঠিক তখনি নূহা গেটের ভিতর থেকে মাথা বের করে উঁকি দিয়ে বলে, 'আপনি ভাবছেন, আমাদের গতকালই প্রথম দেখা হয়েছে! কিন্তু না। আপনাকে অনেক দিন ধরে আমি চিনি। আগেও আমাদের দেখা হয়েছে৷' বলে সে আবার ভিতরে চলে যায়৷
মেয়েটার সাথে আগে কোথায় দেখা হয়েছে৷ শরিফুল ভাবতে থাকে৷ কিন্তু আগে দেখা হয়েছে বলে তার মনে হয় না৷ রিকশাওয়ালা প্যাডেল দিতে শুরু করেছে৷ এখন তার গন্তব্য বাংলা মটর। নূহা রিকশা ভাড়া দিয়ে গেছে। সে নিষেধ করেছিল। শুনেনি। ইবরং একশ টাকা বাড়তি দিয়ে বলেছে, সে যেখানে নামতে চায় যেন সেখানে নামিয়ে দেয়৷
শরিফুল ঘড়ি দেখে। আজকে তার কাওরান বাজার বস্তিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় পার হয়ে গেছে৷ এখন গেলে পড়ানোর জন্য কাউকে পাবে না তবুও একবার যাওয়া দরকার। অন্য আরেকটা কাজ আছে৷
চলবে.......
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....