গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া
১২তম পর্ব
©মারুফ হুসাইন।
শরিফুলকে বসতে বলে আফজাল সাহেব পিয়নকে ডেকে চা দিতে বলল। তিনি তার চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করেন, 'শরিফ সাহেব, কেমন আছেন?' শরিফুলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি যোগ করলেন, 'প্রথম দিন আপনার সাথে দেখা হলো। এরপর আর একবারো দেখা করতে পারলাম না। তার জন্য আমি দুঃখিত। তবে আপনার আর আপনার ছাত্রীর আপডেট কিন্তু আমি নেই।'
'জি ধন্যবাদ। আর আমি জানি আপনি ব্যস্ত থাকেন। তাই দেখা হয়ে উঠে না।'
চা রেডি করাই থাকে। তাই নিয়ে আসতে দেরী হয়নি। পিয়ন এসে দু কাপ দু জনের হাতে দিয়ে চলে গেল। হাতে কাপ নিয়ে আফজাল সাহেব বললেন, 'তো আজ আমার অফিসে আসলেন! কোনো প্রয়োজনে?'
'হ্যাঁ, আসলে কিভাবে বলব বুঝে উঠতে পারছি না।' শরিফুল ভণিতা করে৷ সে এতো অল্প সময় পড়িয়ে টিউশনি ছেড়ে দেয়ার কথা বলতে পারছে না বলে।
'আরে বলে ফেলুন, সমস্যা নেই!'
'আসলে আগামি মাস থেকে আমি টিউশনিটা ছেড়ে দিতে চাচ্ছি!'
'কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে? হলে আমাকে বলতে পারেন!' একটু থেমে আফজাল সাহেব আরো যোগ করলেন, 'সম্মানি নিয়ে ঝামেলা হলেও বলতে পারেন!'
'না, না এমন কিছু না৷ আসলে আমার ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলার কারণে ছেড়ে দিতে চাচ্ছি৷'
আফজাল সাহেব উঠে দাঁড়ায়, 'দরকার হলে আপনি কিছুদিন গ্যাপ নেন। ঝামেলাটা দূর করে আবার জয়েন করেন৷ বুঝেনই তো বাচ্চা মেয়ে, আপনার সাথে কী সুন্দর মিশে গেছে। আবার নতুন কেউ আসলে তার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা সেটাও একটা ব্যপার! তাই চাচ্ছি আপনি তাকে সময় দিন। জোরাজুরি নেই। কিন্তু আমার দিকটাও একটু বিচার করে দেখার অনুরোধ রইল।'
শরিফুল কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। সে ব্যপারটা বুঝতে পারে, বাচ্চাদের সাথে সবাই মিশতে পারে না৷ তাদের মতো করে পড়াতে পারে না৷ কিন্তু সে পারে৷ সে ছেড়ে দিলে নতুন কেউ এসে গুছিয়ে নিতে পারবে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে৷ আর সেও চায়, সামিয়ার জীবনে অনেক ভালো কিছু হোক৷ আর সে যতটা আপন করে নিয়ে তাকে গাইড করবে। অন্য কেউ তা করবে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে৷
'আচ্ছা শরিফ সাহেব! দরকার হলে আপনি কিছু দিন ব্রেক নেন, সামিয়াকে স্কুলে ভর্তি করানো অবধি আপনি দেখে রাখেন!'
শরিফুল কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থেকে উঠে পড়ে, 'ঠিক আছে, আজ আসি!'
আফজাল সাহেবের অফিস থেকে সে বের হয়৷ আজ নূহার সাথে দেখা করার কথা। মেয়েটাকে এখন আর চাইলেও সে এড়িয়ে যেতে পারে না।ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তার মনে হয়, মেয়েটা তার সাথে থাকলে একটু আনন্দ পায়, ভালো থাকে। সেটা তার কেড়ে নেয়ার কী দরকার! মেয়েটা একটু ভালো থাকুক না!
স্কুল থেকে বের হয়ে তাকে ফোন দেয়ার কথা। সে ঘড়ি দেখে, ১২টা ৫বাজে। এতোক্ষণে তার ফোন চলে আসার কথা ছিল। সে চাইলে ফোন দিতে পারে৷ কিন্তু দেয় না। সে চায় না পরবর্তীতে তার উপর অভিযোগ আসুক। মোবাইল পকেটে রাখতে যাবে তখনি তার মোবাইলে কল আসে, 'কোথায় আপনি?'
'মতিঝিল।'
'ঠিক আছে৷ থাকুন আমি আসছি!'
শরিফুল ফোন রেখে পাশের একটা চায়ের দোকানে চলে যায়। নূহার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
আধ ঘন্টার মধ্যে নূহা চলে আসে৷ শরিফুলকে ফোন দেয়। সে দোকান থেকে বের হয়ে একটু দূরেই নূহাদের গাড়ি দেখতে পায়। গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সে সামনে যেতেই দরজা খুলে দিয়ে নূহা বলে, 'আসুন!'
শরিফুল গাড়িতে উঠে বসে, 'কোথায় যাবেন?'
'আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে যাব। আজ বাবা বাসায়। তাই বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।'
'তাহলে আসার কী দরকার ছিল!'
'আপনার সাথে দেখা না হলে ভালো লাগে না।'
শরিফুলের ফোন আসে, 'এক মিনিট!' নূহার উদ্দেশ্যে বলে ফোন রিসিভ করে লাউড দেয়। সাউন্ড কমিয়ে ফোন কানে নেয়, 'আচ্ছা আপা, কাল আসব তাহলে?'
ওপাশ থেকে উত্তর আসে৷
'আচ্ছা আপা!' বলে শরিফুল ফোন রাখে।
'কে ফোন দিয়েছিল?'' নূহা জিজ্ঞাসা করে।
'স্টুডেন্টের মা। আজ যেতে নিষেধ করল।'
'ওহ আচ্ছা৷ কেন?'
'কী জানি!'
নূহা ঘুরে বসে, 'এই আপনি তো স্টুডেন্ট পড়ান!' তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বুঝাই যাচ্ছে, সে কোনো পরিকল্পনা নিয়েই জিজ্ঞাসা করেছে।
'হ্যাঁ৷ এটা আবার জিজ্ঞাসা করার কী আছে!'
'কী সাব্জেক্ট ভালো পড়ান?' শরিফুলের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নেড়ে জিজ্ঞাসা করে।
নূহার পরকিল্পনা তার আর বুঝতে বাকি থাকে না, 'বলা যাবে না।'
'ঠিক আছে বলতে হবে না।' বলে নূহা সামনের দিকে ঘুরে বসে, 'আমি আপনার পড়াশুনার ব্যাকগ্রাউন্ড জানি। বাবার সাথে কথা বলে রাখব। সামনের মাস থেকে আমাকে পড়াবেন।'
'না, আমি পারব না।'
'না, আমার নতুন টিউটর দরকার। আপনি আমাকে পড়াবেন!'
'টিউটর দরকার হলে খুঁজে দিব। কিন্তু আমি যেতে পারব না।'
নূহা আবার ঘুরে বসে। তার মুখে হাসি, 'ঠিক আছে, একটা শর্তে আপনাকে ছাড়ব।'
'কী বিপদে পড়লাম' শরিফুল মনে মনে ভাবে৷ তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ, 'আচ্ছা বলুন কী শর্ত?'
'আমার সাথে প্রতিদিন দেখা করতে হবে।'
'না, আমি পারবা না।'
'তাহলে কিন্তু আমি প্রতিদিন আপনার মেসে গিয়ে হাজির হবো!'
'আল্লাহ কী পাগলের পাল্লায় পড়লাম!' মিনমিন করে বলে নূহার দিকে তাকায়। নূহা ঠোঁটগুলো দু দিকে প্রসারিত করে। শরিফুল গাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে বলে, 'ঠিক আছে, প্রতিদিন না, দুয়েক দিন পর দেখা করব!'
'আচ্ছা। ঠিক আছে৷ কথার ব্যতিক্রম হলে কিন্তু আমি আপনার মেসে গিয়ে উপস্থিত হবো।'
'ঠিক আছে৷' মুখ কালো করে রেখেই শরিফুল উত্তর দেয়।
'প্রমিজ?'
'হ্যাঁ, প্রমিজ!'
'ঠিক আছে৷ তাহলে আর আমার জন্য টিউটর দেখতে হবে না।'
গাড়ি বাংলা মটর চলে এসেছে। শরিফুল এখনো মুখ কালো করে বসে আছে।
'আপনার মেসের কাছাকাছি চলে এসেছি তো!'
'হ্যাঁ নামিয়ে দিন!'
'দিব না।' বলে নূহা সামনের দিকে ঝুকে শরিফুলের বরাবর মাথা নিয়ে এসে বলে, 'এভাবে মুখ কালো করে রাখলে নামাব না।'
নূহার পাগলামি দেখে শরিফুলের হাসি চলে আসে৷ সে হাসি আটকে রাখতে চেয়েও পারে না। খিলখিল করে হেসে দেয়।
চলবে.........
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....