"এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি?
আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো!"
--জহির রায়হান(আরেক ফাল্গুন)
বইয়ের নামঃ আরেক ফাল্গুন
লেখকঃ জহির রায়হান
ধরনঃ চিরায়ত উপন্যাস
প্রকাশনীঃ অনুপম প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্যঃ ১২০৳
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৭৮
প্রেক্ষাপটঃ
---------------
'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসটি সরাসরি '৫২ এর প্রেক্ষাপটে না লিখে তার কয়েক বছর পরের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে,কিন্তু '৫২ এর সেই ভাষা আন্দোলন যে তখনো জীবিত তা প্রতিক্ষণেই বোঝা গিয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসটি সময়ের দাবি পূরণে সফল হয়েছে সদর্পে।
লেখক পরিচিতিঃ
------------------------
জহির রায়হান (১৯ আগস্ট ১৯৩৫-৩০ জানুয়ারি ১৯৭২) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক,ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। বাংলা সাহিত্যের অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার,১৯৯২ সালে স্বাধীনতা পুরষ্কার লাভ করেন। তার রচিত প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে। এছাড়াও তার উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাস হলো-হাজার বছর ধরে,আরেক ফাল্গুন।
পাঠ সংক্ষেপঃ
--------------------
বইটিতে ঠিক ১৯৫২ সালের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে তার দুবছর পরবর্তী সময়ের কথা। রক্তের মধ্যে তখন উত্তেজনা, আকাশে বাতাসে রফিক, সফিক, জব্বারের লাশের গন্ধ তখনো ভাসছে। ভাষার জন্যে জীবন দান করেছেন যারা তাদের আত্মত্যাগ এর কোন মূল্যায়নই হয়নি। তখনো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পাইনি। পুলিশের দমন পীড়ন নীতি জোরদার ভাবে চলছে। এখনো তারা মায়ের ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে চায়না। বেয়নেটের আঘাতে দমিয়ে রাখতে চায় সংগ্রামী চেতনাকে। ভাষা আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত তরুন সমাজ কাঠ, শোলা দিয়ে শহীদ মিনার নির্মান করে ভাষা শহীদদের সম্মান জানানোর জন্য। সেই শহীদ মিনার কেও গুড়িয়ে ফেলা হয় স্বৈরাচারী শাসনের কঠিন পদতলে। তখন সেই সংগ্রামী যুব সমাজ মাঠে নেমে এসে। গল্পের শুরুটা অনেকটা এইভাবে, সাদা জামা সাদা প্যান্ট, হাতে বই খাতা। খালি পায়ে যুবকটি চলছে নিঃশব্দে। হঠাৎ দেখায় তাকে পাগল বলে মনে হতে পারে। তড়িঘড়ি করে কোথায় যেন চলছে। কিছুক্ষন পর একজন থেকে দশজন হল তারপর বিশজন, সবার খালি পা। মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে একটি মেয়ে আসছে গায়ে এপ্রন, হাতে স্টেথোস্কোপ, ডাক্তার হবে হয়তো, তারও পা খালি। সব কলেজ, ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নেমে এসেছে। পিছু হটার কোন পথ নেই। এখনই সময়, নয়তো আর কখনোই নয়। খালি পায়ে চলছে একঝাক তরুন তরুনী। তাদের দাবি একটাই ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে হবে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করতে হবে। বায়ান্ন পরবর্তী তরুনসমাজের তখনকার চিত্র গুলো এভাবেই ফুটে উঠেছে বইটিতে। যারা বিভিন্ন উপায়ে শান্তিপূর্ন ভাবে আন্দোলন করে যেতে থাকে, প্রতিবাদ করে যেতে থাকে তাদের দাবি আদায়ের জন্য। কিন্তু তার মাঝে কোন হিংস্রতা নেই, আছে শুধু নিঃশব্দ আকুতি এবং রাজপথ না ছাড়ার দৃঢ় প্রত্যয়। বইটির শেষের দিকে দারুন একটা দৃশ্যপট আছে, যেখানে শয়ে শয়ে তরুন তরুনীকে জেলে ভরে রাখা হয়। এদের সংখ্যা দেখে জেলার বিরক্ত হয়ে ওঠে। তখন তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে ওঠে, “এই দেখেই অতিষ্ঠ হয়ে গেলেন, আসছে ফাল্গুন আমরা তো দ্বিগুন হব”। ফাল্গুনের পর ফাল্গুন যেন ভরে উঠবে পুলিশ স্টেশন গুলো, একটাই দাবিতে তা হলো অস্তিত্বের দাবি।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
----------------------
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে নিহত হওয়া ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করার জন্য ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ছাত্ররা বিদ্রোহ শুরু করে। সেই সময়ের ঐ বিদ্রোহের একটা স্পষ্ট চিত্রই "আরেক ফাল্গুন"। ১৯৫৫ সালেই প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। সেই মানুষগুলো সাধারন জীবনের সকল আনন্দ বেদনা ত্যাগ করেছিলেন নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। উপন্যাসের শেষ লাইনটি যথার্থই ছিল সে সময়ের প্রেক্ষাপটে। "আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুন হব"। পরের অনেক ফাল্গুনেই এ দেশের মানুষ কয়েক হাজারে দ্বিগুন হয়েছিল নিজেদেরকে স্বাধীন করতে।
উল্লেখযোগ্য উক্তিঃ
------------------------
১. 'আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।'
২. 'শহীদের খুন ভুলব না, বরকতের খুন ভুলব না, শহীদ স্মৃতি অমর হোক।'
৩. 'ছেলেটার বোধ হয় কেউ মারা গেছে। তাই শোক করছে খালি পায়ে হেঁটে। কেউ বললো, কে জানে এটা একটা ফ্যাশনও হতে পারে। আজকাল কত রকমের ফ্যাশন যে দেখি।'
ব্যক্তিগত মতামতঃ
-------------------------
কিছু গল্প আছে যা শেষ করার পর মনের ভিতর এক অদ্ভুত রকমের শূন্যতা কাজ করে। আরেক ফাল্গুন এরকম একটি উপন্যাস। দুই রাত আর তিন দিনের এই কাহিনীতে আপনি এক মুহূর্তের জন্য বিরক্তিবোধ করবেন না। শুধু আক্ষেপ করবেন কেন জহির রায়হান আর কিছুদিন আমাদের মাঝে থাকলেন না!
নামকরণের স্বার্থকতাঃ
-------------------------------
নামকরণ নিয়ে বলতে গেলে, যে ফাল্গুনে শহীদ হয়েছিলো ভাষা সৈনিকেরা, দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত সেই ফাল্গুন আসতেই থাকবে। গল্প যেন সেই ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। ৫২ এর পরে ধীরে সেই আন্দোলন ও শহীদদের স্মরণ করা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর সেই ভাবনাকে ধারণ করেই উপন্যাস 'আরেক ফাল্গুন'। ফাল্গুনে ভাষার গল্প বলতে এমন নামকরণের বিকল্প ছিলনা।
বইটির ভালো ও খারাপ দিকঃ
-----------------------------------------
বইটির সবচেয়ে ভালো দিক হলো-পাঠককে আন্দোলনের ইতিহাস নয়,আন্দোলনের ভাষা শিখায় এটি। লেখকের গল্প বলার সাবলীল ভঙ্গিতে চরিত্রগুলো এবং দৃশ্যগুলো অনেক বেশী জীবন্ত মনে হয়েছে।
বইটির কোনো খারাপ দিকই আমার চোখে পড়ে নি।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....