গল্প:- গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ©মারুফ হুসাইন পর্ব ৪

গল্প:- গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া 

©মারুফ হুসাইন পর্ব ৪

গ্রীস্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া

'দু-তিন দিন ধরে তোমাকে খুব মন মরা দেখাচ্ছে!' আফজাল সাহেব পায়ে মোজা পরতে পরতে বলল।
'কই না তো!'
মোজাগুলো পরে আফজাল সাহেব মুনার মুখামুখি দাঁড়ালেন। বাহুতে হাত রেখে বললেন, 'মুনা! কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো!'
'না কোনো সমস্যা হয়নি।' বলে সে আফজাল সাহেব থেকে ছাড়িয়ে নিল, 'কবে ফিরবেন আপনি?' কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে সে,

'দু দিন থাকতে হবে হয়তো!' মুনা তার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে বুঝতে পেরেও আর কথা বাড়ালেন না৷ অফিসের কাজে তার ঢাকার বাইরে যেতে হচ্ছে। দু রাত থাকতে হবে। প্রায় অফিসের কাজে তার ঢাকার বাইরে যেতে হয়।

'সাবধানে যাইয়েন! পৌছে ফোন দিয়েন!' আফজাল সাহেব দরজায় পা বাড়াতেই পিছন থেকে মুনা বলল।
মুনা ঘড়ি দেখে। দুপুর তিনটা বাজে। সামিয়ার রুমে উঁকি দেয়৷ মেয়েটা ঘুমুচ্ছে৷ মুনা এগিয়ে গিয়ে মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে আসে।
গল্প গ্রীস্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া


নিজের রুমের বারান্দায় চলে যায়৷ বারান্দায় একটা দোলনা বসানো হয়েছে৷ সেখানে বসে মেইলের পাসওয়ার্ডটা মনে করার চেষ্টা করে৷ সংসার, চাকরী সব কিছু সামলিয়ে এখন আর ঐ মেইলটাতে ঢুকা হয় না৷ একটা সময় সুযোগ পেলেই ড্রাইভে ঢুকে বসে থাকত। কিন্তু এখন পাসওয়ার্ডটাই ঠিকভাবে মনে করতে পারছে না৷ ভাবে, কত দিন এই ড্রাইভটায় ঢুকে পুরানো স্মৃতিগুলো চেক করা হয় না৷ কত দিন আগে, ড্রাইভে ঢুকা হয়েছিল৷ সে মনে করার চেষ্টা। এক বছর, দুই বছর নাকি আরো বেশি! সে মনে করতে পারে না৷

পাসওয়ার্ডটাও ঠিকঠাকভাবে মনে পড়ছে না৷ যতটুকু মনে পড়ছে, তাতে তাদের দুই জনের নাম ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কয়েক বার চেষ্টা করতেই পাসওয়ার্ড ম্যাচ হয়ে গেল। ড্রাইভে কত কত ছবি৷ স্ক্রল করে সে একটা একটা ছবি দেখতে থাকে, তাদের দুই জনের কত কত স্মৃতি। ঢাকা শহরের এমন কোনো জায়গা নেই, তারা এক সাথে ঘুরে বেড়ায়নি৷

একটা গ্রুপ ছবিতে তার চোখ আটকে যায়, ছেলেরা সবাই হলুদ পাঞ্জাবি আর মেয়েগুলা সব নীল শাড়িতে৷ পঁচিশ-ত্রিশ জনের একটা গ্রুপ ছবি৷ মুনা ছবিটা জুম করে, অনেক দিন পুরানো কম রেজ্যুলেশনের ছবি হওয়ায় ছবিটা ফেটে গেছে। তবুও নিজেদের চিনতে অসুবিধা হয় না। ফ্রেমের দুই মাথায় তাদের দুইজনকে দেখা যাচ্ছে৷

সেদিন হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে একটা পাঠক সংগ এই মিলনমেলার আয়োজন করেছিল। তার এক বান্ধুবী এই সংগের সদস্য ছিল৷ সে তার সাথেই সেদিন সেখানে যায়। বান্ধুবীর কথায় সেও নীল শাড়ি পড়েছিল৷ সেই আড্ডা থেকেই শরিফের সাথে তার পরিচয়। ছবিটা যখন তোলা হয়েছিল, তখনো তাদের আলাপ হয়নি। ছবিটা তোলা বেশ কিছুক্ষণ পর বান্ধুবী শরিফের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়৷

'মাম্মা! মাম্মা!' হঠাৎ সামিয়ার ডাকে মুনা হকচকিয়ে যায়। সে ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, 'হ্যাঁ, মাম্মা বলো!'
শরিফুল টিউশনি থেকে বের হয়৷ সাড়ে চারটা বাজে৷ আড়াইটায় টিউশনিতে ঢুকেছিল৷ এখনো খাওয়া-দাওয়া করা হয়নি। সকালেও কিছু খায়নি৷ টিউশনিতে যাওয়ার পর থেকেই ক্ষিদায় পেট মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিয়েছে৷ তাই টিউশন থেকে বের হয়ে সোজা হোটেলে ঢুকল।

খেয়ে-দেয়ে বের হয়ে কাওরান বাজার বস্তিতে যাওয়ার কথা ভাবল৷ বিলকিস আপার জন্য ঔষধ নিয়ে গতকাল রাতেও গিয়েছিল৷ চার দিন হয়ে গিয়েছিল, ওনার ওষুধ শেষ হয়েছে। কিন্তু টাকার অভাবে কিনে দিতে পারেনি৷ পরশু বেতনটা পেয়ে ভেবেছিল, সবার আগে ওনার ওষুধ কিনে নিয়ে যাবে৷ কিন্তু বিভিন্ন কারণে আর যাওয়া হয়নি। গতকাল ওষুধ নিয়ে গিয়ে দেখে তার অবস্থা তেমন ভালো নয়।

শরিফুলের আগমন টের পেয়েই বিলকিস আপা উঠে বসতে চেয়েছিল, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'শরিফুল! কেমন আছিস ভাই?'
শরিফ বুঝতে পারে, আপার অবস্থা তেমন ভালো নয়৷ তাই আর তাকে উঠতে দেয় না। হাতের উপর হাত রেখে বলে, 'আপা! আমি ভালো আছি৷ পাখির কাছে তোমার ওষুধ দিয়ে গেছি৷ দু দিন খেয়ে দেখো!'
'ওষুধ খাইয়া আর কী হইব ভাই! আমি আর বেশি দিন নাইরে।' বিলকিস আপার চোখের কোণে শরিফুল পানি দেখতে পায়, 'আমি মইরা যামু তার লাইজ্ঞা কোনো আফসোস নাই৷ কিন্তু আমি মইরা গেলে আমার মাইয়াটার কী হইব!'

'আপা! তোমার কিচ্ছু হবে না৷ ওষুধ কিনে দিয়ে গেছি৷ দু-দিন খেয়ে দেখো। ভালো না লাগলে হাসপাতালে নিয়ে যাব।' বলে শরিফুল উঠে যায়, 'আপা! যাই আমি। কাল আসব আবার!'
'আসিস ভাই! তোরে দেখলে মনডা ভালা হইয়া যায়!'
শরিফুল আর দেরী করে না। বিলকিস আপার ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তার এই অবস্থা দেখে শরিফুলেরও কষ্ট হয়।

সে তখন মাত্র অনিয়ম করা শুরু করেছে। কখন কী করতো নিজেও জানে না। তার কিছুই ভালো লাগত না সারা দিন এক ধ্যানে বসে থাকত অথবা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। টানা দু-তিন খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো না হওয়ায় শরীর বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছিল। রাতে মেসে থাকতে ভালো লাগছিল না বলে মেস থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছিল। হুট করে সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়।

দু দিন পর জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা ছাপড়া ঘরের চকিতে আবিষ্কার করে৷ তার মাথায় জলপট্টি দিয়ে পাশেই এক মহিলা বসে ছিল। সে চোখ খুলতেই জিজ্ঞাসা করে, 'এহন কেমন লাগছে ভাই!'
তাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে দু দিন সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলা এই মহিলাটাই বিলকিস আপা৷ যে একজন যৌনকর্মি হওয়া সত্ত্বেও গভীর রাতে রাস্তায় একজন অপরিচিত মানুষকে পড়ে থাকতে দেখে নিজের বাসায় এনে সেবা করে সুস্থ করে তুলেছে৷

বিলকিস আপার কথা ভাবতে ভাবতে শরিফুল রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কাওরান বাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে। তার কথা ভাবতেই তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার মনে হতে থাকে, বিলকিস আপা হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবে না৷ রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আপন বলতে এই একজনই ছিল। সে চলে গেলে তার আপন বলতে আর কেউই থাকবে না।
চলবে......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ