গল্পঃ ব্লাড পেইন্টিং, শেষ পর্ব | লেখক:- মারুফ হুসাইন।
✋এক নজরে ব্লাড পেইন্টিং পর্ব সমূহ💕
১৫.
গোলাম মাওলা আরিফের কথার সত্যতা যাচাই করে দেখেছে৷ তার নাম্বারের শেষ লোকেশন তার ভাষ্যানুযায়ীই ছিল৷ তাই তার নামও সন্দেহের খাতা থেকে কেটে ফেলতে হচ্ছে।
গোলাম মাওলা ভাবল, জেরিনের মৃত্যুর খবর তাকে দেয়া উচিৎ। কিন্তু কিভাবে দিবে তার বুঝে আসছে না৷ লোকটা আসার পর থেকেই হয়রানির স্বীকার হয়েছে৷ অবশ্য এমন হয়রানি করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। সে নিজের চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরাল৷ সিগারেট শেষ এক কন্সটেবলকে ডেকে আরিফকে নিয়ে আসতে বলল।
কন্সটেবল আরিফকে এনে গোলাম মাওলার সামনে দাঁড় করাল।
'আরিফ সাহেব বসুন!' সামনের চেয়ারটায় ইশারা করল। তারপর কন্সটেবলকে বলল, 'দু কাপ চা নিয়ে আসুন!'
কন্সটেবল চলে গেল। গোলাম মাওলা সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে আরিফের দিকে এগিয়ে দিল, 'নিন!'
'না ধন্যবাদ! সিগারেট থেকে আমার জন্য এতো আয়োজনের কারণটা বললে আমি খুশি হব!'
'আরিফ সাহেব! আসলে আমাদের কিছুই করার ছিল না। পুলিশের চাকরী! বুঝেনই তো!'
'কী বলতে চাচ্ছেন?'
'আরিফ সাহেব! আমাদের পুলিশের চাকরী। কোনো একটা দূর্ঘটনা ঘটলে সম্ভাবনাময় সব কিছুই ঘেটে দেখতে হয়।'
'অফিসার! এতো ভূমিকা বাদ দিয়ে দয়া করে আপনি আসল ঘটনাটা বলবেন?'
ততক্ষণে চা চলে এসেছে৷ গোলাম মাওলা আরিফের দিকে চা এগিয়ে দিল, 'আমি আপনাকে একটা খারাপ খবর দিতে যাচ্ছি?'
'কী সেটা? জেরিনের কিছু হয়নি তো?' আরিফের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
গোলাম মাওলা চুপ করে রইল
'কী হয়েছে অফিসার?'
'জেরিন সুইসাইড করেছে৷'
'একটা মানুষ মারা গেল। আর আপনারা এতোদিন পর এতো হয়রানি করে তারপর বলছেন!' আরিফ উত্তেজিত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে উচ্চস্বরে বলে উঠল৷
গোলাম মাওলা আরিফকে বুঝিয়ে শান্ত করে জেরিনের সাথে কিভাবে কী হয়েছে সব কিছু বিস্তারির বলল। আরিফ মাথা নিচু করে বসে আছে৷ তার চোখে পানি টলমল করছে।
'আরিফ সাহেব!' আরিফ ঘাড় উচু করে গোলাম মাওলার দিকে তাকাল। গোলাম মাওলা মোবাইল বের করে পেইন্টিংয়ের ছবি দেখিয়ে বলল, 'এই পেইন্টিংটা চিনেন?'
'জি! এটা আমি এক আর্ট ফেস্টিভ্যাল থেকে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা দিয়ে কিনে জেরিনকে গিফট করেছিলাম৷'
'কোন ফেস্টিভ্যাল থেকে? কবে কিনেছিলেন?'
'জেরিনের আত্মহত্যার সাথে এই পেইন্টিংয়ের কী সম্পর্ক?'
'মিঃ আরিফ সম্পর্ক আছে৷ কিন্তু আমি এখন আপনাকে এই সম্পর্কে বলতে পারব না৷'
আরিফ আর্ট ফেস্টিভ্যালের ডিটেইলস বলল।
'ধন্যবাদ মিঃ আরিফ!' বলে গোলাম মাওলা একটা সিগারেট ধরাল। আরিফের দিকেও একটা সিগারেট এগিয়ে দিল৷ আরিফ আর না করল না। সিগারেট নিল। গোলাম মাওলা লাইটার জ্বালিয়ে আরিফের সিগারেটের সামনে ধরে বলল, 'জেরিনের লাশ তার কাকা-কাকি নিতে চায়নি৷ তাই আমরা এখনো তার শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করিনি। মর্গের ফ্রিজারে আছে৷'
'একটা মরা মানুষকে এতোদিন এভাবে রেখে দিলেন আপনারা!'
'সরি আরিফ সাহেব! আমাদের কিছুই করার ছিল না। আমি আমার লোককে বলে দিব, সব ফর্মালিটিজ পূরণ করে জেরিনের বডি আপনার হাতে তুলে দিবে।'
আরিফ কিছু বলল না। এক দিকে তাকিয়ে সিগারেটে টান দিল৷ তার চোখ লাল হয়ে আছে, পানিতে টলমল করছে৷
১৬.
পেইন্টিংয়ে আঁকা ছবির মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ ছবিটা উদ্ধার করতেও অনেক কষ্ট হয়েছে। কোনো ডিজিটাল মাধ্যম দ্বারা উদ্ধার করা যায়নি৷ কোনো আর্টিস্টও স্কেচ করতে পারেনি৷ তখন রাফাত পেইন্টিংটা নিয়ে পেইন্টিংয়ের মেয়েটার ছবি স্কেচ করার ব্যবস্থা করে দেয়৷
ছবি দ্বারা মেয়েটার খোঁজ পাওয়া না গেলেও রাফাত বিভিন্ন হাসপাতাল, ব্লাড ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জেনে গেছে, পেইন্টিংটা কার ব্লাড দিয়ে আঁকা হয়েছে। তবে সেখানে ঠিকানা পাওয়া গেলেও কোনো ছবি পাওয়া যায়নি।
গোলাম মাওলা ধারণা করছে, ছবির মেয়েটারই ব্লাড৷ তার সামনে দুইটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, এক. মেয়েটা নিজের রক্ত দিয়েই নিজের ছবি এঁকেছে৷ দুই.মেয়েটার রক্ত দ্বারা অন্য কেউ মেয়েটার ছবি এঁকে দিয়েছে৷
কিন্তু দুই ক্ষেত্রের যেটাই হোক না কেন, গোলাম মাওলা ভেবে বের করতে পারছে না, ব্লাড দিয়ে ছবিটা কেন এঁকেছে? আর ছবিটা মানুষকে সম্মোহিত করে সুইসাইডে উদবুদ্ধই বা কিভাবে করছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে, মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে। যে ব্লাড ব্যাংকের স্যাম্পল থেকে মেয়েটার ব্যপারে জানতে পেরেছে, সে হাসপাতাল থেকে মেয়েটার পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও পেয়েছে। সেটা গোলাম মাওলাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে৷ তবে এখানেও দুইটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, রাফাত গোলাম মাওলাকে জানিয়েছে ঠিকানা প্রায় সাত বছর আগেকার এবং ওখানে যেতে প্রায় অর্ধ দিন লেগে যাবে৷
একে তো গিয়ে খবর নিয়ে আসতে অনেক সময়ের ব্যপার৷ দ্বিতীয়ত মেয়েটাকে ওখানে পাওয়া যাবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আবার ঐ আর্ট ফেস্টিভ্যালের কমিটির সাথেও কথা বলা দরকার। অবশ্য মেয়েটাকে পেলে হয়তো ফেস্টিভ্যাল অবধি যাওয়া লাগবে না৷ গোলাম মাওলা ভেবে পাচ্ছে না, কিভাবে কী করবে? সব কিছু তার কাছে কেমন এলোমেলো লাগছে।
সে প্রথমে ভেবেছিল, মেয়েটার ঠিকানায় রাফাতকে পাঠিয়ে এদিকের দিকগুলা নিজে দেখবে। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের ডিসিশন চ্যাঞ্জ করে ফেলে। সে কারো উপর দায়িত্ব চাপিয়ে ভরসা করতে পারছে না। মন কেমন সায় দিচ্ছে না৷ তাই নিজে গিয়েই তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিল।
১৭.
মেয়েটাকে না পেলেও গোলাম মাওলা মেয়েটার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পেয়ে গেল৷ তাদের সাথে কথা বলে 'হাতের রগ কেটে সুইসাইড' এর ব্যপারটা গোলাম মাওলার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল৷ কিন্তু এখনো বুঝতে পারছে না, এই পেইন্টিংটা কিভাবে সুইসাইডের জন্য উদবুদ্ধ করছে?
উর্মিলা নামের মেয়েটা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। শহরে এক মেসে থেকে পড়াশুনা করত। ঠিক মেস বলা যায় না। এক পরিবারের সাথে সাবলেট থাকত৷
মেয়েটার জীবনে সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিভাবে কী হয়ে গেল, কেউ কিছুই বুঝতে পারল না। যে পরিবারের সাথে সাবলেট থাকত, সেই পুরো পরিবার এক সাথে কোথাও ঘুরতে যায়। তারা যখন ফিরে এসে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে, তখন ফ্ল্যাটের ফ্লোরে জমাট বেধে যাওয়া রক্তের স্রোত দেখতে পেল। যে স্রোতটা উর্মিলার রুম থেকে এসেছে৷ স্রোত লক্ষ্য করে এগিয়ে তারা উর্মিলার রুমে ঢুকে দেখে তার নিস্তেজ বডি ফ্লোরে পড়ে আছে৷ হাতের কাছেই ব্লেডটা। যেটা রক্তের দাগ লেগে আছে।
এই ঘটনা ঘটেছে, প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেছে৷ গোলাম মাওলা মেয়েটার বাবার কাছ থেকে চেয়ে একটা ছবিও দেখে, হ্যাঁ! ঠিক পেইন্টিংয়ের ছবিটাই৷
সে উর্মিলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিটেইলস নিয়ে আসতেও ভুল করেনি৷
উর্মিলার সহপাঠিদের থেকে খোঁজ-খবর নিয়ে গোলাম মাওলা জানতে পারে, উর্মিলা খুব চঞ্চল এবং প্রচন্ড মিশুক টাইপের একজন মেয়ে। এমন একটা স্টেপ নেয়ার পিছনে কোনো কারণ থাকতে পারে বলে তাদের মনে হয়নি। এক সহপাঠির সাথে উর্মিলার সম্পর্কও ছিল৷ তবে সেখানে কোনো ঝামেলা বা কিছু ছিল না। তাদের দু জনের মধ্যে এমন কিছুও ঘটেনি যার জন্য সে এমন একটা স্টেপ নিবে। এছাড়া তারা দুজন কমিটেড থাকলেও তাদের মধ্যে পুরো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল৷ আলাদা করে কোনো ন্যাকামি ধরণের কিছু ছিল না৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য পাঁচটা বন্ধু যেভাবে মিশে তারা ঠিক সেভাবেই মিশত৷ তা ছাড়া উর্মিলার জীবনে এমন আহামরি কিছু ছিল না, যার জন্য সে এমন একটা কাজ করবে।
গোলাম মাওলা উর্মিলার ঐ প্রেমিকের সাথেও দেখা করেছিল। ছেলেটা এখন বিয়ে-শাদি করে পুরো সংসারী হয়ে গেছে৷ উর্মিলার মৃত্যু ছেলেটার জীবনে প্রাথমিক অবস্থায় ইফেক্ট ফেললেও তা স্থায়ী হয়নি। সে নিজের স্বাভাবিক জীবনে চলে গেছে৷ উর্মিলার সুইসাইডে এই ছেলেটার কোনো সম্পৃক্ততা আছে বলে তার মনে হয়নি৷ মেয়েটার আকষ্মিক এমন একটা ডিসিশনে সে প্রচন্ড শক খেয়েছিল।
গোলাম মাওলা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে ভুলেনি যে উর্মিলার সাথে কোনো পেইন্টার বা আর্টিস্টের কোনো পরিচয় ছিল কিনা? আর্টিস্টের কথা আসতেই দুয়েক জন তাদের মস্তিষ্ক হাতড়ে বলেছে, হ্যাঁ শেষ দিকে উর্মিলার মুখে একজন আর্টিষ্টের কথা শোনা যেত। ঐ আর্টিস্টের প্রতি সে কোনো দূর্বলতা প্রকাশ না করলেও তার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহী ছিল। কিন্তু উর্মিলা তার বন্ধুদেরকে কখনোই তার সাথে দেখা করায়নি। কারণ হিসেবে এমন কিছু একটা বলতো, 'লোকটা একা থাকতে চায়৷ বেশি মানুষের সমাগম পছন্দ করে না।' তাই সে কাউকে দেখা করায় না৷
গোলাম মাওলা এক রহস্য ভেদ করতে গিয়ে আরেক রহস্যের বেড়াজালে আটকে গেছে। উর্মিলার ঠিকানায় যাওয়া থেকে শুরু করে তার বন্ধুদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে দু দিন এক রাত পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। সে প্রচন্ড ক্লান্তি অনুভব করছে। আর্টিস্ট পর্যন্ত কিভাবে পৌছাবে তাও তার বুঝে আসছে না।
এর মধ্যে সে ঐ আর্ট ফেস্টিভ্যালের কমিটির প্রধানের সাথেও দেখা করে এসেছে৷ তাদের এক্সিভিশনে অনেক আর্টিস্ট অংশগ্রহণ করে৷ এখন এটা কার পেইন্টিং তারা কিভাবে বলবে! তবে পেইন্টিংয়ের ছবিটা রেখে তারা একটু সময় চেয়েছে। তাদের হলরুম অথবা অফিসের কোনো সিসিটিভি ফুটেজ কিংবা অংশগ্রহণকারি আর্টিস্টদের রেজিস্টার থেকে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে তারা তাকে ফোন করে জানাবে বলে কথা দিয়েছে।
১৮.
ব্যাস্ততা আর ক্লান্তিতে গোলাম মাওলা সায়মার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। গোলাম মাওলা যখন বুঝে উঠতে পারছিল না, কী করবে না করবে ঠিক তখনি সায়মার ফোন আসে৷ সায়মা অনুরোধ করে, হাসপাতালে গিয়ে তাকে একবার দেখে আসতে। গোলাম মাওলার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সায়মার ডাক কেন জানি সে উপেক্ষা করতে পারেনি। দেখতে চলে যায়। তার দেখাশোনার জন্য এখন একজন মহিলা কন্সটেবলকে রাখা হয়েছে৷
তার ইচ্ছা ছিল, সে সায়মার সাথে দেখা করেই বাসায় ফিরে যাবে৷ কিন্তু সেখানে গিয়ে সে যখন সায়মার সাথে আলাপ জুড়ে দেয়, তখন ভুলে বসেছে একজন অসুস্থ জুনিয়রকে সে দেখতে এসেছে৷ সে নিজের ক্লান্তির কথা সায়মার কাছে বলতে শুরু করে৷ সায়মাও আদর্শ স্রোতার মতো গোলাম মাওলার কথা শুনে যাচ্ছে। সে বুঝতে পেরেছে, লোকটা ক্লান্ত। এখন তার একজন ভরসার মানুষ দরকার৷ যার সাথে মন খুলে কথা বলা যাবে। সে এখন মন খুলে একটু কথা বলতে পারলেই বাঁচে৷ তাই হয়তো তাকে পেয়ে এখন সব ভুলে কথা বলতে শুরু করেছে।
ব্যপারটা সায়মাকেও উৎফুল্ল করে তুলছে, মানুষ যখন কাউকে আপন ভাবে, তখনি তার সাথে এভাবে কথা বলে নিজের সুখ-দুঃখ, ক্লান্তি শেয়ার করে নিজেকে একটু হাল্কা করতে চায়৷ গোলাম মাওলা এখন তাই করছে৷ তার মানে গোলাম মাওলা তাকে শুধু একজন সহকারী নয়, আপন কেউ ভাবতে শুরু করেছে৷
একটা ফোন কল তাদের এই মুহুর্তের ব্যাঘাত ঘটায়। গোলাম মাওলা পকেট থেকে ফোন বের করে, আননোন নাম্বার৷ কলটা রিসিভ করে, 'হ্যালো! কে বলছেন?'
ওপাশ থেকে বলে, 'আপনি যাকে হন্ন হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন! ঠিকানা মেসেজ করেছি! চলে আসুন!'
গোলাম মাওলা উঠে দাঁড়ায়। সায়মা জিজ্ঞাসা করে, 'স্যার! কী হয়েছে?'
সে উত্তর দেয় না৷ দ্রুত পায়ে হেঁটে সোজা বেরিয়ে যায়৷ গন্তব্য শহরের অদূরেই একটা জায়গা।
১৯.
গোলাম মাওলা অবাক হয়। সে ভাবতেও পারেনি, অপরাধি নিজেই এভাবে ধরা দিবে। আর কেসটা এতো দ্রুত সমাধানের দিকে যাবে!
মেসেজে পাওয়া ঠিকানায় পৌছে বাড়িটা পেতে তার অসুবিধা হয়নি৷ সে পিস্তলটা হাতে নিয়ে আস্তে-ধীরে বাড়িটায় প্রবেশ করল। বড় ড্রয়িং রুমের এক কোনে বুকশেল্ফটা দেখতে পায়৷ মেসেজে লেখা আছে, বুকশেল্ফটা সরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেই তার দেখা মিলবে।
গোলাম মাওলা সিড়ি বেয়ে নিচে নামে। বিশাল হলরুম। রুমের চার পাশের দেয়াল অদ্ভুদ অদ্ভুত সব পেইন্টিং আঁকা। প্রতিটা পেইন্টিংএর উপরেই একটা করে রঙিন ডিমলাইট। সে লাইটের আলোয় পুরো রুমটা আবছা আলোকিত হয়ে আছে। আলোকিত বলা যায় না, আলো-আধারের কেমন এক অদ্ভুত কম্বিনেশন। মিটি মিটি আলোতে গোলাম মাওলার চোখে রুমটার মাঝে ফ্লোরে আরেকটা অদ্ভুত ব্যপার চোখে পড়ল, বিশাল এক স্টার পেইন্ট করে। পুরো স্টারের চার-পাশে মোমবাতি লাগান। যদিও সেগুলা জ্বলছে না। এই আয়োজন দেখে গোলাম মাওলার বুঝতে অসুবিধে হয় না, এখানে ব্ল্যাক ম্যাজিক-ট্যাজিক কিছু করা হয়।
'মাওলা সাহেব! আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।' গোলাম মাওলা পিছনে ফিরে তাকায়। অন্ধকার থেকে রোলিং চেয়ারে করে পিস্তল তাক করে একজন লোক বেরিয়ে আসল। গোলাম মাওলার চিনতে অসুবিধে হয়নি,
'ডা. শেখ আপনি!' গোলাম মাওলা তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল, 'অবশ্য সায়মার ফোনে আপনার কল রেকর্ডিং শুনেই আমার সন্দেহ হয়েছিল।'
'বুঝতে পেরেই আপনার ডাকে সাড়া না দিয়ে পালিয়ে এসেছি৷'
'তাহলে আমাকে ডেকে আনলেন কেন?'
'গত দু বছরে কত কত সুইসাইড হলো। কারো চোখ পেইন্টিংয়ে যায়নি। আপনার গিয়েছে। সেটা নিয়ে ঘাটতেও শুরু করেছেন। তাই আমার কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে। তাই আপনি গায়েব হয়ে গেলে, আর পেইন্টিং নিয়ে কারো মাথা ব্যথা থাকবে না৷ সুইসাইডগুলা সুইসাইড হিসেবেই থাকবে!' একটু থেমে বলল, 'অবশ্য আমি আপনার কাজে মুগ্ধ! কতদূর পৌছে গেছেন! উর্মিলার মৃত্যু অবধি বের করে ফেলেছেন!'
'এগুলা কেন করছেন?'
'মেয়েটাকে ভালোবাসতাম। তার চোখেও আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি৷ ছোট বেলা থেকে একা একা বড় হয়েছি৷ স্কুল, কলেজেও তেমন বন্ধু-বান্ধব ছিল না৷ বড্ড একা ছিলাম৷ তাতে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম বলে সমস্যা হতো না৷ সমস্যাটা অন্য জায়গায় হয়েছে।'
'কোথায়?'
'সেই একাকিত্ব দূর করার জন্য একজন জীবনে আসল। তার সঙ্গ পেয়ে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। আমার ভবঘুরে জীবনের অবসান ঘটাতে সে ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলতে লাগল, এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ছবি এঁকে আর কত! জীবন ঘুছিয়ে নেও! তার অনুপ্রেরণা, চেষ্টায় আমি ভবঘুরে জীবন থেকে সরে আসার চেষ্টা করি। চেষ্টায় সফলতা আসে। সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমার পুলিশে চাকরী হয়। ট্রেইনিং ডাক পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে তার কাছে ছুটে যাই৷ তার বাসায় গিয়ে তাকে আনন্দের খবরটা দেই৷ সেও খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে। কী করবে না করবে বুঝতে পারছিল না৷ তার চেহারায় খুশিতে চমকাচ্ছিল। তখন আমার মনে হলো, ঠিক এই মুহুর্তে তার একটা ছবি আঁকা দরকার! যা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় ছবি৷ আমি তাকে জোর করে সামনে বসিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলাম৷ ছবি আঁকা শুরু করতেই তাকে ভালোবাসার কথা জানালাম৷ বললাম, তাকে আমার সারা জীবন চাই! তখনি তার মুখ থেকে সমস্ত খুশি উবে গেল৷ আমাকে রিজেক্ট করে দিয়ে বলল, আমি তোমারে বন্ধু হিসেবেই চাই! এর বেশি কিছু তোমাকে নিয়ে ভাবিনি! আমার মন খারাপ হয়ে গেল। মাথা নষ্ট হয়ে গেল। পাশেই পেপার কাটার ছিল। আমি এক মুহুর্তও অপেক্ষা করলাম না৷ তার হাত টেনে ধরে পেপার কাটারের টান বসিয়ে দিলাম। ফিনকি দিয়ে হাত থেকে রক্ত বের হতে লাগল। তখন আমার কী হলো আমি জানি না, সে রক্তই আমার ঐ রহস্যময় পেইন্টিংয়ের মাধ্যম হয়ে উঠল।' বলে ডা. শেখ একটু থামল, 'এরপর থেকে কোনো নারীর চোখে ভালোবাসা দেখলে আমার সহ্য হয় না। সে ভালোবাসা যার জন্যই হোক। তার মৃত্যু আমার চাই৷ সে জন্য দীর্ঘ্য সাধনার পর ঐ রহস্যময় পেইন্টিংটাকে আরো রহস্যময় করে তুলেছি৷ এটার দিকে কেউ তকিয়ে থাকলেই হিপ্নোটাইজড হয়ে যাবে৷ নিজের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকবে। আর যদি সে দ্রষ্টা কোনো নারী হয় তাহলে তো কথাই নেই, সে নারীর চোখে প্রেম থাকলেই সে হিপ্নোটাইজড হতে থাকবে। ঘরে একা হলেই সুইসাইড এটেম্প করবে। যেন তার এটেম্প সাক্সেস হয়।' বলে ডা. শেখ ফ্লোরের স্টার পেইন্টটার দিকে ইশারা করল, 'পেইন্টিংটায় এতো সমস্ত ক্ষমতা দিয়েছি এটার মাধ্যমেই বিশাল সাধনা করে৷' ডা. শেখ পিস্তল নামিয়ে রেখেছিল৷ গোলাম মাওলা তা একদমই খেয়াল করেনি। এখন আবার পিস্তল তাক করে বলল, 'আমি এই পেইন্টিং নিয়ে ঘাটাঘাটি বন্ধ চাই৷ তাই আপনি না থাকলে এই পেইন্টিংয়ের ঘাটাঘাটিও থাকবে না।' বলে ডা. শেখ যখন গুলি ছুড়তে যাবে, ঠিক তখনি পিছন থেকে আওয়াজ আসল,
'স্যার! ওর এতো কথা কী শুনছেন!'
গোলাম মাওলা পিছনের লোকটাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘুরাল। সাথে সাথে বিকট দুইটা গুলির আওয়াজ।
বুলেটটা রাফাতের ঠিক কপালের মাঝে গিয়ে বিধল। রাফাত নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। রাফাতের বন্দুক থেকে যে বুলেটটা বের হয়েছে সেটা ডা. শেখের বন্দুকে লেগে বন্দুক ছিটকে পড়ে গেলেও বুলেটটা তার গতি কিঞ্চিত কমিয়ে ডা. শেখের বুকে বিধল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো ঘটনাটা ঘটে গেল৷ গোলাম মাওলাও কয়েক মুহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গোলাম মাওলা নিজেকে সামলে নিয়ে রাফাতের নার্ভ চেক করল, ডেথ৷ ডা. শেখের নার্ভ এখনো চলছে। গুলিবিদ্ধ জায়গা বেধে তাকে কোলপাজা করে তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
গাড়িতে ডা. শেখের যখন জ্ঞান ফিরল তখন তার সাথে কিভাবে কী হলো কিছুই বুঝতে পারছে না৷ গোলাম মাওলাকে ফিসফিস করে সে কিছু একটা বলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
পরিশিষ্ট.
গোলাম মাওলা নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। কেসটা এখন পুরাপুরি সলভ হয়েছে৷ দু দিন আগের রাতের ঘটনার পর সব কিছু এক বিন্দুতে নিয়ে আসতে তার বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে৷ এখন পুরো কেসটার পর্দা হটানোর সময় এসে গেছে। তার সামনে ফারুক আর সায়মা। সায়মা গতকালই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে৷ আবার আজই অফিসে এসে বসে আছে৷
'কিভাবে কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছ না?' গোলাম মাওলা কথা শুরু করল।
'জি না স্যার!' ফারুক বলল।
'কিন্তু স্যার! রাফাতই যে মূল কালপ্রিট নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে?' সায়মা প্রশ্ন করল৷
'যেখানে তোমরা ফ্রি হলেই নিজেদের পার্সোনাল ব্যপারগুলো নিয়ে আলাপ করো সেখানে রাফাতের সাথে প্রায় দেড় বছর ধর কাজ করেও তার পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে কখনো বলতে শুনেছো? অথবা তার পরিবারের ব্যপারে?'
'না স্যার!' সায়মা, ফারুক এক সাথেই উত্তর দেয়।
তারপর গোলাম মাওলা বলতে শুরু করে 'ডা. শেখ যখন আমাকে গুলি ছোড়ার প্রস্তুতি নিল, ঠিক তখনি রাফাত কোত্থেকে এসে পিছন থেকে গুলি ছুড়ে বসল৷ ততক্ষণে ডা. শেখও ছুড়েছে৷ ঠিক সে মুহুর্তে আমার মাথায় যে ভাবনাটা এসেছে। সেটা হলো, আমি এখানে আসার ব্যপারে কাউকে কিছু বলিনি৷ তাহলে রাফাত কিভাবে আসল? আমি সে ব্যপারে মাথা ঘামাইনি। তখন পর্যন্ত আমার মনে হয়নি রাফাত যে কালপ্রিট হতে পারে৷ আমি রাফাতের নার্ভ চেক করে দেখি, মৃত। তখনো ডা. শেখ জীবিত৷ আমার চোখে সে অপরাধী হলেও আমার এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর বাকি৷ তাই সে যেহেতু মরেনি৷ তাকে বাঁচানো দরকার! তাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হই৷ গাড়িতেই তার জ্ঞান ফিরে৷ চোখ খুলে আমাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে, মাওলা সাহেব! আমার কী হয়েছে? আমি কোনো উত্তর দেই না। তখন সে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলে, মাওলা সাহবে! আমার বোধহয় আর বেশি সময় নেই৷ আপনি ল্যাবে যে পেইন্টিংটা দিয়েছিলেন, সেটার মাধ্যম আমি উদ্ধার করতে পেরেছি৷ ওটার মধ্যে একটা মেয়ের ছবিও আছে৷ পেইন্টিংটার পুরো রিপোর্ট আমি রাফাতের কাছে সকালে দিয়েছি৷' বলে গোলাম মাওলা একটা সিগারেট ধরায়, 'ডা. শেখ নিখোঁজ হয়েছে প্রায় তিন-চার দিন হয়ে গেছে৷ কিন্তু সে বলছে সকালে দিয়েছে৷ তখনি আমার কেমন কেমন লাগে। তখনি আমার মনে হলো এই কেসে ব্ল্যাকম্যাজিকের খেলাও চলছে। তাই ডা. শেখ গত তিন দিন ধরে যা করছে, তা তাকে দিয়ে করানো কোনো ব্যপারই না। তখন আমার মাথায় ঐ প্রশ্নটা আবার উঁকি দেয়, রাফাত এখানে কিভাবে আসল? আমি উত্তর খুঁজতে ব্লাড ব্যাংকে ফোন দেই। যেই ব্লাড ব্যাংক থেকে রাফাত উর্মিলার তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছিল৷ কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়, দু দিন আগে কোনো পুলিশ তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য নেয়নি৷ তখন আমার ঝাপসা ঝাপসা মনে হয় রাফাত অবসর পেলেই অফিসের টেবিলে বসেই কাগজ কলম নিয়ে আঁকাআঁকি করত। তবুও আমার বিশ্বাস হতে চায় না৷ তখনি কোইন্সিডেন্টলি আর্ট ফেস্টিভ্যালের কমিটির প্রধানের মেসেজ আসে। ঐ আর্টিস্টের ছবি পাওয়া গেছে। আমাকে মেইল করা হয়েছে। আমি মেইল চেক করে অবাক হয়ে যাই। আমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।' গোলাম মাওলা থেমে বলে, 'চা দিতে বলো!'
ফারুক কন্সটেবলকে ডেকে চা দিতে বলে৷
'ততক্ষণে ডা. শেখ মারা গেছেন৷ আমি গাড়ি ঘুরিয়ে আবার ঐ বাড়িটাতে ফিরে যাই৷ বাড়িটা খুঁজে দেখতে থাকি, রাফাতের কাছে দেখা বিভিন্ন জিনিষপত্র আমার চোখে পড়ে। খুঁজতে খুঁজতে আমি আমাদের কেসের পেইন্টিংটার মতো সেম দুইটা পেইন্টিং পাই!...'
'দুইটা পেইন্টিং কেন?' সায়মা গোলাম মাওলাকে থামিয়ে প্রশ্ন করে।
'বলছি!' তারপর ফারুককে উদ্দেশ্য করে বলে, 'রাফাতের ডেস্কের ল্যাপটপটা নিয়ে আসো!'
ফারুক রাফাতের ডেস্কের ল্যাপটপটা এনে গোলাম মাওলার টেবিলের উপর রাখে৷
'জেরিনের ফ্ল্যাট থেকে যেদিন পেইন্টিংটা চুরি হয়েছে, আমি আর সায়মা বের হওয়ার এক ঘন্টা পর থেকে সেই দিনের সিসিটিভি ফুটেজ দেখো!'
ফারুক আর সায়মা মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে৷
'স্যার! এই যে রাফাতকে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে৷' ক্লিপটা পোজ করে ফারুক বলে।
'হ্যাঁ! পুরো কেসে সে আমাদের এমন অনেক মিসগাইড করেছে। আর সকালে তো তুমি জেরিনের বিল্ডিংয়ের দারোওয়ানকে ধরে এনেছো!তারপর তাকে থার্ড ডিগ্রি দিতে তো দেখেছোই?'
'হ্যাঁ।' ফারুক উত্তর দিল।
'আমি সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই ওরে ধরে আনতে বলেছি। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেদিন আমরা চলে আসার পর রাফাত গিয়েছিল। টাকা দিয়ে বলেছে তার আসার কথা গোপণ রাখতে। আর যদি মুখ খুলে তাহলে তাকে মেরে ফেলবে। টাকা এবং ভয় পেয়ে ও আর মুখ খুলেনি৷'
'আর স্যার! ডা. শেখের ব্যপারটা?' সায়মা বলল।
'সে পেইন্টিংটার রহস্য প্রায় উন্মোচন করে ফেলেছিল৷ তাই তাকে হিপ্নোটাইজ করে কালপ্রিট নিজের মতো চালাচ্ছিল। তার আগেই রাফাত তোমার চোখে ভালোবাসা দেখতে পেয়েছে৷ সেটা ওর সহ্য হয়নি বলে ডা. শেখের মাধ্যমে তোমাকে একটা সময় ডেকেছে যখন অফিসে কেউ থাকে না। আর ঐ সময় পেইন্টিংটা তোমার দেখা মানে, তুমি হিপ্নোটাইজড হয়ে পেইন্টিংটা নিয়ে যাবে। মনে আছে? সামিয়ার হাজবেন্ড বলেছিল, সে সামিয়ার মুখ থেকে একটা পেইন্টিং কেনার কথা শুনেছে৷ পেইন্টিংটা কোনো হকার টাইপ কারো কাছ থেকে কিনেছে বলে৷'
'হ্যাঁ!'
'মূলত পেইন্টিংটা দেখে হিপ্নোটাইজড হয়েই কিনেছিল৷ কারণ পেইন্টিংটার উপর এমনভাবে ব্ল্যাক ম্যাজিক করা, যে মেয়ের চোখে প্রেম খেলা করবে সেই মেয়ে পেইন্টিংটা দেখলেই এটার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।' ততক্ষণে চা চলে এসেছে গোলাম মাওলা চায়ের কাপ হাতে নিল, 'এবং কেসটা ধামাচাপা দেয়ার জন্য ডা. শেখকে গিনিপিক বানানো হয়েছিল।'
'স্যার! ডা. শেখকেই কেন?' সায়মা জিজ্ঞাসা করে৷
'কারণ সে আগেই পেইন্টিংয়ের রহস্য জেনে ফেলেছিল। তখন অবধি কিন্তু সে নিখোঁজ হয়নি। আর তোমার ঘটনাটার পর আমি যখন তার ফোন দেয়ার ব্যপারটা জেনে গেলাম, তখন কিন্তু তাকে গায়েব করে দেয়া হয়েছে৷ পরবর্তীতে রাফাতের মনে হয়েছে, এই কেসটা বন্ধ করা দরকার। নাহয় তার উদ্দেশ্য সঠিকভাবে এগুবে না৷ তাই ডা. শেখের মাধ্যমে আমাকে ডেকে নিয়ে এর পিছনের পুরো কাহিনিটা ডা. শেখকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিয়েছে। যেন ডা. শেখকে অপরাধী প্রমাণ করে কেসটা বন্ধ করে দেয়া যায়৷ এবং রাফাত তার উদ্দেশ্য 'শহরে কারো চোখে ভালোবাসার দেখা মিলবে না'র দিকে এগিয়ে যেতে পারে৷' গোলাম মাওলা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, 'একটা প্রশ্ন থেকে যায়, আমি কিভাবে বুঝলাম রাফাত ডা. শেখ দ্বারা তার কাহিনি বলাচ্ছে?'
'হ্যাঁ স্যার!' ফারুক বলে।
'ডা. শেখ আমাকে বলেছিল, সে সরাসরি পুলিশে জয়েন করেছে৷ যেখানে মূলত সে একজন ডাক্তার। এবং তার চাকরীর সেক্টরও সেটাই৷ ভাগ্যক্রমে গোয়েন্দার ল্যাবে তার পোস্টিং হয়েছে৷ কিন্তু তার চাকরীর সুযোগ সুবিধা পুলিশের মতো নয়, ডাক্তারের মতোই।'
'তাহলে স্যার! ডা. শেখের গুলি থেকে রাফাত আপনাকে বাঁচাল কেন?'
'কারণ আমি মারা গেলে কেসটা বন্ধ তো হতোই না৷ আরো ক্রিটিকাল হয়ে উঠত৷ তাই সে ডা. শেখকে এমনভাবে হিপ্নোটাইজ করেছে যে সে সব কিছু বলে আমাকে গুলি করবে৷ আর রাফাতের পরিকল্পনা ছিল, ডা. শেখের গুলি করার আগ মুহুর্তে গিয়ে তাকে মেরে কেস ক্লোজ করে দেয়া। তখন ব্লাড পেইন্টিংটা তো তার কাছেই৷ সে তোমার কাছ থেকে ছবি উদ্ধার করার কথা বলে আগেই নিয়ে রেখেছে!'
'হ্যাঁ স্যার!' ফারুক উত্তর দিল
'তোমার মাথায় একবারও ভাবনা আসেনি, কোন আর্টিস্ট ছবিটার স্কেচ করতে পারেনি৷ কিন্তু রাফাত করে এনে দিয়েছে।'
'না স্যার!'
'কিন্তু আমার মনে হয়েছে৷' বলে গোলাম মাওলা চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিল, যাই হোক, সে আগেই আরেকটা সাধারণ কালির পেইন্টিং করে রেখেছে৷ আমার কাছে কনফেস করে আমাকে মারতে গিয়ে ডা. শেখের মরে যাওয়া মানে সে অপরাধী সাভ্যস্ত হওয়া এবং সহজেই কেস ক্লোজ হয়ে যাওয়া৷ তখন নকল পেইন্টিংটা আমাদেরকে দিয়ে আসলটা দ্বারা সে তার উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যেত৷ কিন্তু তার পরিকল্পনায় টুইস্ট আসল, তার নিজের ভুলেই। কারণ সে গুলি করতে কয়েক সেকেন্ড লেট করে ফেলেছে৷ যার কারণে ডা. শেখও হাতের বন্দুকটা থেকেও ততক্ষণে গুলি ছুড়ে ফেলেছে। আর দূর্ভাগ্যবশত রাফাত গুলির লাইনে এসে পড়েছিল।'
গোলাম মাওলা টেবিলের উপর হাত রেখে ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুকে বসল, 'কারো মনে আর কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন?'
'না স্যার!' সায়মা, ফারুক সমস্বরে উত্তর দিল৷
গোলাম মাওলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, 'আমার উপর দিয়ে এ কদিন বেশ ঝড়-ঝাক্কি গেল৷ এখন ছুটি নিয়ে কোথাও গিয়ে মাইন্ড রিফ্রেশ করতে হবে৷' বলেই সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।
'স্যার আমারবউপর দিয়েও তো কম ঝাক্কি গেল না৷ আমাকেও সাথে নিয়ে যান না!' বলেই সায়মা কেমন অসহায় দৃষ্টিতে গোলাম মাওলার দিকে চেয়ে রইল৷
সাথে সাথে পাশ থেকে ফারুক বলে উঠল, 'প্রেমে পড়ে শরীর থেকে দুই ব্যাগ রক্ত ঝরিয়ে এতোদিন হাসপাতালে পড়ে থেকেও তোর মাথা থেকে প্রেমের ভুত নামেনি?'
সায়মা চোখ-মুখ খিঁচিয়ে ফারুকের দিকে ঘাড় একটু ঘুরিয়ে নিচু স্বরে বলে, 'চুপ করতো তুই! এতো বেশতি কথা বলস কেন!'
গোলাম মাওলা সব শুনেও চুপ করে থাকে। কিছু বলে না৷ মুচকি হাসে। কেমন রহস্যময় মুচকি হাসি৷ ফারুক-সায়মা কেউই যে রহস্যের কুল কিনারা করতে পারে না৷
সমাপ্ত
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....