বইঃ নানকার লেখকঃ দীপু মাহমুদ

বইঃ নানকার
লেখকঃ দীপু মাহমুদ
প্রকাশনীঃ কিংবদন্তী পাবলিকেশন
ধরণঃ ঐতিহাসিক উপন্যাস
সারসংক্ষেপ:
সুনাই আম গাছের ডালে দড়ি বেধে ফাঁসি দিয়েছে। জমিদার মস্তই মিয়া এবং তার ছোট ভাই কস্তই মিয়ার কাছে নির্যাতিত সুনাই। এ কথা জেনেও প্রতিবাদ করার মতো শক্তি কারো নেই। তাদের কাছে নানকার জমিদারের কথায় শেষ কথা। সুনাই হায়াত মাইলের মেয়ে। হায়াত মাইমল নানকার, সবকিছু জেনেও তাদের চুপ থাকতে হয়। চুপচাপ অত্যাচার সহ্য করার এই পরম্পরা পূর্বপুরুষ থেকে বয়ে এসেছে। সব কিছু জেনেও প্রতিবাদ করতে পারে না জমিদারের কাছে । নানকাররা দিনের পর দিন শোষিত, নির্যাতিত হতে থাকে জমিদারের কাছে। ততকালীন সিলেটের সানেশ্বর অঞ্চলের জমিদার মস্তই মিয়া। সানেশ্বর অঞ্চলে নানকারদের বসবাস। নানকার বলতে বুঝায়, যারা রুটির বিনিময়ে কাজ করতো তাদের। তখন জমিদারি আমল। নানকাররা ছিলো নিচু শ্রেনীর। জমিদার কখনোই তাদের মানুষ বলে গণ্য করতো না, তাদের থাকার জন্য সামান্য পরিমান জমি আর চাষের জন্য নানজমি দেওয়া হতো, তাছাড়া তাদের আর কিছুই ছিলো না। নান জমিতে যে চাষ করতো তা দিয়ে জমিদারের চাহিদা মিটিয়ে তারা চলার মতো কিছু অবশিষ্ট ও থাকতো না। তাদের জীবন ছিলো হুকুমের, হদবেগারীর। জমিদারের সামনে কথা বলার অধিকার কোন নানকারের নেই। যুগ যুগ ধরে চলে আসা বংশপরম্পরায় নানকাররা ছিলো জমিদারের । নির্যাতনের মাত্রা এতটাই ভয়ানক ছিলো যে, নানকার বাড়িতে কেউ মারা গেলে লাশ উঠানে থাকা অবস্থায় যদি জমিদার ডাক দেয় তবে লাশ উঠানে রেখেই জমিদারের কাছে যেতে হতো। সে ডাকে সাড়া না দিলে তার জন্য অপেক্ষা করতো ভয়ানক শাস্তি। নানকারের নিজস্ব বলে কিছু ছিলো না। সব চলতো জমিদারের কথায়, যখন যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করতো নানকারদের। একসময়, নানকাররা অত্যাচার আর বিভৎস জীবন থেকে নিজেদের রক্ষা এবং জমিদারের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মুখিয়ে উঠলো। বিশুর জমিদার মস্তই মিয়ার ভাই কস্তই মিয়াকে পেটানো একক বিদ্রোহ থেকে শুরু হলো, নিজেদের অধিকার আদায়ের দাসত্ব থেকে মুক্তির বিদ্রোহ। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো গ্রাম থেকে গ্রামে। বিদ্রোহ রূপ নিলো বিপ্লবে। নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে শুরু করলো। গঠন করলো কৃষক সমিতি। তারা সিন্ধান্ত নিলো, জমিদারের আদেশে বেগার খাটবে না তারা, জমির ফসল জমিদারের গোলায় যাবে না, জমিদারের ডাকে সাড়া দিবে না। নানকারদের জীবনে সৃষ্টি হলো মুক্তির চিন্তা, নানকারদের সংগঠিত করার জন্য নইমউল্লা, মোহিত কিরাণ, ভ্রমর, গগন দাস, রজনী দাস, হায়াত মাইমল, হামিদ আলী, তকল মোল্লা সহ সকলে মিলে আলোচনা করলো। নানকাররা সংগঠিত হলো, তাদের সমর্থন দিলো কমিউনিস্টরা। পাড়ায় পাড়ায় নানকাররা সংগঠিত হলো। আন্দোলন ছড়িয়ে পরলো, তারা দাবি তুললো, নানকার প্রথার পুরোপুরি উচ্ছেদ করতে হবে। জমিদারি জোর-জুলুমের অবসান করতে হবে। জমিদারি উপঢৌকনের অবসান ফসলের খাজনা আদায় বন্ধ করতে হবে। জোত-জমি থেকে প্রজা উচ্ছেদ এর সবরকম আইন বাতিল করতে হবে। নানকাররা আর জমিদারে সব ধরনের খাজনা এবং জমিদারের হাটে পন্য তোলা বন্ধ করে দিয়ে, নিজেরা হাট বসিয়ে সেখানে বেচা-বিক্রি শুরু করলো। তারা বুঝতে পেরেছে যতদিন তারা জমিদারের অত্যাচার সইবে, ততদিন তারা নিজেদের জীবনের পরাজয় নিয়ে চলতে হবে। এই আন্দোলনের পরিনতি হলো বিদ্রোহে। জমিদার মস্তই মিয়া নিজের জমিদারি ও নানকার বিদ্রোহ ঠেকাতে নিজে অপকর্ম করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দোষ চাপিয়ে দিলো নানকারদের উপর। নানকাররা কৃষক সমিতির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়ে পুলিশের সহায়তায় তাদের নির্যাতন করতে শুরু করলো। জমিদার ও পুলিশ মিলে নানকারদের উপর জোর জুলুম আরও বাড়িয়ে দিলো। নানকাররা তা বরদাস্ত করলো না, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়লো, পুলিশের গুলিতে নানকারদের রক্তে লাল হয়ে গেল সুনাই নদী। নানকাররা তাদের অধিকার আদায়ে নিজের জীবনে বিলিয়ে দিলো। এভাবেই নিজেদের অধিকার আদায় করে প্রথার অবসান করলো তারা।
পাঠক প্রতিক্রিয়া:
আমি যখন নবম শ্রেনীতে উঠলাম তখন থেকেই ইতিহাসের প্রতি আমার আলাদা একটা টান ছিলো। ইতিহাস নিয়ে পড়তে ভালো লাগে, এ পর্যন্ত আমার একাডেমিক শিক্ষা ইতিহাস নিয়ে। নানকার পড়ার আগে ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ, বলশেভিক বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব সহ অনেক ইতিহাস পরেছি, রাশিয়ায় জারদের হটিয়ে শ্রমিক শ্রেনীর অধিকার আদায় জেনেছি। অতীতে পড়া ইতিহাসের আগ্রহ নিয়ে নানকার পড়া ইচ্ছে প্রবল হয়েছিলো। নানকার বইটা হাতে পেয়েছি বেশ কিছুদিন, ফেসবুকে কিংবদন্তী পাবলিকেশন গ্রুপ থেকে নানকার বইয়ের কিছু কিছু অংশ পরে মনে আগ্রহ জেগেছিলো কবে বইটা পড়বো। আজ বইটি শেষ করে লিখছি, নানাকার শুধু ইতিহাস নয় এটা ঐতিহ্য, ইতিহাসের প্রতিফলন। যাদের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ বেশি জমিদারি আমল ও সেই সময়ের জীবন মান সম্পর্কে জানার ইচ্ছে অধির, তারা নানাকার পরতে পারেন। নিঃসন্দেহে নানকার একটা সেরাদের সেরা উপন্যাস। বইটিতে ভাষাগত দিকটি এমন সুন্দর এবং সাবলীল ভাবে লেখক প্রকাশ করেছে, যে কেউ খুব সহজেই বুঝতে পারবে।
এছাড়াও বইটিতে মুনাই ও বিশুর প্রেম কাহিনী আপনাকে সামনে টানবে। মুনাই এবং বিশুর প্রেম কাহিনী বইটিতে যোগ করেছে আলাদা ভাব। যা পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। এই প্রেম কাহিনি এই উপন্যাসের একটা স্তম্ভ। নানাকার উপন্যাস দীর্ঘ কিন্তু যখন শুরু করবেন কখন শেষ হয়ে যাবে বুঝতেই পারবেন না, প্রতিটা লেখা সামনে টানবে আপনাকে।
বাইন্ডিং:
বইটির প্রডাকশন নিয়ে বলার কিছু নেই। হাতে নিলেই বুঝবেন কতটা মানসম্মত। প্রথম সারির প্রডাকশন, কালি পেজ কভার সব কিছু অসাধারণ। ধন্যবাদ কিংবদন্তী পাবলিকেশন কে এত সুন্দর প্রডাকশন করার জন্য। বইটি আপনারা কিংবদন্তী পাবলিকেশন এবং রকমারি থেকে ও সংগ্রহ করতে পারবেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ