গল্পঃ গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া১৩তম পর্ব ©মারুফ হুসাইন

গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া
১৩তম পর্ব
©মারুফ হুসাইন।
গ্রীষ্মের বিকেলে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ১৩তম পর্ব ©মারুফ হুসাইন Story:- Grismer Bikele Ghorepora krisnochura by Maruf hossin part 13. Bangla tru love story



সামিয়াকে স্কুলে ভর্তি করানো অবধি শরিফুল পড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার একটু ঝামেলা হবে ঠিকই। কিন্তু কিছু করার নেই৷ আফজাল সাহেবের কথা সে ফেলতে পারেনি। এছাড়া তারও আফজাল সাহেবের কথা ঠিক মনে হয়েছে। এখন সে পড়ানো ছেড়ে দিলে নতুন কেউ এসে সামিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করে পড়াতে পারবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাচ্চাদের সাথে তাদের মতো মিশে যেতে না পারলে তাদেরকে পড়ানো যায় না। 

শরিফুল টিউশন শেষ করে বের হয়ে একটা টংয়ে বসেছে। তার নাম্বারে কল আসে৷ আননোন নাম্বার। ফোন রিসিভ করে৷ 'হ্যালো' বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে, 'কোথায় তুমি?'
ওপাশের লোকটাকে শরিফুলের চিনতে অসুবিধা হয় না। তার পরিচিত কন্ঠ৷ অনেক দিন ফোনে কথা হয়নি। তবুও সে চিনতে পারে, 'মগবাজার। টিউশন শেষ করে বের হয়েছি।'
'আজ সামিয়াকে পড়াতে আসতে হবে না৷'
'আচ্ছা, ঠিক আছে।' বলে ফোনটা রেখে দিতে যাবে, তখনি ওপাশ থেকে বলে ওঠে, 'শোন!'
কানের কাছ থেকে মোবাইলটা সরিয়ে এনেও আবার কানের কাছে নিয়ে যায়, 'জি!'
'এক্সাক্ট কোথায় আছো বলো!'
'কেন?'
'তোমার সাথে লাঞ্চ করব। তাই!'
'আমি পারব না। আমার কাজ আছে!'
'আমি জানি তোমার কাজ নেই। তুমি ইচ্ছা করে আমাকে ইগ্নোর কর‍তে চাও!'
'হ্যাঁ, ঠিক তাই৷ বুঝেও বলছো কেন?'
'শরিফ তুমি এটা ঠিক করছো না।'
'আমি বেঠিক কিছু করছি না।'
'পাগলামি করো না। বলো কোথায় আছো আমি আসছি!' মুনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 'যাস্ট লাঞ্চই করব। এর বেশি কিছু না।' মুনার কন্ঠে আকুতি ফুটে ওঠে। 
শরিফুল আর না করতে পারে না।

একটা রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলায় শরিফুল, মুনা মুখামুখি বসে আছে। কারো কন্ঠে কোনো কথা নেই। শরিফুলের দৃষ্টি নিচের দিকে। মুনা কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ সে বুঝতে পেরেও সেদিকে খেয়াল দিচ্ছে না। সে জানে মুনার  দিকে তাকালে এই চাহনি সে বেশিক্ষণ ইগ্নোর করে থাকতে পারবে না।
'তুমি বলে টিউশনটা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলে?'
'হ্যাঁ।'
'কিন্তু কেন?'
'বুঝতেই তো পারছ কেন! তবুও জিজ্ঞাসা করছো কেন!' শরিফুল চোখ তুলে মুনার দিকে তাকায়। তার বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করে৷
'ঠিক আছে, তোমার টিউশনি ছাড়তে হবে না৷ তুমি না চাইলে আমি তোমার মুখামুখি হবো না।' বলে একটু থেমে মুনা যোগ করে, 'তবে আজকের দিনটা আমাকে দেও!' বলে শরিফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে পানি ছলছল করছে।
মুনার চাহনি, কন্ঠের আকুতি শরিফুল অনূভব করতে পারলেও সেদিকে তাকাচ্ছে না৷ সে জানে, সে মুনার দিকে তাকালেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারবে না৷ ইমোশন বেরিয়ে আসবে। সে টেবিলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। 
'কী দিবে না আমাকে? তুমি না চাইলে লাগবে না!'
শরিফুল মাথা তুলে তাকায়, মুনার চোখ ছলছল করছে। সে বুঝতে পারে, এতো বছরেও মুনার মন থেকে তার জন্য ভালোবাসা একটু কমেনি, 'ঠিক আছে। আজ সারা দিন তোমার জন্য রইল।' তার ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু সে প্রকাশ করতে পারছে না৷
ততক্ষণে তাদের টেবিলে খাবার চলে এসেছে৷ দুইজনের সামনে খাবার সার্ভ করা হয়।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে তারা এক সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করছে৷ তারা এক সময় যে জায়গাগুলো চষে বেড়াত তার কোনো একটা জায়গাও বাদ রাখছে না। অবশ্য এসব জায়গায় যাওয়ার তাদের প্ল্যান ছিল না। পুরানো অভ্যাস৷ তাই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে প্ল্যান না থাকা সত্ত্বেও তারা ঘুর‍তে ঘুরতে সে জায়গাগুলোতে চলে যাচ্ছে। টিএসসিতে দাঁড়িয়ে দুই জন দু কাপ চা নেয়৷ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক কাপ চা দুই জন ভাগাভাগি করে চালিয়ে দিত। আজকেও সে ইচ্ছাটা দুই জনের মনে জেগে উঠলেও কেউই প্রকাশ করেনি৷ দুই জনই ইচ্ছাটা মনে সুপ্ত রেখে চা শেষ করে হাঁটতে শুরু করে।

'আমি ঠিক এ জায়গাটাতেই সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম।' নিলখেতের মোড়ে আসতেই নির্দিষ্ট জায়গাটা ইশারা করে মুনা বলে উঠল।
'আমি সেদিন বেরিয়েছিলাম....' শরিফুল না চাইতেও বলতে শুরু করেছিল। বুঝতে পেরেই থেমে যায়। 
মুনা দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘুরে শরিফুলের দিকে তাকায়, 'শেষ করো! থেমে গেলে কেন?'
'চলো, ফিরি!'
'যেটা বলতে চেয়েছিলে, সেটা শেষ করো!'
'কিছু বলতে চাইনি।' বলেই শরিফুল রিকশা ডাকে। উঠে বসে। মুনা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পার হলেও সে রিকশায় উঠে না৷ দম ধরে দাঁড়িয়ে আছে৷  শরিফুল তার দিকে তাকিয়ে বলে, 'উঠছো না যে!'
মুনা কিছু না বলেই ধীরে সুস্থে উঠে বসে।

রিকশা এগিয়ে যায়৷ কিছু দূর যেতেই মুনা শরিফুল হাত টেনে নেয়৷ শরিফুল হাত সরিয়ে নিতে চেয়েও সরাতে পারে না৷ তার ইচ্ছা করে না৷ এক সময় এই হাত ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত। ভরসার হাত ছিল। কত দিন হলো, এই হাতের ছোঁয়া পায় না৷ সে নিজের ভিতর শূন্যতা অনূভব করে। যে শূন্যতা আর কখনোই পূরণ হবার নয় বলে মনে হয়।
এই হাতটা তারই থাকার কথা ছিল। সেদিন এমনটা না হলেও পারত। একটা দিন তার জীবন থেকে কত কিছু কেড়ে নিল। আর সব কিছু ঐ একদিনেই হওয়ার ছিল। আর ঐ একটা দিনই তার জীবনটা পুরাপুরি উলট-পালট করে দিয়েছে।

রিকশা শান্তিবাগ ঢুকে গেছে। পুরোটা সময় দু জন চুপচাপ বসে ছিল৷ কেউই কিছু বলেনি৷ মুনা কখন তার হাত ছেড়ে দিয়েছে সেটাও সে বলতে পারে না।
বাসার কাছে আসতে মুনা রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালার হাতে ভাড়া দেয়, 'বাংলামটর নামিয়ে দিবেন!' বলে দ্রুত পায়ে সোজা বিল্ডিংয়ে ঢুকে যায়। একবার শরিফুলের দিকে তাকিয়েও দেখেনি।  শরিফুল মুনার পথের দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিকশা চলতে শুরু করলে তাত দৃষ্টিচ্যুত হয়৷ তার একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে। রিকশাওয়ালাকে দোকানের সামনে দাঁড়াতে বলে।

চলবে.......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ