গল্পঃ ব্লাড পেইন্টিং পর্ব ৬ || © মারুফ হুসাইন।
✋এক নজরে ব্লাড পেইন্টিং পর্ব সমূহ💕
১১.
গোলাম মাওলা ডা. শেখকে কল করে। প্রথম কলে রিসিভ না করলেও দ্বিতীয় কলে রিসিভ করে ভাঙ্গা গলায় বলে, 'হ্যালো!'
'ডা. শেখ আপনার সাথে জরূরী কথা আছে। এখনি দেখা করতে হবে।'
'কে? গোলাম মাওলা সাহেব?' বলতে বলতে ঘুম চোখেই কান থেকে মোবাইল সরিয়ে নাম্বারটা দেখে নেয়৷
'হ্যাঁ!'
'মাওলা সাহেব, এখন তো অনেক রাত! দেখা করাটা জরূরী? সকালে করলে হয় না?'
'না এখনি করতে হবে৷'
'ঠিক আছে, কোথায় আসব বলুন?' উঠে বসে চোখ ডলতে ডলতে ডা. শেখ বলে।
'অফিসে চলে আসুন!'
'ঠিক আছে৷' বলে ডা. শেখ ফোন নামিয়ে রাখে৷
ততক্ষণে রাফাত খেয়ে-দেয়ে চলে এসেছে।
'রাফাত তুমি এখানেই থাকো! আমি একটু অফিসে যাচ্ছি। আর সায়মার জ্ঞান ফিরলেই আমাকে ফোন দিবে!'
'ঠিক আছে স্যার!'
গোলাম মাওলা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা টংয়ে বসে সিগারেট ধরায়৷ দোকানিকে চা দিতে বলে। তখনি ফারুকের ফোন আসে, 'স্যার! আরিফের খবর পেয়েছি৷'
'তাহলে ফোন করে সময় নষ্ট করছ কেন! ধরে নিয়ে আসো!'
'স্যার একা সম্ভব নয়।'
'তাহলে লোক নিয়ে যাও!'
'ঠিক আছে স্যার!'
গোলাম মাওলা ফোন পকেটে রেখে চা-সিগারেটের বিল মিটিয়ে ওঠে পড়ে৷ মনে মনে কেসটা সাজাতে থাকে। কিন্তু কোনো কুল-কিনারা খুঁজে পায় না। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার মনে হয়। আর এই অন্ধকারেই সে পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে৷
ভাবতে ভাবতে অল্প সময়েই সে অফিসে পৌছে যায়৷ ডা. শেখ এখনো আসেনি৷ সে ডা. শেখকে ফোন করে, 'কত দূর আপনি?'
'এখনো বের হয়নি। হচ্ছি৷ পৌছুতে পৌছুতে আধ ঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট লাগবে। ঠিক আছে৷ জলদি আসুন!'
গোলাম মাওলা ঘড়ি দেখে, আড়াইটার উপর বাজে। ঘুমে তার চোখ লেগে আসছে৷ সে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দেয়৷ হুট করে পেইন্টিংটার কথা তার মনে পড়ে৷ সে অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ি থেকে পেইন্টিংটা নিয়ে আসে। কী অদ্ভুত পেইন্টিং৷ লাল-টুকটুকে৷ না ঠিক লাল না, খয়েরী৷ রক্ত জমাট বাধলে বা শুকিয়ে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমন। গোলাম মাওলা পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন সম্মহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে চাইলেও চোখ ফেরাতে পারছে না। পেইন্টিংটা তাকে কেমন আসাড় করে দিচ্ছে৷
'স্যার!'
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গোলাম মাওলা পেইন্টিং থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। এক কন্সটেবল দাঁড়িয়ে আছে৷
'কিছু বলবে?'
'না, স্যার! বেল বাজল। তাই ভাবলাম ডেকেছেন।'
গোলাম মাওলার অজান্তেই বেলে চাপ পড়েছিল। ব্যপারটা সে বুঝতে পেরে বলে, 'এক কাপ চা নিয়ে এসো!'
সে আবার চেয়ারে হেলান দেয়৷ বুঝতে পারে, পেইন্টিংটার মধ্যে এমন কিছু আছে, যার জন্য পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে থাকলে মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে পড়ে। চিন্তা শক্তি নিজের কন্ট্রলে থাকে না। সে মনে মনে ভাবে, এখনি সে কোনো আর্ট বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে আর্টটার ব্যপারে জানবে। তার পরিচিত কোনো আর্ট বিশেষজ্ঞের আছে কিনা, মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু তেমন কেউ আছে বলে তার মনে হয় না। হুট করে তার নিজের এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে যে কিনা ভালো আর্ট করে। তাহলে নিশ্চই ঐ দিকটায় তার জানাশোনা থাকবে।
গোলাম মাওলা মোবাইলে বন্ধুর নাম্বার খোঁজতে থাকে। অনেক দিন হয়েছে কথা হয় না। তাই যে নাম্বারটা আছে, খোলা পাবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। চাকরী জীবনের এই একটা অসুবিধে। সব সময় ব্যস্ততা লেগেই থাকে। চাইলেও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা হয় না। সবাই যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
গোলাম মাওলা তার বন্ধু সাজেদকে কল করে৷ নাম্বারটা খোলা আছে৷ প্রথম রিংয়েই সাজেদ কল ধরে, 'আরে দোস্ত! তুই এতো দিন পর!'
'হ্যাঁ একটু দরকারে ফোন করেছি।'
'তুই পুলিশ মানুষ। আমাদের কাছে আবার কী দরকার?'
'আছে, পরে বলছি৷ আগে বল কেমন আছিস?'
'ভালো আছি। তুই?'
'আছি খুব ঝামেলায়। একটা কেস নিয়ে মহা মুশকিলে পড়েছি৷ তার জন্যই তোকে ফোন দেয়া!'
'তোর এসব পুলিশি কাজে আমাকে দরকার পড়ল কিভাবে?'
'একটা ভয়ংকর সুইসাইড কেস নিয়ে কাজ করছি। আর আশ্চর্যজনকভাবে যে মেয়েগুলা সুইসাইড করছে বা সুইসাইড এটেম্পট করছে। তাদের কাছে, একটা পেইন্টিং পাওয়া যাচ্ছে৷'
'মানে?'
'মানে ঐ পেইন্টিংটা যে মেয়ের কাছে থাকে, সেই সুইসাইড এটেম্প করছে।'
'অদ্ভুত! পেইন্টিংটা আমি দেখতে চাই!'
'সে জন্যই তোকে ফোন করা, তোর কাছে এমন কেউ আছে যার আর্ট নিয়ে অগাধ জ্ঞান৷'
'হ্যাঁ, আছে৷ আমার এক শিক্ষক। তার সাথে আমি দেখা করতে চাই৷ পারলে এখনি৷'
'এখন! এতো রাতে কিভাবে সম্ভব!'
'কখন সম্ভব?'
সাজেদ কিছুক্ষণ ভেবে বলে, 'সকালে আমি তোর অফিসে চলে আসব। তোকে নিয়ে ওনার কাছে চলে যাব।'
'ঠিক আছে। সকালে দেরী করিস না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার।'
গোলাম মাওলা ঘড়ি দেখল। সাড়ে তিনটার একটু বেশি বাজে। ডা. শেখ এখনো আসেনি৷ সে ডা. শেখকে ফোন করল। কিন্তু মোবাইল বন্ধ। সে অবাক হলো। আবার ফোন করল। কিন্তু ব্যতিক্রম কিছু হলো না। নাম্বার বন্ধ।
গোলাম মাওলা বিরক্ত হয়ে ফোনটা টেবিলের উপর ছুড়ে দিল। ঘুমে তার চোখ জ্বালা করছে৷ চেয়ার থেকে ওঠে চোখ-মুখে পানি দিয়ে ফিরে এসে চেয়ারে আরাম করে বসতেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
মোবাইলের রিংটোনে তার ঘুম ভাংল৷ হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিতে ইচ্ছে করছে না। আলসেমি লাগছে। তবুও সে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিল৷ ভাবল, ডা শেখের কল হবে। কিন্তু না, রাফাতের কল। সে কল রিসিভ করল, 'হ্যাঁ রাফাত বলো!'
'স্যার! সায়মার জ্ঞান ফিরেছে৷'
'কখন ফিরেছে?'
'ঘন্টাখানেক হবে।'
'ঠিক আছে৷ আমি আসছি৷'
কল কেটে গোলাম মাওলা ঘড়ির দিকে তাকাল। ফজরের আজানের সময় হয়ে গেছে। এখনো ডা. শেখ আসেনি৷ আবার তাকে কল করল৷ এখনো নাম্বার বন্ধ।
১২.
কেবিনে প্রবেশ করতেই গোলাম মাওলাকে দেখে সায়মা মুচকি হাসল। তার হাতে স্যালাইনের নল লাগান৷ এক রাতেই মেয়েটাকে কেমন রোগা দেখাচ্ছে। বেশ রক্তক্ষরণ হওয়াতে ফ্যাকাশেও দেখাচ্ছে 'কী অবস্থা তোমার?'
'স্যার! কিছুটা ভালো ফিল করছি।' বলে একটু থেমেই বলল, 'সরি স্যার! এমনটা করা আমার উচিৎ হয়নি।'
'ঠিক কী হয়েছিল, বলো তো!'
'স্যার! আমি যখন আপনার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, ঠিক তখনি ডাক্তার শেখে আমাকে ফোন করে বলে যে কেসটা নিয়ে কী ইম্পোর্ট্যান্ট কথা আছে৷ যত দ্রুত সম্ভব আমি যেন তার সাথে দেখা করি৷ সে ল্যাবেই আছে৷ আমি ভাবলাম, উনার সাথে দেখা করে তারপর না হয় আমার কাজে গেলাম৷ কিন্তু আমি ল্যাবে গিয়ে দেখি কারেন্ট নেই৷ আর লাঞ্চের সময় হওয়াতে ল্যাবে একজন বাদে কেউই ছিল না৷ রিপোর্টগুলার প্রগ্রেস নিয়ে তার সাথে কথা বলি। কিছুক্ষণ বাদে সে ওয়াশরুমে যায়৷ আমি একা ল্যাবে ঘুরে ঘুরে ডা. শেখের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি৷ তখনি পেইন্টিংটা আমার চোখে পড়ে৷ আমি দেখতে থাকি৷ এরপর আমি কিভাবে কিভাবে বাসায় পৌছেছি বলতে পারি না। আমার যখন ঘুম ভাংল৷ তখন আমি প্রথমে অবাক হলাম, আমার তো মার্কেটে যাওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু বাসায় আসলাম কখন! পরেই মনে পড়ল, ডাক্তার শেখের ফোন পেয়ে ল্যাবে গিয়েছিলাম৷ সেখানে তাকে না পেয়ে বের হয়ে যাই৷ তখন শরীর ক্লান্ত লাগায় বাসায় চলে আসি। ঘুম থেকে উঠে আমি আর দেরী করিনি৷ মার্কেটে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গেলাম৷ রাতে আমার একটা পরিকল্পনা ছিল৷ সেটার জন্য টুকটাক কেনাকাটা করতে হতো৷ আমি ফিরে এসে রেডি হতে লাগলাম৷ শেষ পর্যায় ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন নিজেকে ভালোভাবে দেখছিলাম, ঠিক তখনি আয়নায় দেখলাম যে আমার দেয়ালে পেইন্টিংটা ঝুলানো৷ এরপর আমার আর কিছুই মনে নেই। পেইন্টিংটা কিভাবে আমার বাসায় গেল আমি জানি না স্যার!'
'তুমিই ল্যাব থেকে নিয়ে বের হয়েছিলে।'
'না স্যার! আমি এমনটা করতে যাব কেন?'
'সিসিটিভিতে তোমাকে পেইন্টিংটা নিয়ে বের হতে দেখা গিয়েছে৷'
'আমাকে?' সায়মার চোখে বিস্ময় দেখা গেল৷ গোলাম মাওলা তার বেডের উপর হাত রেখে পাশের চেয়ারে বসে কথা বলছিল।সায়মা তার নল লাগানো হাতটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে গোলাম মাওলার হাতের উপর রেখে বলল, 'স্যার! বিশ্বাস করুন, আমি আনলেও একটুও সজ্ঞানে আনিনি। আমাকে ডা. শেখ ফোন দিয়েছিল বলেই আমি ল্যাবে গিয়েছিলাম৷ বিশ্বাস না হলে আপনি মোবাইলে দেখতে পারেন৷ তার কল রেকর্ডও আছে।'
'সায়মা! আমি জানি তুমি সজ্ঞানে করোনি। আর ডা. শেখ তোমাকে ফোন দিয়ে নিয়েছে, সেটাও জানি। আমি তোমার মোবাইল থেকে কল রেকর্ড শুনেছি। তোমার মোবাইলের লক আমার সামনে অনেকবার খুলেছো! সেখান থেকে লকটা মনে করে খুলেছি।'
সায়মার মনে পড়ে গেল, গোলাম মাওলার মেসেজ বক্সে তাকে পাঠানোর জন্য একটা মেসেজও লেখা ছিল। তাহে নিশ্চই সেটাও দেখেছে৷ তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তাহলে স্যার নিশ্চই সব কিছু বুঝে গেছে।
গোলাম মাওলা কিছু জানে না ভেবেই ছোঁয়ে দেখার তাগিদ থেকে সুযোগ পেয়ে হাতে হাত রেখেছিল। কিন্তু এখন যখন বুঝতে পারল, গোলাম মাওলা সব জেনে গেছে৷ তখন তার লজ্জায় হাতটা সরিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সরাতে পারছে না, যদি স্যার! আবার কিছু ভেবে ফেলে।
সে ভেবেও পাচ্ছে না, কী বলবে এখন৷ গোলাম মাওলার দিকে তাকাতেই তার লজ্জা লাগছে।
সায়মার কেবিনে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করল। গোলাম মাওলা নিরবতা ভেঙ্গে বলল, 'সায়মা! তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করো না। কেসটা আমরা দেখছি। তুমি শুধু নিজের সুস্থ হওয়ার কথা ভাবো।' সে উঠল।
রাফাত পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। রাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'যদি এখন সায়মাকে কিছু খাওয়ানোর অনুমতি থাকে তাহলে খাইয়ে তুমি অফিস থেকে তার দেখাশোনার জন্য কাউকে ডেকে এনে বাসায় চলে যাও। রেস্ট নিয়ে তারপর এসো!' বলে একটু থেমে বলল, 'আমার এখন আবার অফিসে যেতে হবে।'
'ঠিক আছে স্যার!'
গোলাম মাওলা অফিসে ফিরে আসে। এখন সাতটার উপর বাজে৷ সাজেদের আসার কথা। সে আসতে আসতে এক কাপ চা খাওয়া যায়৷ গোলাম মাওলা কন্সটেবলকে চা দিতে বলে। তখনি তার রুমে ফারুক ঢুকে, 'স্যার! আরিফকে ধরে নিয়ে এসেছি।'
'ঠিক আছে, আমি চা খেয়ে আসছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করব।'
চা আসে। গোলাম মাওলা চায়ে চুমুক দেয়। তখনি সাজেদ ফোন দেয় 'কিরে তোর অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।'
'গেটম্যানকে মোবাইল দে। আমি বলে দিচ্ছি।'
'ভিতরে গিয়ে কী করব!'
'আয়! চা খেয়ে বের হই!'
'বাইরেই চা খাওয়া যাবে৷'
'আচ্ছা দাঁড়া তাহলে আসছি।'
গোলাম মাওলা কল কেটে আরো একবার ডা. শেখকে ট্রাই করে৷ নাম্বার বন্ধ। সে ফারুককে ডাকে, 'আরিফকে জিম্মায় রাখো! আমি এসে জিজ্ঞাসাবাদ করব। আর তুমি ডা. শেখের বাসায় যাবে৷ তাকে তার বাসা থেকে নিজের সাথে করে নিয়ে আসবে৷'
'ঠিক আছে স্যার!'
গোলাম মাওলা পেইন্টিংটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে৷ সাজেদের সাথে আলাপ করতে করতে সাজেদের শিক্ষকের বাসার দিকে যাচ্ছে। তখনি ফারুক ফোন দিয়ে জানায়, 'ডা. শেখ বাসায় নেই। দারোওয়ান বলেছে, ভোর রাতে বের হয়েছে৷ এখনো বাসায় ফিরেনি৷'
চলবে.........
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....