বইয়ের নামঃ সাতকাহন।
লেখকঃ সমরেশ মজুমদার।
ধরনঃ সমকালীন উপন্যাস।
প্রকাশকঃ আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড।
রিভিউ লিখেছেনঃ সাদিয়া আক্তার
একজন সাধারণ কিশোরী মেয়ে থেকে কিভাবে অসামান্য, প্রতিবাদী, আপোষহীন এক সমৃদ্ধ নারী হয়ে ওঠে সেই গল্প নিয়েই "সাতকাহন" উপন্যাস।
লেখক পরিচিতিঃ
-------------------------
সমরেশ মজুমদার একজন বিখ্যাত ভারতীয় লেখক। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ। তাঁর লেখা প্রথম গল্পের নাম 'অন্যমাত্রা'। বিখ্যাত এই ঔপন্যাসিক উপন্যাসের পাশাপাশি বেশকিছু ছোটগল্প, গোয়েন্দাকাহিনী ও ভ্রমনকাহিনী লিখেন। তাঁর লেখা কয়েকটি উপন্যাস হলো _ গর্ভধারিণী, সাতকাহন, উত্তরাধিকার, কলবেলা, কালপুরুষ, মৌষলকাল, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি। তন্মধ্যে 'সাতকাহন' উপন্যাসটি সর্বশ্রেষ্ঠ। সমরেশ মজুমদার তাঁর অসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে লাভ করেন 'আনন্দ', 'আকাদেমী', 'বঙ্কিম পুরস্কার' সহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কার।
চরিত্র সমূহঃ
------------------
"সাতকাহন" উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্র পাওয়া যায়। আমি এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি চরিত্রের নাম উল্লেখ করছি।
★দীপাবলি—উপন্যাসের প্রধান চরিত্র
★অমরনাথ—দীপার বাবা
★অঞ্জলি—দীপার মা
★মনোরমা—দীপার ঠাকুরমা
★সত্যসাধন—দীপার শিক্ষক
★রমলা সেন—অমরনাথের একসময়ের বন্ধু যিনি পরে দীপাকে অনেক উৎসাহিত করেন
★অলোক—দীপার স্বামী
এছাড়াও মায়া, অশীম, অনন্ত, শৈশবের দুই বন্ধু খোকন, বিশু সহ অসংখ্য চরিত্রের আগমন ঘটে এই উপন্যাসে।
পাঠ সংক্ষেপঃ
--------------------
সমরেশ মজুমদারের কালজয়ী উপন্যাস 'সাতকাহন' এর প্রধান চরিত্র দীপাবলি বন্দ্যোপাধ্যায়। মূলত তাকে কেন্দ্র করেই কাহিনী আবর্তিত হয়। কিশোরী দীপাবলি কিভাবে সমাজের সকল বাধা, প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে একজন সফল নারী হয়েছেন তার চমৎকার বর্ননা এখানে পাওয়া যায়।
আংড়াভাসা নদী সংলগ্ন চা-বাগানে দীপাবলি বেড়ে ওঠে। সেখানে তার শৈশব কাটে মা অঞ্জলি, বাবা অমরনাথ, ঠাকুরমা মনোরমা, দুই ভাই আর বন্ধু খোকন ও বিশুকে নিয়ে। অন্য সবার শৈশবের ন্যায় দীপার শৈশবও কাটে হাসি-আনন্দে, মায়ের আদর-শাসনে, বন্ধুদের সাথে উল্লাসে। কিন্তু কে জানতো শৈশবের এই উল্লাস অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে? তখনকার সময়ে বাল্যবিবাহ এর প্রথা চালু ছিল। এগারো বছর বয়সে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় এক মৃত্যুপথযাত্রী ছেলের সাথে, শুধুমাত্র বংশধর রক্ষার জন্য। বিয়ের পর তার সিঁথির সিদুর স্থায়ী হয়েছিল মাত্র বাহাত্তর ঘন্টার জন্য। মূলত এখান থেকেই দীপার জীবন পাল্টে যায়। কালবৈশাখীর মতো করে আসা এই অতীতকে ভুলে সে নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছে। সাফল্য পর্যন্ত তার এই পথ ছিল কন্টকময়।
সংগ্রামী এই জীবনে দীপা পাশে পেয়েছিলো তার বাবা অমরনাথ এবং শিক্ষক সত্যসাধন মাস্টারকে। চা-বাগান থেকে জলপাইগুড়ি কলেজ তারপর কালকাতার জীবন। সময়ের ব্যবধানে সেই কিশোরী হয়ে উঠলো একজন স্বতন্ত্র নারী। তারপর সে ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের চাকরিতে যোগদান করে। পরবর্তীতে সে নতুন জীবন সঙ্গী বাছাই করে বিয়ে করে। প্রয়োজনে সেই সঙ্গীকে ছেড়ে আসতেও দীপা সংকোচ করেনি।
পাঠ প্রতক্রিয়াঃ
----------------------
দীপা সকল নারীদের জন্য এক শ্বাশত চরিত্র। তার সংগ্রামী জীবনের গল্প হাজারো নারীর মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। দীপার ঠাকুরমা মনোরমা সেকালের মানুষ হলেও তার চিন্তাভাবনা ছিলো যথেষ্ট আধুনিক। অঞ্জলি,রমলা সেন, মায়ার অনুপ্রেরণায় দীপা দূর্গম পাহাড়কে জয় করতে শিখেছে। তার আত্নসম্মানবোধ ছিলো আকাশ সম। মেয়েরাও যে সমাজ থেকে পিছিয়ে নেই তারাও যে দেশের সম্পদ, এটা দীপা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য উক্তিঃ
---------------------------
১. 'মৃত্যু কী সহজ, কী নিঃশব্দে আসে। অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে।'
২. 'তুমি যতক্ষণ নিজে মনে না কর যে তুমি অন্যায় করছ ততোক্ষণ যে যাই বলুক কানে নিবেনা। তোমার বিচারক তুমি নিজ।'
৩. 'একটি পিঁপড়ের কামড় কখনো বেদনা হতে পারেনা কিন্তু নিত্য যদি একই জায়গায় কামড় দেয়া হয় তাহলে সেই বিষ চিকিৎসার বাইরে চলে যায়। '
৪. 'ভালোবাসা হলো বেনারসি শাড়ির মতো, ন্যাপথালিন দিয়ে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখতে হয়। তাকে আটপৌরে ব্যবহার করলেই সব শেষ।'
ব্যক্তিগত মতামতঃ
--------------------------
'সাতকাহন' এমন একটি বই যা পড়লে আমাদের চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে। নারীরা তাদের ভেতর কত উন্নত মনোভাব পোষণ করছে, কিভাবে সকল সামাজিক কুুসংস্কার, বেড়িকে অগ্রাহ্য করে সফলতা অর্জন করছে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দীপাবলি। বিবাহ সূত্রে দীপা যেই বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়, এই সম্পত্তি ফিরিয়ে দিয়ে সে যে নির্লোভ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছে, এই বিষয়টি আমাকে চমৎকৃত করে। আমার কাছে মনে হয় এই বইটি নারী পুরুষ প্রত্যেকের পড়া উচিৎ। তাহলে সবাই জানতে পারবে নারীদের আসল স্থান কোথায়।
নামকরণের স্বার্থকতাঃ
--------------------------------
বাংলা ব্যাকরণে "সাতকাহন" শব্দটিকে একটি বাগধারা হিসেবে আমরা জানি। এর শাব্দিক অর্থ হলো প্রচুর পরিমান। এই শব্দের ভাবগত অর্থ হলো কোনো বিষয় পর্যালোচনা করেএবং বিশ্লেষণ করে তার নিগূঢ় অর্থ বের করা। 'সাতকাহন' উপন্যাসটিতে লেখক কেন্দ্রীয় চরিত্র দীপাবলির জীবনের খুঁটিনাটি গল্প তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। দীপার জীবনের প্রতিটি চড়াই-উৎরাই এখানে সুস্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্যই উপন্যাসের নাম দেওয়া হয়েছে 'সাতকাহন'। আর আমার মনে হচ্ছে এই নামটিই যথার্থ হয়েছে। এমন নামকরণের কোনো বিকল্প ছিলনা।
ব্যাক্তিগত রেটিংঃ ৪.৫/৫
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....