বইঃ দেশে বিদেশে PDF, সৈয়দ মুজতবা আলী | Deshe Bideshe PDF By Syed Mujtaba Ali

বইয়ের নাম : দেশে বিদেশে
লেখক : সৈয়দ মুজতবা আলী

প্রাথমিক কথাঃ
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ভ্রমণ কাহিনী "দেশে বিদেশে" বইটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে গণ্য করা হয়৷ লেখকের কাবুলবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এটি।লেখকের রম্য রসাত্বক বর্ণনা, বিভিন্ন পরিচিত কিংবা অপরিচিত মানুষের সাথে রসালাপ, ভ্রমণের সময় বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা এবং শেষ পর্যায়ে এসে আফগানিস্তান ছেড়ে আসার করুণ কাহিনী অসাধারনভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই ভ্রমণ কাহিনীতে। লেখক মাত্র ২৩ বছর বয়সে আফগানিস্তান সরকারের অনুরোধে "কাবুল কৃষি কলেজে" ফার্সি এবং ইংরেজী ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন৷ সেই সময়কার ঘটনা নিয়ে এটি লিখিত৷ পাকিস্তান সহ আফগানিস্তানের মানুষ, তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন, মনন, ধ্যান ধারনা, জীবনবোধ. কাবুলে অবস্থান, আফগানিস্তানের ঘটনাপঞ্জী, প্রতিটি বিষয় তিনি যথাযোগ্য মর্যাদায় রসময় করে তুলে এনেছেন। ২০৮ পৃষ্ঠার বইটির দাম ৩৫০ টাকা৷ 

১৯২৭ সালের এ ভ্রমণ কাহিনীটি লেখা হয় ১৯৪০ সালে এবং বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে৷ ২০১৫ সালে এটির ইংরেজী সংস্করণও প্রকাশিত হয় "ইন আ ল্যান্ড ফার ফ্রম হোম" নামে৷ ইংরেজী অনুবাদ করেন নাজেস আফরোজ। গত শতাব্দীর বিশের দশকে ও তার পরবর্তী সময়ের আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের পতন ও গণতন্ত্রের অভ্যুদয়ের সূচনালগ্নের এক মূল্যবান সাক্ষী এই বই। সেরা বাংলা বই হিসেবে এটিকে ১৯৪৯ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ‘নরসিংহদাস পুরস্কার’ দিয়ে সম্মানিত করেছিল। 

কাহিনী সংক্ষেপঃ
"দেশে বিদেশে" ভ্রমন কাহিনীটি শুরু হয় লেখকের কোলকাতা থেকে পেশওয়ার, খাইবার পাস, জালালাবাদ হয়ে কাবুল যাওয়ার বর্ননা দিয়ে। সময়টা ছিলো ১৯২৭ সালের জুন মাস৷ লেখক আফগান সরকারের আমন্ত্রণে কাবুলে শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন৷ কলকাতার হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত হন ইয়োরোপিয়ন থার্ড নামক যানবাহনে উঠার জন্য৷ 

স্টেশন থেকেই বর্ণনা করতে থাকে ভ্রমণের এ কাহিনীটি৷ সকল সাধারণ ঘটনাকে লেখক রসাত্মক ভাষা বর্ণনায় অসাধারণ রূপদান করেন৷ গাড়ির মধ্যে অচেনা অজানা লোকদের সাথে জমে আড্ডা আলাপ৷ উঠে আসে গাড়িতেই পাঠানদের সরল বন্ধুত্ব, খোশগল্প, আড্ডাবাজী, আতিথেয়তার বর্ণনা৷ 

গাড়িতে প্রথমেই আলাপ জমে মুরুব্বি ড্রাইভারের সাথে, যাকে লেখক সর্দারজী নামে উল্লেখ করেন৷ লেখক বলেন, দেখলুম পাঠানদের বাইরের দিকটা যতই রসকষহীন হোক না কেন, গল্প শোনাতে আর গল্প বলাতে তাদের উৎসাহের সীমা নেই৷ তর্কাতর্কি করে না, গল্প জমাবার জন্য বর্ণনার রঙতুলিও বড় একটা ব্যবহার করে না৷ সব যেন উডকাঠের ব্যাপার, সাদামাটা কাঠখোট্টা বটে৷ কিন্তু ঐ নিরস নিরলঙ্কার বলার ধরনে কেমন যেন একটা গোপন কায়দা রয়েছে যার জন্য মনের উপর বেশ জোর দাগ কেটে যায়৷ বেশিরভাগই মিলিটারী গল্প, মাঝে মাঝে ঘরোয়া অথবা গোষ্ঠী সংঘর্ষের ইতিহাস৷ পাঠানদের গল্প শেষ হয় প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে৷ 

পাঠান মুল্লুকে লোকজন যার যে রকম খুশী চলে৷ খাস পাঠান কখনো কারো জন্য সহজে রাস্তা ছেড়ে দেয় না৷ ঘোড়ার নালের চাট লেগে যদি পায়ের এক খাবলা মাংস উড়ে যায় তাহলে সে রেগে গালাগালি কিংবা মারামারি কিংবা পুলিশ ডাকবে না৷ পরম শ্রদ্ধা আর বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, দেখতে পাস না? চালক ততোধিক অবজ্ঞায় বলবে, তোর চোখ নাই? ব্যাস, যে যার পথে চলে যায়৷ 

গাড়ি থেকে পেশোয়ার স্টেশনে নেমে দেখা হলো লেখকের বন্ধু এবং পেশোয়ারের পুলিশ কর্মকর্তা শেখ আহমদ আলীর সাথে৷ তিনি আগে থেকেই লেখককে গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন৷ লেখক বলেন, দেখলুম পেশোয়ারের বারো আনা লোক আহমদ আলীকে চেনে, আহমদ আলী বোধ হয় দশ আনা চেনেন৷ পেশোয়ারের তাপমাত্রা ১১৪ ডিগ্রী! 

আহমদ আলী বলেন, হন্তদন্ত হওয়ার মানে শয়তানের পন্থায় চলা৷ তাইতো বাইসিকেলের আরেক নাম শয়তানের গাড়ি! 

পাঠান অত্যান্ত অলস এবং আড্ডাবাজ, কিন্তু আরামপ্রয়াসী নয়৷ যেটুকু সামান্য তার বিলাস তার খরচাও ভয়ঙ্কর বেশি কিছু নয়৷ যাদের গায়ের জোর যেমন বেশি তাদের স্বভাবও তেমনি শান্ত, পাঠানদের বেলায় কথাটা খাঁটি৷ 

পাঠানদের দাওয়াত খাওয়া নিয়ে লেখক বলেন, বাঙ্গালিরা খাবারের সকল পদ নিয়েই খাওয়া শুরু করেন৷ পাঠানরা সব পদ পায় না৷ যে যেটা পায় সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট, জান গেলেও খুজবে না৷ হঠাৎ যদি কেউ বলে অমুকতো মাংস পায়নি, তখন সবাই মাংসের পেয়ালা নিয়ে তেড়ে যাবে তার দিকে৷ কিন্তু তার পর হয়তো খোশগল্পে মত্ত হয়ে আবার ভুলে গেছে মাংস দিতে! এদিকে ঐ লোক পোলাওয়ের মরুভূমিতে তৃষ্ণায় মারা গেলো নাকি মাংসের থৈ থৈ ঝোলে ডুবে প্রাণ দিলো তার খবর কারো নেই! গল্পের নেশায় বেখেয়ালে অন্তত আধ ডজন অথিতি সুদ্ধু শুকনো রুটি চিবিয়েই যাচ্ছেন৷ 

পেশোয়ার থেকে কাবুল যেতে পাসপোর্ট নয়, তিনদিন মেয়াদি স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতে হয়৷ সেই স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে লেখক পেশোয়ার থেকে বাসে করে কাবুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন৷ 

গাড়িতে উঠা থেকে শুরু করে পথ ঘাট, আবহাওয়া, ভূ প্রকৃতি সবকিছুর বর্ণনা দিয়েছেন লেখক৷ গাড়ি বিপদ সঙ্কুল গোলযোগপূর্ণ খাইবার পাস হয়ে কাবুলের দিকে এগুচ্ছে৷ জালালাবাদ পর্যন্ত পৌছার আগে গাড়ির চাকা পাংচার হলো, ইঞ্জিন কয়েকবার নষ্ট হলো৷ গাড়ির দুরাবস্থার বর্ণনা দিয়ে লেখক লেখেন, গাড়িটা এতই বাজে যে তার হর্ণ ছাড়া সবই বাজে! মোটরের বনেট খুলতে পেরে ড্রাইভার যেন বউ এর ঘোমটা খোলার আনন্দ পায়৷ গাড়ির ইঞ্জিনের হরেক রকম আওয়াজ থেকে আমেজ পেলুম বিবিজান অনিচ্ছায় শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন৷ 

রাতের বেলা গাড়িতে একটা মাত্র হেড লাইট, তাও মিটমিট করে জ্বলে! কাবুলের নিকটে এসে সেটাও নিভে গেলো৷ তখন একটা হারিকেনের ব্যবস্থা করা হলো৷ লেখক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো, হারিকেনের সামান্য আলোতে গাড়ি চালাতে আসুবিধা হচ্ছে? ড্রাইভার জবাব দিলো, হচ্ছে বই কি, হারিকেনের আলোটা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, ওটা না থাকলে গাড়ি জোরে চালাতে পারতুম৷ 

লেখক বলেন, আফগানিস্থানের বড় শহর পাঁচটি, কাবুল, হিরাত, গজনী, জালালাবাদ, কান্দাহার৷ জালালাবাদ আফগানিস্থানের শীতকালীন রাজধানী৷ পেশোয়ার থেকে জালালাবাদের দূরত্ব একশ মাইল৷ জালালাবাদ থেকে কাবুল আরো একশ মাইল৷ আফগানিস্থানের অধিবাসিরা পাঠান, তাদের মাতৃভাষা পশতু৷ কিন্তু কাবুলের অধিবাসীরা এসেছে ইরান থেকে, তাদের মাতৃভাষা ফার্সী৷ 

অবশেষে কাবুল পৌছার বর্ণনা দিয়ে লেখক বলেন, সে যাত্রা যে কাবুলে পৌঁছতে পেরেছিলুম তার একমাত্র কারণ বোধ হয় এই যে, রগরগে উপন্যাসের গোয়েন্দা শত বিপদেও মরে না, ভ্রমণকাহিনী লেখকের জীবনেও সেই সূত্র প্রযোজ্য৷ 

তারপর আমরা দেখতে পাই অধ্যাপক বকদানফের সাথে সাক্ষাৎ হলো লেখকের৷ তিনি জাতে রুশ, মস্কোর বাসিন্দা ও কট্টর জার পন্থী৷ ১৯১৭ এর রুশ বিপ্লবের সময় দেশ থেকে পালিয়ে তেহরানে আশ্রয় নেন৷ তারপর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনাকে ফার্সীর অধ্যাপক হিসেবে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন৷ বগদানফ বহুভাষার পন্ডিত ছিলেন৷ 

পুরো আফগানিস্থানের প্রাচীনকাল থেকে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সবিস্তারে তুলে ধরেন লেখক৷ সুলতান মাহমুদ, তৈমুর, বাবুর, হুমায়ুন, নাদিরশাহ, আহমদ শাহ আবদালী কেউই বাদ যাননি৷ লেখক কাবুলে সমকালীন সময়ের বিভিন্ন আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হন এবং অত্যন্ত সূক্ষ রসবোধের সাহায্যে তাদের সাথে কথোপোকথন ও দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ তুলে ধরেন। ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান, রুশ, তুর্কি রাজদূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে লেখকের সাক্ষাৎ ও সুসম্পর্ক তৈরি হয়৷ 

উঠে এসেছে কাবুলের জীবনযাত্রার টুকরো টুকরো ছবি, তার বাজারের কথা, সুধীজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণের ছবি, নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয় আর সে বন্ধুত্ব গাঢ় হবার গল্প।সৈয়দ আলী তার সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও হাস্য রসাত্মক লেখনী দ্বারা তার প্রতিটি চরিত্রকেই জীবন্ত করে তুলেছেন। লেখার প্রতিটি মোড়েই একটি বাংলা বা ফারসী কবিতা ফুটে আছে পথের পাশের ঘাসফুলের মতো। 

'দোস্ত মুহাম্মদ ছিলেন এক রসিক পাঠান অফিসার। বিদ্রোহের সেই অবরুদ্ধ সময়েও এতটুকু মলিন হয়নি যার ভালবাসা। সৈয়দ আলীর সাথে তার খুবই ভাল সর্ম্পক ছিল। মওলানা জিয়াউদ্দীন ছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক। কাবুলে তিনি ছিলেন সৈয়দ আলীর সহকর্মী। কাবুলে বিদ্রোহের দুর্দিনে মওলানা জিয়াউদ্দীন তার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে কাবুলে অসহায় এক অবস্থায় পড়েন। তখন ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সহায়তায় তার স্ত্রীকে মেয়েদের বিশেষ ফ্লাইটে করে ভারতে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন মুজতবা আলী।

পুরো বইজুড়ে বিশেষ অবস্থান থাকে ভৃত্য আব্দুর রহমানের৷ সহজ সরল আফগান এই যুবক শেষ পর্যন্ত সঙ্গ দেন লেখককে৷ সে রান্না থেকে শুরু করে সকল কাজ করতো৷ লেখক নিজ হাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে বইয়ের পাতায় তুলে ধরেন আব্দুর রহমানের অবয়ব৷ সেটি পাঠক মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন৷ মনিব-ভৃত্যের প্রথাগত সর্ম্পকের বাইরে আবদুর রহমান নামের অত্যন্ত হৃদয়বান এক পাঠান যুবকের চিত্রই তুলে ধরেছেন তিনি। বিদ্রোহের দিনগুলোতে যখন কাবুল ক্রমেই একটি বিপজ্জনক জায়গায় পরিণত হচ্ছিল তখন আবদুর রহমান হয়ে ওঠে তার পরম বন্ধু্। দিনের পর দিন একসাথে তরকারিহীন রুটি চিবিয়ে কাটিয়েছেন তারা। সে দুঃসময়েও তাকে ছেড়ে চলে যায়নি আবদুর রহমান। এমনকি শেষদিন লেখকের সাথে ভারত চলে যেতে বায়না ধরে আব্দুর রহমান৷ আব্দুর রহমান নিজে কাঁদে, লেখককে কাঁদায়৷ সে সাথে লেখকের বর্ণনা পড়ে পাঠকও কাঁদতে বাধ্য৷ 

আমরা দেখতে পাই কাবুল রাজপরিবারের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বিস্তারিত বিবরণ৷ বাদশা আব্দুর রহমান, বাদশা হাবীব উল্লাহ, বাদশা নসরউল্লা, বাদশা আমানউল্লাহ, মুইন উস সুলতান ইয়ানেতউল্লাহর কাহিনী আমরা বিস্তারিত জানতে পারি৷ জানতে পারি ইনায়েতউল্লাহর বিবাহে সৎমায়ের গুটি চাল৷ দৈবক্রমে ছোট ভাই আমানউল্লাহ বাদশা হন৷ তারপর সারাদেশে সংস্কার কাজ পরিচালনা করেন৷ বাদশাহ আমানউল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও রীতি-নীতির প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। আমানউল্লাহ নানারকম সংস্কারমূলক কাজ করেছিলেন যেমন, নারী শিক্ষা, নারী-পুরুষ সমানাধিকার ইত্যাদি। বাদশা আসলে আফগান মুসলমানদের আধুনিকায়নের চেষ্টা করেছিলেন, যেমন উনি মেয়েদের বোরখা পড়া ও পর্দা করার বিরোধী ছিলেন, ছেলেদের কুর্তা-জামার বদলে কোট-প্যান্ট পড়ার প্রচলন করেছিলেন। আমানউল্লাহর পত্নী সুরাইয়াও ছিলেন সংস্কারের পক্ষে। তিনি আমানউল্লাহর ভ্রমণসঙ্গিনী হয়ে ইউরোপ ভ্রমণকালে জনসমক্ষে বোরখা ছাড়া বের হন।

আফগানিস্তানের তখনকার রাজনৈতিক সংকটটা ছিল মূলত রাজতন্ত্রের পতনের আন্দোলন। বাদশা আমানউল্লাহর সংস্কার প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার প্রভাবশালী মোল্লা ‘হযরত অফ শোরবাজার’-এর নেতৃত্বে অন্যান্য মোল্লা ও সাধারণ আফগানরাও বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আফগানিস্তানের রাজত্ব নিয়ে যখন এই ঘোর সঙ্কটকাল, লেখক সেই সঙ্কটের প্রত্যক্ষদর্শী, আর তাঁর কলম সেই সঙ্কটদৃশ্য এঁকেছে দারুণ নৈপুণ্যের সাথে। 

বাদশাহ আমানউল্লাহ পদত্যাগ করে তার বড় ভাই এনায়েতউল্লাহকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে প্রস্তাব করে৷ এনায়েতউল্লাহ প্রস্তাবে রাজী না হলে আমানউল্লাহ বড় ভাইকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ক্ষমতা গ্রহনে বাধ্য করে৷ লেখক এখানে বেশ হাস্যরস করে বলেন পৃথিবীর চিরন্তন ইতিহাস আফগানিস্থানে এসে উল্টে গেলো৷ সর্বত্র বাদশাহকে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়৷ আর এখানে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ক্ষমতা গ্রহণে বাধ্য করা হলো৷ নতুন বাদশা ছিলো লেখকের টেনিস খেলার পার্টনার৷ কিন্তু নতুন বাদশা বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি৷ 

সে সময়কার ব্রিটিশ-রাশিয়ার যে ‘গ্রেট গেম’ তার সাথে আফগান বাদশাহের উৎখাতের কোন যোগসূত্র রয়েছে কি না প্রশ্ন ইদানিং অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। গবেষকরা ধারণা করেন যে সে সময়কার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইংরেজদের একটা ভূমিকা ছিল। মোল্লা এবং ইংরেজদের মাঝে গোপন আঁতাত ছিল এটাও অনুমান করা যায়। কাজেই বিদ্রোহকে ‘গ্রেট গেম’-এর একটা অংশ হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।

লেখকের কাবুলে অবস্থানের শেষ পর্যায়ে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে৷ মোল্লা শোরবাজারারের সহায়তায় ডাকু সর্দার বাচ্চা সকাও হবীউল্লাহ তখন কাবুল দখল করে নেয়। নতুন বাদশা এনায়েতউল্লাহ পলায়ন করে৷ আত্মীয়স্বজন আর সভাসদ বাচ্চা সকওফর হাতে বন্দী হয়৷ বাচ্চায়ে সাকোর অত্যাচার আর লুণ্ঠনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে কাবুলের জনজীবন৷ দুর্গম কাবুল যুদ্ধসঙ্কটাপন্ন, লেখক একা বাঙালি৷ নির্ভর করছেন ভাগ্য আর স্থানীয় বন্ধুদের ওপর, মুখোমুখি হচ্ছেন নির্মম ইংরেজের বিমাতাসূলভ আচরণের৷ অনুভব করছেন পরাধীনতার তিক্ত আঁচটুকু৷ নিত্য শুনছেন প্রতিবেশী আর প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ৷ নিজে মুখোমুখি হচ্ছেন মৃত্যুর৷ দীর্ঘদিন অর্ধাহান অনাহারে দিন কাটানোর পর বৃটিশ দূতাবাসের সহায়তায় আফগানিস্থান ত্যাগের করুণ কাহিনীর মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই ভ্রমণ কাহিনী। 

শেষ বিদায়ের দিনে লেখকের সাথে ভারতে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করে আব্দুর রহমান। বিদায়ের সময় আবদুর রহমান যখন তার হাতে চুমু খেয়ে ‘ব আমানে খুদা’ অর্থাৎ ‘খোদার হাতে সমর্পন করলাম’ বলে কেঁদে ওঠে, তখন স্বভাবতই কেঁদে ওঠে লেখকের মনও। সে সাথে আমার মনে হয় আমার মতো অন্যান্য পাঠকূলও কেদে উঠেন হয়তো৷ দেশ থেকে বহু দূরে ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে আবদুর রহমানের হৃদ্যতায় এক অকৃত্রিম বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিলেন লেখক। তাই তো প্লেন থেকে নিচে তাকিয়ে তুষার আবৃত আফগানভূমিতে তার কাছে সবচেয়ে শুভ্র মনে হয়েছিল আবদুর রহমানের সাদা পাগড়িটিকে। আর তারও চেয়ে শুভ্র মনে হয়েছিল তার হৃদয়কে।’

গুরুত্বপূর্ন চরিত্রসমূহঃ
> আব্দুর রহমান- আফগান যুবক, লেখকের ভৃত্য এবং অন্যতম প্রধান চরিত্র।সহজ সরল আব্দুর রহমানকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার সাহিত্যের আল্পনায়।পুরো কাহিনীজুড়ে হাস্যরসাত্বক ঘটনার জন্ম দিলেও শেষ পর্যায়ে আব্দুর রহমানের সাথে লেখকের বিদায়ের মুহূর্তে মর্মান্তিক এবং করুণ পরিনতি হয়।
> অধ্যাপক বেনওয়া- অধ্যাপক এবং কাবুলে লেখকের বন্ধু।
> শেখ আহমেদ আলী খান পাঠান- লেখকের বন্ধু এবং পেশোয়ারের পুলিশ কর্মকর্তা।
> অধ্যাপক খুদাবখশ- ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক
> অধ্যাপক বগদানফ- অধ্যাপক এবং কাবুলে লেখকের বন্ধু
> দোস্ত মুহম্মদ- অধ্যাপক এবং লেখকের বন্ধু
> মুইন-উস-সুলতান- আফগানিস্তানের যুবরাজ, শেষ দিকে স্বল্প সময়ের বাদশাহ, নাম ইনায়েতুল্লাহ৷ 
> বাচ্চায়ে সাকো- ডাকাত, যার আক্রমণে আফগানিস্তানে আমানুল্লাহর পতন ঘটেছিল৷ মূল নাম হবিউল্লাহ৷ 
> কর্নেল বলশফ- রাশিয়ান এয়ারফোর্সের কর্নেল
> স্যার ফ্রানসিস- কাবুলে ব্রিটিশ লীগন্যাশনের প্রধান।

নামকরণঃ 
বইটির অংশবিশেষ ভারত থেকে খাইবার পাস পৌঁছাবার কাহিনী, সেটি আদতে লেখকের স্বদেশের কথাই। আর অন্য অংশ জুড়ে কাবুল তথা আফগানিস্তানের আখ্যান। যা কিনা লেখকের কাছে রাষ্ট্রীয় ও মানসিক– দুই দিক থেকেই বিদেশ। ধারণা করা যায়, এই কারণেই বইয়ের নাম নির্ধারিত হয় দেশে বিদেশে। সে হিসেবে বইয়ের নামটি সার্থক বলতে হবে৷ 

বইয়ের কিছু উক্তিঃ
১) যাত্রার দিনই অর্ধেক ভ্রমণ৷
২) উঠোন সমুদ্র পেরোলেই অর্ধেক মুশকিল আসান৷
৩) হন্তদন্ত হওয়ার মানে শয়তানের পন্থায় চলা৷
৪) দুঃখ না পেলে দুঃখ ঘুচবে কি করে৷
৫) প্রকৃতি মরুপ্রান্তরে প্রাণ সৃষ্টি করেন না বটে, কিন্তু প্রাণ গ্রহণে তিনি বিমুখ নন৷ 
৬) ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষে মানুষে ভেদ থাকে না, সবাই সমান৷
৭) কোনো দেশের গরীব মুসলিম মেয়েরা পর্দা মানে না, অন্তত আপন গায়ে মানে না৷
৮) একবার ঠকলে ঠকের দোষ, দুবার ঠকলে তোমার দোষ৷
৯) সব কিছু পণ্ড না হলে পণ্ডিত হয় না৷
১০) আফগানিস্থানের প্রাচীন ইতিহাস পোঁতা আছে সে দেশের মাটির তলায়, আর ভারতবর্ষের পুরাণ মহাভারতে৷ 
১১) পণ্ডিতজন যে স্থলে মতানৈক্য প্রকাশ করেন মূর্খ যেন তথায় ভাষণ না করে৷ (রাসেল)
১২) কুইনিন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনিন সারাবে কে? 
১৩) সৎমার অধিক ভালোবাসাকে সহজে বিশ্বাস করা যায় না৷ 
১৪) অত্যান্ত কাঁচা কাঁচা লঙ্কাও পাঠার বলি দেখে খুশী হয় না৷ 
১৫) কাবুল স্বর্ণহীন হোক, কিন্তু বরফহীন যেন না হয়৷ 
১৬) যে শিল্প কাজে লাগে না সে শিল্প শিল্পই নয়৷ 
১৭) স্ত্রীকে বেঁধে রাখতে হয় মনের শিকল দিয়ে, হৃদয়ের জিঞ্জির দিয়ে৷ 
১৮) বর্ষা নামলে বাংলার বিদ্রোহ বিপ্লবও ছেঁড়া কাথা গায়ে টেনে নিদ্রা যায় মনের হরিষে৷
১৯) কাকা আর আমি একা, চোর আর লাঠি দুজন৷
২০) বাঘ হতে ভয়ঙ্কর কু-রাজার দেশ৷ (কনফুৎসিয়)
২১) রাজ্য চালানো হচ্ছে সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে জীবন কাটানো৷ সিংহের পিঠ থেকে এক মুহূর্তের জন্য নামবার উপায় নেই৷ যতক্ষণ উপরে আছ সিংহ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না, কিন্তু তোমাকে অহরহ সজাগ থাকতে হবে৷ এজন্যই ক্ষমতার তখৎকে সিংহাসন বলা হয়৷"
২২) চা বাগানের কুলীরা যে প্রচুর পরিমাণে বিনা দুধ চিনিতে লিকার খায় সে পানের তৃপ্তির জন্য নয়, ক্ষুধা মরার জন্য৷
২৩) জীবিতাবস্থায়ই যখন মহাপুরুষের আশ্রয়স্থল নেই তখন মৃত্যুর পর তার জন্মভূমিইবা কি মৃত্যুস্থলই বা কি?
২৪) মায়ে মায়ে তফাৎ নাই৷ বীরের মা যে রকম ডুকরে কাঁদে ঠিক সেরকম চাষা মরলে তার মাও ডুকরে কাঁদে৷

লেখক সম্পর্কেঃ 
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক, রম্যরচয়িতা ও বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে। পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। তাঁর পৈতৃক ভিটা মৌলভীবাজার, সিলেট। 

সিলেটের গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় মুজতবা আলীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনেভর্তি হন। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের ছাত্র। এখানে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি,হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়ভাষাশিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডি.ফিল লাভ করেন ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৩৪-১৯৩৫খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিশরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

 ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুজতবা আলী আফগানিস্থানের কাবুলে শিক্ষা দপ্তরে অধ্যাপনা করেন। সেখানে তিনি ইংরেজি ওফরাসি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে  বরোদার  মহারাজার আমন্ত্রণে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি আট বছর কাটান। এরপর দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এবংকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে কিছুদিন আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন পাটনা, কটক, কলকাতা এবং দিল্লিতে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন। বিশ্বভারতীর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অবসরগ্রহণ করেন।

তাঁর বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমনকাহিনী। এছাড়াও লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। বিবিধ ভাষা থেকে শ্লোক ও রূপকের যথার্থ ব্যবহার, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা এবং এর মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হল, "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।" তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ৩০ টি৷ 

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক নরসিং দাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে আনন্দ পুরস্কার প্রদান করা হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে মরণোত্তরএকুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

 তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকাতে৷ 

পাঠানুভূতিঃ
বইটির কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম! কোথা থেকে কোথা যাচ্ছেন লেখক কিছুই বুজতে পারছিলাম না। শব্দের কাঠিন্যতা আমাকে আরো অস্থির করে তুলছিলো৷ সনাতন বাংলা শব্দের সহিত ফার্সি, উর্দু, হিন্দী, ইংরেজী সংমিশ্রণ আমার পাঠকে কঠিন করে তুলছিলো৷ তিনি যে ১৫টি ভাষার পান্ডিত্য লাভ করেছিলেন তার প্রমাণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম এ বই পড়তে গিয়ে৷ তাৎক্ষনিক গুগলের সাহায্য নিয়ে লেখক, ভারতবর্ষ, আফগানিস্তান আর বইটা সম্পর্কে একটু ঘাটাঘাটি করে কিঞ্চিত জেনে নিলাম৷ আর পড়তে বসে কাজে লাগালাম মোবাইলের বাংলা থেকে বাংলা অভিধান এপ্স৷ এতেকরে পাঠ খুব ধীরে এগুলেও বেশ উপকার বোধ করেছি৷

বইটি রম্য রসাত্মক ভাষা উপাদান দিয়ে বৈঠকিয় আড্ডার মেজাজে লেখা৷ আর এতে পাঠক আফগান পাঠানদের স্বাধীন আর আড্ডাবাজির জীবন সম্পর্কে জানতে পারা যায়। আরো রয়েছে নানা ভাষায় নানা কবির নানা বয়ান। লেখকের জানার বিশালতা থেকে এ লেখাকে অলকৃত করতে কবি ওমর খৈয়াম, শেখ সাদী থেকে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার সময় সান্যিধ্য পাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাউকেই বাদ দেন নি। লেখকের পাঠাভ্যাস আর জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে সাম্যক ধারণা পাওয়া যাবে এই বইয়ের বিভিন্ন উদৃতি থেকে৷ 

পেশোয়ার থেকে কাবুল যাত্রার যে কাহিনী বইটিতে আছে, সেটি শুধু রচনাগুণেই নয়, তথ্যগুণেও অমূল্য। সাধারণ জ্ঞান থেকে  আফগানিস্তান সম্পর্কে ধারণা হতেই পারে দেশটি ঊষর, মরুময়, ছায়াহীন, প্রাণহীন, জীবন স্পন্দন যেখানে রসহীন পাথর, আছে কেবল যুদ্ধ বিগ্রহ আর হানাহানি।বাঙালির চোখে অচেনা আফগানিস্তানকে লেখক যে মুগ্ধ প্রেমিকের উচ্ছ্বাস নিয়ে এঁকেছেন, তার প্রতিচ্ছবি বইটির পাতায় পাতায় বিরাজমান৷ পড়তে পড়তে কতো যে হাসতে হলো তার ইয়ত্তা নেই৷ একই সাথে হাসি রম্য, ইতিহাস, দর্শন, কাব্য রস পাওয়া যাবে৷ সে সাথে পাওয়া যাবে দুঃখ দুর্দশার বর্ণনা৷ শেষের দিকে যখন আফগান রাজক্ষমতার দ্বন্দ্ব সংঘাত চরমে তখনকার বর্ণনায় পাঠক পাবে থ্রিলারের অনুভূতি৷ আর ভৃত্য আব্দুর রহমানে সাথে বিদায় মূহুর্তে পাঠক পাবে বিরহ ব্যাথার এক করুণ অনুভূতি৷ অন্তত আমার চোখে পানি সংবরণ করতে পারিনি৷ 

অধিকাংশ ভ্রমণ কাহিনীতে দেশের ও মানুষের কথার চাইতে লেখকের নিজের গল্পই বেশি থাকে, অথচ একটা ভ্রমণ কাহিনী হওয়া উচিত ঠিক তার উল্টোটা। গল্পটা হওয়া উচিত সেখানকার মানুষদের, সেখানকার প্রকৃতি আর সেখানকার সমাজ এবং সংস্কৃতির৷ কোন ভ্রমণকারী যদি ভ্রমণ-স্থলকে উপভোগ করতে না পারেন, তার কাদা, তার বালু, তার পাহাড়, তার ফুল, তার কাটায় যদি সৌন্দর্য অনুভব করতে না পারে তবে সেটি তার অন্তরের দীনতা, আর সেই দীনতা তাঁর কোনদিনই ছিল না। তিনি যখন যেখানে গিয়েছেন, সেই জায়গাটাকে ঠিক সেখানকার মত করেই অনুভব করার চেষ্টা করেছেন। আফগানিস্তান এর বিভিন্ন বিষয়ে তার যে প্রাঞ্জল বর্ণনা তা পড়লে মনে হবে, তিনি যেন মরুতে মধুর চাষ করেছেন।আব্দুর রহমানসহ প্রতিটি চরিত্রকে আর প্রতিটি ঘটনাকে লেখক এমন ভাবে বর্ণনা করেছেন সবগুলো পাঠকের সম্মুখে জীবন্ত হয়ে উঠেছে৷ 

আমার মনে হয়ছে আমি নিজে যেন লেখকের সাথে আড্ডা, সেই হাসি আন্দে, সেই কষ্ট সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশ নিচ্ছি৷ আমি নিজেই যেন বইটির একটি চরিত্র৷ কাবুলের বরফ ঢাকা পথঘাটে আমি লেখকের সংঙ্গী৷ কী এক অসাধারণ ঘোরের মধ্যদিয়ে পড়ে শেষ করলাম বইটি৷ লেখক যখন পাঠকে একটি জীবন্ত লেখা উপহার দেন তখন পাঠক হয়ে উঠেন লেখকের বইয়েরই একটি কাল্পনিক চরিত্র৷ এখানেই একজন লেখকের সার্থকতা৷ সৈয়দ মুজতবা আলী সত্যি একজন সফল লেখক৷ আর সে জন্যই বইটি বেচে থাকবে হাজারো বছর৷ 
বইঃ দেশে বিদেশে PDF, সৈয়দ মুজতবা আলী | Deshe Bideshe PDF By Syed Mujtaba Ali


একটি পরামর্শঃ
বইটি সম্পাদনা করে দুর্বোধ্য শব্দসমূহ পরিবর্তন কর সহজ বাংলা শব্দ যোগ করলে সর্বস্তরের পাঠকদের জন্য এটি অধিক সুখপাঠ্য হতো, বিশেষ করে কিশোরদের জন্য

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ