গল্পঃ গ্রীস্মের বিকেলে ঝরে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া || © মারুফ হুসাইন।

Post ID 111602

গল্পঃ গ্রীস্মের বিকেলে ঝরে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া || 
© মারুফ হুসাইন। 
গ্রীস্মের বিকেলে ঝরে যাওয়া কৃষ্ণচূড়া


মেয়েগুলা খিলখিল করে হাসছে৷ শরিফুলের ইচ্ছা করছে, তাদের গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করুক, 'এই তোমরা খুব মজা পাচ্ছ?'

প্যান্টের চারটা পকেট হাতড়েও সে কোনো কানা কড়িও পায়নি৷ পকেটে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ছিল। তবে যে প্যান্টটা চ্যাঞ্জ করে এসেছে৷ সে প্যান্টের পকেটে৷ সে ভাবছে, এবার আর তার রেহায় নেই। দোকানির সাথে সে চা নিয়ে খুব খিটখিট মেজাজ দেখিয়েছে৷ চা একটু ঠান্ডা হওয়ায় ধমকিয়েছে৷ তখন থেকেই স্কুল পড়ুয়া মেয়েগুলা তাকে খেয়াল করেছে৷  যখন সিগারেট জ্বালিয়ে পকেট হাতড়ে টাকা খুঁজে না পাওয়ায় তার অসহায় চাহনী দোকানির উপর পড়েছে৷ তখন থেকেই তাদের খিলখিল করে হাসার শব্দ তার কানে লেগেছে৷ 

দোকানি তার দিকে তিক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে। প্রতিশোধের সুযোগ পেয়ে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, 'কী মামা! টাকা নাই?'

দোকানির তীক্ষ্ম ও প্রতিশোধ পরায়ণ চোখ থেকে  বাঁচতে সিগারেটের টান দিয়ে বিরক্তি, হতাশা ও বিব্রত চোখে সে পাশে তাকাতেই বুঝতে পারল, মেয়েগুলো তার অসহায় অবস্থা দেখেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে৷ তার থেকে কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে তারা  বেলপুরি খাচ্ছে৷ শরিফুলের কর্মকান্ডে তারা বেশ মজা পেয়েছে৷

শরিফুলের ইচ্ছা করছে মেয়েগুলোকে কষিয়ে চড় মেরে বলতে, 'এই অন্যের অসহায়ত্ব দেখে এভাবে হাসবে না।' 
কিন্তু সে সুযোগ নেই৷ চড় মারত গেলে একটা বিশ্রী কান্ড হয়ে যাবে৷ তাকে গণধোলাইও খেতে হতে পারে।  তাই সে ইচ্ছা চেপে বেঞ্চের উপর বসে পড়ল। দোকানি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ অপেক্ষা করছে শরিফুল কখন  বলে, ভুলে টাকা আনিনি। বললেই তার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগটা হয়ে যাবে৷ 

বেঞ্চে বসে অর্ধেক সিগারেট শেষ করে দোকানির দিকে তাকাল। এখনো সে তার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেছে যেন সে পালিয়ে যেতে না পারে। মেয়েগুলোর দিকেও তাকাল। তাকে হাসাহাসি বন্ধ করলেও একটা মেয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল৷ তবুও মেয়েটা চোখ সরায়নি৷ অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ আকাশি রঙের স্কুল ড্রেসে মেয়েটাকে আকাশের মতোই সুন্দর লাগছে৷ শ্যামবর্ণের এই মেয়েটা আরো কুড়িখানেক আকাশি রঙা স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের মতোই৷ তবুও শরিফুলের মনে হচ্ছে, শ'য়ে শ'য়ে  আকাশি রঙা মেয়ের মাঝেও সে এই মেয়েটাকে ঠিকই আলাদা করে চিনে নিতে পারবে। কিন্তু কী কারণে তার বুঝে আসছে না৷ হয়তো তার চাহনি। এই চাহনি পৃথিবীর কোনো পুরুষের অগাহ্য করার ক্ষমতা নেই।

শরিফুল চোখ ঘুরিয়ে নিল। দোকানির চোখাচোখি হতেই বিলের কথা মনে পড়ে গেল।  ভাবতে লাগল, 'এখন কী করা যায়!'
একবার ভাবল, পকেটের মোবাইলটা দিয়ে বলবে, 'মামা! বিল দিয়ে মোবাইল নিয়ে যাব।'
কিন্তু মোবাইল দিয়ে গেলে এখন গন্তব্যে পৌছাতে বেগ পেতে হবে। মাথায় অন্য কোনো উপায়ও আসছে না৷ তাই মোবাইল দিয়ে আপাদত দোকানিকে শান্ত রাখার চিন্তাটাকেই চূড়ান্ত করল। তার আগে ফোন করে ঠিকানাটা লিখে নিতে হবে৷ 

বেঞ্চ থেকে উঠে দোকানির দিকে এগিয়ে যেতেই স্কুল ড্রেস পরা মেয়েটা দ্রুত এগিয়ে এসে দোকানিকে জিজ্ঞাসা করল, 'উনার বিল কত?'
'পনেরো টাকা'
শরিফুল কিছু বুঝার আগেই মেয়েটা পনেরো টাকা দোকানিকে দিয়ে দ্রুত হেঁটে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো একটা প্রাইভেটকারে উঠে পড়ল৷

শরিফুল কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেও মাথা ঘামাতে চাইল না। উঠতি বয়সের মেয়েগুলা হুটহাট এরকম অনেক পাগলামিই করে। তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। 

রাস্তায় পা বাড়াতেই তার ফোন বেজে উঠল। জসিমের কল, 'কিরে গিয়েছিস?'
'না, যাচ্ছি৷'
'ঠিক আছে, জলদি যা। স্যার সাড়ে বারোটার মধ্যে যেতে বলেছেন।'
'যাচ্ছি। কাছাকাছি আছি।'
'ঠিক আছে৷ কী হয় কথা বলে জানা!'
'আচ্ছা' বলে শরিফুল কল কেটে দেয়। দু মাস আগে মোটা অংকের টাকার একটা টিউশনি চলে যাওয়ায় জসিমকে দুয়েকটা টিউশনি ম্যানেজ করে দিতে বলেছিল৷ তাই গত দু দিন আগে এই টিউশনির অফারটা দেয়৷ জসিমের নতুন বসের মেয়েকে পড়াতে হবে। এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। চার  বছর বয়স। সামনের জানুয়ারিতে স্কুলে ভর্তি করাবে বলেই এখন থেকে টিউশনে দেয়া৷  বাচ্চাদের শরিফুল পড়ায় না। কিন্তু ঐ টিউশনিটা চলে যাওয়ায় হাতে বেশ টান পড়ে যাচ্ছে। সে জন্যই রাজি হওয়া। অবশ্য জসীম যেভাবে বলে দিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে তার রাজি হলেই হবে না। আজকের ইন্টারভিউ পাশ করতে পারলে, তবেই টিউশনি হবে। 

শান্তিবাগে ঢুকে কয়েকটা গলি পার হতেই তার গন্তব্য পেয়ে গেল। বিল্ডিংয়ের গেটে পা রাখতেই গার্ড তার মুখামুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'কার কাছে যাবেন?'
জসিম তাকে নামটা বলেছিল। কিন্তু সে ভুলে গেছে৷ মনে করার চেষ্টা করেও মনে করতে না পেরে জসিমকে ফোন করল, 'গার্ড আটকিয়েছে। কী নাম বলব?'
'আফজাল হাসান'
শরিফুলের নামটা চেনা চেনা লাগছে। অতি পরিচিত এই নামে কেউ নেই৷ কোথাও শুনেছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় ঠিক মনে করতে পারছে না৷ আশেপাশে কত শত মানুষ আর কত শত নাম৷ যেকোনো কোথাও যেকোনো কারো কাছে শুনতে পারে, ভাবল।

'আফজাল সাহেবের বাসায় যাব।' ফোন রেখে গার্ডকে বলল।
'আপনার নাম?' গার্ড ইন্টারকমে ডায়াল করে জিজ্ঞাসা করল।
'শরিফুল। বলবেন, নতুন টিউটর।'

'লিফটের ৭। ফ্ল্যাট সি' ইন্টারকমে কথা শেষ করে গার্ড শরিফুলকে উদ্দেশ্য করে বলল। 

লিফটের সাতে উঠে বামে তাকাতেই ফ্ল্যাট সি পেয়ে গেল৷ কলিংবেল বাজাতেই শর্টপ্যান্ট আর ঢিলা টিশার্ট পরা একজন লোক গেট খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলল, 'শরিফ সাহেব!'
'হ্যাঁ।'
'ভিতরে আসুন!' বলে সরে দাঁড়িয়ে সোফা দেখিয়ে বলল, 'আপনি বসুন! আমি আসছি৷'

শরিফুল সোফায় বসল। মিনিট পাঁচেক পর কাজের লোক তার জন্য চা-বিস্কিট দিয় গেল। 
বেশ কিছুক্ষণ পর জামা-কাপড় পরিবর্তন করে আফজাল সাহেব আসল, 'জসিম সাহেব থেকে আপনার কথা শুনেছি অনেক। আপনি নাকি বেশ ভালো ছাত্র ছিলেন। পড়ানও নাকি খুব ভালো।'
শরিফুল কিছু বলল না। মুচকি হাসল।

'সামিয়া! এদিকে আসো বাবা!' আফজাল সাহেব উচ্চ স্বরে ডাক দিলেন। পিচ্চি মেয়েটা দৌড়ে আসল৷ তাকে পাশে বসিয়ে আফজাল সাহেব বললেন, 'আপনি ওকেই পড়াবেন৷' বলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, 'মা! আংকেলকে সালাম দাও!'
পিচ্চি মেয়েটা মিষ্টি কন্ঠে সালাম দিল। 
'ওকে সামনের বার স্কুলে ভর্তি করাব। ওর মা, আমি দু-জনই চাকরী করি। ব্যস্ত থাকায় ওকে আমরা পড়াতে পারি না। তাই ওর প্রাথমিক প্রস্তুতির দায়িত্বটা আপনারই নিতে হবে।'
'জি, আচ্ছা৷'
'মা যাও তুমি খেলা করো!' সামিয়াকে বলে আমার দিকে তাকালেন, 'জসিমের কাছ থেকে শুনেছি, আপনি অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাহলে এতো বছর হয়ে গেল এখনো চাকরীতে জয়েন করছেন না কেন?'
শরিফুল মুচকি হাসে, 'আসলে চাকরীর প্রয়োজন নেই। একা মানুষ। টিউশনিতেই বেশ চলে যায়।'
'আপনার ফ্যামিলি?' ভ্রু কুচকে আফজাল সাহেব জিজ্ঞাসা করেন।
'কেউ নেই। বেশ আগেই মা-বাবা মারা গেছেন। আমি উনাদের একমাত্র সন্তান ছিলাম।'
'বিয়ে-শাদি তো করবেন৷ তার জন্য হলেও তো কিছু একটা করা প্রয়োজন৷' বলেই আফজাল সাহেব যোগ করেন, 'সরি, আপনার ব্যক্তিগত বিষয়ে চলে যাচ্ছি।' আফজাল সাহেব দাঁড়ালেন, 'তাহলে আপনি সামনের সামনের সপ্তাহ থেকে পড়ানো শুরু করুন।'
'জি আচ্ছা৷' বলে শরিফুল উঠে দাঁড়াল৷
'আর বাকি ব্যপারে আমি জসিমের কাছে জানিয়ে দিব৷ আশা করি আপনার পছন্দ হবে।' দরজা অবধি এগিয়ে দিতে দিতে আফজাল সাহেব বললেন৷

জসিমের কথা শুনে মনে হয়েছিল, লোকটা খুব খিটখিটে মেজাজের হবে। কিন্তু শরিফুলের এখন এমন কিছু মনে হচ্ছে না৷ বরং বেশ আন্তরিক মনে হচ্ছে৷ 
গেট খোলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। আফজাল সাহেব দরজা খুলে দিলেন, ' ও তুমি চলে এসেছ। ভালোই করেছো।' বলে শরিফুলের দিকে তাকালেন, 'উনি শরিফ সাহেব। আগামি সপ্তাহ থেকে সামিয়াকে পড়ানো শুরু করবেন।'

শরিফুল ফুটপাত ধরে হাঁটছে৷ একটা সিগারেট টানতে পারলে তার ভালো লাগত। কিন্তু পকেটে কোনো টাকা নেই৷ নতুন টিউশনিতে এসে সে এতো বড় সত্যের মুখামুখি হয়ে যাবে, কখনো ভাবতেও পারেনি। যে সত্য থেকে সে বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়িয়েছে, সে ভাবতেও পারেনি সেই সত্য এভাবে তার সামনে চলে আসবে।

আফজাল সাহেব যখন তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, উনি শরিফ সাহেব৷ আগামি সপ্তাহ থেকে সামিয়া পড়ানো শুরু করবে। ততক্ষণে অনেক বছর আগের ঘটনা, মুহুর্তগুলো শরিফুলের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করেছে। মুনাকে দেখে চিনতে তার একটুও অসুবিধা হয়নি৷ এতো বছর পরও ঠিক আগের মতোই আছে৷ তার দিকে তাকিয়ে মুনার মুখের হাসিও মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তার দিকে কয়েক পলক তাকিয়েই শরীর ভালো না থাকার অজুহাত দেখিয়ে সে সরে গিয়েছিল। 

শরিফুল টিউশনিতে যাবে না বলে ভাবছে৷ যা থেকে সে এতোগুলা বছর পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার তার মুখামুখি গিয়ে সে কিভাবে দাঁড়াবে। কিন্তু না গিয়েও উপায় দেখছে না। হাতে খুব টান পড়ে যাচ্ছে৷ আরো একটা টিউশনি না হলেই নয়। আবার না গেলে জসিমের সাথেও মুখ কালাকালি হবে।

টিউশনিটায় যাবে কিনা, ভাবতে ভাবতে রমনার পাশ ঘেষে শরিফুল ফুটপাত ধরে হাঁটছে। মুনার চেহারা থেকে বিলীন হয়ে যাওয়া হাসিটা তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। নিজের অজান্তেই মনে মনে অনেকগুলা বছর পূর্বে ফিরে যেতে হচ্ছে।

চলবে....

#গ্রীষ্মের_বিকেলে_ঝরে_পড়া_কৃষ্ণচূড়া
১ম পর্ব
©মারুফ হুসাইন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ