পালিয়ে বিয়ে বৈধ, নাকি অবৈধ !-মাহমুদ বিন নূর

পালিয়ে বিয়ে বৈধ, নাকি অবৈধ-
লেখক ~ মাহমুদ বিন নূর

image from facebook


পালিয়ে বিয়ে করা। অর্থাৎ, অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক যুবক-যুবতী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ, নাকি অবৈধ—এ ব্যাপারে ব্যাপক মতানৈক্য রয়েছে। তবে, অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যাবে—এই মতটি বেশি প্রাধান্য প্রাপ্ত।
কেননা, যদি দু'জন প্রাপ্ত বয়স্ক আকলমন্দ সাক্ষ্যির সামনে, প্রাপ্ত বয়স্ক বিবাহের উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী একজন প্রস্তাব দেয় এবং অপরজন তা গ্রহণ করে নেয়, তাহলে ইসলামী শরীয়া মুতাবিক বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যায়। অভিভাবকের সম্মতি থাকুক বা না-থাকুক। অভিভাবক জানুক বা না-জানুক। তবে, যদি গায়রে কুফুতে বিবাহ করে, তথা এমন পাত্রকে বিবাহ করে, যার কারণে মেয়ের পারিবারিক সম্মান বিনষ্ট হয়, তবে অভিভাবক সে বিয়ে আদালতের মাধ্যমে ভেঙ্গে দিতে পারে। যদি কুফুতে বিবাহ করে, তাহলে পিতা এ- অধিকারও পায় না।
অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে নিম্নে কিছু হাদিস পেশ করলাম...
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ؛ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم، قَالَ: «الْأَيِّمُ أَحَقُّ بِنَفْسِهَا مِنْ وَلِيِّهَا.
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত: রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, মেয়ে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে অভিভাবকের চেয়ে অধিক হকদার।( ১)
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ قَالَ: ” جَاءَتِ امْرَأَةٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّ أَبِي وَنِعْمَ الْأَبُ هُوَ، خَطَبَنِي إِلَيْهِ عَمُّ وَلَدِي فَرَدَّهُ، وَأَنْكَحَنِي رَجُلًا وَأَنَا كَارِهَةٌ. فَبَعَثَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى أَبِيهَا، فَسَأَلَهُ عَنْ قَوْلِهَا، فَقَالَ: صَدَقَتْ، أَنْكَحْتُهَا وَلَمْ آلُهَا خَيْرًا. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا نِكَاحَ لَكِ، اذْهَبِي فَانْكِحِي مَنْ شِئْتِ
হযরত সালামা বিনতে আব্দুর রহমান রাযি. থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, একদা এক মেয়ে রাসূল সা. -এর কাছে এল। এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা! কতইনা উত্তম পিতা! আমার চাচাত ভাই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল আর তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। আর এমন এক ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছেন যাকে আমি অপছন্দ করি। এ ব্যাপারে রাসূল সা. তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলে পিতা বলে, মেয়েটি সত্যই বলেছে। আমি তাকে এমন পাত্রের সাথে বিয়ে দিচ্ছি যার পরিবার ভাল নয়। তখন রাসূল সাঃ মেয়েটিকে বললেন, “এ বিয়ে হবে না, তুমি যাও, যাকে ইচ্ছে বিয়ে করে নাও”।( ২)
– حَدَّثَنَا حُسَيْنٌ، حَدَّثَنَا جَرِيرٌ، عَنْ أَيُّوبَ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: ” أَنَّ جَارِيَةً بِكْرًا أَتَتِ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَذَكَرَتْ أَنَّ أَبَاهَا زَوَّجَهَا وَهِيَ كَارِهَةٌ فَخَيَّرَهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ”
إسناده صحيح على شرط البخاري.
হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত: জনৈক কুমারী মেয়ে রাসূল সা. -এর কাছে এসে বলল, আমার পিতা আমার অপছন্দ সত্বেও বিয়ে দিয়েছে, তখন রাসূল সা. সে মেয়েকে ইখতিয়ার দিলেন। (৩)
عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: جَاءَتْ فَتَاةٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَتْ: ” إِنَّ أَبِي زَوَّجَنِي ابْنَ أَخِيهِ، لِيَرْفَعَ بِي خَسِيسَتَهُ، قَالَ: فَجَعَلَ الْأَمْرَ إِلَيْهَا، فَقَالَتْ: قَدْ أَجَزْتُ مَا صَنَعَ أَبِي، وَلَكِنْ أَرَدْتُ أَنْ تَعْلَمَ النِّسَاءُ أَنْ لَيْسَ إِلَى الْآبَاءِ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ “
হযরত বুরাইদা রাযি. থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, জনৈক মহিলা নবীজী সা. -এর কাছে এসে বলল, আমার পিতা আমাকে তার ভাতিজার কাছে বিয়ে দিয়েছে, যাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। রাবী বলেন, তখন রাসূল সা. বিষয়টি মেয়ের ইখতিয়ারের উপর ন্যস্ত করেন, [অর্থাৎ ইচ্ছে করলে বিয়ে রাখতেও পারবে, ইচ্ছে করলে ভেঙ্গেও দিতে পারবে] তখন মহিলাটি বললেন, আমার পিতা যা করেছেন, তা আমি মেনে নিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, মেয়েরা যেন জেনে নেয় যে, বিয়ের ব্যাপারে পিতাদের [চূড়ান্ত] মতের অধিকার নেই্। (৪)
উপরোল্লিখিত হাদীস ছাড়াও আরো এমন অনেক হাদীস রয়েছে, যা দ্বারা প্রমাণিত হয়—বিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবক নয়; প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে পিতা বা অভিভাবকের হস্তক্ষেপের অধিকার নেই। এটা ইমাম আবু হানিফা সহ, হানাফী মাযহাবের সমস্ত উলামায়ে কেরামের নির্ভরযোগ্য মতামত।
_________________
অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত বিবাহ শুদ্ধ হবে না— এ ব্যাপারে কতক ইমাম ও স্কলার একমত পোষণ করেন। তাদের স্বপক্ষে তারা বিভিন্ন দলীল উপস্থাপন করেন।
তাদের দলীল....
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَيُّمَا امْرَأَةٍ نَكَحَتْ بِغَيْرِ إِذْنِ مَوَالِيهَا، فَنِكَاحُهَا بَاطِلٌ»، ثَلَاثَ مَرَّاتٍ «فَإِنْ دَخَلَ بِهَا فَالْمَهْرُ لَهَا بِمَا أَصَابَ مِنْهَا، فَإِنْ تَشَاجَرُوا فَالسُّلْطَانُ وَلِيُّ مَنْ لَا وَلِيَّ لَهُ»
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত: রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, যে মহিলাকে তার অভিভাবক বিয়ে দেয়নি, তার বিয়ে বাতিল, তার বিয়ে বাতিল, তার বিয়ে বাতিল। এরপর স্বামী যদি তার তার সাথে মিলামিশা করে তবে সে মহরের অধিকারী হবে স্বামী তার সাথে [হালাল পদ্ধতিতে] মেলামেশা করার কারণে। আর যদি তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে যার অভিভাবক নেই, বাদশাই তার অভিভাবক বলে বিবেচিত হবে। (৫)
{সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৮৭৯, সুনানে তিরামিজী, হাদীস নং-১১০২, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৮৭৯}
এই হাদীসের ব্যপারে মন্তব্য...
ইমাম বুখারী রহি. বলেন, হাদীসটি মুনকার। {আলইলালুল কাবীর-২৫৭}
ইমাম তাহাবী রহি. বলেন, হাদীসটি ফাসিদ। {শরহু মাআনিল আসার-৩/৭}
এই হাদীসের ব্যপারে উলামায়ে কেরামের জবাব...
জবাব নং ১
হযরত আয়শা সিদ্দিকা রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীসের ব্যপারে ইমাম বুখারী রহি. থেকে মুনকার হওয়ার এবং ইমাম তাহাবী রহি. থেকে ফাসিদ হওয়ার কালাম রয়েছে। পক্ষান্তরে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে বৈধ, তাদের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন, সহীহ মুসলিম ও মুয়াত্তা মালিকের বর্ণনাটি সহীহ। তাই, তাদের মত প্রাধাণ্যপ্রাপ্ত হবে।
জবাব নং-২
এ হাদীস দ্বারাই বুঝা যাচ্ছে—এখানে বিবাহ বাতিল হয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়। কারণ হাদীসের শেষাংশে বলা হচ্ছে, স্ত্রী মহরের অধিকারী হবে। যদি বিবাহ শুদ্ধই না হতো, তাহলে মোহর আবশ্যক হওয়ার কথা আসছে কেন? মোহর তো বিবাহের মাধ্যমে আবশ্যক হয়। বিবাহ ছাড়া আর্থিক জরিমানার জন্য ব্যবহৃত হয় আরবী عقرا শব্দ। অথচ এখানে ব্যবহৃত করা হয়েছে, মোহর শব্দ। যা বিবাহের সাথে খাস। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে—এখানে আসলেই বিবাহ বাতিল হয়ে যায়, এটি উদ্দেশ্য নয়। বরং, ধমকী দেয়া উদ্দেশ্য। যেন অভিভাবকদের না জানিয়ে মেয়েরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়।
জবাব নং ৩
أَنَّ عَائِشَةَ، زَوْجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، زَوَّجَتْ حَفْصَةَ بِنْتَ عَبْدِ الرَّحْمنِ، الْمُنْذِرَ بْنَ الزُّبَيْرِ. وَعَبْدُ الرَّحْمنِ غَائِبٌ بِالشَّأْمِ.
প্রশ্নে উল্লেখিত অভিভাবক ছাড়া মহিলা কর্তৃক বিয়ে সম্পন্ন না হওয়ার হাদীসটি হযরত আয়শা সিদ্দিকা রা. -এর। অথচ, খোদ আয়শা রাযি. তার ভাই আব্দুর রহমানের মেয়ে হাফসাকে তার অভিভাবক আব্দুর রহমানকে ছাড়াই নিজে বিয়ে দিয়েছিলেন, মুনজির বিন যুবায়েরের সাথে। (৬)
সুতরাং বুঝা গেল যে, উক্ত হাদীস দ্বারা খোদ বর্ণনাকারী হযরত আয়শা রাযি. বিবাহ শুদ্ধ হয় না—এটা বুঝাননি; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, অভিভাবক ছাড়া বিয়ে অসম্পূর্ণ হয়।
কারণ, যে অভিভাবক মেয়েকে লালন পালন করল, তাকে না জানিয়ে বিয়ে করাটাতো অসম্পূর্ণই। তাই বলা হয়েছে তা বাতিল। বাতিল মানে অসম্পূর্ণ।
যাহোক, অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ শুদ্ধ হবে না—এক পাক্ষিক এটা বলা ঠিক নয়। কেননা, বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অসংখ্য দলিল রয়েছে। আর শুদ্ধ হওয়ার মতই প্রাধাণ্যপ্রাপ্ত।
এই মাস'আলাটা এখতেলাফ পূর্ণ। আর এখতেলাফি বিষয়ে একপাক্ষিক আলোচনা করা মোটেও ঠিক নয়। আমি এখানে উভয় পক্ষের মতামত এবং দলিল উপস্থাপন করেছি এবং প্রাধাণ্যপ্রাপ্ত মতামতও খণ্ডন সহকারে উল্লেখ করেছি।
বি: দ্র: এই পোস্টে পালিয়ে বিয়ে করার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়নি! এখানে মূল মাস'আলাটা বর্ণনা করা হয়েছে— অভিভাবক ছাড়া বিয়ে হবে, নাকি হবে না।
__________________________________________
১/ মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৮৮৮,
২/ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-১৫৯৫৩
৩/ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৪৬৯
৪/ সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৮৭৪
৫/ সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৮৭৯
৬/ তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-৪২৫৫
|| পালিয়ে বিয়ে বৈধ, নাকি অবৈধ!|
লেখক ~ মাহমুদ বিন নূর

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ