অনুপ্রেরণার গল্প, লেখক : আলী আব্দুল্লাহ | Anupreronar Golpo By Ali Abdullah

বই অনুপ্রেরণার গল্প    (pdf no available)
লেখক : আলী আব্দুল্লাহ
প্রকাশনী : মুহাম্মদ পাবলিকেশন
বিষয় : আত্মশুদ্ধি ও অনুপ্রেরণা
পৃষ্ঠা : 112, কভার : পেপার ব্যাক
আইএসবিএন : 9789843465993
ভাষা : বাংলা
Image

দীর্ঘ প্রেমের ছোট্ট গল্প ......

ছেলেটির বয়স অল্প। ঝকঝকে গায়ের রং। সমুজ্জ্বল মুখমণ্ডল, দীর্ঘ চোখের পলক। খুব সুন্দর করে কথা বলেন। ব্যক্তিত্বে একধরনের গাম্ভীর্য রয়েছে। খুব বেশি আকর্ষণীয় একজন যুবক।

ব্যবসার উদ্দেশ্যে তিনি ছেলেটিকে কিছু মূলধন দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সিরিয়ায়। সিরিয়া থেকে ব্যবসা করে ফিরে এসে মূলধন-সহ এত মুনাফা কেউ কখনো তার হাতে তুলে দেয়নি। দাসী মাইসারাও ছেলেটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মাইসারার বাঁধভাঙা প্রশংসার কারণেই হোক আর অন্য যে কারণেই হোক—ছেলেটির প্রতি তার শ্রদ্ধা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় ছেলেটিকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছাটিও তার মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। তবে এই ছেলেটির থেকে তার বয়স অনেক বেশি। এর আগে বড় বড় সরদার, নেতা এবং গোত্র প্রধানগণ অনেকেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি রাজি হননি। কিন্তু কেন জানি এই ছেলেটির জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

তিনি তার এই ব্যাকুলতা তার বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনাব্বিহের কাছে প্রকাশ করলেন এবং নাফিসা বিনতে মুনাব্বিহকে অনুরোধ করলেন, ছেলেটার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলতে। তার বান্ধবী নাফিসা ছেলেটির সঙ্গে কথা বলল। মজার ব্যাপার হলো, বয়সের এত বড় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ছেলেটি বিয়েতে রাজি হয়ে গেল।

এরপর পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের উপস্থিতিতে বেশ চমৎকারভাবে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো।

সেই সুদর্শন বুদ্ধিদীপ্ত যুবক ছেলেটি হলো আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যিনি বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায় শুরু করলেন, তাঁর থেকে প্রায় ১৫ বছরের বড় খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু আনহার সঙ্গে।

আমাদের নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রাদিয়াল্লাহু আনহাকে এতটা ভালোবাসতেন যে, তার (খাদিজার) মৃত্যুর বহু বছর পরও যখন নবিজির তাঁর স্মৃতি মনে পড়ত, তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে যেতেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হৃদয়ে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার জন্যে ভালোবাসা ছিল অটুট।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার সঙ্গে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে হয়। তার নবুয়তপ্রাপ্তির বহু আগে। যতদিন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা বেঁচে ছিলেন, ততদিন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কোনো বিয়ে করেননি। নবিজির কনিষ্ঠ পুত্র ইবরাহিম ছাড়া তাঁর সকল সন্তানই মা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার গর্ভে হয়েছিল। নবিজির এই পুণ্যবতী স্ত্রী তাঁর সঙ্গে অনেক নির্যাতন এবং কষ্ট সহ্য করেছেন। তাঁর দ্বীনপ্রচারের কাজে সাহায্য করতে গিয়ে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম প্রেম, তাঁর প্রেয়সী স্ত্রী খাদিজার সঙ্গে নবিজির বিবাহিত জীবন ছিল মধুময় সুখের জীবন। তাঁদের দুজনার সুখের সংসার আলো করে এসেছিল, জয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা, আল-কাসিম আর আবদুল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই ছয়জন সন্তানের মধ্যে পাঁচজনকেই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশাতেই তাঁর কাছে নিয়ে যান। কেবল ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বাদে বাকি সবাই নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশাতেই মারা যান।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রথম স্ত্রী খদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতেন। খাদিজার মৃত্যুর পরও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি সামান্য পরিমাণও কমেনি। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময়ই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে স্মরণ করতেন। তার কথা বলতেন। এই কারণে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীরা মৃত খাদিজাকে নিয়েও দারুণ ঈর্ষা বোধ করতেন। কিন্তু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিন্তা-চেতনায় ছিলেন তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা। তার প্রতি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসা, আকর্ষণ, মমতা, শ্রদ্ধা ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুখেদুঃখে সবসময়ই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন তাঁর পাশে। মন দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, তাঁর সবকিছু দিয়ে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার হক আদায় করেছেন।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার পর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী ছিলেন আমাদের মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা। মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ও খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে দারুণ ঈর্ষা করতেন। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম এর হাদিসে এসেছে যে, মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন, আমি খাদিজা ছাড়া নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর কোনো স্ত্রীকে নিয়ে এতটা ঈর্ষা অনুভব করিনি। এটি এজন্য নয় যে আমি তাকে কোনোদিন দেখিনি। বরং এটি এজন্য যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতেন।”

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাঝে মাঝে একটা ভেড়া জবাই করে বলতেন, এই ভেড়ার মাংস খাদিজার বান্ধবীদের জন্য পাঠিয়ে দাও। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে শুধু তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজার কথা বারবার মনে করতেন কেবল তাই নয়; বরং খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যুর পরও তিনি খাদিজার প্রিয় বান্ধবীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এই কাজটা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করতেন তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজার প্রতি ভালোবাসা থেকে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন আচরণ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বেশ পীড়া দিত। তিনি বেশ ঈর্ষাবোধ করতেন। এরকম একটি দিন তো মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সহ্য না করতে পেরে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেই বসলেন,

‘শুধুই খাদিজা আর খাদিজা!'

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, মহান আল্লাহ তাআলাই আমার অন্তরে খাদিজার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছেন।

সত্যি কথা বলতে মহান আল্লাহ তাআলা খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন। খাদিজার প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই ভালোবাসা ছিল সম্পূর্ণ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে।

ইমাম আহমাদ ও তিরমিজি থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে আছে, মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, 'এমন অনেকদিন হয়েছে যে, খাদিজার প্রশংসা না-করে নবিজি ঘর থেকে বের হননি। একদিন এভাবে তিনি খাদিজার প্রশংসা করছিলেন। আমি সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলাম, ‘তিনি এমন কী ছিলেন? 
তিনি তো একজন বয়স্ক মহিলামাত্র। তার চেয়ে উত্তম নারী দিয়ে কি আল্লাহ আপনার স্ত্রীর স্থান পূরণ করে দেননি?

এ কথা শোনামাত্র নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রেগে গেলেন। তিনি রাগান্বিত গলায় বললেন, 'না। আল্লাহর শপথ, তিনি খাদিজার চাইতে উত্তম কাউকেই আমার জীবনে আনেননি। যখন সবাই আমাকে অস্বীকার করেছে, তখন সে আমার ওপর আস্থা রেখেছে। যখন সবাই আমাকে মিথ্যুক ডেকেছে, তখন সে আমাকে বিশ্বাস করেছে। যখন সবাই আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তখন সে— তাঁর সবকিছু দিয়ে আমাকে স্বস্তি দিয়েছে। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে আমার ওপর রহমত দিয়েছেন, আমাকে তাঁর থেকে সন্তান দান করেছেন।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন আল্লাহর প্রিয় একজন বান্দি। তিনি যখন জীবিত, তখন একদিন জিবরাইল আলাইহিস সালাম এলেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, এখন খাদিজা আপনার কাছে আসবেন। তিনি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছেন। যখন তিনি আসবেন, তাঁকে বলবেন, আল্লাহ তাকে সালাম দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বলবেন যে, আমিও তাঁকে সালাম জানিয়েছি।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম ভালোবাসার মানুষটি এতই অসাধারণ ছিলেন যে, স্বয়ং আমাদের মহান রব তাঁকে সালাম জানিয়েছেন। আর জিবরাইল আলাইহিস সালামও নিজের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে সালাম পৌঁছে দিতে বলেছেন। এরপর জিবরাইল আলাইহিস সালাম বলেছিলেন, খাদিজাকে তার জান্নাতের বাড়ির সুসংবাদ দিন।

খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন একজন জান্নাতি নারী, যার প্রেম হয়েছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটির সঙ্গে। তাঁরা দুজন মিলে রচনা করেছিলেন একটি দীর্ঘ প্রেমের মায়ামাখা ছোট্ট গল্প।

একজন জীবিত শহিদের গল্প .....

উহুদের ময়দান। ভীষণ এক যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় প্রায় নিশ্চিত৷ কুরাইশরা উলটো দিকে পালিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। এখন আর কুরাইশদের এদিকে আক্রমণ করার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। বেশিরভাগ সাহাবি তাই একটু অসতর্ক হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। অনেকে গনিমত সংগ্রহ করতে ব্যস্ত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদেরকে আরও সতর্ক হতে বললেন। উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কিংবা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এই মুহূর্তে ঠিক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে অবস্থান করছেন এখন নয়জন সাহাবি। তাদের মধ্যে সাতজন আনসারি। আর বাকি দুজনার একজন হলেন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস এবং আরেকজন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে উহুদের ময়দানে অবস্থানরত এই তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটা দারুণ রোমাঞ্চকর। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাবার নাম উবাইদুল্লাহ। আর মা হচ্ছেন সাবা। তিনি ঠিক আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো কুরাইশ বংশের তাইম শাখার লোক। অর্থাৎ আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাইম নামের একই কাবিলার মানুষ।

একবারের ঘটনা। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ব্যবসার কাজে কুরাইশদের এক ব্যবসায়ী কাফেলার সঙ্গে সিরিয়াতে গেলেন। তারা সিরিয়া শহরে পৌঁছলেন এবং সেখানকার বাজারে কুরাইশের লোকেরা বেচাকেনা শুরু করল। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন বাজার ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন একজন খ্রিষ্টান পাদরিকে। পাদরি বাজারে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন—ওহে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, আপনারা এ বাজারে আগত লোকদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের মধ্যে মক্কাবাসী কোনো লোক আছে কি না?

তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু পাদরির কথা শুনে তার কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর পাদরিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হ্যাঁ। আমি মক্কার লোক।

পাদরি বললেন, তোমাদের মধ্যে আহমাদ কি আত্মপ্রকাশ করেছেন?

কোন আহমাদ?

পাদরি তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আহমাদ। যে মাসে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন এটা সেই মাস। তিনি হবেন শেষ নবি। মক্কায় আত্মপ্রকাশ করে কালো পাথর এবং খেজুর উদ্যান রয়েছে এমন এলাকায় হিজরত করবেন। যুবক, খুব তাড়াতাড়ি তোমার তাঁর কাছে যাওয়া উচিত।

পাদরির প্রত্যেকটা কথা তালহার মনে দারুণ প্রভাব ফেলল। সে ব্যবসা ফেলে রেখে, সে যেই কাফেলার সাথে সিরিয়া এসেছিল, তাঁদের ফেলে রেখে নিজের বাহনে সওয়ার হয়ে সোজা চলে এলো মক্কায়। তিনি মক্কায় নিজের বাসায় পৌঁছেই, পরিবারের লোকদের জিজ্ঞেস করল—

আমার সিরিয়া সফরের সময় মক্কায় নতুন কোনো কিছু ঘটেছে কি?

তারা উত্তর দিলো

হ্যাঁ। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ নিজেকে নবি দাবি করেছেন এবং আবু কুহাফার ছেলে আবু বকর তাঁর অনুসারী হয়েছে।

তালহা যখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলেন তখন ছুটে গেলেন আবু বকরের কাছে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন—

এই কথা কি সত্যি যে, মুহাম্মদ নবুয়ত দাবি করেছেন এবং আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন?

হ্যাঁ, সত্যি।

এরপর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তালহাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সিরিয়ায় তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া পাদরির ঘটনাটি খুলে বললেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তালহার মুখ থেকে পাদরির ঘটনা শুনলেন। তিনি তালহাকে নিয়ে গেলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছেও তালহা সিরিয়ায় তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই অভিনব ঘটনাটি বিস্তারিত বর্ণনা করলেন।

ঘটনা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুশি হলেন দারুণ। সেইদিন তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে কালেমা শাহাদত পাঠ করে প্রবেশ করলেন ইসলামে।

বিপত্তি ঘটল অন্য জায়গায়। তালহার মা ব্যাপক হইচই শুরু করলেন। ছেলে পিতৃধর্ম ত্যাগ করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মে প্রবেশ করেছে—এটা মেনে নেওয়া সম্ভব না। তিনি ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলেকে তাদের গোত্রের নেতা বানাবেন। সব আশার গুড়ে বালি। তালহার গোত্রের লোকেরা তালহাকে আবারও আগের ধর্মে ফিরে আসতে ভীষণ চাপাচাপি শুরু করল। তালহা তার সিদ্ধান্তে অটল রইল।

তার ইসলামের ওপর অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত তার মা এবং গোত্রের লোকজন একদমই মেনে নিতে পারল না। একদিন একদল লোক তালহার হাত-পা বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলো। এরপর তাকে ওপর করে শোয়ানো হলো। পিঠে ও মাথায় বেদম পেটানো হলো। তালহার মা-ও দাঁড়িয়েছিলেন সেই লোকগুলোর সঙ্গে। তাদের একটাই কথা, তালহাকে ইসলাম ছেড়ে ফিরে আসতে হবে। তালহা অবশ্য এত অত্যাচারের পরেও ইসলামকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছিলেন। মক্কায় দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি ধৈর্য ধরে ইসলামের ওপর অবিচল থাকেন এবং গোপনে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে থাকেন মানুষের কাছে। সে সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে দেখা করতে, তাঁর কথা শুনতে অন্য সাহাবিদের মতো তালহাও যেতেন দারুল আরকামে। এরপর সময় কেটে যায়। পরিস্থিতির পটপরিবর্তন হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিয়ে হিজরত করেন মদিনায়। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরিবারও হিজরতের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন যোগ দেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরিবারের সঙ্গে হিজরত করার উদ্দেশ্যে। তিনি হিজরতের সময় তাদের পুরো দলটিকে নেতৃত্ব দেন। মদিনায় হিজরতের পর যখন কুরাইশদের সঙ্গে ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হলো, তখন তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু সরাসরি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদরের যুদ্ধ থেকে পাওয়া গনিমতের অংশ দিয়েছিলেন তালহাকেও।

এই তালহাই এখন উহুদের ময়দানে আরও কিছু সাহাবিকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন। সমস্যা হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন তিরন্দাজ সাহাবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ ভুলে গিয়ে গনিমত সংগ্রহ করতে পাহাড় থেকে নেমে পড়েছেন। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের নেতৃত্বে পুনরায় আক্রমণ করে বসেছে কুরাইশের কাফিররা।

ভয়াবহ আক্রমণ। এর মধ্যেই সাহাবি আমর বিন ইয়াজিদ শহিদ হয়ে গেছেন। কাতাদা বিন নুমানের চোখে কাফিরের ছোড়া তির এসে বিঁধেছে। তার চোখের কোটর থেকে মণি বের হয়ে ঝুলছে। আবু দুজানা বেশ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পিঠ পেতে দিয়েছেন কাফিরদের ছুড়ে আসা তিরগুলোর দিকে। ঢাল হিসেবে দুজানার পিঠ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তির ছুড়ছেন কাফিরদের লক্ষ করে। আর তালহা এক হাতে তরবারি আর এক হাতে বর্শা নিয়ে বীরের মতো লড়ে যাচ্ছেন কাফির বাহিনীর সাথে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে এসেছেন পাহাড়ের চূড়ায়। কাফিরদের অতর্কিত আক্রমণের কারণে অন্য সব সাহাবি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন তাঁর কাছ থেকে। এখন তাঁর সঙ্গে অবস্থান করছেন তালহা, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস; আর অল্পকিছু আনসারি সাহাবি। কুরাইশ বাহিনীর একটি অংশ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘিরে ফেলেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সঙ্গে থাকা সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, হবে।' এদের সরিয়ে দিতে পারবে, ন্নাতে সে আমার সাথি

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা শুনে তালহা বলে উঠলেন, আমি যাব, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না। তুমি থাকো।

একজন আনসারি বলল, আমি যাব।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যাও তুমি।

আনসারি সাহাবি গেলেন এবং কুরাইশদের সঙ্গে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে শহিদ হলেন।

এভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদেরকে যতবারই সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালেন, ঠিক ততবারই তালহা নিজে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেকবারই তাকে থাকতে বললেন, এবং অন্য একজন আনসারি সাহাবিকে পাঠালেন। এভাবে এক এক করে যখন সব আনসারি সাহাবি শহিদ হলেন, তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তালহাকে উদ্দেশ করে বললেন, এবার তোমার পালা, তালহা। তুমি যাও।

তালহা কুরাইশ বাহিনীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। কাফির কুরাইশরা এগিয়ে আসছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিকে। উদ্দেশ্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করা। ইবনে কামিয়া তরবারি দিয়ে আঘাত হানার চেষ্টা করেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর হাতের ঢাল দিয়ে সেই তরবারির আঘাতকে আটকে দিয়েছেন। তারপরও নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বর্মতে আঘাত লেগেছে। মুখের সেই বর্ম ভেঙে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গালে ঢুকে গেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে ক্ষত থেকে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর আরও একটা আক্রমণ চালানো হয়েছে। চালিয়েছে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসেরই ভাই উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাস। উতবা তির নিক্ষেপ করেছে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ করে। সেই তির গিয়ে বিঁধেছে আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বর্ম ভেদ করে আরেক চোয়ালে। তার একটি দাঁত শহিদ হয়েছে তখন। রক্তে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাড়ি ভিজে যাচ্ছে। এই দৃশ্য কোনো মুসলমানের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে গেছেন। সে একাই দৌড়ে গিয়ে কাফিরদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়ে, তাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। পরক্ষণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে, তাঁকে কাঁধে তুলে পাহাড়ের ওপরে উঠে নিরাপদে রেখে আবারও কুরাইশদের আক্রমণ করতে ছুটে যাচ্ছেন। তালহা একাই অসম্ভব সাহসিকতায় কুরাইশদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন। কুরাইশদের তরবারির আঘাত তালহার শরীরকে করেছে ক্ষতবিক্ষত। তালহা যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। বীরদর্পে কাফিরদের ওপর চালিয়ে যাচ্ছেন তার তরবারি। তার জীবন থাকতে তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো ক্ষতি হতে দেবেন না। কিছুতেই না।

উহুদ পাহাড়গুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই। পরিস্থিতি এখন কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং আবু উবাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবিজির সন্ধান পেয়ে ছুটে এসেছেন পাহাড়ের চূড়ায়। তারা দুজন আহত নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেবা-শুশ্রূষা দেওয়ার জন্য এগিয়ে গেলেন। নবিজি বললেন,

আমাকে ছাড়ো, তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখো।

তারা দেখলেন নবিজিকে কাফিরদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে, তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বীরের মতো যুদ্ধ করে এখন রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর একটি হাত দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তালহার সারা দেহে তরবারি এবং বর্শার ৭০টিরও বেশি আঘাত।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উহুদের যুদ্ধের পরে তালহার ব্যাপারে বলতেন, যদি কেউ কোনো মৃতব্যক্তিকে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে দেখে আনন্দ পেতে চায়, সে যেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহকে দেখে।

তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ঠিক এই কারণেই জীবিত শহিদ বলা হয়। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তো উহুদের যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, সে দিনটির সবটুকুই তালহার।

উহুদের যুদ্ধ হয়ে গেছে প্রায় দু-বছর হলো। পঞ্চম হিজরির জিলকদ মাস। আরবের বিভিন্ন গোত্র এবং ইহুদিরা একসঙ্গে মুসলিমদের মদিনায় আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। এবার মুসলিমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা বিশাল কাফির বাহিনীর মোকাবিলা করবে এই মদিনাতে অবস্থান করেই। পারস্য থেকে আসা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় এক সাহাবি সালমান আল ফারসি যুদ্ধের একটি অভিনব কৌশলের কথা নবিজিকে জানিয়েছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদের সঙ্গে মাশওয়ারা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সালমানের সেই কৌশলটি এই যুদ্ধে বাস্তবায়ন করা হবে। সেই কৌশল অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে মদিনা শহরের যেই দিকটি থেকে কাফির বাহিনী আক্রমণ করবে, সেই দিকটিতে একটি খন্দক খনন করা হবে। যাতে করে কাফির বাহিনী সেই গভীর খন্দক পার হয়ে মদিনায় প্রবেশ করতে না পারে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী মদিনার উপকণ্ঠে সালা পর্বতের পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে পাঁচ হাত গভীর খন্দক খনন করা শুরু করে। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুও খন্দক খননের কাজে অংশগ্রহণ করেন। তারা সবাই মিলে খন্দক খনন সফলভাবে সম্পন্ন করেন।

মুসলিমদের পরিস্থিতি বেশ নাজুক। বাইরে বিশাল কাফির বাহিনী মদিনা অবরোধ করছে। আর এদিকে ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এরকম অবরুদ্ধ অবস্থায় মুসলিমদের মধ্যে কয়েকজন নিজের স্ত্রী সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তারা খন্দকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে স্ত্রী, সন্তানসন্ততির নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছিলেন। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু ঠিক সেই সময় যাচ্ছিলেন খন্দকের পাশ দিয়ে। হেঁটে যাওয়ার সময় খন্দকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো একজন মুসলমানের কথা তাঁর কানে ভেসে এলো। লোকটি বলছেন—আমাদের স্ত্রী-পরিজনদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা উচিত।

তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু কথাটা শুনে একটু থমকে দাঁড়ালেন। তারপর তাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, আল্লাহু খাইরান হাফিজান। আল্লাহ সর্বোত্তম নিরাপত্তা বিধানকারী। যারা নিজেদের শক্তি এবং বাহুবলের ওপর ভরসা করেছে, তারা ব্যর্থ হয়েছে।

লোকেরা তালহার কথা শুনে বলল,

আপনি ঠিকই বলেছেন।

খন্দকের যুদ্ধে মুসলিমরা একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করেছিলেন। আল্লাহ তাদের বিশাল কাফির বাহিনী এবং সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিজয় উপহার দিয়েছিলেন।

এরপর কেটে গেছে অনেকটা বছর, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ নিয়ে গেছেন তাঁর কাছে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিমদের খালিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় দুই বছর। এখন হিজরি ১৩ সন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বেশ অসুস্থ। তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে।

তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু দেখতে এসেছেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু চুপ করে আছেন। হয়তো কিছু চিন্তা করছেন। তালহাও কোনো কথা বলছেন না।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নীরবতা ভেঙে বললেন, উমরকে কি আমার স্থলাভিষিক্ত করব? আবু মুহাম্মদ (তালহা) আপনার মত কী?

তালহা বললেন, সাহাবিদের মধ্যে উমর সর্বোত্তম গুণের অধিকারী, তিনি সত্য-মিথ্যার

পার্থক্যকারী।

তাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করার ব্যাপারে আমি আপনার পরামর্শ চেয়েছি তালহা। তার স্বভাবে কিছুটা কঠোরতা আছে এবং তিনি একটু বেশি কড়াকড়ি আরোপ করে থাকেন।

তার মধ্যে কী কী ত্রুটি আছে? জিজ্ঞেস করলেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। আপনার সময়ে তিনি যখন এত কঠোর, আপনার পরে নিজে দায়িত্ব পেলে না জানি কতটা কঠোর হয়ে পড়েন।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তার ওপর যখন খিলাফতের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়বে তিনি নরম হয়ে যাবেন।

তার গুণাবলি ও যোগ্যতা যে সকলের থেকে বেশি সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার স্বভাবের একটি দিক সম্পর্কে আমার যা প্রতিক্রিয়া আমি নির্দ্বিধায় বললাম।

তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু পরিষ্কার করে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উমর ইবনুল

খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে তার মতামত বলেছিল। তিনি কোনো ভণিতা করেননি; বরং বলেছেন স্পষ্ট ভাষায়। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু এমনিতে সাহসী ছিলেন। ছিলেন দানশীল এবং উত্তম ব্যবসায়ী। তার দানশীলতার বিভিন্ন কাহিনি রয়েছে। একবার হাদরামাউত থেকে ৭০ হাজার দিরহাম তার হাতে এলো। তিনি রাতে ঘুমাতে পারলেন না। চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই অবস্থা দেখে তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম জিজ্ঞেস করল। আবু মুহাম্মাদ, আপনার কী হয়েছে? মনে হয় আমার কোনো আচরণে আপনি কষ্ট পেয়েছেন?

না। একজন মুসলিম পুরুষের স্ত্রী হিসেবে তুমি চমৎকার! কিন্তু সেই সন্ধ্যা থেকে আমি চিন্তা করছি, এত অর্থকড়ি ঘরে রেখে ঘুমালে একজন মানুষের তার পারওয়ারদিগারের প্রতি কেমন ধারণা হবে?

এতে আপনার চিন্তিত হওয়ার কী আছে? এত রাতে গরিব-দুঃখী আর আত্মীয়স্বজন কোথায় পাবেন? সকাল হলেই বণ্টন করে দেবেন।

আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন। একেই বলে বাপ কি বেটি!

তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু সেইদিন তার স্ত্রী, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে উম্মে কুলসুমের প্রতি খুশি হলেন বেশ। তার কথামতো পরদিন সকালবেলা ভিন্ন ভিন্ন থলে ও পাত্রে সব দিরহামগুলো ভাগ করে, মুহাজির এবং আনসার গরিব-মিসকিনদের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। একবার তো তিনি প্রায় ৩ লক্ষ দিরহাম এক ব্যক্তিকে দিয়ে দিয়েছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এলো। তালহার সঙ্গে ব্যক্তিটির আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বলে কিছু সাহায্য চাইল।

তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু সেই ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বললেন, অমুক জায়গায় আমার এক খণ্ড জমি আছে। উসমান ইবনে আফফান ওই জমিটির বিনিময়ে আমাকে ৩ লাখ দিরহাম দিতে চাচ্ছেন। তুমি ইচ্ছা করলে সেই জমিটা নিয়ে নিতে পারো। অথবা আমি জমিটা বিক্রি করে ৩ লক্ষ দিরহাম তোমাকে দিয়ে দিতে পারি।

লোকটি জমি না নিয়ে জমি বিক্রির অর্থ নিতেই বেশি আগ্রহ দেখাল। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুও তার কথামতো জমি বিক্রি করে পাওয়া সমুদয় অর্থ লোকটিকে দান করে দিলেন।

আমিরুল মুমিনিন উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু তার মৃত্যুর আগে যে ছয়জন সাহাবির মধ্যে যেকোনো একজনকে খালিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হজরত তালহা ছিলেন অন্যতম। কিন্তু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু এখানেও মহানুভবতার পরিচয় দেন। তিনি নিজে খলিফা হওয়ার চিন্তা না করে বরং খলিফা হওয়ার পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন এবং উসমান বিন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে খলিফা হওয়ার সমর্থন দেন। এর বহুবছর পর যখন খলিফা উসমান বিন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করা হয়, তখন তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু মক্কায় গিয়ে মা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার সঙ্গে উটের যুদ্ধে যোগদান করেন। 

সেই যুদ্ধের দিন মারওয়ান ইবনুল হাকামের ছোড়া একটি তির গিয়ে বিঁধে তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর পায়ে। তিনি আহত হন। তার ক্ষত স্থানটি থেকে তখনো রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছিল না। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই অবস্থা দেখে কাকা ইবনে আমর তাকে অনুরোধ করেছিলেন বসরার দারুল ইলাজে (হাসপাতালে) চলে যাওয়ার। কাকা রাদিয়াল্লাহু আনহুর অনুরোধ তিনি রেখেছিলেন। তিনি বসরার দারুল ইলাজে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। আল্লাহ তাঁর বান্দা তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার পয়গাম পাঠিয়ে দিয়েছেন। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহুর শরীর রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু সেইদিন দারুল ইলাজে পৌঁছে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। শহিদি মর্যাদার চাদরাবৃত করে আল্লাহ তাঁর বান্দাকে নিয়ে গেলেন তাঁর কাছে।


আহমদ ইবনু হাম্বল রাহিমাহুল্লাহকে প্রহারের এই ঘটনার প্রায় বিশ বছর পর কোনো এক জুমার দিনে, মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর মৃত্যু যখন উপস্থিত হলো, তিনি বারবার বলতে শুরু করলেন, এখন না পরে, এখন না পরে।

তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ তাঁর পাশে ছিলেন, বাবাকে এই কথা বলতে শুনে সে জিজ্ঞেস

করলেন, এই মুহূর্তে আপনি এটা কী বলছেন?

তিনি বললেন, বৎস! ইবলিশ দাঁতে আঙুল কামড়িয়ে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে বলছে,

আহমদ তুমি আমাকে পরীক্ষা করো। তাঁর জবাবে আমি বলছি, লাবাদ, লাবাদ।

অর্থাৎ তাওহিদের ওপর আমার দেহ থেকে প্রাণ বের না হওয়া পর্যন্ত সে আমার সম্মুখে অগ্রসর হতে পারবে না।

এরপর খুব সুন্দর একটা ব্যাপার ঘটল। তিনি তাঁর পরিবারের লোকদেরকে ইঙ্গিতে বললেন, তাঁকে অজু করিয়ে দিতে। তারা ইমাম আহমদ রাহিমাহুল্লাহকে অজু করাতে শুরু করলেন। তখন তিনি তাঁর আঙুল খিলাল করে দেওয়ার জন্য বললেন। এই পুরো সময়টাজুড়ে তিনি তাঁর রবের জিকির করছিলেন।

একসময় তাঁকে সুন্দরভাবে অজু করানোর কাজ সম্পন্ন হয়। আর তার ঠিক পরেই তিনি ইনতিকাল করেন।

আল্লাহ এই মহান ইমামকে জান্নাতুল ফিরদাউস নাসিব করুন। আমিন।

আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন। We Respect Every Author Hardwork boipaw

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ