বইয়ের নাম: রাসূল ﷺ-এর ভালোবাসায়! PDF Download.কৃতজ্ঞতায়: ড. মুহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী, ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

বইয়ের নাম: রাসূল ﷺ-এর ভালোবাসায়! PDF Download.
কৃতজ্ঞতায়: ড. মুহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী, ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া,
ইকবাল হোসাইন মাসুম, কাউসার বিন খালেদ।
সোর্স: ইসলাম হাউজ ডটকম
পৃষ্টা সংখ্যা: ৩২ (পকেট সাইজ)।
মুদ্রিত মূল্য: বিনা মূল্যে।
প্রকাশনায়: বিলিভার্স ভিশন।
বইয়ের নাম: রাসূল ﷺ-এর ভালোবাসায়! PDF Download.  ড. মুহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী এর বই PDF Download ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া এর সকল বই PDF Download



রাসূল ﷺ-কে কিভাবে ভালোবাসবো?
সমস্ত প্রশংসা মহান রব্বুল আলামিনের জন্য। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মাদ ﷺ উপর।

মুমিন মাত্রই রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর প্রতি মহব্বত পোষণ করে। কেননা রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর প্রতি মহব্বত রাখা ঈমানের এক অপরিহার্য অংশ। পরম শ্রদ্ধা, গভীর ভালোবাসা আর বিপুল মমতার এক চমৎকার সংমিশ্রণের সমন্বিত রূপ হচ্ছে ‘মহব্বত’ নামের এ আরবী অভিব্যক্তিটি।

ঈমানের আলোকে আলোকিত প্রত্যেক মুমিনের হৃদয় আলোড়িত হয়, শিহরিত হয় যখন প্রিয় নবী ﷺ-এর নাম উচ্চারিত হয়, তাঁর জীবন-চরিত আলোচিত হয় কিংবা তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী পাঠ করা হয়। তাঁর একনিষ্ঠ দিক নির্দেশনায় পথ খুঁজে পায় পথহারা বিভ্রান্ত মানব সন্তানেরা, আর দুর্বল চিত্তের লোকেরা ফিরে পায় মনোবল। মানবতার কল্যাণকামীরূপেই আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন এ বিপর্যস্ত ধরাধামে। সত্যিই তিনি তাঁর যুগের যমীনকে মুক্ত করেছেন অশান্তির দাবানল হতে, উদ্ধার করেছেন অজ্ঞানতা ও মুর্খতার নিকষ অন্ধকার হতে। তাইতো জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে বরণ করে নিয়েছে মানবতার বন্ধুরূপে।

সত্যের এহেন প্রতিষ্ঠাতা, চারিত্রিক মাধূর্য ও ব্যবহারিক সৌন্দর্যের এমন রূপকারের প্রতি একটু বেশী পরিমাণে ভালোবাসা পোষণ করা এবং তাঁর প্রতি পাহাড়সম প্রগাঢ় শ্রদ্ধা রাখা মুমিন জীবনে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ইসলামী শরী‘আত নবী ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত পোষণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য বলে আখ্যায়িত করেছে।

আল্লাহ বলেন, ‘‘বল, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দ হওয়ার আশংকা তোমরা করছ, এবং সে বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তার পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত।’’ [আত-তাওবাহ: ২৪]
যাদের কাছে আল্লাহ ও রাসূল ﷺ সর্বাধিক প্রিয় নয়, তাদেরকে আল্লাহ এ আয়াতটিতে ভীষণ আযাবের হুমকি দিয়েছেন। ওয়াজিব ও অপরিহার্য কাজ বর্জন না করলে এ ধরনের হুমকি দেয়া হয় না।

ইমাম বুখারী (রাহ.) আবু হুরাইরা (রা.) থেকে তার সহীহগ্রন্থে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘‘শপথ ঐ সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কেউই ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তান হতে অধিকতর প্রিয় হব।’’ [বুখারী-১৩]

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘‘তোমাদের কেউই ঈমানদার হবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও সকল মানুষ হতে প্রিয়তম না হই।’’ [সহীহ বুখারী-১৫, সহীহ মুসলিম-১৭৮]

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ না করলে ঈমানদার বলে কেউ বিবেচিত হবে না। অতএব ঈমানের অনিবার্য দাবী হল- রাসূল ﷺ -কে ভালোবাসা।

তবে রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা পোষণে আমাদের সমাজের সকল মুসলিম ভাই ও বোনেরা ব্যালেন্স রক্ষা করতে পারেন না। দেখা যায় যে, একদল লোক তাঁর মহব্বতে পাগলপারা হয়ে তাকে অতিমানবীয় পর্যায়ে উন্নীত করে এবং তাঁকে আল্লাহর বহু গুণাবলীতে শরীক করে। যেমন তিনি গায়েব জানেন, মৃত্যুর পরও মানুষের ভাল-মন্দ করতে পারেন, মানুষের জন্য দো‘আ করেন ও দো‘আ কবুল করতে পারেন, তিনি এখনই আমাদের শাফা‘আত কবুল করতে পারেন ইত্যাদি আরো নানাবিধ ভ্রান্তিপূর্ণ আকীদা পোষণ। আরেকদিকে অন্যদল তাকে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ফেলে অন্য মানুষের মতই তাকে ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয় বলে বিশ্বাস করে। এদের কেউ কেউ তাঁর মুখনিঃসৃত কোন কোন হাদীস ও আমলকে অস্বীকার করে। ফলে তাঁকে অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা এ প্রকার লোকেরা অনুভব করে না।

এ উভয় শ্রেণীর লোকেরা প্রকৃতপক্ষে রাসূল ﷺ-কে সত্যিকার ভাবে মহব্বত করা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে। কারণ তারা এমন সব কাজ করছে যা রাসূল ﷺ-এর প্রতি তাদের মহব্বতের দাবীর অসারতা প্রমাণ করছে। এসব কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

১. প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে রাসূল ﷺ -এর সুন্নাহ থেকে দূরে সরে থাকা
সুন্নাহ থেকে অপ্রকাশ্যে দূরে থাকার উদাহরণ হল: যেমন মৌলিক ইবাদতসমূহকে আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব প্রথা মনে করা এবং আল্লাহর কাছে সাওয়াবের আশা না করেই এগুলো পালন করা, অথবা রাসূল ﷺ-কে অনুসরণ করা ও তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন থেকে বিরত থাকা, তাঁর প্রতি হৃদয়ে মহব্বত পোষণ না করা, সুন্নাহ ভুলে যাওয়া ও তা না শেখা এবং এর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করা।
আর প্রকাশ্যে সুন্নাহ থেকে দূরে সরে থাকার উদাহরণ হল: ওয়াজিব ও মুস্তাহাব পর্যায়ের দৃশ্যমান সুন্নতী আমল ত্যাগ করা, যেমন ‘‘রাতেব’’ তথা সুন্নাতে মোয়াক্কাদা নামের সালাতসমূহ, বিতর এর সালাত, খাওয়া ও পরার সুন্নাতসহ, হজ্জ ও সিয়ামের নানাবিধ সুন্নাত পরিত্যাগ করা। এমন কি কেউ কেউ এগুলোকে নিতান্ত ফুজুলী বা অতিরিক্ত কাজ বলে মনে করে। অথচ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূল ﷺ বলেন, ‘‘অতঃপর যারা আমার সুন্নাত থেকে বিরাগ পোষণ হয়, তারা আমার দলভুক্ত নয়।’’[বুখারী-৫০৬৩, মুসলিম-৩৪৬৯]

২. বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ প্রত্যাখ্যান করা
যুক্তির বিচারে উত্তীর্ণ নয় কিংবা বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় অথবা এ হাদীস অনুযায়ী বর্তমানে আমল করা সম্ভব নয় ইত্যাদি নানা যুক্তিতে সহীহ ও বিশুদ্ধ হাদীস অস্বীকার করা কিংবা সেগুলোকে তার প্রকৃত অর্থ থেকে অপব্যাখ্যা করে মনগড়া অর্থে প্রণয়ন করা। অনেকে একজন রাবীর বর্ণনা হওয়ার কারণেও খবরে আহাদকে অস্বীকার করে। কেউ কেউ আবার শুধুমাত্র কুরআন দ্বারা আমালের অজুহাত দেখিয়ে সুন্নাহকে অস্বীকার করে। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘‘রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও।’’ [সূরা আল হাশর: ৭]

৩. রাসূল ﷺ -এর সীরাত অনুসরণ থেকে সরে আসা
প্রগতি ও উন্নতির প্রভাবে রাসূল ﷺ-এর সীরাত ও আদর্শ অনুসরণ হতে সরে এসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতি ঝুঁকে পড়তে দেখা যায় অনেককে। এর চেয়ে মারাত্মক হল- রাসূল ﷺ-এর কথা ও কাজের সাথে অন্যদের কথা-কাজ তুলনা করে সাধারণের উদ্দেশ্যে পেশ করা। এতে সাধারণ মানুষ রাসূলের প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। অথচ রাসূল ﷺ-এর কথা ও কাজ ইসলামী শরী‘আতেরই অংশ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘এতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি প্রেরণ করা হয়।’’ [আন নাজম:৪]

৪. রাসূল ﷺ -এর সম্পর্কে আলোচনার সময় মনসংযোগ না করা এবং আগ্রহের সাথে শ্রবণ না করা
অথচ আল্লাহ বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর আওয়াজের উপর তোমাদের আওয়াজ উঁচু করো না এবং তোমরা নিজেরা পরস্পর যেমন উচ্চস্বরে কথা বল, তার সাথে সেকরকম উচ্চস্বরে কথা বলো না।’’ [সূরা হুজুরাত: ২]

৫. সুন্নার যারা প্রকৃত অনুসারী তাদেরকে ত্যাগ করা, তাদের গীবিত করা ও তাদেরকে উপহাস করা।

৬. নবী ﷺ -এর বৈশিষ্ট্য ও তার মু‘জিযাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞান না রাখা।

৭. দ্বীনের মধ্যে নানা প্রকার বিদ‘আত চাল করা।
দেখা যায়, অনেক লোক ইবাদাতের নামে নানাবিধ বিদ‘আত চালু করেছে আমাদের সমাজে। অথচ রাসূল ﷺ বিদ‘আত থেকে উম্মতকে সাবধান করেছেন। এদেরকে যখন বিদ‘আত ছেড়ে দেয়ার আহবান জানানো হয়, তখন তারা বিদ‘আতকে আরো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে।

৮. রাসূল ﷺ -এর সম্পর্কে বাড়াবাড়ি
রাসূল ﷺ সম্পর্কে বাড়াবাড়ির অর্থ হচ্ছে তাঁকে নবুওয়াত ও রিসালাতের উর্ধ্বে স্থান দেয়া এবং অনেকক্ষেত্রে আল্লাহর গুণাবলীতে তাঁকে শরীক করা ও তাঁর কাছে দো‘আ করা, শাফা‘আত চাওয়া ইত্যাদি। অথচ সহীহ বুখারীর বর্ণনায় তিনি স্বয়ং বলেন, ‘‘তোমরা আমার সম্পর্কে অতিরঞ্জন করো না, যেমন নাসারাগণ অতিরঞ্জন করেছে ইবনু মারইয়াম সম্পর্কে। আমি তো শুধূ আল্লাহর বান্দা। বরং তোমরা বলো – (আমি) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’ সুনান আবি দাউদে একটি হাদীসে বলা হয়েছে, নবী ﷺ বলেছেন, ‘‘তোমরা আমার কবরকে উৎসবস্থলে পরিণত করো না, আর আমার উপর সালাত পড়। কেননা তোমরা যেখানেই থাক তোমাদের সালাত আমার কাছে পৌঁছে।’’ [সহীহ সুনান আবি দাউদ-২০৪২]
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় তিনি আরো বলেন, ‘‘আল্লাহ লানত করুন ইহুদী ও নাসারাদেরকে, তারা তাদের নবীদের কবরকে মাসজিদরূপে গ্রহণ করেছে।’’ [বুখারী-১৩৩০, মুসলিম-১২১২]

৯. রাসূল ﷺ -এর উপর সালাত ও দরূদ পাঠ না করা
রাসূল ﷺ-এর উপর দরূদ পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। অথচ তার নাম উচ্চারণ করে অথবা শুনে অনেকেই দরূদ ও সালাম পাঠ করে না। তিরমিযীর একটি বর্ণনায় রাসূল ﷺ বলেন, ‘‘ঐ ব্যক্তির নাক ধুলি ধুসরিত হোক যার কাছে আমার উল্লেখ করা হয় কিন্তু সে আমার উপর সালাত (দরুদ) পাঠ করেনি।’’ তিরমিযী অন্য আরেকটি বর্ণনায় তিনি ﷺ বলেন, ‘‘কৃপণ ঐ ব্যক্তি, যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হয় অথচ সে আমার উপর সালাত পাঠ করেনি।’’

উপরোক্ত বিষয়ের সবগুলোই রাসূল ﷺ-এর মহব্বতের পরিপন্থি। সুতরাং আজ যারা রাসূল ﷺ-কে ভালোবাসার শরয়ী দায়িত্ব পালন করে নিজেদের ঈমানের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়, তাদের উচিত উপরোক্ত দল দু’টির চিন্তা-চেতনা ও কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসা এবং শরী‘আত তাঁর জন্য ভালোবাসার যে উপায়, উপকরণ ও উপাদান নির্ধারণ করেছে তা সত্যিকারভাবে অনুসরণ করা। ‘তাঁকে ভালবাসি’-মুখে এ দাবী করে জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে উপেক্ষা করা যেমন ভালোবাসার দাবীকে অসার প্রমাণিত করে, তেমনি অতিরিক্ত ভালোবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে তাঁকে স্রষ্টার সমপর্যায়ে উন্নীত করাও অত্যন্ত গর্হিত ও শরী‘আতের দৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যাত।
ইসলামী শরী‘আত রাসূলুল্লাহ ﷺ -কে যেভাবে ভালোবাসার নির্দেশনা আমাদেরকে দিয়েছে নিম্নে আমরা সে বিষয়টি তুলে ধরছি

১. সকল মানবের উপর রাসূলু্ল্লাহ ﷺ -কে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া
আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মাদ ﷺ-কে সৃষ্টির আদি ও অন্তের সকলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। অতএব নবী ﷺ হলেন সর্বশেষ নবী, নবীদের নেতা ও সর্দার। সহীহ মুসলিমের একটি বর্ণনায় এসেছে, নবী ﷺ বলেছেন, ‘‘আল্লাহ ইসমাঈলের সন্তান থেকে কিনানাকে চয়ন করেছেন এবং কিনানা থেকে কুরাইশকে নির্বাচন করেছেন। আর কুরাইশ থেকে চয়ন করেছেন বনু হাশিমকে এবং আমাকে চয়ন করেছেন বনু হাশিম থেকে।’’ [মুসলিম-৬০৭৭]
সহীহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় রাসূল ﷺ বলেছেন, ‘‘আমি আদম সন্তানের নেতা এবং এতে কোন অহংকার নেই। আর আমি ঐ ব্যক্তি প্রথম যার কবর বিদীর্ণ হবে, প্রথম যিনি শাফা‘আতকারী হবে এবং প্রথম যার শাফা‘আত কবুল করা হবে।’’
রাসূল ﷺ-এর শ্রেষ্ঠত্বের আকীদা, মনে-মগজে ধারণ করার অর্থই হল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্ভ্রম পোষণ করা এবং তাকে যাবতীয় সম্মান ও মর্যাদা দেয়া।

২. সকল ক্ষেত্রে রাসূল ﷺ-এর সাথে আদব ও শিষ্টাচার রক্ষা করা
নিম্ন বর্ণিত রূপে রাসূল ﷺ-এর সাথে শিষ্টাচার রক্ষা করা যায়।

ক. উপযুক্ত বাক্য দ্বারা তার প্রশংসা করা। এক্ষেত্রে আল্লাহ রাববুল আলামীন যেভাবে তার প্রশংসা করেছেন এবং রাসূল ﷺ স্বয়ং তাঁর নিজ সম্পর্কে বলার জন্য যা শিখিয়ে দিয়েছেন, তাই হলো তাঁর প্রশংসা করার জন্য সর্বোত্তম অভিব্যক্তি। সালাত ও সালাম পেশের মাধ্যমে এ কাজটি অতি উত্তমভাবে আদায় হয়।
আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ নবীর উপর সালাত পেশ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার উপর সালাত ও সালাম পেশ কর।’’ [সূরা আহযাব: ৫৬]
সালাত ও সালাম রাসূলের স্তুতি বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম বলেই তাশাহুদ, খুতবা, সালাতুল জানাযা, আযানের পর ও যে কোন দো‘আর সময়সহ আরো বহু ইবাদাতে তা পেশ করার নিয়ম করে দেয়া হয়েছে; বরং তার উপর সালাত ও সালাম পেশ আলাদাভাবেই একটি ইবাদাত হিসেবে স্বীকৃত।

খ. রাসূল ﷺ-এর মর্যাদা, ফযীলত, বৈশিষ্ট্য, মু‘জিয়া ও সুন্নাহ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তাঁকে বেশী বেশী স্মরণ করা। মানুষকে তাঁর সুন্নাহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা, তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও উম্মতের উপর তাঁর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, তাঁর সীরাতকে সদাপাঠ্য বিষয় বস্তুতে পরিণত করা। এর মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সদা জাগরুক থাকবে।

গ. শুধু ‘মুহাম্মদ’ নামে তাকে উল্লেখ না করা, বরং এর সাথে ‘নবী’ বা ‘রাসূল’ সংযোজন করে সালাত ও সালাম পাঠ করা। আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা একে অপরকে যেভাবে ডাক, রাসূলকে তোমাদের মধ্যে সেভাবে আহবান করো না।’’ [সূরা নূর: ৬৩]

ঘ. মসজিদে নববীতে কেউ এলে এ মসজিদের আদব রক্ষা করা, বিশেষ করে তাঁর কবরের পাশে এসে স্বর উচ্চ না করা। উমর (রা.) একদল লোককে এজন্য খুব সতর্ক করেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর শহর মদীনা মুনাওয়ারার সম্মান রক্ষা করাও অপরিহার্য।

ঙ. তাঁর হাদীসের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন, হাদীস শোনার সময় ধৈর্য ও আদবের পরিচয় দেয়া, হাদীস শেখার প্রতি অনুপ্রাণিত হওয়া। এক্ষেত্রে এ উম্মতের প্রথম প্রজন্মসমূহের আদর্শ অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়।

৩. রাসূল ﷺ যে সব বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন তা সত্য বলে প্রতিপন্ন করা
এসব বিষয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল- ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ, দ্বীনের মৌল স্তম্ভসমূহ, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে তাঁর দেয়া যাবতীয় সংবাদ ইত্যাদি। তাঁর সত্যতা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
‘‘শপথ তারকার, যখন তা অস্ত যায়। তোমাদের সাথী (মুহাম্মদﷺ) ভ্রষ্ট হননি এবং বিভ্রান্তও হননি। তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোন বক্তব্য প্রদান করেননি। এতো শুধুই ওহী, যা তাঁর কাছে প্রেরিত হয়।’’ (সূরা নাজম: ১-৪)
আর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দেয়া সংবাদকে অসত্য বলা ও একে কোন অপবাদ দেয়া হল সম্পূর্ণ কুফুরী ও মারাত্মক অশিষ্টতা, যার কোন ক্ষমা আল্লাহর কাছে নেই।
আল্লাহ বলেন, ‘‘আর এ কুরআন তো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো থেকে রচিত নয়, বরং এ হচ্ছে তার পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যতা প্রতিপাদনকারী এবং সে গ্রন্থের বিশদ বিবরণ যা রাববুল আলামীনের পক্ষ থেকে সন্দেহাতীতভাবে অবতীর্ণ। তারা কি বলে যে, সে তা রচনা করেছে? বল, তাহলে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে এস এবং তোমাদের সাধ্যানুযায়ী আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে ডাক, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। বরং যে জ্ঞান তাদের আয়ত্বে নেই সে সম্পর্কে তারা মিথ্যাচার করছে….।’’ (সূরা ইউনুস:৩৭-৩৯)
ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে শিষ্টাচারিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল- তাঁর সবকিছু পরিপূর্ণভাবে মেনে নেয়া ও তাঁর নির্দেশের আনুগত্য করা, তাঁর দেয়া সব সংবাদ সত্য বলে মেনে নেয়া এবং খেয়ালের বশবর্তী হয়ে যুক্তির খাতিরে তা প্রত্যাখ্যান না করা কিংবা কোন সংশয়ের কারণে তাতে সন্দেহ প্রকাশ না করা অথবা অন্য লোকদের মতামত ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্যাসকে তাঁর উপর প্রাধান্য না দেয়া।’’ [মাদারিজুস সালেকীন ২/৩৮৭]

৪. তাঁর ইত্তেবা করা, আনুগত্য পোষণ ও তাঁর হিদায়াতের আলোকে পরিচালিত হওয়া
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয় রাসূলুল্লাহর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ, বিশেষ করে ঐ ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা পোষণ করে এবং আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করে।’’ [সূরা আহযাব: ২১]
ইমাম ইবনু কাসীর বলেন, ‘‘সকল কথা, কাজ ও অবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে এ আয়াতটি একটি মৌলিক দলীল।’’ [তাফসীরুল কুরআনিল আযীম: ৩/৪৭৫]
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল আমি তো তোমাকে তাদের হেফাযতকারী রূপে প্রেরণ করিনি।’’ [সূরা নিসা: ৮০]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুসরণ কর আল্লাহর এবং অনুসরণ কর রাসূলের; আর তোমাদের মধ্যে যারা উলুল আমর তাদের। আর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিতণ্ডায় লিপ্ত হও, তাহলে আল্লাহ ও রাসূলের (সমাধানের) দিকে ফিরে আস, যদি তোমরা ঈমান পোষণ করে থাক আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি। এটাই পরিণামের দিক দিয়ে সর্বোত্তম ও সুন্দরতম।’’ [সূরা নিসা: ৫৯] এ প্রসঙ্গে রাসূল ﷺ নিজেই অসংখ্য হাদীসে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছেন।

৫. রাসূল ﷺ সুন্নাতের বিধান দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়া
এ বিষয়টি রাসূল ﷺ-কে ভালোবাসার অন্যতম একটি মানদন্ড। এর বাস্তবায়ন না হলে ভালোবাসা তো নয়ই বরং ঈমানের দাবীও কেউ করতে পারে না।
সেটিই আল্লাহ বলেছেন এভাবে, ‘‘তোমার রবের শপথ! কক্ষণও নয়, তারা ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না তারা তোমাকে নিজেদের মধ্যকার বাদানুবাদের ক্ষেত্রে হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয়, অতঃপর তুমি যে মিমাংসা করে দাও তাতে তাদের মনে কোন দ্বিধা তারা রাখে না এবং পরিপূর্ণভাবে মেনে নেয়।’’ [সূরা নিসাঃ ৬৫]
ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘‘যারা নবী ﷺ-এর সুন্নাত থেকে বের হয়ে যায়, আল্লাহ নিজে তাঁর পবিত্র সত্ত্বার কসম করে বলেছেন যে, তারা ঈমানদার নয়।’’ [মাজমু আল ফাতাওয়া ২৮/৪৭১]

৬. রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর পক্ষে অবস্থান নেয়া
রাসূল ﷺ-কে মহব্বত করার একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ও বড় উপায় হচ্ছে তাঁর পক্ষে অবস্থান নেয়া ও তাঁকে সাহায্য করা।
আল্লাহ বলেন, ‘‘যে সকল দরিদ্র মুহাজিরকে তার বাসস্থান ও সম্পত্তি হতে বহিষ্কৃত করা হয়েছে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে, তারাই হল সত্যবাদী।’’ [সূরা হাশর: ৮]
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পক্ষে অবস্থান নেয়া ও তাঁকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে চমৎকার ও সত্যিকার সব উদাহরণ পেশ করেছেন তাঁরই প্রিয় সাহাবাগণ। আজকের প্রেক্ষাপটে যেখানে বিভিন্ন দেশের অমুসলিমগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্নক কথা বলছে, সেখানে আমাদের উচিত তার প্রতিবাদ করা এবং নবী ﷺ-এর পক্ষে অবস্থান নেয়া। অতএব রাসূল ﷺ-এর আদেশের সারবত্তা তুলে ধরা ও মানুষকে তা মেনে নেয়ার আহবান জানানোই হল মূলত আজকের প্রেক্ষাপটে রাসূল ﷺ-কে সাহায্য করার অর্থ।

৭. রাসূল ﷺ -কে মহব্বত করার আরেকটি উপায় হল
তাঁর প্রিয় সাহাবাদেরকে ভালোবাসা ও তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়া, তাদেরকে আমাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ ও তাদের সুন্নাতের অনুসরণ করা। আল কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সাহাবাদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন এবং তাদের গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন ও তাদের প্রতি তিনি যে সন্তুষ্ট সে ঘোষণাও দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সাহাবাগণের প্রতি ভালোবাসা পোষণের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে রাসূল ﷺ -এর প্রতি ভালোবাসা আরো পাকাপোক্ত হয়।

৮. রাসূল ﷺ -এর সুন্নাতের প্রচার ও প্রসার করা তাঁর প্রতি ভালোবাসা পোষণের অন্যতম একটি উপায়
নিজের জীবনে সুন্নাতকে বাস্তবায়ন না করে এবং সুন্নাতের প্রচার প্রসারের জন্য কোনরূপ চেষ্টা না করে শুধু মৌখিকভাবে তাঁকে ভালোবাসার দাবী করলেই তাঁর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা হয় না- বিষয়টি সবার কাছেই স্পষ্ট। আজ আমাদের সমাজে যেখানে সুন্নাত ও বিদ‘আতের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটেছে, অথবা যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত সুন্নাত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কিংবা তথাকথিত কতিপয় আধুনিক শিক্ষিতরা সুন্নাতের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করছে, সেখানে সত্যিকার সুন্নাতের বিপুল প্রচার ও প্রসার রাসূল ﷺ -এর ভালোবাসার দাবীদারদের উপর এক অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিশেষে এ কথা বলে শেষ করবো যে, আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে জানা, বোঝা ও আমল করার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় নেতা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, মহানবী ﷺ-কে প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসার তাওফীক দিয়ে আমাদের ঈমানকে পরিপূর্ণ করে দেন। আমীন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ