গল্প: গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ৭ম পর্ব ©মারুফ হুসাইন

গল্প: গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া
৭ম পর্ব
©মারুফ হুসাইন
নূহা ফোন রেখে দেয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আরেকবার নিজেকে দেখে নেয়৷ শাড়িটা ঠিক করে। অনেক ছোটবেলা থেকেই সে শাড়ি পরতে পারে। মায়ের কাছ থেকে শাড়ি পরা শিখেছিল৷ মা শাড়ি পরতে পছন্দ করত বলে মায়ের আলমারি ভরতি শাড়ি ছিল৷ সে প্রায় সেগুলা পরার চেষ্টা করত। কিন্তু পারত না। তখনি মা ধীরে ধীরে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
সে নিজেকে আরেকবার ভালো করে দেখে নিয়ে ড্রাইভারকে ফোন দেয়, 'শহিদ ভাই! গাড়ি বের করেন।'
'কোথায় যাবেন আপা?' শহিদ জিজ্ঞাসা করে।
'একটু বের হবো। আপনি গাড়ি বের করেন।'
'ঠিক আছে৷'
'আর বাবা জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, বন্ধুবীর সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছি।'
'ঠিক আছে।'
নূহা ফোন রেখে আবার আয়নায় নিজেকে দেখে। কপালের টিপটা ঠিক করে নেয়।
শহীদ মিনারের সামনে গাড়ি থামিয়ে নূহা নেমে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শরিফুলকে ফোন দেয়। ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে ভেসে আসে, 'আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।'
নূহা আবার ডায়াল করে। এবারো একই ফলাফল। মোবাইল বন্ধ কেন, সে বুঝতে পারে না৷ লোকটা আবার কোনো ঝামেলায় পড়ল কিনা ভেবে তার চিন্তা হয়৷ বুঝতে পারে না, যে লোকের সাথে তার তেমন কোনো সম্পর্কই হয়ে উঠেনি, তার জন্য এমন চিন্তা হচ্ছে কেন! না চিন্তার কোনো কারণ নেই। সে হয়তো ইচ্ছা করেই ফোন বন্ধ করে দিয়েছে৷
'আপা! আমরা কি এখানেই দাঁড়াব?' শহিদ গাড়ি থেকে নেমে নূহার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে।
নূহার ভাবান্তর হয়৷ সে শহিদের দিকে তাকায়, 'বলছি!'
সে বুঝে উঠতে পারে না, কী করবে। শরিফুলের আবার ফোন দেয়। একই ফলাফল। শহিদ মিয়া একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সে শহিদকে ডাক দেয়, 'গাড়ি স্টার্ট করেন!' বলে সে গাড়িতে উঠে বসে।
'এখন কই যাব আপা!'
'বাসায় ছাড়া যেকোনো দিকে যান!' বলে উদাস চোখে জানালায় ঠেক দিয়ে বাইরে তাকায়।
আজ নূহার জন্মদিন। বাবা আজও হয়তো বাসায় আসবেন না। জন্মদিনের কথা আছে কিনা সেই ব্যপারেই নূহা সন্দিহান। আম্মু সুস্থ থাকা অবস্থায় তার জন্মদিনের দিন বিশাল আয়োজনে ঘরে ভরে ওঠত। কিন্তু এখন সেটা সুখ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই না৷ সে রাতের কথা তার আজও মনে আছে, আব্বু-আম্মুর মধ্যে তুমুল ঝগড়া। দুই জনের কেউ থামছেন না। সে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। তার কিছুই করার নেই। সে এসব ঝগড়ার মানে বুঝতে পারে না। আব্বু বাসায় আসলেই তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে কষ্ট পাওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না। প্রতিদিনই তাদের ঝগড়া হত৷ তাদের ঝগড়ায় কষ্টে তার কান্না চলে আসত৷
সেদিন তাদের ঝগড়া তুমুল আকার ধারণ করে। সে দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর মায়ের চিৎকার শুনতে পায়। আর কিছুক্ষণ ঘরের কাজের লোকদের দৌড়াদৌড়ি, চেঁচামেচি শুনে সে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ততক্ষণে তার জীবনের একাকিত্বের অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে। তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে, নিলুফা আন্টি এগিয়ে আসে। যে দীর্ঘদিন ধরে তাদের সাথে আছে। মূলত তার দেখাশোনার জন্যই নিলুফা আন্টিকে রাখা হয়েছিল। এখনো সে এই বাড়িতে আছে৷
'আম্মুর কী হয়েছে আন্টি?' ছোট্ট নূহা জিজ্ঞাসা করে।
'কিছুই হয়নি মা!' বলে নিলুফা আন্টি নূহার হাত ধরে, 'চলো মা! আমরা রুমে যাই!' সেই থেকেই আম্মু বিছানায়। কথা বলতে পারেন না। প্যারালাইজড৷
'থামান! শহিদ ভাই গাড়ি থামান!' নূহা বাইরের দিকে তাকিয়েই হন্তদন্ত করে বলে ওঠে।
শহিদ স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি সাইড করে ব্রেক চাপে। নূহা দ্রুত দরজা খুলে পিছনের দিকে এগিয়ে যায়৷ শাড়ি পরে দৌড়াতে পারছে না। যতটুকু সম্ভব দ্রুত এগিয়ে যায়। শরিফুল সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
'আপনি এখানে?' যেন কিছুই হয়নি। এমন একটা ভাব করে শরিফুল বলে।
রাগে নূহার গা জ্বলতে থাকে৷ তবুও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে, 'আসুন! গাড়িতে উঠে বসুন!' বলে নূহা শরিফুল হাত ধরে এগিয়ে যায়৷
শরিফুল অপ্রস্তুত হয়ে যায়৷ কী করবে, সে বুঝে উঠতে পারে না। হাত ছাড়িয়ে নিবে ভেবেও ছাড়িয়ে নিতে পারে না। নূহার পিছু পিছু গিয়ে গাড়িতে ওঠে৷
'আপা! কোথায় যাব?' শহিদ জিজ্ঞাসা করে।
'ভালো কোনো ক্যাফেটেরিয়ায় চলেন!'
শহিদ গাড়ি চালু করে।
'আপনি এই কাজটা করলেন কেন?' নূহা শরিফুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে৷
'কী করেছি?'
'কী করেছেন জানেন না?' নূহা চেহারায় রাগ এনে বলে।
'না তো!'
'ঠিক আছে। জানতে হবে না।' বলে সে নব্বই ডিগ্রীতে শরিফুলের দিকে ঘুরে বসে, 'আজকে আমার জন্মদিন। আমাকে উইশ করেন!' তার মুখে চঞ্চলতা ফুটে ওঠেছে।
উইশ করবে কিনা শরিফুল বুঝতে পারে না। আর করলেও কী বলে করবে, তার মাথায় আসে না৷
মুনার ইদানিং কিছুই ভালো লাগে না৷ তার সব কিছুতেই উদাস লাগে। মনে হয়, তার সাথে এমনটা না হইলেও পারত। তার বিয়ের কথা চলছিল। কথা প্রায় পাকাপাকির দিকে চলে যাচ্ছিল৷
শরিফুলের সাথে কথা হয়। তাকে নিয়ে বাবার অফিসে যাবে। কথা বলিয়ে দিবে। বাবার সাথে মুনার বেশ ভালো সম্পর্ক। তার কথা তিনি ফেলতে পারতেন না৷ সে জানত শরিফুলকে বাবার সামনে নিয়ে গেলে বাবা মেনেই নিবেন।
বাবাকে সে জানিয়ে রাখল। তিনি দুপুরে টাইম দিয়ে বললেন যেন তাকে নিয়ে সোজা অফিসে চলে আসে৷
সে শরিফুলকে সকালে ফোন দিয়ে জানাল, 'বাবা দুপুরে তোমাকে অফিসে নিয়ে যেতে বলেছে। আমি নিলখেতের মোড়ে আসবা। ওখান থেকে তোমাকে নিয়ে বাবার অফিসে যাব।'
শরিফুল চলে আসবে বলে জানাল।
দুপুরে নিলখেত দাঁড়িয়ে নূহা শরিফুলকে ফোন দেয়। ফোন বন্ধ। মুনা অপেক্ষা করতে লাগল। তাকে বারবার কল দিতে লাগল। কিন্তু কল ঢুকে না। সে অপেক্ষা করতে লাগল। হয়তো কোনো কারণে ফোন যাচ্ছে না। এখানে আসলে তাকে খুঁজে পেতে শরিফুলের অসুবিধা হবে না। তাই সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো৷ শরিফুলের কোনো খোঁজ নেই৷
মুনার এসব বিষয়ে ভাবতে আর ভালো লাগছে না। বারান্দায় দোলনা বসে ছিল। সে উঠে দাঁড়াল৷ রুমে গিয়ে আফজাল সাহেবকে ফোন করল, 'আজকে তাড়াতাড়ি আসবে। বাইরে ডিনারে যাব!'
চলবে......
10

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ