গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ১৪তম পর্ব ©মারুফ হুসাইন

গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া

১৪তম পর্ব
©মারুফ হুসাইন
ফোনের রিংটোনে শরিফুলের ঘুম ভাঙ্গে। নূহার কল। সে ঘুম চোখে কল রিসিভ করে, 'হ্যালো!'
'কোথায় আপনি?'
'মেসে, ঘুমুচ্ছি৷'
'ঠিক আছে৷ দ্রুত উঠুন। আমি আপনার মেসের সামনেই আছি। তাড়াতাড়ি আসেন!'
শরিফুল বিরক্ত হয়, 'এতো সকালে এখানে কেন এসেছেন?'
'ইচ্ছা হয়েছে, এসেছি। আপনি দ্রুত আসুন!' বলে নূহা ফোন কেটে দেয়।
শরিফুল উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যায়। গলি পার হয়ে রাস্তায় উঠতেই নূহার গাড়ি দেখতে পায়। সেখানে এগিয়ে যায়।
গাড়ির গেট খুলে ভিতরে বসে৷ নূহা স্কুল ড্রেসে বসে আছে।
'এতো সকালে কেন এসেছেন?'
'স্কুলে প্রোগ্রাম আছে। প্রোগ্রাম শেষে আম্মুকে দেখতে যেতে হবে। তাই ভাবলাম, এখনি দেখা করে যাই।'
'তাই বলে আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে!'
'একদিন ঘুম নষ্ট হলে কিছু হয় না।' বলেই শহিদের দিকে তাকায়, 'শহিদ ভাই! কোনো রেস্টুরেন্টে যান। কিছু খেতে হবে। তাড়াতাড়ি যান। ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র পয়তাল্লিশ মিনিট আছে।'
'এখন আবার খেতে যেতে হবে কেন?'
'আপনার সাথে ব্রেকফাস্ট করতে ইচ্ছে করেছে তাই।'
খাওয়া-দাওয়া শেষে শরিফুল বিল দিতে যায়। কিন্তু বিল পেইড। সে গাড়ি থেকে নামার পর নূহা কয়েক মূহুর্ত দেরী করে নেমেছে। তখন শহিদের হাতে টাকা দিয়ে তাকে খেয়ে নিতে বলেছে এবং তাদের খাওয়া শেষে বিল পে করে দিতে বলেছে। তাই তারা খাবার শেষ করে উঠার আগেই শহিদ বিল পে করে রেখেছে।
শরিফুল বিরক্ত হয়। এই মেয়েটা কখনোই তাকে বিল দিতে দেয় না৷ হয়তো তার অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝে বলেই দেয় না। কিন্তু তার আত্মসম্মানে বাধে৷ গাড়িতে উঠে বলে, 'এমন হলে আমি আর কখনোই আপনার সাথে কোথাও খেতে যাব না। এবং কোথাও যাবও না!'
'শহিদ ভাই! আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে উনাকে উনার মেস অবধি পৌছে দিবেন!' শরিফুলের কথা বুঝতে পেরেও এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নূহা শহিদকে উদ্দেশ্য করে বলে।
'আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?'
'কেমন করলে?'
'এভাবে প্রতিবার বিল দিয়ে দিলে আমার আত্মসম্মানে বাধে। তাই চাচ্ছি, আপনি আর এমনটা করবেন না।'
'দেখা যাবে।'
'দেখা যাবে বললে আমি আর আপনার সাথে কোথাও যাব না৷'
'ঠিক আছে, আপনিও মাঝে মধ্যে দিয়েন।' বলে নূহা পাশ থেকে তার স্কুল ব্যাগটা উঠিয়ে নেয়।
স্কুলের কাছাকাছি চলে এসেছে৷ নূহা স্কুল ব্যাগ থেকে একটা ওয়ানটাইম ব্যাগ বের করে শরিফুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে দিয়ে বলে, 'এটা আপনার জন্য!'
'কী এটা?' ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে।
'ছোট্ট একটা গিফট!'
'আমি নিব না।'
'কেউ ভালোবেসে কিছু দিলে না করতে নেই৷'
'কিন্তু আমি করছি। এটা আমি নিতে পারব না।'
'দামি কিছু না। আপনি নিতে পারেন!' ততক্ষণে স্কুলের সামনে এসে গাড়ি থেমে গেছে৷ নূহা ব্যাগটা শরিফুলের হাতে ধরিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত স্কুলে ঢুকে যায়। শরিফুলকে কিছু বলার সুযোগ দেয় না। শহিদ এক্সিলেটরে চাপ দেয়।
শরিফুল ভেবে পায় না, গিফটটা নিবে কিনা! না নেয়ার কথাই ভাবে। আবার মনে হয় নূহা ঠিকই বলেছে, ভালোবেসে কেউ কিছু দিলে না করতে নেই৷ তাই একবার ভাবে নিয়ে যাবে। দোটানায় থেকেই শরিফুল র্যাপিং খুলে ফেলে। একটা মোবাইল বেরিয়ে আসে। সে এবার দোটানা থেকে নিশ্চিত হয়ে যায়, গিফটটা সে নিচ্ছে না। কম দামি কিছু হলে নেয়া যেত। কিন্তু এতো দামি গিফট সে নিতে পারে না।
'শহিদ ভাই! নূহা আসলে বলবেন, গিফটটা আমি নেইনি। এতো দামি গিফট আমি নিতে পারব না।' মেসের কাছাকাছি এসে গাড়ি থেকে নামার সময় শরিফুল শহিদকে বলে গাড়ি থেকে নেমে যায়।
নূহার স্কুল থেকে বের হতে হতে বিকেল হয়। গাড়িতে উঠে বসেই ওয়ানটাইম ব্যাগটা দেখতে পায়, 'শহিদ ভাই! উনি এটা নেয়নি?'
'না৷ বলল এতো দামি গিফট সে নিতে পারবে না।'
'ঠিক আছে, হসপিটাল চলুন!'
নূহার আম্মার অবস্থার অবনতি হয়েছে৷ মায়ের কাছে বসতেই তার খারাপ লাগে, দুঃখ হয়। মায়ের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো৷ হাতে সেলাইনের নল।চোখ বন্ধ৷ নূহা উনার নল লাগানী হাতের উপর হাত রাখে৷ বলে, 'আম্মু জানো আমি প্রেমে পড়েছি।'
'কার প্রেমে?' নূহা চেয়েছিল মা তাকে এমন একটা প্রশ্ন করুক। কিন্তু উনি এমন কিছু করলেন না। আগের মতোই চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।
'কিন্তু জানো, এই লোকটা কত পাষাণ। সে দেখে আমি তার জন্য পাগল হয়ে আছি। তার সঙ্গ চাই৷ তাকে চাই৷ কিন্তু এই পাষাণ লোক আমাকে এড়িয়ে চলতে চায়৷ আমার জোরাজুরিতে আমার সাথে থাকলেও আমার জন্য তার মন একটুও গলে না। কেমন শক্ত শক্ত হয়ে থাকে।' নূহা থামে। সে মায়ের মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়৷ কিন্তু উনি কিছুই বলেন না৷ আগের মতোই চুপচাপ শুয়ে থাকেন। নূহার কান্না চলে আসে। সে বুঝতে পারে না, এই কান্না কিসের জন্য৷ মায়ের এমন অবস্থার জন্য নাকি তার প্রতি শরিফুলের যে উদাসীনতা তার জন্য!
নূহা হসপিটাল থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠে শরিফুলকে ফোন দেয়, 'কোথায় আপনি?'
'কেন?'
'আপনি গিফটটা নেননি কেন?'
'নিতে ইচ্ছে করেনি তাই৷'
'কোথায় আছেন বলেন! আমি আসছি!'
'বলতে পারব না৷'
'ঠিক আছে, আপনার বলতে হবে না। আমি আপনার মেসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।'
শরিফুল জানে, এই মেয়ে এই কাজই করবে৷ তাই তার লোকেশন বলে দেয়াটাই ভালো হবে।
গিফটটা না নিয়ে শরিফুল আর কোনো উপায় পায়নি। নূহার পাগলামির কাছে তার হার মানতে হয়েছে৷ নূহা নিজেই শরিফুলের মোবাইল টেনে নিয়ে সিম চ্যাঞ্জ করে আগের মোবাইলটা ফেলে দিয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'এটা ফেলছেন কেন?'
'এই নষ্ট মোবাইল রেখে কী করবেন!'
আসলেই কিছু করার নেই৷ তাই সে আর কিছু বলতেও পারেনি৷ শরিফুল গিফটটা নেয়ায় নূহার রাগ, অভিমান একদম মিইয়ে গেল৷ সে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু শরিফুল মুখ কালো করে বসে আছে। নূহা দুষ্টুমি করে তাকে হাসানোর চেষ্টা করছে৷ তাকে খোঁচাচ্ছে৷ শরিফুল বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু নূহার চঞ্চলতায় সে তার কালো মুখ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না৷ সে হাসতে বাধ্য হলো।
চলবে.......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ