মারা যাওয়ার আগে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের লেখা শেষ চিঠি ছিল এটা!
গল্পঃ এক মুঠো ভালোবাসা
✍️Total Content Credit :- Nameera Nur Nidra
আমি মারা যাবো। উহুম, নিজেই নিজেকে শেষ করবো না। আমার মধ্যে আমি বয়ে বেড়াচ্ছি ব্রেইন টিউমার নামক এক অসুখ। এটা আমার পরিবারের কেউ জানে না। আমি জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা গুরুত্ব দেয়নি। আচ্ছা আজ আমার জীবন কাহিনীটা বলি তবে।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার জন্ম। সবার নাকি মেয়ে হোক এটাই ইচ্ছা ছিল। আমি হওয়ার প্রায় দশ বছর পর আমার ছোট ভাই আসে এই পৃথিবীতে। তখন থেকেই আমার পরিবারের কেউ আমাকে তেমন পছন্দ করতো না। কারণ একটাই, আমি মেয়ে! আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমার আগে যদি আমার ভাই হতো তাহলেই বোধ হয় ভালো হতো।
মাত্র দশ বছর বয়সেই সবার অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। নিজের বাবা-মায়ের বিষন্ন মুখ দেখতে আমার একটুও ভালো লাগতো না। আমি খুব করে চাইতাম আমার পরিবারের প্রতিটা মানুষ আমাকে ভালোবাসুক। কিন্তু আমি সেটা চেয়েও পাইনি। এক মুঠো ভালোবাসার জন্য ডুকরে কেঁদেছি। সেই ছোট থেকেই আমি বাস্তবতা মানতে শিখেছি।
সবাই বলে বড় হলে তারপর ম্যাচিউরিটি আসে মানুষের মধ্যে। আমি এই কথাটা বিশ্বাস করি না। কারণ ম্যাচিউরিটি আসে বাস্তবতার শিকার হওয়ার পর। যা আমি মাত্র দশ বছর বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম।
ধীরে ধীরে বড় হতে থাকি। পরিবার, প্রতিবেশী, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার কাছেই আমি যেন অপশনাল। আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। আমি কিছুই পারবো না। পরিবারের জন্য এক টাকা ও আয় করতে পারবো না। লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবো না। আরো কত কথা!
এরপর আসে আরেক বিপর্যয়। নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলি। আমি নিজে তাকে আমার মনের কথা বলেছিলাম। তার উত্তরে সে আমাকে বলেছিল,
"নিজের দিকে তাকিয়েছো কখনো? আমি সব সময় লেভেল মেনে চলি। তুমি আমার লেভেলেরই না। আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখো।"
আমি এরপর নিজেকে আরো গুটিয়ে নিই। ধীরে ধীরে আমি ঘরবন্দী করে নিয়েছিলাম নিজেকে। নিজের প্রতি ঘৃণা হয় আমার। এমন জীবন তো আমি চাইনি। আমি তো সবার সাথে হেসেখেলে বাঁচতে চেয়েছি। তবে কেন আমি সবার থেকে শুধুই তুচ্ছতাচ্ছিল্য পাই? এর উত্তর আমার জানা নেই।
একদিন জানতে পারলাম আমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। সেদিন থেকেই আরো একবার লড়াই শুরু। প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে আমি যখন বিছানায় শুয়ে কাতরায়, তখন আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলানোর মতো কাউকে পাইনি। মাথার ব্যাথা দিনে দিনে আরো প্রখর হতে শুরু করলো। আমি আমার পরিবারকে জানিয়েছিলাম এই কথা। তারা আমার কথার তেমন গুরুত্ব দেয়নি। আমিও আর কিছু বলিনি কাউকে।
একদিন টাকা জমিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার যখন রিপোর্ট দেখে বললো আমার মাথায় টিউমার হয়েছে এবং এটা অতি শীঘ্রই অপসারণ না করলে আমি আর বাঁচবো না! তখন মুচকি হেসে আমি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসি। হয়তো সময় গেছে আমার মুক্তির!
আমি বুঝতে পারছি আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। আমার জীবনের অন্তিমকাল এসে গেছে। তাই তো নিজের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু যার সাথে আমি সব মনের কথা শেয়ার করি সেই ডায়েরীতে সবটা লিখে গেলাম।
আমার প্রিয় পরিবার, তোমাদের সবার অপ্রিয় আমি চলে যাচ্ছি। এখন থেকে আর আমাকে দেখে তোমাদের কারো মুখ কালো হবে না। তোমরা ভালো থেকো। ভালোবাসি তোমাদের। অনেক বেশি ভালোবাসি।
আমার ব্যর্থ ভালোবাসা! তুমি বলেছিলে আমি তোমার যোগ্য না। সেটা মেনে নিয়েই আমি চলে যাচ্ছি। আমি চাই তুমি ভালো থাকো তোমার যোগ্য এবং প্রিয় একজনকে নিয়ে। অনেক অনেক শুভকামনা এবং ভালোবাসা রইলো তোমার জন্য।
আমার প্রিয় প্রতিবেশীরা, আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আপনারা নিজের জন্য ও এত ভাবেননি যতটা আমার জন্য ভেবেছেন। আপনারা আমার যা কিছু জানেন সেটার অর্ধ শতাংশ আমি নিজেই জানিনা। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। আর আমি মারা যাওয়ার পর কাকে নিয়ে উপহাস, হাসিঠাট্টা করবেন এবার সেটা ভাবুন কেমন!
আমার সবচেয়ে কাছের তুই। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মিরা। একমাত্র তুই আমার পাশে ছিলি। একমাত্র তুই আমার মন ভালো করার মেডিসিন ছিলি। সেই তুই ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলি ভুল বুঝে। বিশ্বাস কর, তোর ভালোবাসা আমি তোর থেকে কেড়ে নেইনি। তোর বয়ফ্রেন্ডকে আমি নিজের ভাইয়ের চোখে দেখতাম। কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে এই কথাটা আমি জানতাম না। তবুও আমাকে মাফ করে দিস।
সবশেষে আমার কারোর বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ নেই। আমি একা এসেছিলাম। আর একাই চলে যাবো। আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা রেখেছেন সেটাই পেয়েছি আমি। এতেই আমি সন্তুষ্ট।
আর লিখতে পারছি না। ডায়েরীর পাতাগুলো ভিজে যাচ্ছে চোখের পানিতে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। আমার জীবনের ইতি টানার আগে একটা আক্ষেপ রয়ে গেল। খুব বেশি কিছু চাইনি। শুধু এক মুঠো ভালোবাসা চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আর পেলাম কোথায়!
ভালোবাসা এতটাই দামি যে এক মুঠো ভালোবাসা আমার নিয়তিতে লেখা নেই। ভালো থাকুক আমার চারপাশের সকল মানুষগুলো। ভালো থাকুক আমার প্রিয়জনেরা। ভালো থাকুক আমার ভালোবাসা!
লেখাগুলো পড়ে নিজের অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। আমার বয়ফ্রেন্ড নামক সেই লুজার তো আসলে কাউকেই ভালোবাসেনি। সব ছিল ওর টাইমপাস। এই কথাটা জানতে অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার। ততদিনে ফিহা আর আমাদের মাঝে নেই। হারিয়ে গেছে ঐ দূর আকাশে!
ফিহা মারা যাওয়ার পর সবাই ভেঙ্গে পড়েছে খুব। পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবাই আজ আফসোস করছে। কারণ তারা কেউই ফিহার থেকে মাফ চওয়ার সময় অবধি পায়নি। আমিও তো ওর কাছে মাফ চাইতে পারিনি।
সেই সময়টুকু যে পাইনি আমি। এই অনুতাপ নিয়েই বাঁচতে হবে আমাদের সারাজীবন। ফিহা যাকে ভালোবাসতো সেই আহিলের চোখে আজ পানি। সে চেয়েও আর ফিহাকে পাবে না। কারণ আহিল ফিহাকে ভালোবাসে সেটা বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। আজ সবাই অনুতাপের আগুনে জ্বলছে। কিন্তু ফিহা আর নেই! সে এক মুঠো ভালোবাসার আক্ষেপ নিয়েই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে!
Content source :- FB
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....