বইঃ অপেক্ষা
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
পৃষ্ঠাঃ ২২০
প্রচ্ছদ শিল্পীঃ ধ্রুব এষ
প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর, ১৯৯৭
প্রকাশনাঃ অক্ষর বিন্যাস।
মূল্যঃ ৩০০ টাকা
''অপেক্ষা'' উপন্যাসটি হুমায়ূন আহমেদ এর একটি অনবদ্য সৃষ্টি। প্রিয় মানুষকে হারানোর শোক, প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষা করা কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার এই উপন্যাসে লেখক তুলে ধরেছেন।
উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়, স্বামী হাসানুজ্জামান ও ছেলে ইমনকে নিয়ে সুরাইয়ার সুখের সংসার চলতে থাকে। সেই সংসারে নতুন অতিথি আসতে চলছে এই খবর স্বামীকে দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে রাত জেগে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেদিন হাসানুজ্জামান অফিস থেকে আর বাসায় ফিরে আসে না। মুহূর্তের মধ্যে সুরাইয়ার সুখের সংসারে অন্ধকার নেমে আসে, সব যেন থমকে যায় নিমেষেই। সবজায়গায় তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয় হাসানুজ্জামানকে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না।
পরিবারের প্রধান কর্তার অনুপস্থিতিতে নিমেষেই শেষ হয়ে যায় সুন্দর গোছানো সংসারটি। হুট করেই স্বামীর হারিয়ে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারে না সুরাইয়া। তার স্বামী একদিন ফিরে আসবে এই আশায় সে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে।
ইমনের একটা ফুটফুটে বোন জন্ম নেয় সুপ্রভা। জগতের সব ব্যাপারেই সুরাইয়ার বিতৃষ্ণা চলে আসে। তার ফুটফুটে মেয়েটাও অনাদর পেতে থাকে মায়ের কাছে। তার মেজাজ দিনদিন খিটখিটে হতে থাকে এবং তার প্রভাব পরে দুই সন্তান এর ওপর। ইমন ও সুপ্রভার সাথেও তার আচরণ অসহনীয় হতে থাকে। সুরাইয়ার সমস্ত ভাবনায় তার স্বামী। কবে ফিরবে সে? হঠাৎ একটা মানুষ কিভাবে হারিয়ে যেতে পারে কখনো কি দেখা মিলবে হাসানুজ্জামান এর? নাকি অপেক্ষা করতে করতেই তার জীবন কেটে যাবে? এই বিষয়টি উপজীব্য করে মূল গল্প এগিয়ে যায়।
একটি উপন্যাস নির্ভর করে বেশ কয়েকটি পার্শ্বগল্পের ওপর। মূল গল্পের সাথে ঔপন্যাসিক পার্শ্বগল্প গুলোও সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যায়। অপেক্ষা উপন্যাসেও তার সুস্পষ্ট বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। স্বামীর জন্য সুরাইয়ার অপেক্ষা করা মূল গল্প হলেও অন্যান্য চরিত্রগুলোও উপন্যাসে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ইমন ও মিতুর খুনসুটি, ঝগড়া, প্রেম, ভালোবাসা এবং সুরাইয়ার ভাই জামিলুর রহমানের পরিবারের গল্প বেশ ভালোভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। উপন্যাসের করুন পরিস্থিতির মাঝেও এসব কাহিনি পাঠকের মনে স্বস্তির জোগান দেয়।
⚫ সুরাইয়া
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুরাইয়া। তার স্বামী হাসানুজ্জামান এর হারিয়ে যাওয়া সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। স্বামীর জন্য তার যে অপেক্ষা সেটার মাধ্যমেই উপন্যাসের মূল গল্প গড়ে উঠেছে। উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায় সুরাইয়া বেশ হাসিখুশি এক আদর্শ গৃহিণী, যে তার সংসার, সংসারের সদস্যদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। হঠাৎ তার স্বামীর হারিয়ে যাওয়া যেন তার সমস্ত জগৎ এলোমেলো করে দেয়। স্বামী কিভাবে নিখোঁজ হলো, সে কোথায় আছে, কবে ফিরবে নাকি কখনোই ফিরবে না এসব চিন্তাভাবনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
দুই সন্তানের প্রতি তার আচরণও অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। নিজের সন্তানের প্রতি তার এই নির্মমতা যেন সকল পাঠককেই কাঁদায়! তবে সুরাইয়ার উপর তখন প্রচন্ড মানসিক চাপ থেকেই সৃষ্টি হয় এরকম অস্বাভাবিক আচরণের।
সুরাইয়ার বড় ভাই অনেকগুলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলেও সুরাইয়া তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। স্বামীর জন্য তার এই অপেক্ষা কোনোদিনই শেষ হবে না এটাই উপন্যাসের মূল উপজীব্য।
⚫ ইমন
সুরাইয়ার ছেলে ইমন এই উপন্যাসের নায়ক। লেখক বেশ যত্নের সাথে এই চরিত্রটি গড়ে তুলেছেন। ছোটবেলা থেকেই ইমন বেশ গম্ভীর স্বভাবের। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই সে বলে না। বাবার হারিয়ে যাওয়ার পর মায়ের অস্বাভাবিক আচরণ, মামার বাড়িতে আশ্রিত থাকার কষ্ট তাকে আরও কঠিন করে দিয়েছে। এসবকিছুর থেকে দূরে থাকার জন্য সে লেখাপড়া কে সঙ্গী করে নিয়েছে। যদিও লেখাপড়ায় সে অসম্ভব ভালো। তারপরও মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে হতো মায়ের সঙ্গে গল্প করতে, ছোট বোনটার সাথে গল্প করতে। তার দুই মামাতো ভাই শোভন ও টোকনের মতো বাঁধাহীন উশৃঙ্খল জীবন তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিলো। ইমন যে একেবারেই আবেগ অনুভূতিহীন না তার প্রমান উপন্যাসে কয়েকবারই পাওয়া যায়। ইমন সবসময় চেষ্টা করেছে মিতুর প্রতি তার এই আবেগ লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সেই আবেগ প্রকাশ হয়ে গেছে।
উপন্যাসের একপর্যায়ে ইমন কিছু দুর্ঘটনার স্বীকার হয় এবং তার লেখাপড়ার প্রতি মন থাকে না। ইমনের চারপাশের চিরচেনা জগৎ এলোমেলো লাগে। সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। তার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে শোভন টোকন এর মতো অন্ধকার কোনো জগতে।
পাঠকের মনে তখন একটাই প্রশ্নের জন্ম দেয়,
সে কি সত্যিই তার জীবন পাল্টে নেয়? নাকি তার প্রিয় মানুষটার হাত ধরে নতুন জীবন শুরু করে?
⚫ মিতু
মিতু উপন্যাসের নায়িকা, সুরাইয়ার বড় ভাই জামিলুর রহমানের মেয়ে। উপন্যাসে মিতুর পরিচয় পাওয়া যায় এক সাহসী মেয়ে হিসেবে।
ছোটবেলা থেকে মিতু এবং ইমন একই সাথে বড় হয়। ওদের মধ্যে সারাক্ষণ খুনসুটি লেগে থাকতো। মিতু ইমনকে নানাভাবে বিরক্ত করতো। সেই বিরক্তের ভিতরও ভালোবাসা লুকিয়ে ছিলো। ইমন সেই ভালোবাসার কথা জানলেও মিতু তাতে কোনো সংকোচ বোধ করে না।
ভালোবাসার মানুষের প্রতি এক ধরনের অধিকার থাকে। ইমন যখন নবনী নামের একটা মেয়েকে পড়াচ্ছে জেনে সে ইমনের প্রতি রেগে যায়। সেই রাগের মাধ্যমে ইমনের প্রতি তার নিজের অধিকারের কথাটাই যেন জানিয়ে যায়। একপর্যায়ে ইমনের প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় এবং অন্য ছেলের সাথে বিয়েতেও রাজি হয়ে যায়।
কিন্তু সেই অভিমান কি শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়? ইমনের দুঃসময়ে কি সে পারবে তাকে ছেড়ে দূরে থাকতে?
⚫ সুপ্রভা
উপন্যাসের প্রানবন্ত চরিত্র হচ্ছে সুপ্রভা। ইমনের একমাত্র বোন সুপ্রভা। সুপ্রভার মধ্যে অত্যন্ত দুরন্তপনা দেখা যায়। ইমনের মতো পড়ালেখার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। পড়াশুনা তার একদমই ভালো লাগে না। তার জন্মের কয়েক মাস আগে বাবা হারিয়ে যাওয়ায় ছোটবেলা থেকে সে বেশ অবহেলায় বড় হয়েছে। তবুও সে সবসময় নিজেকে খুশি রাখতে চেষ্টা করেতো। তার মা তাকে ভালো না বাসালেও তার বড় মামা জামিলুর রহমানের কাছে সে ছিলো অত্যন্ত আদরের। এ কারণে সে কখনো ভালোবাসার অভাব কিছুটা ভুলতে পেরেছে।
সুপ্রভা লেখাপড়ায় অত্যন্ত কাঁচা ছিলো, যা তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
⚫ শোভন ও টোকন
জামিলুর রহমানের দুই ছেলে শোভন ও টোকন। তার এই দুই সন্তান অত্যন্ত দুষ্টু স্বভাবের। তাদের দুষ্টুমির সীমা দিনদিন বেড়েই চলে। একপর্যায়ে তা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। দুই ছেলেরই আর লেখাপড়া হয় না। জামিলুর রহমানের কড়া শাসনও তাদের ভালো করে তুলতে পারে না, তারা বিপথে চলে যায়। নিজেদের স্বাধীন মতো ঘুরে বেড়ায়।
⚫ জামিলুর রহমান
সুরাইয়ার বড় ভাই জামিলুর রহমান। সারাজীবন ব্যাবসা নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকতেন। নিজের জীবনকে একটা গন্ডীর ভেতরে আবদ্ধ করে রাখতেন। এই মানুষটা কখনো ভালোবাসা প্রকাশ করতো না। একারনেই ভাগ্নী সুপ্রভা কে নিজের মেয়ের থেকে বেশি ভালোবাসলেও তা সে গোপন করে রাখতে চাইতেন।
তার ছেলেদেরও সে ভালোবাসতেন কিন্তু কখনো প্রকাশ করতেন না। তার ছেলেরা বিপথে চলে গেলে তিনি মানসিক ভাবে কিছুটা ভেঙে পড়েন।
অত্যন্ত ধনসম্পদ এর মালিক হয়েও জীবনে সুখী হতে পেরেছেন কি জামিলুর রহমান?
এছাড়াও আরো কিছু ছোট চরিত্র এই উপন্যাসে রয়েছে। এদের মধ্যে ইমনের ছোটচাচা ফিরোজ, ইমনের দাদি, সুরাইয়ার ভাবী ফাতেমা উল্লেখযোগ্য। মূল কাহিনীতে এদের তেমন ভূমিকা নেই, তবে এরা কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোকে এগিয়ে নিতে সক্ষম।
⚫ প্রিয় উক্তি
হুমায়ূন আহমেদ এর অন্যান্য উপন্যাসের মতো এই উপন্যাসেও রয়েছে সেরা কিছু উক্তি।
★মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না, আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্যে।
★মানুষের জীবন কি চক্রের মতো? চক্রের কোনো শুরু আছে, শেষ নেই। মানব জীবনও কি তাই? রহস্যময় এক চক্রের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে অপেক্ষা করে কেউ কেউ। কিংবা সকলেই। কিসের অপেক্ষা?
★পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দময় জিনিসগুলি বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যেমন জোছনা, বৃষ্টি, মানুষের ভালোবাসা।
★মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষা নামের ব্যাপারটি খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক।
★খুব খারাপ সময়ের পরপরই খুব ভাল সময় আসে। এটা জগতের নিয়ম।
উপন্যাসে হৃদয় বিদারক অনেক কিছুই ঘটে কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সুরাইয়া হাসানুজ্জামান এর জন্য অধীর অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ইমনের বিয়ের রাতে তার স্বামী ফিরে আসবে।
সত্যিই কি আসে ফিরে তার স্বামী?
সুরাইয়ার অপেক্ষার কি ইতি ঘটে অবশেষে,,,,?
সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে বইটি পড়তে হবে।
সবমিলিয়ে অপেক্ষা বইটি হুমায়ূন আহমেদ এর এক অনন্য সৃষ্টি। যা পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবে। বইটি পড়ার পরে পাঠকের মনে সৃষ্টি হবে চরিত্রগুলোর জন্য গভীর মমতা, ভালোবাসা।
এই উপন্যাসের সার্থকতা হলো উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে বর্ণনা করা, যা লেখক বেশ যত্নের সাথে বর্ণনা করেছেন। চরিত্রগুলোর বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমেই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে। লেখক চরিত্র গুলো বেশ সুগঠিত করে তুলে ধরেছেন উপন্যাসে।
⚫ ব্যাক্তিগত রেটিংঃ ১০/১০
⚫ ব্যাক্তিগত মতামত
উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে যেখানটায় থমকে যাই তা হলো সুপ্রভার হঠাৎ মৃত্যু। সুপ্রভা মারা যায়। তাকে মনে রাখলেও কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে না। অপরদিকে সুপ্রভার বাবা বছরের পর বছর নিঁখোজ। বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তা কেউ জানে না। কিন্তু সুরাইয়ার দৃঢ় বিশ্বাস হাসানুজ্জামান একদিন ফিরে আসবে।
বাস্তবতা কত কঠিন হয় তারই প্রকাশ যেন এই বইটি। বইটি থেকে শিখলাম,"আমাদের সমস্ত অপেক্ষা শুধুমাত্র জীবিতদের নিয়ে।" কেউ কখনো মৃত মানুষের জন্য অপেক্ষা করে না। কি নির্মম, তবুও সত্য...!
বইটি পড়লে নিমিষেই চোখের কোণে জল চলে আসে...! লেখকের অনেক গুলো উক্তি পাঠকের মন ছুঁয়ে দিতে সক্ষম।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....