আকাশ মেঘমালা - লেখক : সালমা সাহলি | Akash Meghmala By Salma Shahli

আকাশ মেঘমালা (pdf free download no available)
লেখক : সালমা সাহলি
প্রকাশনী : নবপ্রকাশ
বিষয় : সমকালীন উপন্যাস
পৃষ্ঠা : 160
ভাষা : বাংলা
Image

কিছু গল্প, যেন আমাদের সময়ের কথা বলে। আমরা যে জীবন নিয়ে হেঁটে চলি দীর্ঘ দীর্ণ পথ, গল্পের চরিত্রেরা আমাদের সঙ্গেই চলে। তারা আমাদের সঙ্গ দেয়, আমাদের হাসায়, কখনো অশ্রুজলে ভাসিয়ে নেয় প্লাবনের মতো।জীবনের গল্পগুলোই তো এমন। প্রতিটি মানুষের যাপিত জীবনের যে গল্প, সে গল্পই তো রূপ নেয় গল্প-উপন্যাসে, কখনোবা হয় ইতিহাস।লেখক সালমা সাহলি আমাদের সেইসব গল্পই বলেছেন তার ‘আকাশ মেঘমালা’ গল্পগ্রন্থে। গল্পগুলো পড়লে মনে হবে, এ যেন আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনকার জীবনের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে অক্ষরের জবানবন্দিতে।প্রতিটি গল্প তাই গল্প ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে জীবন্ত, আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের মতো সত্য ও শাশ্বত।

খোকা........
প্রায় পঁচিশ মিনিট পর কল ব্যাক করল মৌমিতা৷ শামিমা কল রিসিভ করে সালাম দিল৷ মৌমিতা বলল, ওয়ালাইকুম সালাম আপু, আজ পড়ব না৷ পাঁচ মিনিট হলো বাইরে থেকে এসেছি৷ টায়ার্ড লাগছে খুব৷

তাহলে আজ রেস্ট নিন। আগামীকাল কল দিব ইনশাআল্লাহ।

কাল রাতে আমাদের একটা দাওয়াত আছে আপু৷ আসলে, পরশু আমার হাবি আউট অফ টাউন যাচ্ছে দুই সপ্তাহর জন্য৷ তাই আজ একটু গ্রোসারি করতে বের হয়েছিলাম দুজনে৷ সে একটা কাজ সেরে বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনতে যাবে; আরো প্রায় দুই ঘন্টা লাগবে, তাই আমি বাস ধরে চলে এলাম৷ না হয় আপনি তো অপেক্ষা করবেন। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই আপনাকে কল দিলাম৷

কিন্তু আপনি তো আজ টায়ার্ড আছেন বললেন৷ ঠিক আছে আপু অসুবিধা নেই।

কাল রাতে দাওয়াত আছে বললেন, আমি কি তাহলে যোহরের পর কল দিব? শামিমা জানতে চাইল৷ মৌমিতা বলল, গরম পড়েছে তো আপু৷ কাল দুপুরে আমরা একটু বিচে যাব৷ রাতে আবার আমাদের একটা দাওয়াত আছে৷ পরশুদিন পড়ব আমি৷

সরি আপু, পরশুদিন আমি একটু ব্যস্ত থাকব৷ তার পরের দিন, সতেরো তারিখ পড়াব ইনশাআল্লাহ৷ আপনি এখন রেস্ট করুন তাহলে৷

কথা শেষ করতে যাচ্ছিল শামিমা, কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে মৌমিতা দ্রুত বলে উঠল, আপা, আপা! রেখে দিয়েছেন?

না, আছি৷ বলুন৷

আপনি তো এখন ফ্রি আছেন, তাই না আপা?

জ্বি। কিছু বলবেন?

শামিমা মনে মনে একটু অস্বস্তি বোধ করল৷ বিয়ের পর থেকে সে এমন কিছু লোকের সাথে পরিচিত হয়েছে যারা তার মাদ্রাসায় পড়াশোনা নিয়ে বেশি প্রশ্ন করেছে। সেসব প্রশ্নগুলো জানার আগ্রহের থেকে বেশি কৌতূহল ছিদ্রান্মেষণের৷ প্রশ্নগুলোর ধরণ হয় এমন- 'মাদ্রাসার খাবার কেমন? মাছ মাংস থাকে? মানুষের যাকাত সদকার টাকায় খাওয়া-পরা পোষায় পুরো বছর? পুরুষ টিচার আছে? অনেক মাদ্রাসায় গোপনে অনেক রকমের ঘটনা ঘটে, আপনাদের মাদ্রাসায় মেয়েদের নিরাপত্তা কেমন? কীভাবে ঘুমায়, ফ্লোরে নাকি চকি বিছানা আছে?? মানুষকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে শামিমা এখন ক্লান্তবোধ করে৷ মানুষ বুঝতেই চায় না, এসব প্রশ্ন আসলে তাদের সংকীর্ণ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু না৷ মৌমিতাও হয়ত তাই করবে৷ করুক, সে তাদের ভুল ধারণা ভাঙতে চেষ্টা করে সব সময়, আজও করবে৷

মৌমিতা বলল, ভাবলাম, আপনার সাথে একটু কথা বলি৷ প্রায় দুই মাস ধরে আপনার কাছে পড়ছি, কিন্তু আপনার নাম ছাড়া কিছুই জানি না৷ আপনার সম্পর্কে বলুন৷

আপু, কী জানতে চান আমার সম্পর্কে?

এই... কী করেন, জব করেন কিনা, এখানে, মানে আমেরিকায় কোথায় থাকেন, কার সাথে থাকেন, এসব আর কী...।

জব করি কিনা, এই প্রশ্ন করলে আমাকে বেকারই বলতে হবে৷ ঘর সংসার নিয়েই আছি, হাউজ-ওয়াইফ বলতে পারেন৷ আলহামদুলিল্লাহ। আমি, আমার এগার বছর বয়সি এক ছেলে আর স্বামী, এই তিন জন নিয়েই আমাদের সংসার৷ কোন স্টেটে থাকেন?

টেনেসি৷

ও হ্যাঁ, টেনেসি! আমার হাসব্যান্ড প্রায়ই যায় ওখানে৷ ওর চাকরির জন্য যেতে হয়৷ দুই বছর আগে আমরাও একবার বেড়াতে গেছিলাম৷

আর আপনি কোথায় থাকেন, কী করেন? আমিও আপনার সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না৷

আমি আছি টেক্সাসে৷ আমার বিয়ে হয়েছে সাত বছর চলছে৷ আমার দুই বাচ্চা। মেয়ের নেক্সট মান্থে ছয় বছর হবে আর ছেলের বয়স চার বছর৷ আমি একটা ল’ফার্মে জব করি৷ তবে সপ্তাহে এক বা দুই দিন দুই-তিন ঘন্টার জন্য অফিসে যেতে হয়৷ বাকি দিন নিজের সুবিধা মতো অনলাইনে কাজ৷ আমার বাচ্চারা ছোট, অনলাইনে বসে বাসায় থেকে কাজ করতে পারছি৷ এটাই সুবিধা৷ আমার হাবির স্কুল জীবনের বন্ধুর বড় ভাইয়ের ল’ফার্ম, এই জন্য খুব সহযোগিতা পেয়েছি। আর আমার হাবিও জব করে, তবে তাকে মাঝে মাঝে আউট অফ স্টেট যেতে হয় গত দুই বছর ধরে৷

শামিমার ইচ্ছা করল সে বলে, তার হাসব্যান্ডকেও আউট অফ স্টেট যেতে হয়৷ একটা ফ্রেন্স’স কোম্পানির দুইটা স্টেটের ম্যানেজার সে৷ মৌমিতার হাসব্যান্ড কী জব করে? জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে আবার থেমে গেল শামিমা৷ পরপুরুষ সম্পর্কে অহেতুক কৌতূহল উচিৎ হবে না। সে শুধু বলল, মাশা আল্লাহ! খুব ভাল৷

আপনি কতদিন ধরে আছেন আমেরিকায়?

বেশি দিন না, দুই বছর চলছে। ফ্যামিলির সবাই একসাথে এসেছেন? না, ছেলের বাবা আগে এসেছেন। আমি আর আমার ছেলে এসেছি প্রায় দুই বছর হলো।

আমাদের দেশে স্বামীরা স্ত্রীকে রেখে বিদেশে চলে আসে৷ তারা দেশে আর স্বামীরা বিদেশে৷ কিছু লোক তাদের স্ত্রীকে আনতে চেষ্টা করে ঠিকই, কিন্তু সব স্ত্রী তো আসতেও পারে না৷ কাগজপত্রের সমস্যার কারণে৷ আগে পরে যা-ই হোক, আপনি যে আসতে পেরেছেন, এটাই বড় কথা৷

হ্যাঁ, আপা ঠিক বলেছেন৷ কাগজপত্র ঠিক না থাকলে বিদেশে তাদের অনেক রকমের প্রবলেম ফেইস করতে হয়। আল্লাহই উত্তম ফয়সালাকারী৷ আপনি কত বছর ধরে আছেন?

আমি আছি প্রায় দশ বছর৷

আপনার বাবার ফ্যামিলির সবাই কি এখানে?

না৷ আমি এপ্লাই করেছি আমার ফ্যামিলির জন্য। আমার মা বাবা আর এক ভাই এক বোনের জন্য৷ আর আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এখানে আমার এক মামা আছেন শুধু

বিয়ের পরপর কি আমেরিকা এসেছেন?

না৷ আমি স্টুডেন্ট ভিসায় আসি, আর আমার হাসব্যান্ডকে তার ভাই ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় নিয়ে আসেন প্রায় এগার বছর আগে৷ আমি তখন একটা দোকানে কাজ নিয়েছিলাম৷ তার পাশের একটা পাকিস্তানি দোকানে কাজ করত আমার হাসব্যান্ড, সেই থেকে পরিচয়৷ আমি একেবারে নতুন এখানে, তখন একজন বাঙালির আন্তরিকতা, সহযোগিতা অনেক সাহস যোগায় মনে৷ এভাবে ধীরে ধীরে সম্পর্ক তারপর বিয়ে৷ নিজের পছন্দে বিয়ে?

হ্যাঁ। আমি তো নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করাকেই সমর্থন করি আপা। অপিরিচিত কোন এক ছেলেকে হুট করে বিয়ে করে নিয়ে পরে অশান্তিতে জীবন যাপন করার থেকে আগে থেকে একে অপরকে চিনলে জানলে বিবাহিত জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়৷ বিশেষ করে আজকের যুগে৷

মৌমিতার কথা শুনে শামিমার মনে পড়ে গেল তার স্বামীর কথা। সেও তো এমন চিন্তার মানুষ, এমন করেই কথা বলে৷ অথচ শামিমা একটুও তা বিশ্বাস করে না৷ সে ছোট বেলা থেকেই দেখে এসেছে, তার পরিবার আত্মীয় স্বজন প্রায় সবারই প্রস্তাবিত সম্পর্কে বিয়ে করা এবং প্রায় সকলেই বেশ সুখী৷ অন্যদিকে তার এক ফুফুর মেঝ ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করে বৌ নিয়ে এসেছিল। আর কিছুদিন পর আবার বৌ নিয়ে চলেও গেছে শহরে৷ ছোট বেলায় সে দেখেছে, সেই ফুফুদের পরিবারে কেউই সুখী ছিল না এই বিয়েকে কেন্দ্র করে৷ তার বাবার সেই চাচাত বোনের বাড়ি শামিমাদের বাড়ির কাছেই ছিল৷ ফুফু যখনই তাদের বাড়ি আসতেন, তার মাকে দুঃখ করে বলতেন, “ভাবী আল্লাহ তোমাকে ছেলে দেয় নাই, এইজন্য আমাদের অনেকের মনে হতো, শফিক ভাইয়ের ছেলে নেই, দুই মেয়ে পরের ঘরে চলে গেলে তারা একা হয়ে যাবে, দুঃখী হয়ে যাবে৷ এখন মনে হয়, ছেলে হলেই যে কপালে সুখ আসে তা নয়৷ আমার বড় ছেলেটা বড় হতে না হতেই মারা গেল৷ ছোট ছেলেটা কী রকম সরল-ভোলা তো জানো। 

আমাদের চোখের আলো হলো এই মেঝ ছেলেটা৷ কিন্তু কী হয়ে গেল দেখো৷ আমাদের মনে তো আশা ছিল, শফিক ভাই আর না হয় সাহেদ ভাইয়ের একটা মেয়েকে আমার মেঝ ছেলের বৌ করে নিয়ে যাব৷ আমার কোন ভাই বোন নাই, তোমাদের কারো একজনের মেয়ে গেলে আমার মনে শান্তি লাগত৷ ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করে আনল, আমরা খুশি মনে গ্রহন করলাম, কিন্তু আমার ছেলে তো আর আমার নাই৷ খুঁটিনাটি বিষয়ে সারাক্ষণ বিরক্তি দেখাল, ভাই বোনের দোষ ধরল, ওর বৌকে নাকি কষ্ট দিচ্ছে সবাই৷ 

তারপর একদিন রাতে বলল, ওর শহরে চাকরি হয়েছে, বন্ধুর সহযোগিতায় সেখানে বাসাও নিয়েছে, তার ঘরের কাজের জন্য বৌকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবে। আবার ফুফুর সেই ছেলেও সুখী ছিল না তার বৌ নিয়ে, এখন তার দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। কিন্তু সেটা সবার কাছে বলতে পারত না সে৷ আগে একবার শামিমার চাচার কাছে তার মনে চেপে রাখা কষ্ট সে জানিয়েছিল। আর এখন কাউকে কিছু বলতে হয় না৷ তার অবস্থা এখন সবার সামনে। 

মৌমিতা বলে চলেছে, এ্যারেঞ্জ ম্যারিজ ব্যাপারটাই আমার কাছে ভাল লাগে না। মনে হয় ছেলে মেয়ের উপর জোর করে একটা অন্যায় চাপিয়ে দেয়া হয় এতে।

আপু আপনি মনে হয় একটু বেশি স্বাধীনচেতা এবং সেইসাথে বেশ আধুনিক মনেরও। আপনার হাসব্যান্ডও নিশ্চয় আপনার মনোভাবের!

হ্যাঁ৷ আমরা দুজনেই বিশ্বাস করি, ফ্রিডম হচ্ছে আমাদের লাইফে মোস্ট ইম্পর্টেন্ট ব্যাপার৷ বিশেষ করে নিজের জীবনের সাথে জড়িত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে

তো হওয়া উচিৎ। তাই না আপা?

হয়ত...।

হয়ত বলছেন! অন্যের পছন্দে বিয়ে করে জীবন কাটানো গেলেও সুখী হওয়া কি যায় আপা? আজ আমরা খুব হ্যাপি একটা কাপল নিজেদের পছন্দে বিয়েটা হওয়ার কারণেই তো!

আসলে সুখ একটা আপেক্ষিক বিষয় আপু৷ নিজের পছন্দে জীবন সাজালে মানুষ আজীবনের জন্য সুখী হবে- একথা কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে না৷ আপনার এই কথাটা ঠিক৷ আমি এগ্রি করি৷ গ্যারান্টি নাই। তবুও নিজের পছন্দের

জীবনসঙ্গী হলে অনেক বেশি হ্যাপি হওয়া যায়৷

আপু, প্রত্যেক মানুষের চিন্তা, নীতিবোধ আলাদা। আমার মনে হয় জীবনে সুখী হওয়ার জন্য তিনটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণা৷ তাক্বওয়াপূর্ণ দ্বিনদারিতা, ভালবাসা বা সম্মান এবং জীবনের মৌলিক চাহিদা পুরণের মতো সামর্থ্য৷ এই তিনটা দিক থাকলেই একটা দম্পতি তো বটেই, পুরো পরিবারটাই সুখী হতে পারে৷ পূর্ব পরিচিত বা ভাল চেনাজানা হলে যে তারা খুব ভাল হবে, আর বিয়ের পর একই রকম থাকবে সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? যারা ভাগ্যবান তারা সুখী হয়, সফলও হয়৷ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এদের অসুখী সংসার৷ কত কত দিন মাস বছর সম্পর্ক রেখে, দেখে বুঝে বিয়ে করে দুজন মানুষ পরে পস্তাতে থাকে৷ 

কিছুদিন বা কয়েক বছর পরে, ধীরে ধীরে তাদের একে অপরের চোখের সামনে দোষত্রুটি বের হতে থাকে৷ এক সময় তাদের মনে হয় জীবনের চুড়ান্ত ভুলটা করে ফেলেছে তারা৷ তারপর ছাড়াছাড়ি৷ যদি বাচ্চাকাচ্চা থাকে, তখন মাঝখান থেকে কষ্টটা তাদের হয় সব চেয়ে বেশি৷ কিছু পছন্দের বিয়ে তো এমনও হয় যে, এই বিয়েকে কেন্দ্র করে বড় বড় ক্রাইম পর্যন্ত হয়ে যায়৷ আচ্ছা আপু, কিছু মনে করবেন না প্লিজ, একটা বিষয়, ইসলামের দৃষ্টিতে সেটা কেমন তা আপনার জানার জন্য বলতে চাই৷


না আপা, কিছু মনে করব কেন, আপনার কাছে কুরআন পড়ছি। আপনি আমার টিচার, আমাকে ইসলাম এবং অন্যান্য বিষয়েও জানাতে পারেন৷ আমি কিছু মনে করব না, বরং খুশি হব৷

মৌমিতার কথায় বেশ খুশি হলো শামিমা৷ নিশ্চিন্ত মনে বলল, অনেক ধন্যবাদ, ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ, আর এত আন্তরিক হওয়ার জন্য। আমি বলতে চাচ্ছিলাম আপু, “মিশকাত, আহমাদ, এবং তিরমিজি এই তিনটা হাদিস গন্থে একটা হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া স্ত্রীলোকের বিবাহ বাতিল৷ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ওয়ালী/অভিভাবক ছাড়া বিয়ে হয় না৷ আরেকটা হাদিস এসেছে, কোন নারী কোন নারীকে বিয়ে দিতে পারে না এবং কোন অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া স্ত্রীলোকের বিবাহ বাতিল৷” অর্থাৎ আপু, একজন মেয়ে পুরুষ অভিভাবক ছাড়া একা নিজের পছন্দে বিয়ে করার অনুমতি নেই। অভিভাবক থাকা এবং তাদের অনুমতি জরুরি৷ এটা ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে একটা মেয়ের দুনিয়া ও আখিরাতে ভালোর জন্যেই।

বুঝতে পেরেছি আপা৷ আমি এটা আগে জানতাম না। আমরা রেজিষ্ট্রি ম্যারিজ করেছি আর আমার মামা সব জানত, মামা উপস্থিতও ছিল৷ বাবা মায়ের কাছে সেভাবে অনুমতি নেয়া হয় নাই আমার, কিন্তু বাবা মাও জানত আমার পছন্দে বিয়ে হচ্ছে। বাবা মা আমার মামার উপর আমার এখানে দেখাশোনার ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন৷

মাশাআল্লাহ, তাহলে তো ভাল৷ তাহলে আশা করা যায়, সব ঠিক আছে। আমার মনে হলো, বিষয়টি আপনাকে জানানো দরকার, তাই বলেছি। আপনার বিয়ে অশুদ্ধ চিন্তা করে বলিনি কিন্তু৷

ঠিক আছে, বলেছেন বলেই তো জানলাম৷ সামনে আমার ছেলে মেয়েদের

জানাতে পারব৷ আপা, আমি ইসলাম সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না, আপনি শেখাবেন

ইনশা আল্লাহ।

নাম্বার নিয়ে যোগাযোগ করেছি।

আমাকে৷ সালেহা ভাবী যখন আপনার কথা বলেছে, তখন আমি সাথে সাথে আপনার

হ্যাঁ, এখানে আসার পর সালেহা আপার বোনের সাথে আমার একটা বাসায় পরিচয় হয়েছিল। তখন উনি আমার ফোন নাম্বার নিয়েছিলেন। তারপর সালেহা আপু আর উনার আম্মার সাথে পরিচয় হয়৷

সালেহা ভাবী আপনাকে খুব পছন্দ করে৷

আমি যতটুকু জানি, উনি আপনাকেও পছন্দ করেন। আসলে সালেহা আপা খুব ভাল মনের মানুষ৷ আল্লাহ উনাকে রহম করুন, নিরাপদে রাখুন। আচ্ছা আপু আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?

আমার দেশের বাড়ি নরসিংদী, তবে আমি ঢাকায় বড় হয়েছি। আপনার বাড়ি কোথায়?

নওগাঁ৷ আর আমার শ্বশুরবাড়ি বগুড়া।

শামিমার কথা শেষ হতেই মৌমিতা উৎফুল্ল হয়ে বলল, তাই! আমার শশুরবাড়িও বগুড়া৷

ও আচ্ছা৷ বগুড়া কোথায়?

আদমদীঘি৷

তাই! আমার শ্বশুরবাড়িও তো আদমদীঘি৷ আপনার শ্বশুরবাড়ি আদমদীঘির কোথায়? কোন ইউনিয়ন?

তাতো জানি না আপা৷ ভুলে গেছি। আপনার শ্বশুরবাড়ির নাম কি? কার বাড়ি?

বাড়ির নাম কী, তাও তো সঠিক জানি না। আমি এখানে আসার পর আর দেশে যাই নাই, আমার ফ্যামিলির জন্য এপ্লাই করেছি তো৷ আমেরিকা আসার পর পড়াশোনা, তারপর বিয়ে সংসার বাচ্চা···, সব মিলিয়ে সময় পাই নাই। আর দেশে যেতে খরচ তো কম না।

দেশে না গেলেও, আপনার শ্বশুর, শ্বশুরবাড়ির নাম জানা উচিৎ আপা৷ এই এখন বলতে পারলে আমি হয়ত চিনতাম!

মতি দুই একবার বলেছিল, আমি ভুলে গেছি। আমার শ্বশুরবাড়ির তেমন কেউ নাই। এখানে মতির এক ভাই আর দেশে এক বোন আছে শুধু তাই, শ্বশুরবাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ হয় না। আমার শ্বশুরের নাম জানি তো৷ উনার নাম হচ্ছে, আব্দুল মাজিদ৷

মৌমিতার কথায় শামিমার বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল হঠাৎ। কয়েক মুহূর্ত থেমে সে কাঁপা কণ্ঠে বলল, আপনার হাসব্যান্ডের নাম? আব্দুল মতিন হাসান। সবাই ওকে হাসান ডাকে, আর আমি মতি ডাকি৷

আর বড় ভাই আব্দুল মুহিত? বড় বোন মোতিয়া বেগম?

জ্বি জ্বি৷ আপনি চিনেন! আপনি ওদের আত্মীয়?

উঠল।

শামিমার সামনের সাদা দেয়ালটা ধোঁয়াটে রঙ বেরঙের ঢেউ তুলে যেন কেঁপে

আমি...?

ওদের কী হন আপনি?

শামিমা নিজের অজান্তে জিজ্ঞাসার সুরে ‘আমি’ বলে থেমে গেলে মৌমিতা আবার প্রশ্ন করল৷ কিন্তু মৌমিতার উৎফুল্ল হয়ে করা প্রশ্ন শামিমার কানে ঠিকভাবে পৌঁছেনি৷ স্কাইপির অপর প্রান্তের ভেসে আসা কথাগুলো ঠাস ঠাস কিছু শব্দ হয়ে এসে তার কানের ভেতরটা ফাটিয়ে চৌচির করে দিচ্ছে মনে হচ্ছে। সে কী বলবে, কী করবে বুঝতে পারল না৷ তার বুকটা বড় বড় নখ দিয়ে কেউ খামচে ধরেছে যেন, হাত পা কাঁপছে৷ ওপাশ থেকে মৌমিতা বলছে, মতিকে জিজ্ঞাসা করব৷ আপনার নাম বললে চিনবে? হ্যালো, আপা...। আপা শুনতে পারছেন? আপা...। আমার কথা শোনা যায় না? আপনি কিছু বলছেন না। মনে হয় আমার কথা শুনছেন না৷ আচ্ছা, আমি আবার কল দিচ্ছি।

মৌমিতা লাইন কেটে দিল৷ শামিমা নির্বাক নির্জীব হয়ে বিছানায় বসে আছে৷ শুধু মনের ভেতরে তার ভয়, রাগ, ঘৃণা মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতি তোলপাড় করে দিচ্ছে৷ ভীষণ অস্থির লাগছে তার৷ বিছানার চাদর দুই হাতে খামচে ধরে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল সে।

মৌমিতা আবার কল করেছে, রিং বেজে চলেছে। শামিমার অস্থিরতা বাড়ছে। সে বুঝতে পারছে না কী করবে৷ অনেক কষ্টে নিজেকে গোসলখানার সামনে পর্যন্ত টেনে আনল৷ দরজা খুলে বেসিনের সামনে এসে দাঁড়াল৷ তার মনে হচ্ছে, তার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, বুকের হৃৎপিণ্ডটা ধপ ধপ করে লাফাচ্ছে। টেলিফোন বেজেই চলেছে৷ কী বলবে কী করবে সে জানে না৷ সে মাথায় পানি দিল৷ মুখেও কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে ফিরে এল কামরায়৷ মৌমিতা আবার কল করেছে, তবে এবার টেলিফোনে৷ বুঝতে পারছে এই সংকট থেকে শামিমা চাইলেও নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারবে না৷ এই অবস্থায় কী করবে, কীভাবে মুখোমুখি হবে তাও জানে না সে৷ তবু কল ধরে সালাম দিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলল, আপনি কল করেছিলেন, আমি ধরতে পারিনি৷ আমাকে একটু বাথরুমে যেতে হয়েছিল।

হ্যাঁ, অসুবিধা নেই৷ তখন কথা বলতে বলতে আপনার কথা শুনছিলাম না শেষে৷ তাই আবার কল দিয়েছিলাম৷ আপা আপনি তো আমার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে চিনেন৷ আপনাদের আত্মীয় ওরা?

না।

তাহলে সবাইকে এত ভাল করে চিনেন কি করে? আপনার শ্বশুরবাড়ি আর আমার শ্বশুরবাড়ি তো একই জায়গায় বললেন।

আপা দশ মিনিট পর কল দিচ্ছি আপনাকে৷

আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? গলাটা অন্য রকম শোনাচ্ছে।

হঠাৎ একটু খারাপ লাগছে৷

আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি রেস্ট নিন তাহলে৷

আচ্ছা। সময় নিয়ে শামিমা নিজেকে সামলে নিল কিছুটা আমেরিকা আসার সময় মোতিয়া বেগম তাকে বলে দিয়েছিলেন, সে এসে যদি হাসানের আচরণে উল্টাপাল্টা কিছু দেখে, তাহলে যেন সরাসরি তাকে এবং মুহিত ভাইকে জানায়৷ তার মা বেঁচে নেই, ভাই নেই, বাবার বয়স হয়ে গেছে এসব চিন্তা করে সে যেন কখনো নিজেকে হায় না ভাবে৷ সে নিজের শ্বশুরকে আপন বাবার মত দেখেছে, সেবা করেছে, তেমনি তারা দুই ভাইবোনও শামিমাকে নিজের ছোট বোন বলে মন থেকে গ্রহণ করেছে—এটা যেন সে কখনো না ভুলে৷ 

শামিমা চোখ মুছে আব্দুল মুহিতকে কল দিল৷ মুহিত সব শুনে কিছুটা বিচলিত হলেন, তারপর বললেন, আমি শুনেছিলাম, ও বিয়ে করেছে, আর মোহরানা হিসেবে বাড়িটা ঐ মেয়েকে দিয়ে দিয়েছে। অথচ তার আগে আমি তোমাদের জন্য এপ্লাই করতে বলায়, সে বলল এনে তোমাদের কোথায় রাখবে, তুমি পর্দানশীল মেয়ে, ম্যাথিও একটু মানসিক দুর্বল, এ্যাপার্টমেন্টে রাখা কঠিন হবে৷ তখন এত টাকার বাড়িটা আমি ওকে দিয়েছিলাম, দুইটা কারণে৷ এক, ম্যাথিওর কথা ভেবে, দুই, আমি ওকে সাপোর্ট করেছিলাম৷ ও আমাদের বাবা মায়ের আদর তেমন পায়নি। বাবা ছিলেন বিদেশে আর মারা গেছিলেন কম বয়সে৷ 

বাবা মায়ের কথা ভেবেই আমি নিজেকে ওর বাবার জায়গা থেকে দেখেছিলাম, যেমন মোতিয়া মায়ের অভাব পূর্ণ করার চেষ্টা করেছে সবসময়৷ এখন দেখছি, স্নেহ ভালবাসা পেলেও সঠিক শিক্ষাটা ও পাইনি৷ আমি খোঁজ খবরও নিয়েছিলাম৷ গিয়েছিলামও একবার, কিন্তু ঐ বাড়ি গিয়ে জানতে পারি, মতিউর রহমান নামের এক লোকের কাছে হাসান বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে, আর ঐ বাড়িতে এখন মতি নামের লোকের স্ত্রী থাকে?। এসব কথা বলে তারপর তিনি ছোট ভাইয়ের বৌকে কয়েকটি প্রশ্ন করে তার মতামত জানতে চাইলেন৷ শামিমা তার কথার উত্তর দিল৷ উত্তর পেয়ে মুহিত তার করণীয় এখন কী তা বলে দিলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ