বই : কাছের মানুষ দূরের মানুষ
লেখিকা : পিওনা আফরোজ
পৃষ্ঠা :১৩৮
মূল্য : ২৮৫ টাকা
প্রকাশনায় : চন্দ্রভুক প্রকাশন
টানাপোড়েন,ভাঙ্গন,প্রত্যাশা,আকাঙ্ক্ষা,স্বপ্ন সব মিলেই জীবন। বহু রঙে বিচিত্র এই জীবন। ত্রিধরার প্রতিটি সম্পর্ক তৈরি হয় ভালোবাসার ছায়াতলে। কিন্তু সেই ভালোবাসায় যখন অবিশ্বাস দানা বাঁধে তখনই শুরু হয় টানাপোড়েন । বাড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং ক্রমবর্ধমান দূরত্ব। এমনই প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য টানাপোড়েন ও ভালোবাসা এবং একাকিত্বের ঔপন্যাসিক প্রকাশ 'কাছের মানুষ দূরের মানুষ' বইটি।
গল্প কথন: 'কাছের মানুষ দূরের মানুষ ' বইয়ের গল্পটিতে পাঠক দুই ধরনের স্বাদ পাবেন,যার ফলে তারা নিমিষেই হারিয়ে যাবেন কাহিনীর গভীরে। দু'জোড়া নারী-পুরুষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা গল্পটিতে একদিকে যেমন দেখা যায় তাদের প্রেমময় সম্পর্ক এবং নির্ভরশীলতা,ঠিক তেমনি অন্যদিকে পাওয়া যায় স্বার্থপরতা, দ্বন্দ,অবিশ্বাস,নির্জন-নিভৃত একাকিত্বের স্বাদ। অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস যাকে আরও পূর্ণতা দিয়েছে। দাম্পত্য জীবন মাত্রই সন্তান প্রাপ্তি ছাড়া পরিপূর্ণ হয় না। বিশেষ করে নারীত্বের পূর্ণতা তো মাতৃত্বেই। ধন-সম্পদ,মান-সম্মান,প্রিয়জনেরা থাকার পরও তাই নিঃসন্তান দম্পতি মাহমুদ-মিনারার অন্তরে জ্বলতো অপূর্ণতার অনল। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে মাহমুদ-মিনারা দম্পতি মামুনকে সন্তান স্নেহে লালন পালন করেন।মামুন মাহমুদ সাহেবের আপন ভাইয়ের ছেলে। নিঃসন্তান মিনারার পুরো পৃথিবীটাই ছিলেন মাহমুদ । কিন্তু নীলা নামের কেউ একজনের আগমনে সেই পৃথিবীটাই দূর হয়ে গেলো মিনারার কাছ থেকে।মানুষ সব সময় মন খুলে তার প্রতিটি অনুভূতি কারও সাথে ভাগাভাগি করতে চায়,ঘটাতে চায় প্রকাশ।যখন তা না পারে তখনই তৈরি হয় এক সূক্ষ্ম ব্যবধান,যা কোন দাম্পত্য সম্পর্কে থাকা উচিত নয়।তেমনি এক ব্যবধানের ফাঁক গলিয়ে মাহমুদ-মিনারার মধ্যে প্রবেশ করে নীলা নামের চরিত্রটি। মিনারার সন্তানহীনতার কষ্টকে পরম যত্নে আগলে রাখতেন। কিন্তু সেই একই বেদনা যে তার ভেতরটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা কখনও বলতে পারেননি,হয়তো মিনারার কথা ভেবেই পারেননি। নীলা ছিলো তার বেদনা বোনার চাদর। তাতেই গড়ে উঠে ঘনিষ্টতা,যা ক্রমেই মাহমুদ- মিনারার মাঝে তৈরি করে দ্বন্দ -অবিশ্বাস ।অবশেষে ধরায় ভাঙ্গন,কারণ হয় মিনারার বেদনা বিথুর মৃত্যুর ; যা পাঠক হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কাটে। মামুন-মায়া হলো কাহিনীর অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। মায়ার প্রতি ভালোবাসা থাকার পরও রত্মা নামের বিধবা মহিলার সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। দেরীতে হলেও মামুন বেরিয়ে আসতে পেরেছিলো সেই সম্পর্ক থেকে। মিনারার মৃত্যুর পর মামুনের চরিত্রে স্বার্থপরতার চিত্র ধরা পড়ে পাঠকের চোখে। বৃদ্ধ রোগাক্রান্ত মাহমুদ কে হাসপাতালে ফেলে রেখে সই করা চেক বই নিয়ে রীতিমত উধাও হয়ে যায় মামুন। সবকিছু বুঝতে পারলেও মানতে চায় না মাহমুদের মন। আপন জনকে কে অবিশ্বাস করতে চায়? বৃদ্ধ বয়সে একান্ত নির্ভরতার জায়গাটি যখন সরে যায়,একাকিত্ব তখন বিশাল প্রস্তর খন্ড হয়ে বুকে চাপে। আবেগ ঘন এই মূহুর্তটিকে লেখিকা যথাযথ দরদ দিয়ে চিত্রায়িত করেছেন তার উপন্যাসে।
লেখিকা কথন : পিওনা আফরোজ বহু গুণে গুণান্বিতা একজন বাঙালী নারী। সুমিষ্ট কন্ঠী হবার পাশাপাশি প্রিয়ংবদাও ,যার প্রমাণ আমরা পাই "কাছের মানুষ দূরের মানুষ" উপন্যাসে । বাস্তবতাকে বোঝার ও ফুটিয়ে তোলার গুণ তার মাঝে পুরোটাই বিদ্যমান তাতো বলাই বাহুল্য। গুণী এই লেখিকার জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি। বেড়ে ওঠা ঢাকা ও নোয়াখালীতে। লেখালেখিটা তার শুরু হয় কলেজ জীবন থেকেই। আবৃত্তি শিল্পী হিসেবে তার জুড়ি নেই। আবৃত্তি ও কবিতার হাত ধরেই তার সাহিত্যজগতে পদার্পন।এক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই তিনি সম্ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছেন।
যা যা শিক্ষণীয় : উপন্যাসের পটভূমি বাস্তবতার নিরীখে রচিত ।তাই বইটি পাঠকদের জন্য রেখে যায় শিক্ষণীয় কিছু বার্তা।
- দাম্পত্য জীবনে কখনও পরস্পরের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হতে দেয়া উচিত নয়,কারণ যাই হোক না কেন। কেননা , এই ব্যবধানেই দুজনের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে ৩য় পক্ষ।
-মানুষ সব সময় স্বার্থান্বেষী। স্বার্থ পূরণ হয়ে গেলে আর বিবেক কাজ করে না। যা আমরা মামুনের চরিত্র পর্যবেক্ষণে বুঝি। কঠিন হলেও এটাই বাস্তবতা।
- যতক্ষণ প্রয়োজন থাকে ততক্ষণ আশেপাশে প্রিয়জনের অভাব হয় না।
যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তখন চেনা মুখগুলোও বড় অচেনা হয়ে ওঠে। অস্পষ্ট ,রহস্যময় হয়ে যায় আপন স্বজন। জীবনের এই পর্বটি বড়ই অসহায় ,দুর্বিসহ।
- বিশ্বাস বড় নাজুক সম্পদ। তাই এটিকে খুব যত্ন করে ধরে রাখতে হ
সমালোচনা : বইটিতে অনেক চরিত্রের সুন্দর সন্নিবেশ ঘটেছে। অনেক চরিত্রের ভীড়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো ম্লান হয়ে যায়নি ,যা অনেক সময় বিভিন্ন উপন্যাসে দেখা যায়। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো কোনভাবেই মূল কাহিনী থেকে লেখিকার মোটেও বিচ্যুতি ঘটেনি, যদিও উপন্যাসের ব্যাপ্তির প্রয়োজনে অনেক ঘটনার সমাবেশ ঘটাতে হয়েছে তাকে।কিছু ছোটখাট দুর্বলতা উপন্যাসে অবশ্যই ছিলো । তবুও আমার ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, লেখিকা পিওনা আফরোজ পাঠকের মন জয় করতে বহুলাংশে সফল হয়েছেন।কেননা, মানব জীবনের কঠিন সব বাস্তবতা তার আবেগমিশ্রিত লেখনীর মধ্য দিয়ে চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। একাকিত্বের পীড়া,স্বজনহীনতার যন্ত্রণা এবং ভালোবাসার মুহূর্তগুলো এত অনবদ্য আর হৃদয়গ্রাহী করে পিওনা আফরোজ উপহার দিয়েছেন যা বলাই বাহুল্য। এই উপন্যাস পাঠকের মনকে সহজেই নাড়া দেবে।
ভালো লাগা উক্তি :
১) শুধুমাত্র দেহ থেকে প্রাণটা হারালেই মানুষের মৃত্যু হয়না। এই পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছে,যারা প্রতিদিন বারবার মরেও বেঁচে থাকে।
২)জীবনের কত বিচিত্র রং,কত বিচিত্র অনুভূতি।
সব রং মুছে দিয়ে মৃত্যুতেই জীবনের শেষ পরিণতি।'
৩) সব সম্পর্কে 'ভালোবাসি' বলে বোঝানো যায় । কিছু কিছু ভালোবাসা আড়ালের গল্প হয়েই থেকে যায় সারাজীবন।
৪) আসলে ভালোবাসলেই মানুষ নির্ভরশীল হতে থাকে। সুখ-দুঃখ,ব্যথা-কান্না সবকিছুই ভালোবাসার মানুষের কাছে বলতে না পারলে যেন অনুভূতিগুলো পূর্ণতা পায় না।
৫) এর নামই কি ভালোবাসা ? কিন্তু এ তো সেই দূর আকাশের চাঁদের মতোই । ধরা যাবে না। ছোঁয়া যাবে না। কখনো না।
৬) আসলে জীবন মানুষকে যা শেখায় তা কোন বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না।
পরিশেষে অজস্র ভালো লাগা রেখে গেলাম আগেই প্রিয়ংবদা পিওনা আফরোজের লেখনীর সমীপে। কামনা করছি স্রষ্টা যেন উত্তর উত্তর তার লেখনীর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে দেন। যাতে তিনি আরো নতুন সব চমকে তার ভক্ত পাঠক গোষ্ঠিকে আনন্দ দিতে পারেন। আর চন্দ্রভুক প্রকাশনার জন্যও রইলো একরাশ
শুভ কামনা
এমন দারুণ বই পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার জন্য।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....