বইয়ের নাম: আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে রামাদান মাসে একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য
লেখক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সোর্স: ইসলাম হাউজ ডটকম
পৃষ্টা সংখ্যা: ৩২ (পকেট সাইজ)।
মুদ্রিত মূল্য: বিনা মূল্যে।
প্রকাশনায়: বিলিভার্স ভিশন।
রামাদান আল-কুরআনের মাস
রামাদান মাস সিয়াম সাধনা ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফযীলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন।
রামাদান আল-কুরআনের মাস: আল্লাহ একে কুরআন নাযিলের মর্যাদাপূর্ণ সময়রূপে চয়ন করেছেন। তিনি বলেন,
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ﴾
‘‘রামাদান মাস-এতে কুরআন নাযিল হয়েছে।’’ – (সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৫)
এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ وَصُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ»
‘‘রামাদান মাসে এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়। – (সহীহ বুখারী:১৮০০, ৩১০৩, সহীহ মুসলিম:২৫৪৭)
এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদরের ন্যায় বরকতময় রজনী:
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ۞ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ۞ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ۞﴾
‘‘লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।’’ – (সূরা আল-ক্বদর: ৩-৫)
এ মাস দু‘আ কবুলের মাস:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ لِلَّهِ عُتَقَاءَ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ لِكُلِّ عَبْدٍ مِنْهُمْ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَة»
‘‘(রামাদানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। তাদের প্রত্যেক বান্দার দু‘আ কবুল হয়ে থাকে (যা সে রামাদান মাসে করে থাকে)।’’ – (সহীহ সনদে ইমাম আহমাদ কর্তৃক বর্ণিত: ৭৪৫০)
তাকওয়া অর্জনের এ মুবারক মাসে মুমিনদের উপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি হয়েছে পুণ্য অর্জনের বিশাল সুযোগ এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের উচিত চারিত্রিক অধঃপতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, নেতিয়ে পড়া চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সকল প্রকার অনাহুত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা, যাতে তারা রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কুরআন নাযিলের এ মাসে কুরআনের মর্ম অনুধাবন করতে পারে, তা থেকে হিদায়াত লাভ করতে পারে এবং জীবেনের সর্বক্ষেত্রে একেই অনুসরণের একমাত্র মত ও পথ রূপে গ্রহণ করতে পারে।
পবিত্র রামাদান মাসে যেসব দায়িত্ব ও কাজ শরীয়ত কর্তৃক অর্পিত হয়েছে কিংবা যা পালনে শরীয়ত আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে ও যা বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছে, পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে সেগুলো নিচে আমরা দু’ভাগে আলোচনা করব।
প্রথম ভাগ: যা করতে শরীয়ত নির্দেশ দিয়েছে এবং উদ্বুদ্ধ করেছে সেগুলো নিম্নরূপ:
এক: সিয়াম বা রোজা
রামাদান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজই হলো সিয়াম। আর সিয়াম হলো ফজরের উদয়লগ্ন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়্যাতসহ পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা।
সিয়াম পালন তথা রোজা ফরজ এবং এটি ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ۞ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَٰتٖۚ﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমদের উপর রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো- নির্দিষ্ট কয়েকদিন মাত্র ……।’’ – (সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৩-১৮৪)
﴿فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ﴾
‘‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে।’’ – (সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৫)
রোজার গুরুত্ব আরো প্রকটিত হয় সে সব ফযীলতের দ্বারা, যদ্বারা একে বিশেষত্ব দান করা হয়েছে। সে সবের মধ্যে রয়েছে:
রোজার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন: একটি হাদীসে কুদসীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ»
আল্লাহ বলেন, ‘‘বনী আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোজার কথা আলাদা, কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দিব।’’ – (সহীহ বুখারী:১৮০৫, ৫৫৮৩, সহীহ মুসলিম:২৭৬০)
রোজা রাখা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের উপায়:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه»
‘‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোজা রাখবে, তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’’ – (সহীহ বুখারী:১৯১০, সহীহ মুসলিম:১৮১৭)
রোজা জান্নাত লাভের পথ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ فِى الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مَعَهُمْ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَدْخُلُونَ مِنْهُ فَإِذَا دَخَلَ آخِرُهُمْ أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ»
‘‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’- কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না….. রোজাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ – (সহীহ বুখারী:১৭৯৭, সহীহ মুসলিম:২৭৬৬ )
রোজাদারের জন্য রোজা শাফাআত করবে:
উত্তম সনদে ইমাম আহমাদ ও হাকিম বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ»
‘‘রোজা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য শাফাআত করবে। রোজা বলবে, হে রব! আমি তাকে দিবসে পানাহার ও কামনা চরিতার্থ করা থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে আমাকে শাফাআত করার অনুমতি দিন…..।’’ – (মুসনাদ:৬৬২৬, আল-মুস্তাদরাক:২০৩৬)
রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ»
‘‘যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! রোজাদারের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও সুগন্ধিময়।’’ – (সহীহ বুখারী:১৮৯৪, সহীহ মুসলিম:২৭৬২)
রোজা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায়:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّه»
‘‘রোজাদারের জন্য দু’টো খুশির সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় রব আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।’’ – (সহীহ বুখারী:১৮০৫, সহীহ মুসলিম:২৭৬৩)
রোজা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢাল:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ صَامَ يَوْمًا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بَعَّدَ اللَّهُ وَجْهَهُ عَنْ النَّارِ سَبْعِينَ خَرِيفًا»
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখে, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বৎসরের দূরত্বে নিয়ে যান।’’ – (সহীহ বুখারী:২৬৮৫, সহীহ মুসলিম:২৭৬৭)
ইমাম আহমাদ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الصَّوْمُ جُنَّةٌ مِنْ عَذَابِ اللَّهِ كَجُنَّةِ أَحَدِكُمْ مِنْ الْقِتَالِ»
‘‘রোজা ঢাল স্বরূপ-যদ্বারা বান্দা নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারে, যেভাবে তোমাদের কেউ একজন যুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করে।’’ – (মুসনাদ:১৭৯০৯)
রোজার আরো ফযীলতের মধ্যে রয়েছে- এতে ইচ্ছা ও সংকল্পে দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়, চারিত্রিক মাহাত্ম্য অর্জিত হয়, শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায় এবং সর্বোপরি তা মুসলিম উম্মাহ্ একতাবদ্ধ হওয়ার এক বাস্তব নিদর্শন।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....