গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ১৬তম পর্ব ©মারুফ হুসাইন

 গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া

১৬তম পর্ব

©মারুফ হুসাইন



পাখিকে একটা হোস্টেলে দেয়া হয়েছে। সেখানে থেকেই সে পড়াশুনা চালাচ্ছে। শরিফুল মুনাকে নিয়ে একদিন পাখির হোস্টেলে গিয়েছিল। পাখির সাথে দেখা করিয়ে এনে তাকে বলেছে, 'যদি কোনোদিন আমি না থাকি, তাহলে এই মেয়েটাকে তুমি দেখবে?'


মুনা তাকে আশ্বাস দিয়েছে, সে না থাকলেও এই মেয়েটার দেখাশোনার দায়িত্ব নিবে। শরিফুল পাখির ব্যপারে নিশ্চিন্ত হয়। মুনা কখনোই কথার বরখেলাফ করে না৷ সে যতদিন পারে পাখিকে দেখে তো রাখবেই। সে না থাকলে মুনা আছে। তাই এখন আর তার জীবন নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। সে না থাকলেও তার কাধে থাকা দায়িত্বটা একজন তুলে নিবে।


নূহার এক্সাম শেষ হয়ে গেছে৷ এখন তার ফ্রি সময় কাঁটছে। এই সময়টা সে বেশিরভাগই শরিফুলের সাথে কাটাতে চায়। কিন্তু শরিফুল তাকে সময় দিলেও যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করে। সে চাইলেও তা নিয়ে তাকে অবজেকশন করতে পারে না। তা করার অধিকার শরিফুল তাকে দেয়নি। তার এখন বেশিরভাগ সময় মায়ের পাশে হাসপাতালে বসে কাটে৷ মায়ের সাথে কথা বলে। তার জীবনে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সব কিছু মায়ের সাথে শেয়ার করে। মা শুনতে পায় কিনা, সে জানে না। কিন্তু সে চায়, মা তার কথা শুনুক। তার কথার উত্তর করুক!


শরিফুলের অবহেলায় তার যখন মন খারাপ হয় তখন মায়ের কাছে এসে অভিযোগ করে। কিন্তু মা যখন তার কথার কোনো উত্তর দেয় না। তার মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। তাকে একাকীত্ব গ্রাস করে নেয়। তখন বাবার উপর রাগ হয়৷ তার আজকের এই অবস্থার জন্য যত দায় পুরোটাই বাবার। বাবা-মায়ের ঝগড়া থেকে মায়ের এই অবস্থা হয়েছিল, তখন ব্যপারটা বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বুঝে। ওদিন সেই ঝগড়া থেকেই মায়ের সাথে এক্সিডেন্টটা ঘটেছিল৷


বাবার উপর রাগের কারণ শুধু এইটুকুই না। বাবা তার কোনো কিছুর কমতি রাখেননি। কিন্তু সন্তানের সবচেয়ে বড় যে চাওয়া, বাবা-মায়ের সঙ্গ সেটাই তিনি কখনো দেননি। ছোটবেলা মায়ের সঙ্গ কেড়ে নিয়েছেন। নিজেও সবসময় ব্যস্ততা দেখিয়েছেন৷ তাকে কখনো সময় দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি৷


মুনা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে৷ আফজাল সাহেব অফিসের উদ্দেশ্য বের হয়ে যেতেই তার ব্যস্ততা শুরু হয়েছে৷ অনেক রান্না-বান্না করতে হবে। একটা সময় এই দিনটায় তার আয়োজনের শেষ থাকত না। গত কয়েক বছর তার আয়োজনের সুযোগ হয়ে উঠেনি। এই দিনটা আসলেই সকাল থেকে তার মন খারাপ হয়ে থাকত৷ কাউকে কিছু বলাও যেত না। পুরো দিনটা তার অস্থিরতায় কাটত। কিছুই ভালো লাগত না। অনেকগুলো বছরেও তার এই দিনিটার আয়োজনের অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ অভ্যাসের পরিপন্থী হওয়ায় তার মেজাজও খিটখিটে হয়ে থাকত। কিন্তু আজ অনেক বছর পর আবার এই দিনটাকে উদ্দেশ্য করে তার মন ফুরফুরা হয়ে আছে। আজ তার জন্মদিন। আফজাল সাহেব এই দিনটাকে কখনোই স্প্যাশাল করে দেখেননি। হয়তো উনি বলতেই পারবেন না যে আজ মুনার জন্মদিন। বিয়ের পর প্রথম দুয়েক বছর আফজাল সাহেবকে বলেছিল। কিন্তু তিনি এমন একটা ভাব করতেন যেন এটা কোনো বিষয়ই না৷ এতে মুনার মন খারাপ হয়ে যেত। এরপর থেকে আফজাল সাহেব থেকে এসব এক্সপেকটেশন আর রাখে না। তবে আফজাল সাহেবের উপর তার কোনো রাগ নেই। ভালোবাসা, দায়িত্ব পূরণ কোনো কিছুরই কমতি তিনি রাখেন না৷ তবুও সে এইসব দিনগুলোতে একটু স্প্যাশাল কিছু চাইত। কিন্তু আফজাল সাহেব সেগুলোর দিকে কখনো খেয়ালই দেননি। 


মুনার বিশ্বাস, এতো বছর হয়ে গেলেও শরিফুল তার জন্মদিন ঠিকই মনে রেখেছে। আজ এসে তাকে উইশও করবে৷ বিয়ের আগের জন্মদিনগুলো শরিফুল-ই দিনটাকে স্প্যাশাল করে তুলত। তার জন্যই নিজেকে স্প্যাশাল মনে হতো। 


মুনা ভালো-মন্দ রান্না করে। আজকে তার জন্মদিন ঠিকই। তবুও আয়োজনটাও সেই করছে। তার ইচ্ছা হচ্ছে, দুপুরটা এমন কারো সাথে কাটুক যে তাকে স্প্যাশাল ফিল করাত। এছাড়া শরিফুল আর মাত্র দেড় দু মাস পড়াবে। হয়তো এরপর আর কখনোই সে যোগাযোগ করবে না। তাই তার আগে একটা দিন তার সাথে একটু কোয়ালিটি টাইম কাটুক। বিচ্ছেদটা যখন হয়েছিল তখন শরিফুলের উপর অভিযোগের শেষ ছিল না। রাগের শেষ ছিল না। কিন্তু এখনো সে তার ব্যপারটা ক্লিয়ার না করলেও মুনা ঠিকই বুঝতে পারছে যে শরিফুল ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করেনি। তাই শেষটা সুন্দরই থাকুক৷ এতো রাগ, ক্ষোভ রেখে কী লাভ!


মুনা খাবার-টাবার রান্না শেষ করে গোসল করে। শাড়ি পরে৷ ভালো করে সাজগোজ করে শরিফুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে৷ 


পড়ানোর টাইম পার হয়ে বিকেল হয়। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা৷ কিন্তু শরিফুলের কোনো খবর নেই। মুনা অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাংতেই তার মন খারাপ হয়ে ওঠে৷ বারান্দায় গিয়ে দোলনায় বসে। মোবাইল হাতে নেয়। ড্রাইভে ঢুকে অনেক বছর আগে কাটানো তার জন্মদিনের ছবিগুলো দেখতে থাকে। সেই সময়গুলো কতই না রঙ্গিন ছিল! কিন্তু এখন......

মুনার ভাবতে আর ভালো লাগে না৷ ড্রাইভ থেকে বের হয়ে ডায়ালে ঢুকে। শরিফুলকে একটা কল দিবে কিনা ভাবছে! কিছুক্ষণ ভেবেই কল দিয়ে বসে৷ রিং হয়। কিন্তু কেউ কল ধরে না।


শরিফুল দুপুরেই কাওরান বাজার বস্তিতে চলে এসেছিল৷ এই দিনটা পথশিশুদের নিয়ে আয়োজনে কাটে তার। গত কয়েক বছর ধরে এই দিনে তার এটাই রুটিন। উপলক্ষ ভালোবাসার মানুষের জন্মদিন। চাইলে সে আজ ঐ মানুষটার সাথেই আয়োজন করতে পারত। কিন্তু তার ইচ্ছা করেনি৷ কারো সুখের সংসারে সে কাটা লাগাতে চায় না৷ এছাড়া অনেক বছর ধরে পথ শিশুদের নিয়েই তার আয়োজন চলে। এবার এটার ব্যতিক্রম হোক, সে চায়নি।


আয়োজন শেষে সন্ধ্যায় শরিফুল বস্তি থেকে বের হয়। রেললাইন ধরে হেঁটে মগবাজার অবধি যাবে৷ সেখানে বসে এক কাপ চা খেয়ে আবার হেঁটে মেসে ফিরে যাবে।


মগবাজার যাওয়ার পথেই তার মোবাইল বেজে ওঠে। পকেট থেকে বের করে মুনার কল দেখতে পেয়ে সাইলেন্ট করে মোবাইলটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। সে এই কল ধরতে চায় না। তার কল ধরলেই নিজেকে সামলানো মুশকিল হবে। সাথে মুনাও দূর্বল হয়ে যাবে। যেটা সে একদমই চায় না। বরং আর দুটো মাস শেষ হলে দূরত্ব বাড়বে। কারো সুখের সংসার নষ্ট করার ভয় আর তার থাকবে না। দেড় দু'টা মাসের জন্য এসব অনুভূতিকে আর সে প্রশ্রয় দিতে চায় না। দেড়-দু মাসের জন্য বললে ভুল হবে। বরং বলা যেতে পারে, কারো সুন্দর জীবন নষ্ট করে নিজে সুখি হতে চায় না।


চলবে.........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ