আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক লেখকঃ ইমতিয়ার শামীম

বইয়ের নামঃ আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক 
লেখকঃ ইমতিয়ার শামীম 
রেটিংঃ 🌟🌟🌟🌟
রিভিউ লেখকঃ নাইফা আফরিন অহনা 
আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক  লেখকঃ ইমতিয়ার শামীম



"বন্ধুদের বলি আমি,কুয়াশার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সব ডাকঘরের কথা,বলি গাছের কোটরে আর ডালপালার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা সব ডাকঘরের কথা,বলি সেইসব সংগীতের কথা যা মানুষের জন্য অবিরাম এক সংকেত তৈরি করে,  অবিরাম এক ইতিহাস রচনা করে।  যখন আমরা এসব কথা বলি তখনো বৃষ্টি নামে, তবে টিপটিপিয়ে আর আমরা সেই বৃষ্টি দেখি চঞ্চলের চিলেকোঠার মধ্যে থেকে পাখির ছানার মতো মুখ বাড়িয়ে....." — ইমতিয়ার শামীম, আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক 

♪সারসংক্ষেপঃ
————————
জীবন থেকে প্রিয় কিংবা আপন মানুষ চলে যাওয়া আর হঠাৎ কোথাও নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কি আদৌ এক জিনিস? আমাদের সকলের জীবনে কমবেশি এই দুটো মুহূর্তের আবির্ভাব হয়তে হয়েছে হয়তো বা হয়নি।। প্রিয় মানুষ চিরতরে ওপারে চলে গেলে  আমরা সকলেই তার ঠিকানা জানি আর এ ও জানি সে আর কখন ও ফিরবে না আমাদের মাঝে।  কিন্তু  জলজ্যান্ত একজন মানুষকে হুট করে চোখের সামনে তুলে নিয়ে চলে গেলে অনুভূতিটা কেমন হবে? না জানে যুদ্ধের সময় এমন কত যুবকদের নিজ পরিবারের চোখের সামনে তুলে নিয়ে গেছে তার কোনো হিসেব জানা নেই।  সে চলে যাওয়ার পরের অপেক্ষার প্রহর  এবং ধীরে ধীরে মনে এক কোণে সে অপেক্ষা পুষে স্বাভাবিক জীবনের অভিনয় বা স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টা কেমন।  এবং এরকম নির্মম সময়কার আরো কিছু কথা লেখক বই টির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।  

উপন্যাসটি শুরু হয়, সামরিক বাহিনীর নির্মমতা দিয়ে।  হুটকরে একদিন শহরের এক বাড়ির জোয়ান ছেলেকে পরিবারের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়।  এরকম ভাবে সামরিক বাহিনী আরো কয়েকঘরের সুস্থ সবল জোয়ান ছেলেদের তুলে নিয়ে যায়।  যাদের আর ফেরার পথের কোনো দিশপিশ থাকে।  আদৌ বেঁচে আছে নাকি তা জানার উপায় থাকে না।  থাকে শুধু অপেক্ষা।  ঠিক একই ভাবে ভীষণ বড় অপেক্ষার সুতো হাতে ধরিয়ে সামরিক বাহিনী গল্প কথকের বড় ভাইকে তুলে নিয়ে যায়।  আর রেখে যায় অনন্তকাল পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত একটুকরো সুতো।।  আর স্মৃতি।  পুরো দেশ জুড়ে সামরিক বাহিনীর নির্মমতায় মানুষের জীবন তখন যাযাবরের মতো হয়ে গিয়েছিল।  প্রায় রাতে রেলস্টশনে কুউউ ঝিকঝিক আওয়াজ করে আসা ট্রেনে নতুন চেহারা দেখতে পাওয়া যেত। এভাবেই একদিন সেই ট্রেনে চড়ে আসে স্নেহা আর তার পরিবার।।  আচ্ছা, গল্পকথকের ভাই কি আর কখনও ফিরে আসবে? গল্পকথক তার হারানো ভাইকে কখন ভুলতে পারবে? সদ্য তরুণে পদার্পণ করা গল্পকথক আর স্নেহার মধ্যে কি কোন সম্পর্ক আদৌ আছে নাকি স্নেহা শুধু গল্পের কয়েক লাইন মাত্র? 

♪পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ 
————————
বহুদিন পর আমি কোনো বই পড়ে শেষ করলাম।  বইটা পড়া শুরু করার পর কোনো অজানা কারণে আমি কাহিনী ধরতে পারছিলাম না।  মনে হচ্ছিল খুব এলোমেলো।  এক কাহিনী থেকে লাফ দিয়ে অন্য কাহিনী চলে যাচ্ছে এমন মনে হচ্ছিল।  যার কারণে আমি এক বসায় পড়তে পারি নি।  তবে আবার ধৈর্য্য ধরে বই পড়া শুরু করলে ধীরে ধীরে উপন্যাসে ডুব দেই।  

উপন্যাসটিতে লেখক সামরিক বাহিনীর নির্মমতার কথা তুলে ধরেছেন।  তুলে ধরেছেন সামরিক বাহিনী সন্তান তুলে নিয়ে যাওয়ার পর একটি পরিবারের অপেক্ষার প্রহর।  তুলে ধরেছেন  সহজ সরল মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত মানুষদের উত্তেজনা কে। উপন্যাসটিতে লেখক গল্পকথক আর তার বন্ধুদের সম্পর্ককে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।  আছে সদ্য তরুণে পদার্পণ করা ছেলে মেয়েদের সে নির্মম সময়ের ভালোলাগা -ভালোবাসার অনেক কথা।  আর আছে চিঠিযুগ।  হ্যাঁ চিঠিযুগ, মোবাইল ল্যান্ডফোন ছাড়া ও এক সময়কার অপেক্ষমান শুদ্ধ তম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল এই চিঠিযুগ।। যার আদান প্রদান শুধু ডাকঘর নয়, আরো অনেক মাধ্যম যেমন ফুলের টব,  বন্ধু বান্ধবী,  কাগজের প্লেন ইত্যাদি।  উপন্যাসটিতে সেই চিঠিযুগের ছোঁয়া প্রতিপৃষ্ঠায় বিদ্যমান আছে। 

♪ভালো লাগা লাইনঃ 
——————————
★পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো কল্পনা করার ক্ষমতা ছিল কেবল ওই মানুষটির, যে নাকি বলে গেছে, মা মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়, বাবা মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়, প্রিয়মানুষ মরে গিয়ে তারা হয়ে যায়,তারপর আকাশের কোণে সবচেয়ে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে জ্বলতে থাকে,আর তুমি যদি তাকে সত্যি ভালোবাসো,তা হলে রাতে আকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাবে তাকে....
★তারপর আবারও আমাদের চিঠিযুগ ফিরে আসে। চিঠিযুগ ফিরে আসে অনবিচ্ছিন্ন কুয়াশার ফোঁটা হয়ে,চিঠিযুগ ফিরে আসে শিশিরভেজা পথের মধ্য দিয়ে।  যেন হঠাৎ ই দেখা হয়েছে আমাদের ঘন কুয়াশায়, তেমন কোনো পরিচয় ও নেই,কিন্তু আমরা একটু থামি,একজন আরেকজনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেই,চিঠি নেই,চিঠি দেই। তারপর আমরা আবারও অচেনা হই,সামান্য পরিচিত প্রতিবেশী হই এবং...
★এদিকে কুয়াশার মতো ডাকঘরটা ততদিনে মিলিয়ে গেছে আর বসন্তের উজ্জ্বল আলোতে হলুদ হতে শুরু করেছে আমাদের বিলি না হওয়া চিঠি।  আমরা আতঙ্কিত, কবে কোন পলকা হওয়াতেই সব চিঠি ঝরে পড়বে,উড়তে থাকবে ছিমছাম শহরের পথে পথে।
★আরও একটু পর আমরা জানতে পারি, ক্রসফায়ারে একজন মারা গেছে। কেননা ক্রসফায়ারেই মারা যেতে হয়। কেননা ক্রসফায়ারই গন্তব্য আমাদের সকলের।
আমি আমাদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করি,আরও এক বড়ভাই মারা গেল হয়তো। হয়তো আরও এক রূপকথা লেখা হলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ