হজরত মাওলানা সামীরুদ্দীন কাসেমী এর জীবনী - Biography Of Maulana Samiruddin Kasemi Hafijahullah
Maulana Samiruddin Kasemi |
হজরত মাওলানা সামীরুদ্দীন কাসেমী দামাত বারাকাতুহুম একজন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর চমৎকার কাজ সম্পাদন করেছেন। বর্তমান যুগের চাহিদাকে খুব ভালোভাবে বুঝে ছাত্রদের জন্য অনেক বিষয় একত্র করে অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফিকহের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের মধ্যে হাদিসের রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র যোগ করা, প্রতিটি আকিদাকে ১০টি আয়াত ও ১০টি হাদিস দ্বারা প্রমাণ করা, মিরাস বা উত্তরাধিকার বণ্টনকে আধুনিক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা, বিজ্ঞান ও কুরআনের মতো নির্বাচিত গ্রন্থ রচনা করা এবং গোটা পৃথিবীর জন্য নির্ভুল ক্যালেন্ডার তৈরি করে এই অঙ্গনে ইমামের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ইত্যাদি হলো ওই সকল ব্যতিক্রম কাজ, যার ফলে কবির ভাষায় বলা যেতে পারে—
“হাজার বছর নার্গিস ফুল তার সৌন্দর্যহীনতার জন্য কাঁদছে অনেক ত্যাগের বিনিময়েই বাগানের শোভা ও সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়।”
হজরত মাওলানা সামীরুদ্দীন কাসেমী জন্ম ....
হজরত মাওলানা সামীরুদ্দীন সাহেব ৬ নভেম্বর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ২৫ মহররম ১৩৭০ হিজরিতে ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশের গুড্ডা জেলার মাহগাঁওয়া থানার ঘুট্টি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এ প্রদেশটি পূর্বে বাহার প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে পৃথক করে ঝাড়খণ্ড প্রদেশ বানানো হয়েছে। এই গ্রামটি গুড্ডা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যেখানে এখনো বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা নেই।
বংশ তালিকা
নাম সামীরুদ্দীন। পিতার নাম জামালুদ্দীন। দাদার নাম মুহাম্মাদ বখশ। ওরফে লাদুনি। পরদাদার নাম চুলহায়ী। বংশ শায়েখ সিদ্দিকি। অনেক পরে গিয়ে তার বংশ হজরত আবু বকর রা.-এ সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এজন্য এই বংশকে শায়খে সিদ্দিকি বলা হয়। নিয়মতান্ত্রিক কোনো বংশতালিকা নেই। তবে তার বংশে এটাই প্রসিদ্ধ।
শিক্ষাজীবন ....
প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন নিজ গ্রামের মকতবে ভাগলপুর জেলার গরিয়াচক গ্রামের মৌলভি আবদুর রউফ ওরফে গুনি রহ.-এর নিকট। এই মকতবেই তিনি উর্দু, হিন্দি, ফারসি ও গণিতের শিক্ষা লাভ করেন। ১২ বছর বয়সে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসা দারুল উলুম আটকি রাচিতে শিক্ষা লাভ করার জন্য গমন করেন। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে পাটনা ভাগলপুরের মাদরাসা এজাজিয়ায় ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে গুজরাটের দারুল উলুম ছাপিতে যান এবং ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে উপমহাদেশের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। শাবান ১৩৯০ হিজরি মোতাবেক ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন।
উদ্ভাদবৃন্দ ....
তিনি সহিহ বুখারি প্রথম খণ্ড পড়েছেন দারুল উলুমের তৎকালীন শায়খুল হাদিস হজরত মাওলানা আল্লামা ফখরুদ্দিন সাহেব রহ.-এর নিকট। সহিহ বুখারির দ্বিতীয় খণ্ড পড়েছেন হজরত মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান গাঙ্গুহি রহ.-এর নিকট। সহিহ মুসলিম পড়েছেন হজরত মাওলানা শরিফ সাহেব রহ.-এর নিকট। সুনানুত তিরমিজি পড়েছেন হজরত মাওলানা ফখরুল হাসান সাহেব মুরাদাবাদী রহ.-এর নিকট। সুনানু আবি দাউদ পড়েছেন হজরত মাওলানা আবদুল আহাদ সাহেব রহ.-এর নিকট। সুনানুন নাসায়ি পড়েছেন হজরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ বাহারি রহ.-এর নিকট। সুনানু ইবনি মাজাহ পড়েছেন হজরত মাওলানা নাঈম আহমাদ দেওবন্দি রহ.-এর নিকট। মুখতাসারুত তহাবি পড়েছেন হজরত মাওলানা মিয়া আসগর হুসাইন সাহেব দেওবন্দির নিকট। মুআত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পড়েছেন মাওলানা আনজার শাহ কাশ্মীরি রহ.-এর নিকট। তিনি ছিলেন এ যুগের ইলমের পাহাড়। যার সামনে তিনি ছাত্র হয়ে বসার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
মিশকাতুল মাসাবিহ-এর প্রথম খণ্ড পড়েছেন হজরত মাওলানা নাসির খান সাহেবের নিকট। আর মিশকাতুল মাসাবিহ-এর দ্বিতীয় খণ্ড পড়েছেন হজরত মাওলানা সালেম কাসেমী দেওবন্দি সাহেবের নিকট।
ওই সময়ে শায়খুল হাদিস হজরত মাওলানা জাকারিয়া রহ. শায়খুল হাদিস মাদরাসা মাজাহেরুল উলুম সাহারানপুর এর নিকট দুইবার যথাক্রমে ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে হাদিসে মুসালসাল পড়েছেন। আর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা পড়েছেন দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম আল্লামা কারি তৈয়্যব সাহেব রহ.-এর নিকট ।
আরবি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন
তিনি ১৯৭১ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের আরবি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এ বিষয়ে তিনি দীর্ঘ তিন বছর দারুল উলুম দেওবন্দের আরবি ভাষা ও সাহিত্যের উস্তাদ বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক হজরত মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবি রহ. এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। যেখানে তিনি আরবি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন সেখানে এটাও শিখেছেন—কীভাবে সহজ-সরলভাবে ছাত্রদের জন্য গ্রন্থ রচনা করা যায় এবং কঠিন ও জটিল বিষয়কে সহজ ও বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করা যায়। এই পদ্ধতি হজরতের জীবনে এমন শৈল্পিক রূপ ধারণ করেছে যে, আজ পর্যন্ত ছয়টি বড় বড় শাস্ত্রের ওপর কাজ করেছেন এবং সবগুলোকেই অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে ছাত্রদেরকে হৃদয়ঙ্গম করিয়েছেন। যার ফলে ছাত্ররা আজও হজরতকে স্মরণ করে থাকে। হজরত মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবি রহ.-এর তত্ত্বাবধানে এটাও শিখেছেন যে, কীভাবে ছাত্রদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা যায় এবং কতটা সহজ-সরলভাবে জীবনযাপন করা যায়। যেন ছাত্ররা তাকে নিজের অভিভাবক ও কল্যাণকামী মনে করে। হজরত মাওলানা সামীরুদ্দীন সাহেব হজরত মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবি রহ.-এর অত্যধিক ভক্ত ও অনুরক্ত। অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে স্মরণ করেন।
শাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জন
১৯৭২ সালে শাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য ভর্তি হন এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র ও অন্যান্য শাস্ত্রের ওপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের পাঁচ বছরের জীবন হজরত মাওলানার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ সময়ে তিনি সর্বদা একাকী নীরবে বসে জ্ঞান অর্জনে ব্রত থাকতেন। হজরত মাওলানা আবদুল আজিজ সাহেব একবার দারুল উলুম দেওবন্দের উস্তাদ হজরত মাওলানা আবদুল খালেক মাদরাজি সাহেবের সামনে মাওলানা সামীরুদ্দীনের আলোচনা করলে তিনি বলেন, মাওলানা সামীরুদ্দীন সেই ব্যক্তি না, যে কবরস্থানে বসে নীরবে অধ্যয়ন করতেন? আমি বললাম, হ্যাঁ! সে-ই। তারপর মাওলানা আবদুল খালেক মাদরাজি সাহেব মাওলানার পরিশ্রমের বেশ কয়েকটি ঘটনা শুনালেন। যার দ্বারা অধমের ধারণা হয়েছে যে, মাওলানা শিক্ষা জীবনের শুরুতেই অধ্যয়নের প্রতি কতটা পরিশ্রমী ছিলেন। যার ফল হলো, বর্তমানে তিনি ছয়টি শাস্ত্রের ওপর প্রায় ৪০টি বিশাল বিশাল গ্রন্থের লেখক।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ
শিক্ষকতাকালীনই তিনি হাইস্কুলে Gose পরীক্ষা দেন এবং উচ্চ নাম্বার পেয়ে পাশ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলেজে পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আর তা হয়ে উঠেনি। তিনি ভূগোল সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞ। যার কারণে তিনি “সামারাতুল ফালাকিয়াত বা জ্যোতির্বিদ্যার মর্মকথা”র মতো বিশাল গ্রন্থ রচনা করেন এবং “সামীরি ক্যালেন্ডার”-এর ন্যায় নির্ভুল ও ব্যতিক্রমী ক্যালেন্ডার তৈরি করে গোটা পৃথিবীকে অবাক করে দেন। হজরতের গণিতের ওপরও অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। যার ফলে তিনি আধুনিক পদ্ধতিতে উত্তরাধিকার বণ্টন সম্পর্কে “সামারাতুল মিরাস বা উত্তরাধিকারের মর্মকথা”র মতো ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলো তার ভূগোল ও গণিতের ওপর পাণ্ডিত্যেরই কারিশমা।
শিক্ষকতা
শাওয়াল ১৩৯৩ হিজরি মোতাবেক জানুয়ারি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। তখন তিনি গুজরাটের মারগুব পাঠানের মাদরাসায়ে কানযে পাঁচ বছর ছিলেন। সেখানে তিনি শরহে জামি পর্যন্ত বিভিন্ন কিতাবের পাঠ দান করেন। তারপর তিনি গুজরাটের আনন্দের মাদরাসায়ে তালিমুল ইসলামে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং সেখানে তিনি পাঁচ বছর পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিসের কিতাবসমূহের দরস প্রদান করেন। তারপর তিনি খানকায়ে রাহমানি মুঙ্গির বাহারে চলে যান। সেখানেও তিনি দাওরায়ে হাদিসের কিতাবসমূহের দরস প্রদান করেন এবং এখান থেকে ২১ জুন ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসায়ে তালিমুল ইসলাম ঢাজবেরি ইংল্যান্ড তাশরিফ নেন। যা গোটা ইউরোপে তাবলিগের অনেক বড় কেন্দ্র।
হজরত মাওলানা সামীরুদ্দীন কাসেমী এর বাংলায় অনূদিত বই।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....