গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ৫ম পর্ব ©মারুফ হুসাইন।

গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া।

৫ম পর্ব ©মারুফ হুসাইন।

গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া  ৫ম পর্ব ©মারুফ হুসাইন


বিলকিস আপার অবস্থা তেমন ভালো নয়। কালকে থেকে বেশ খারাপ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

'আপাকে ঠিক মতো ওষুধ খাইয়েছিলি?' শরিফুল পাখিকে জিজ্ঞাসা করে৷ পাখি বিলকিস আপার মেয়ে। মাত্র এগারো বছর বয়স হলেও বেশ দায়িত্বশীল। এবার ক্লাস ফোরে পড়ছে। পড়ালেখার পাশাপাশি ঘরের দায়িত্বও তার সামলাতে হয়। শরিফুলই তাকে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেছিল। তার বন্ধু জায়েদ এই মেয়েটার পড়ালেখার খরচ চালায়

'হ্ মামা খাওয়াইসিলাম। তয় মায় তো ওষুধ খাইতেই চায় না৷'

'খেতে না চাইলেও খাওয়াতে হবে।' বলে শরিফুল বিলকিস আপার ঘর থেকে বের হয়ে যায়৷ 

'মামা! ভাত খাইয়া যান!' পাখি পিছন থেকে ডেকে বলে। 

'আমি যাচ্ছি না। তুই রেডি হয়ে আপাকে নিয়ে বের হ। আমি সিএনজি ডেকে আনছি। '

'কই নিয়া যাইবেন?'

'ডাক্তারের কাছে।'


সিএনজিতে উঠে শরিফুল তার এক বন্ধুকে কল করে৷ যে ডাক্তার হিসেবে হাসপাতালে কর্মরত আছে। অনেক দিন ধরে তার সাথে যোগাযোগ হয় না। আজ প্রয়োজনে তাকে ফোন করতে কিছুটা দ্বিধা হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই৷ সরকারি হাসপাতালে ভালো সার্ভিস পেতে হলে এমন জানাশোনা থাকতে হয়। 

প্রথমবার কল রিসিভ না করলেও দ্বিতীয়বারে কল রিসিভ হয়৷ শরিফুলের নাম্বার মাঞ্জুরুলের কাছে সেভ ছিল, 'হ্যাঁ বন্ধু এতো দিন পর? কেমন আছিস?'

'ভালো। তুই?'

'আমাদের আর থাকা!'

'আমি আপাকে নিয়ে হাসপাতাল যাচ্ছি৷ তুই হাসপাতালে আছিস?' শরিফুল কোনো ভণিতা করে না। সরাসরি কাজের কথায় চলে যায়।

'এখন তো আমার ডিউডি নেই। তবুও তুই যা, সমস্যা নেই। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। তুই গেলেই তোকে গেট থেকে রিসিভ করবে। বাকি সব সে ব্যবস্থা করে দিবে।'

'ধন্যবাদ বন্ধু, অনেক উপকার হলো।'


সিএনজি থেকে নামতেই লোকটাকে পেয়ে গেল। ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে তার সাথে ফোনে কথা হয়েছে৷ মাঞ্জুরুলের সাথে কথা বলে রাখার কিছুক্ষণ পরই সে ফোন করে জানাল, মাঞ্জুর স্যার নাম্বার দিয়ে তাকে ফোন দিতে বলেছে৷ 


বিলকিস আপাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। মাঞ্জুরুল ফোন করে দেয়ায় তার কোনো হয়রানি হয়নি। সব কিছু ঠিকঠাকভাবেই হয়েছে৷ মাঞ্জুরুলের ফোন করা লোকটার হাতে শরিফুল কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, 'আপার খোঁজ খবর নিবে। তার দেখাশোনা করবে৷ দরকার হলে আমাকে ফোন দিবে।' 

'না, স্যার টাকা লাগব না। মাঞ্জুর স্যার বইলা দিসে, আমি এমনিতেই খোঁজ খবর নিমু।' লোকটা টাকা নিতে চায় না। তবুও শরিফুল জোর করে টাকা ধরিয়ে দেয়। 


হাসপাতাল থেকে বের হয়ে শরিফুল কিছু দূর হেঁটে গিয়ে একটা টংয়ে বসে সিগারেট ধরায়।

সে সুস্থ হওয়ার পর মেসে ফিরে গিয়েও বিলকিস আপার কথা ভুলেনি। প্রায় তার খোঁজ-খবর নিতে আসত। তাকে দেখে বিলকিস আপাও বেশ খুশি হতো৷ নিজের ভাইয়ের মতোই আদর-যত্ন করত। কথায় কথায় শরিফুল একবার বলেছিল, 'আপা! আপনি এই কাজ ছেড়ে দিতে পারেন না?'

'ছাইড়াই দিতে চাই ভাই।  ছাইড়া দিলে মাইয়াডারে খাওয়ামু কী!' তখন পাখির বয়স অনেক কম৷ পাখির মাথায় হাত বুলিয় দিয়ে বিলকিস আপা বলে।

'অন্য কাজ করলেই তো হয়!'

'করতে চাই ভাই, কিন্তু আমগোরে কাজ দিব কেডা?'

'আপা! আমি আপনাকে মানুষের বাসায় কাজের ব্যবস্থা করে দিব। করবেন?'

'তুই কইসস, আমি আজকে থেইকাই এই কাজ ছাইড়া দিলাম৷ '


ওদিনের কথোপকথন ভাবতে ভাবতেই শরিফুল সিগারেট শেষ হয়ে যায়৷ সেদিন তার এক বলাতেই বিলকিস আপা তার এমন কাজ ছেড়ে দিয়ে মানুষের বাসার কাজে লেগে যায়৷ 


বিল মিটিয়ে সে উঠে পড়ে৷ মায়ের পরে তাকে মায়ের মতো আদর দিয়েছিলেন, এই বিলকিস আপা। কিন্তু সেও এখন বিছানায়, ভাবতেই শরিফুলের মন খারাপ হয়ে যায়, তার আর আপন বলতে কেউই থাকবে না৷ সে মোবাইল বের করে ঘড়ি দেখে। রাতের নয়টা বাজে। মেসে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। কোথায় যাওয়া যায়, সে ভাবতে থাকে।


নূহা খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়৷ তাদের বিশাল এই ডুপ্লেক্স বাড়িতে সে একাই থাকে, বলা যায়। তার মা হাসপাতালে, বাবা কখন কোথায় থাকে বলা যায় না। ব্যবসায়ীক কাজে সারা সপ্তাহ-ই তার বাইরে থাকতে হয়। এই বাড়িতে লোক বলতে সে আর দুই জন কাজের মহিলা। যারা সবসময় এই বাড়িতেই থাকে। ড্রাইভার আর দারোওয়ানদের জন্য এক সাইডে আলাদা রুম করা আছে৷ পুরো বাড়িতে মানুষ বলতে এই ছয় জনই। দ্বিতীয় তলায় সে ছাড়া আর কেউ নেই৷ 


নূহা ডায়াল প্যাড বের করে৷ নাম্বারে ডায়াল করে ভাবতে থাকে, ফোন দিবে কিনা! দুপুরে কলেজ থেকে ফেরার পথে তার মোবাইলে টাকা নেই, একটা কল করতে হবে বলে শহিদ ভাইয়ের মোবাইলটা চেয়ে নিয়েছিল৷ তখন সেদিনের কল টাইম মিলিয়ে শরিফুলের নাম্বারটা নিয়ে রেখেছে৷ সে ডায়াল প্যাডে তাকিয়ে সেদিনের কথা ভাবে৷ শেষ কবে সে এতোটা মন খুলে উৎফুল্ল হয়ে ঘুরেছিল, ভুলে গেছে৷


সে বছরখানেক আগে শরিফুলকে প্রথম দেখেছিল। তখন সে ক্লাস  নাইনে৷ অর্ধেক বছর পার হয়ে গেছে৷ একদিন ক্লাস শেষে বান্ধবীরা বলল, রমনায় যাবে৷ তার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তাদের জোরাজুরিতে রাজি হতে হয়। 


রমনার ভিতরের দিকে এগিয়ে যেতেই এক ছাউনিতে কিছু পথ শিশুর ভিড় দেখে সে উৎসাহ নিয়ে তাকায়। শরিফুল সেই ভিড়ের মধ্যমনি ছিল। ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে সে বেশ উৎফুল্ল ছিল, গল্প করছিল, তাদের সাথে খুনসুটিতে মেতে ছিল৷ 

সেদিন শরিফুল নূহার চোখে প্রথম ধরা পড়ে৷ সে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এক বুড়ো লোকের নির্ভেজাল, নিষ্পাপ হাঁসি দেখে মুগ্ধ হয়। 


নূহা নাম্বারটার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে৷ শরিফুলকে প্রথম দেখার স্মৃতি মনে করে মুচকি হাসছে৷ সে বেখেয়ালেই কল বাটনে ক্লিক করে ফেলল। কলিং উঠতেই সে কল কেটে দেয়।  বুঝে উঠতে পারে না, 'ফোন দিবে কিনা! আর দিয়েই বা কী বলবে!' ভাবতে ভাবতেই আবার কল দিয়ে ফেলে। দোটানায় পড়ে কল কেটে দিবে দিবে করেও সে এবার আর কল কাটেনি।

রিং হচ্ছে৷ নূহা শরিফুলের কল ধরার অপেক্ষায় মোবাইলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অপেক্ষা করছে, কখন কলটা রিসিভ হবে। অল্প কিছু সময় তার কাছে অনন্তকাল মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে তার হার্টবিটও যাচ্ছে। এক্সাইটমেন্টে নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে।


চলবে......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ