১.
'মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিল। তার মানে লাভ কেস!' ফাইলটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে গোলাম মাওলা বলল, 'তোমার কী মনে হয় সায়মা? সুইসাইড না মার্ডার?'
'আপাত দৃষ্টিতে তো সুইসাইডই মনে হচ্ছে স্যার! বাকিটা বলতে পারছি না৷'
🚫 এই কনটেন্টি সম্পূর্ণ কপিরাইট ফ্রি শুধু মাত্র boipaw.com জন্য। (লেখক অনুমোদিত)
গল্পঃ ব্লাড পেইন্টিং। © মারুফ হুসাইন।
'আপাত দৃষ্টিতে অনেক কিছুই মনে হয়। কিন্তু আমাদের যা মনে হয়, সব সময় তো আর সেরকম হয় না।'
'তাহলে কি স্যার এটা মার্ডার?'
গোলাম মাওলা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করতে করতে বলে, 'কী জানি! মার্ডার হলেও বাহ্যিক বিষয়গুলা বলছে সুইসাইড৷ তাই আমাদের সুইসাইড ধরেই সামনে এগুতে হবে ' সে একটা সিগারেট ঠোঁটে গুজে দেয়, 'মেয়েটার ব্যাপারে কী কী জানতে পারলে?'
'তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।'
'শুনো সায়মা!' বলে গোলাম মাওলা সিগারেটটা ঠোঁটে রেখেই দুই হাতে টেবিলের উপর ভর দিয়ে টেবিলের উপর উঠে বসল, 'কোনো কেস সলভ করতে গেলে সব সময় একটা কথা মনে রাখবে, কেসে কোনো কিছুই গুরুত্বহীন নয়৷ সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। বরং তুমি যা গুরুত্বহীন ভাবছো! তা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে৷ বুঝলে?'
'জি স্যার!'
'এখন বলে ফেল, কী কী জানতে পারলে!'
'স্যার! মেয়েটা খুব হাই এক্সপেন্সিভ লাইফ লিড করত......'
'আয়ের উৎস?' সায়মাকে থামিয়ে গোলাম মাওলা জিজ্ঞাসা করল।
'মডেলিং করতো৷ দুয়েকটা শর্ট ফিল্ম, টিভিসিতেও অভিনয় করেছে। '
'মেয়েটার কোনো প্রেমিক আছে?' বলেই সিগারেটে ছোট করে একটা টান দিয়ে বলল, 'সরি, প্রেমিক তো আছেই! প্রেমিকের খোঁজ পেয়েছো?'
'না স্যার! আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।'
'কোনো সুইসাইড নোট তো পাওয়া যায়নি। মোবাইল-ল্যাপটপ ক্র্যাক করে কোনো কিছু পেলে?'
'স্যার! মোবাইল-ল্যাপটপ এখনো ক্র্যাক করা যায়নি। সাইবার টিমে দেয়া হয়েছে। ওরা চেষ্টা করছে৷'
'মেয়েটার শরীরে কোনো আঘাত বা জোর-জবরদস্তির চিহ্ন পাওয়া গেছে?'
'না স্যার।'
'পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কখন দিবে?'
'আমি কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার শেখকে ফোন দিয়েছিলাম৷ উনি বললেন, কাল দুপুরের মধ্যে রিপোর্ট রেডি হয়ে যাবে।'
'মেয়েটার ফ্ল্যাটটা ভালোভাবে সার্চ করে দেখেছো?'
'আমরা দেখিনি। লোকাল পুলিশ দেখেছে।'
'কোনো সুইসাইড নোট ছিল?'
'জি না স্যার!'
'চলো তো, মেয়েটার ফ্ল্যাট থেকে একবার ঘুরে আসি।' গোলাম মাওলা টেবিলের উপর থেকে নামতে নামতে বলল, 'এইটা আপাত দৃষ্টিতে সুসাইড মনে হচ্ছে৷ প্রাথমিক তদন্ত করে সুসাইড মনে হলে তো কেস ক্লোজ করে দিতে হবে৷' দু কদম সামনে এগিয়ে ভারি স্বরে বলল 'সুসাইড করেছে, ব্যস কেস ক্লোজ। অথবা লোকাল পুলিশের তদন্তে ক্লোজ করে দিবে। সুসাইডের জন্য কেউ প্ররোচনা দিলে বা দায়ী থাকলে তাকে এরেস্ট করবে৷ এটা আমাদেরকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে আবার ঝামেলা বাড়ানোর কী দরকার!'
সায়মা কিছু বলল না। চুপ করে রইল।
'যাই হোক, চলো! সুইসাইড কেস। তদন্ত করার নিয়ম৷ তো করতেই হবে।'
গোলাম মাওলা গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে জিজ্ঞাসা করে, 'মেয়েটার নাম?'
'জেরিন আক্তার'
'মেয়েটা কি ফ্ল্যাটে একাই থাকত?'
'হ্যাঁ স্যার! একাই থাকে৷ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা-বাবা নেই৷ সে যখন ছোট তখনি তারা মারা গেছেন৷ ইবটারমিডিয়েট অবধি কাকা-কাকির সাথে থেকে পড়াশুনা করেছে। তারাই তার খরচ চালাত। ইউনিভার্সিটিতে উঠার পর ঢাকা চলে আসে৷ এরপর ধীরে ধীরে তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়৷'
'মৃত্যুর খবর তাদের দিয়েছো?'
'জি স্যার! ওখানের লোকাল পুলিশকে ফোন দিয়ে ওনাদের খবর দিতে পাঠিয়েছিলাম৷ কিন্তু ওনারা এই মেয়ের কোনো দায়-দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে।'
গোলাম মাওলা জেরিনের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল। ফ্ল্যাটটা গতকাল-ই সিল করে দেয়া হয়েছে৷ খুবই ছিমছাম এবং গোছানো। ফ্ল্যাটটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে, জেরিন খুবই উচ্চ রুচিসম্পন্ন মেয়ে। তার বেড রুমে প্রবেশ করতেই দেখল, দেয়ালে বেশ কিছু পেইন্টিং ঝুলান। এর মধ্যে একটা পেইন্টিংয়ে গোলাম মাওলার চোখ আটকে গেল। কী অদ্ভুত সুন্দর পেইন্টিং। পুরাটা পেইন্টিংয়ে যাস্ট একটাই কালার, লাল। আবার লাল দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা জীবের অস্তিত্বও আঁকা হয়নি। এবড়া-থ্যাবড়াভাবে যাস্ট লাল রঙ। বাচ্চাদের হাতে রঙ দিলে তারা যেমন আঁকা বুকি করে, ঠিক তেমন। কিন্তু কী অদ্ভুত জীবন্ত পেইন্টিং। পেইন্টিংটার দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।
গোলাম মাওয়া পেইন্টিংটা দেখছেন। ঠিক তখনি সায়মা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডাক দিল, 'স্যার!'
গোলাম মাওলা কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও এমন একটা ভাব করল, যেন কিছুই হয়নি। পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করল, 'ওয়াচম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছো?'
'জি স্যার!'
'কী কী জানতে পারলে?'
'স্যার! তেমন কিছুই না৷'
'চলো আরেকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে আসি!' বলে ফ্ল্যাটের গেটের দিকে পা বাড়াল, 'যা ফর্মালিটিজ দরকার। কালকের মধ্যে করে ফাইল বন্ধ করে দিতে হবে। কেসে ইন্টারেস্টিং কিছু না থাকলে ইনভেষ্টিগেশন করে মজা নেই৷ এসব সুসাইড কেসে ইন্টারেস্টিং কিছু থাকে না৷ ঘুরেফিরে সব একই। '
গোলাম মাওলা বেরিয়ে আসল। নিচে যেতেই ওয়াচম্যান দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে সালাম দেয়ার ভঙ্গি করল। গোলাম মাওলা তাকে ইশারায় বসতে বলে জিজ্ঞাসা করল, 'তোমার ম্যাডাম কেমন ছিল?'
'কোন ম্যাডাম সার?'
'কাল সকালে পুলিশ যার লাশ নিয়ে গেল।'
'সার! মেডাম খুবই ভালা মানুষ আছিলেন। আমারে ম্যালা ইস্নেহ করতেন। পেরাই সময় আমারে ভালা মন্দ খাবার দিয়া যাইত৷ কিন্তু কিততে কী হইয়া গেল।'
'ম্যাডামের সাথে আর কে কে থাকতেন?'
'মেডাম তো একলাই থাকতো। তয় মাঝে মইধ্যে আরিফ সার আইসা থাকতেন!'
গোলাম মাওলা 'আরিফ কে?' জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সায়মার দিকে তাকাল।
সায়মা ঠোঁট উল্টে মাথা নেড়ে বুঝালো, 'জানি না স্যার!'
'আরিফ কে?' গোলাম মাওলা ওয়াচম্যানকে জিজ্ঞাসা করল।
'মেডামের লগে যার পের্ম-ভালবাসা ছিল৷'
'তোমার আরিফ স্যার কি গতকাল এসেছিল?'
'না সার! গত পাঁচদিন আগে আইসিল৷'
'তোমার আরিফ স্যার মানুষ হিসেবে কেমন?'
'সেও খুব ভালা মানুষ!'
'তোমার আরিফ স্যারের কোনো ছবি দিতে পারো?'
'না সার! আমি ছবি পামু কই!'
প্রাথমিক তদন্ত শেষ করার জন্য এই লোককে দরকার। কিন্তু এই লোককে পাবে কোথায়! গোলাম মাওলার বুঝে আসছে না।
'সায়মা! এই লোককে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করো।'
'স্যার! জেরিনের মোবাইল বা ল্যাপটপ ক্র্যাক করতে পারলেই এই লোককে পেয়ে যাব।'
বিল্ডিংয়ের সিসি ক্যামেরার দিকে গোলাম মাওলার চোখ যায়, 'এগুলা চলে?' সে সিসিক্যামেরায় ইশারা করে ওয়াচম্যানকে জিজ্ঞাসা করল।
'জি সার!'
'ফুটেজ দেখাতে পারবে?'
'সার এইটার ক্ষমতা আমার কাছে নাই। বিল্ডিংয়ের কমিটির লগে আপনের কথা কইতে হইব।'
'সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আরিফ সাহেবের ছবি ম্যানেজ করে নিয়ে আসো।' গোলাম মাওলা সায়মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, 'কাল আমি অফিসে গিয়ে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমার টেবিলে চাই। সাথে আরিফ সাহেবকেও। যদি এটা সুসাইডই হয়ে থাকে তাহলে এই কেস নিয়ে আমি বেশি মাথা ঘামাতে চাই না। কালকের মধ্যে ফর্মালিটিজ শেষ করে কেস ক্লোজ করতে চাই।'
'ঠিক আছে স্যার!'
২.
ফোনের রিংটোনের আওয়াজে গোলাম মাওলার ঘুম ভাঙ্গে। গত রাতে ফিরতে ফিরতে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। রান্না-বান্না করে খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় একটা৷ ঘুমুতে ঘুমুতে দুটো বেজে যায়। তাই চোখ থেকে এখনো ঘুম যায়নি। ঘুম ঘুম চোখেই গোলাম মাওলা মোবাইল হাতে নিল। সায়মার ফোন। মোবাইলে সাড়ে আটটার উপরে বাজে। ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করল, 'হ্যাঁ সায়মা বলো!'
'স্যার! আরেকটা মেয়ে সুইসাইড করেছে?'
কথাটা শুনেই গোলাম মাওলার চোখ থেকে ঘুম উবে গেল। সে উঠে বসল, 'কোথায়?'
'স্যার জেরিনের বিল্ডিংয়ের পরের ব্লকের একটা বিল্ডিংয়ে'
'ঠিকানা মেসেজ করে পাঠাও! আমি আসছি।' বলে গোলাম মাওলা ফোন রেখে দিলেন।
গোলাম মাওলা বিছানা থেকে নেমে কোনোরকম ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। মোবাইল চেক করল, সায়মা মেসেজ করে ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছে।
গোলাম মাওলা আধ ঘন্টার মধ্যে সুইসাইড স্পটে পৌছে যায়৷ সায়মার তদারকিতে লাশ এম্বুল্যান্সে উঠানো হচ্ছে৷ গোলাম মাওলাকে দেখে সে এগিয়ে গিয়ে বলল, 'স্যার! লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি।'
'মেয়েটার ফ্ল্যাটটা কত তলায়?' বলতে বলতে গোলাম মাওলা বিল্ডিংয়ের ভিতরের দিকে যেতে লাগল।
'ছ তলায়।' লিফটের সুইচে প্রেস করে সায়মা বলল।
'পাশাপাশি ব্লকে পরপর দুইটা সুসাইড আমাকে অবাক করছে৷' বলে লিফটে প্রবেশ করল।
'স্যার! আরো অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই মেয়েটাও একা থাকে।'
'কিভাবে নিশ্চিত হলে?'
'ওয়াচম্যান, প্রতিবেশিদের থেকে।' বলে একটু থেমে সায়মা বলল, ' স্যার! আবার সেমভাবে সুসাইড করেছে, হাতের রগ কেটে।'
'এটাতে কোনো সুসাইড নোট ছিল?'
'জি না স্যার!'
গোলাম মাওলা সায়মার থেকে এই সুইসাইডের বিভিন্ন তথ্য শুনতে শুনতে মেয়েটার ফ্ল্যাটে চলে আসল৷ গোলাম মাওলাকে দেখে তাদের আরেক টিম মেম্বার রাফাত এগিয়ে এসে গোলাম মাওলাকে স্যালুট করল।
'ঘরটা ভালো করে সার্চ করেছো?'
'জি স্যার! এখনো দেখছি।'
'কিছু পেলে?'
'জি না স্যার!'
'আত্মহত্যার পিছনের কারণ জানতে পেরেছো?'
'না স্যার!'
'এমন কিছু পেয়েছো যেটা দেখে মনে হচ্ছে, সুসাইড নয়, মার্ডার?'
'না স্যার!'
'কোন রুমে লাশটা পাওয়া গেছে?'
সায়মা আঙ্গুলের ইশারায় রুমটা দেখিয়ে দিল।
এটা সেটা জিজ্ঞাসা করতে করতে গোলাম মাওলা সুইসাইডের রুমটায় ঢুকল। মেঝেতে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে৷ গোলাম মাওলা বসে বেশ কিছুক্ষণ রক্তের দিকে তাকিয়ে রইল৷
ওঠে পিছনে ঘুরতেই তার চোখ দেয়ালে আটকে যায়। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। সে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার পিছু পিছু সায়মা আর রাফাতও বেরিয়ে আসল।
'রাফাত! তুমি এখানের প্রাথমিক তদন্ত শেষ করো৷ একদম নিখুত রিপোর্ট চাই আমার!' গোলাম মাওলা পিছনের দিকে ফিরে রাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল।
'আর সায়মা!' বলে গোলাম মাওলা দ্রুত ফ্ল্যাটেত মূল দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
'জি স্যার!' বলে সায়মা তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করতে লাগল৷
'তুমি আমার সাথে আসো! আরেক জায়গায় যেতে হবে।'
'ওকে স্যার!'
চলবে......
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....