চাকরি ছেড়ে ব্যবসা - লেখক : মুবির চৌধুরী | Chakri Chere Bebsha By Mubir Chowdhury

চাকরি ছেড়ে ব্যবসা (pdf free download no available)
লেখক : মুবির চৌধুরী
প্রকাশনী : স্বরে অ
বিষয় : উদ্যোক্তা, ব্যবসা, জেনারেল বুকস
পৃষ্ঠা : 256, কভার : হার্ড কভার
আইএসবিএন : 9789848047415, ভাষা : বাংলা

সাপ্লায়ার জানিয়েছেন এই পণ্যটি 21 February প্রকাশিত হতে পারে। প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পণ্যটি পেতে আগেই অর্ডার করে রাখুন ।
Image

চাকরি ছেড়ে ব্যবসা বই রিভিউ ........
শব্দ হিসেবে উদ্যোক্তা, ব্যবসা, এন্ট্রাপ্রেনার, উদ্যোক্তাগিরি বা এন্ট্রাপ্রেনারশিপ এগুলো খুব ট্রেন্ডি বা চালু। ডিজিটাল যুগ যে এখন ডিজিটাল ডিজরাপশন হয়ে উঠছে তারও অন্যতম কারণ এই শব্দগুলো। টেক্সট, ভিডিও, পডকাস্ট, ইন্টারভিউ, টক শো, ইনফোগ্রাফিকস, মোটিভেশনাল গুরুদের সেমিনার, সোশ্যাল মিডিয়া, মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সর্বত্র বেশ প্রচলন এসব শব্দের। চাহিদাও আছে বেশ। এক অদ্ভুত মোহময়তা, এ যেন আলাদিনের এক জাদুর প্রদীপ। শুধু ঘষা দেওয়ার বাকি। একবার দৈত্য আসলেই হলো। এরপর কেবল সুখ আর সুখ। উদ্যোক্তা হয়ে ব্যবসা করে জীবনের বাকিটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে আরামেই।

সাদা চোখে দুনিয়ার বেশিরভাগ শীর্ষ ব্যবসায়ীদের দেখে, তাঁদের লাইফস্টাইল, তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে যে কারও ইচ্ছে হতেই পারে ব্যবসা করার। তবে বাইরে থেকে দেখা আর সত্যিই ব্যবসা করে বড় হওয়া এই দুইয়ের মাঝে যে দুস্তর ব্যবধান সেটা কোনো মিডিয়াতে সচারাচর দেখা যায় না।

যারা এই বিষয়ক এক্টিভিজম করেন তাঁদেরও বড় একটা অংশ কেবল এক্টিভিজমই করেন, নিজে ব্যাবসা করে এসে সবাইকে মোটিভেশন দিচ্ছেন এমন মানুষের চেয়ে আদতে অ-ব্যবসায়ী এক্টিভিস্টের সংখ্যা ঢের বেশি। অন্তত এদেশে।
এই প্রক্রিয়ার বেশ কিছু সমস্যা আছে।

প্রথমত : নিজে ব্যবসা না করার ফলে গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে ইনাদের জ্ঞান থাকে ভাসাভাসা।

দ্বিতীয়ত : ইনারা কেবল সফলতা ফোকাস করেন। সফলতার পেছনে যেই পরিশ্রম এবং ঝুঁকি সেটাতে নজর কম। ফলে শ্রোতা/দর্শক/পাঠক বিভ্রান্ত হন।

তৃতীয়ত : এরা অনেকক্ষেত্রে ধার করে কথা বলেন। মানে অন্য কোনো বিদেশি এক্সপার্ট এর কথা শুনে বলেন। কিন্তু ভিনদেশি কোনো এক্সপার্টের ফর্মুলা আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতি, রুচি, পরিস্থিতি, ক্রয়ভ্যাসের দেশে কতটা কার্যকর হবে সেই সম্পর্কে নিরীক্ষা করে কথা বলার চর্চা বিরল। ফলে আশঙ্কা প্রবল যে পরামর্শটা বুমেরাং হবে।

চর্তুথত : আমাদের দেশে কিছু সফলতার উদাহরণ দেখিয়েই পার পাওয়া যায়। তেমন কোনো ফলোআপ না থাকায় বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে অসংখ্য নতুন নতুন তরুণদের সামনে প্রতিনিয়ত কথা বলে নিজের চমৎকারিত্ব জাহিরের অবারিত সুযোগে ব্যর্থতার কেস স্টাডি নিয়ে কে বা মাথা ঘামায়। ফলে ভুল থেকে বাকিদের শিক্ষা নেওয়া হয়ে উঠে না।
খুঁজলে এই প্রচলিত ট্রেন্ডের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতিবাচক পয়েন্ট পাঠকও পাবেন নিশ্চয়ই।

এবার এই বই নিয়ে বলি। লেখক মুবির চৌধুরী নিজে দেশ সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠা নটরডেম কলেজ ও আইবিএ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দেশের শীর্ষ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনে। এরপরও নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটতে শ্রমে ঘামে গড়া কর্পোরেট ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেননি।
উনার সাথে কথা বলে এবং অল্পবিস্তর কাজের অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে উনি খুব মেথডিকাল। আশা করি পাঠকরা সেটা বই পড়তে গেলে বুঝবেন। ব্যাবসার আগে তিনি তা নিয়ে যথেষ্ট পড়াশুনা করেছেন। উনার কাজের অভিজ্ঞতাও এতে একটা ভূমিকা রেখেছে। ভিনদেশি এক্সপার্টদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এদেশীয় সংস্কৃতিতে কিভাবে প্রয়োগ করা যাবে সেই সাধারণজ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তাও তার আছে যথেষ্ট। এর কিছুই তাঁকে ব্যবসার শুরুরদিকে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা অর্জন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। অবশ্য তিনি সেটা নিজ দক্ষতার কাটিয়েও উঠেছেন এবং তারপর সফলতার সাথে নিজের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

চাকরি ছেড়ে ব্যবসা’ বইতে তিনি যে তথ্য ও জ্ঞান আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন সেটা একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীকে অন্তত শুরুর দিকে দুই বছর এগিয়ে রাখবে তাতে আমি নিঃসন্দেহ। প্রচলিত ট্রেন্ডের বাইরে এসে নিজে ব্যবসা করে, সফল হয়ে সেই অভিজ্ঞতা, মেধা দিয়ে সবাইকে সহযোগিতা করার চেষ্টা খুব সহজলভ্য নয়।

আমি নিশ্চিত এই বিষয়ে বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় এই মানের একটি বই আগ্রহী পাঠকের প্রয়োজন পূরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে যাচ্ছে।


মনে রাখবেন, প্রতিটি গোলাপেরই কাঁটা আছে...

আমরা সবাই বিল গেটস, স্টিভ জবস, ইলন মাস্ক, মার্ক জাকারবার্গ এর মতো দুনিয়া কাঁপানো উদ্যোক্তাদের নাম কমবেশি শুনেছি। বলা বাহুল্য, তাঁদের এই ব্যবসায়িক সফলতা আমাদেরকে বিস্মিত এবং উদ্বুদ্ধ করে। হয়তো একবার হলেও চিন্তা আসে, ‘ইস যদি ওদের মতো হতে পারতাম!'

তবে, একটা বিষয় ভুলে যাই যে আমরা কেবল তাঁদের বর্তমান সফল অধ্যায় এবং চাকচিক্যময় জীবনটাই দেখছি। যখন তাঁরা সফল হয়ে ওঠেন নি, তাঁদের কেউ চিনতো না এবং যখন তাঁরা চরম কষ্ট করেছেন সেই সময়ে আমরা তাঁদের দেখিনি। বর্তমানে এসে তাঁদের সেই কষ্টের কথা শুনলেও তার পরিধি ও গভীরতা আমরা হয়তো বেশিরভাগই অনুধাবন করতে পারবো না। প্রত্যেক সফল উদ্যোক্তার ‘সফল’ হয়ে ওঠার পিছনে থাকে অনেক কষ্টের ইতিহাস; থাকে অনেক বছরের সাধনা ও অধ্যবসায়। যেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারলে একজন উদ্যোক্তা অন্যের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং অন্যেরা তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়; সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে কিন্তু তাঁকে অনেক ব্যক্তিগত পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।

তবে একজন উদ্যোক্তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া এক কথা আর সেই উদ্যোক্তার দেখানো পথে হাঁটার চেষ্টা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। আজকে যারা তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন, তাদেরকে যদি সত্যি সত্যিই উদ্যোক্তার সেই কষ্টের ভিতর দিয়ে যেতে হয়; তবে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে কয়জন সেই কষ্টকে জয় করে সফলতার দরজা পর্যন্ত পৌঁছানোর মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা রাখেন।

আমার উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম পাঁচ বছরে অন্তত পাঁচবার ‘সফল ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন শিকেয় তুলে আবার চাকরিতে ফিরে গিয়ে জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বেশ গুরুত্বের সাথে চিন্তা করেছি। একটি ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় আর্থিক অনটন এবং অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনকে বরণ করে নেয়া এবং সেই কষ্টের ভিতর দিয়ে নিজেকে সফলভাবে নিয়ে যাবার জন্য দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন। পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি এই ধরনের সংকটময় পরিস্থিতি সামলে চলে এখনো আমার স্বপ্নকে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি সহ গ্রামীণফোনের ১৬৭ জন কর্মকর্তা একটি স্বেচ্ছা অবসর স্কিমের সুযোগ নিয়ে চাকরি ছাড়ি। যতদূর জানি এই ১৬৭ জনের মাঝে প্রায় ৬০ জন প্রথমেই চাকরিতে না ঢুকে প্রাথমিকভাবে ‘নিজে কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। চার বছর পর (২০১৭ সালে) আমি এই ৬০ জনের কে কোথায় আছেন তার একটু খবর নিতে বসি। অবাক হয়ে দেখি যে আমি সহ মাত্র ৩-৪ জন এখনো ‘নিজে কিছু করা’র চেষ্টায় টিকে আছি। বাকিরা কেউ আবার চাকরিতে ঢুকে গিয়েছেন, কেউবা উন্নততর জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন।

এই হিসাবটা দেয়ার মূল উদ্দেশ্য কাউকে হেয় করা নয়, বরং এই তথ্য দিয়ে আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পথে যে আর্থিক অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপ, তা বহন করার সক্ষমতা সবার সমানভাবে থাকে না। কেউ হয়তো স্বভাবগতভাবে ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন, আবার কারও হয়তো এই ধরনের ঝুঁকি নেয়ার সামর্থ্যেরই যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অনেক সময় উদ্যোক্তা জীবনের এই চাপ এত বেশি হয়ে যায় যে একজন ব্যক্তির পক্ষে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকাটাও একটা কঠিন ব্যাপারে পরিণত হয়। এই চাপ কাটিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বছরের পর বছর ধরে সত্যিকারের মানসিক দৃঢ়তা ও কঠিন সংকল্পের পরিচয় দিতে হয়, যা কিনা শখের বশে ব্যবসা করতে আসা কোনো ব্যক্তির পক্ষে দেখানো খুবই কঠিন।

একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি যা করতে চাচ্ছেন তা কি আদৌ করতে পারবেন কিনা মাঝে মধ্যে তা নিয়েই আপনার নিজের ভিতরে সংশয় দেখা দিবে। কখনো হতে পারে ব্যবসায় লাভ তো দূরের করা, বিনিয়োগ করা পুঁজি তুলে নিয়ে আসতেই কষ্ট হবে। মাঝে মধ্যে ব্যবসায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, অথবা যা আপনি করতে চাচ্ছেন তার উল্টো ফল পাবেন। স্বাভাবিকভাবেই তখন আপনার হতাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সফল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তাঁদের কষ্টের দিনের অভিজ্ঞতা শুনতে যতই রোমান্টিক ও আকর্ষণীয় হোক, নিজে সেই কষ্ট সহ্য করে সামনে এগিয়ে যাওয়া অনেক বেশি কঠিন।

স্মরণীয় বাণী হিসেবে আগে পড়েছি যে, শিক্ষার ফল মিষ্টি হলেও তার শেকড় খুব তিতা। তার মানে এই দাঁড়ায় যে শিক্ষা গ্রহণ করার সময়টা সুখকর না, তবে আপনি যথাযথভাবে শিক্ষিত হয়ে গেলে এর প্রভাব ও ফলাফল বড়। এ কথা একজন ব্যবসায়ীর বেলায়ও যে বেশ ভালোভাবে প্রযোজ্য তা আমি খুব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। ব্যবসার প্রাথমিক পর্যায়ে একজন নতুন উদ্যোক্তাকে অনেক আর্থিক অনটন, বঞ্চনা, সামাজিক কটাক্ষ সহ অনেক ধরনের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়। এটা এমন ধরনের অধ্যায় যা আসলে কোনো বই পড়লে বা কোনো ভাষণ শুনলে বোঝা যায় না; যতক্ষণ না তার ভিতর দিয়ে আসলেই নিজেকে যেতে হয়।

কেউ আপনাকে দৃশ্যত সহায়সম্বলহীন হওয়ার অসহায় অনুভূতি বোঝাতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি সেই অবস্থায় পড়ছেন। সেই অনুভূতি এমন যে আপনি ভিতরে ভিতরে আতঙ্কিত হবেন; কিন্তু তা কাউকে বলতে পারবেন না। এই দুঃখের কথা অন্যের কাছে ভাগাভাগি করতে গেলে আপনাকে তখন শুনতে হবে, “কেন রে বাবা শখ করে ব্যবসা করতে নেমেছিলে? আগেই জানতাম এসব তোমাকে দিয়ে হবে না। এই অনুভূতিতে একবার পড়লে মাত্র ৩০-৪০ টাকার রিকশা ভাড়া বাঁচাতে আপনি এপ্রিল মে মাসের গরম মাথায় নিয়েও হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াবেন। কর্মীদের বেতনের তারিখ পার হয়ে গেলেও প্রয়োজনীয় ন্যূনতম টাকা জোগাড় করতে না পারার সেই অসহায়ত্ব আপনি কাউকে বোঝাতে পারবেন না। এই অনুভূতিগুলো এমন যা আপনার উপর চেপে বসলে রাতে ঘুমাতে পারবেন না।

তাই আমি বলতে চাই যে, যখন আপনি একজন উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখবেন, সেই স্বপ্নের মধ্যে যেমন থাকতে হবে আপনি সফল হলে কেমন করে জীবনটাকে উপভোগ করবেন সেই সুখময় চিন্তা; পাশাপাশি সেই মধুর ভবিষ্যতে যেতে হলে আপনাকে কী কী তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েও যেতে হতে পারে; তাও নিজেকে স্মরণ করাবেন বারবার। শুধু সুখস্বপ্ন আর কাল্পনিক সফলতার রঙিন চশমা পড়ে থাকলে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনার চলার পথটা যে অনেক বেশি কষ্টকর হয়ে যাবে, তা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। আপনার কল্পনার সাথে বাস্তবতার হালকা ব্যাঘাত ঘটলেই তখন আপনি হতাশ হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে ব্যবসা করার ইচ্ছাকে বিদায় বলে দিবেন এমন আশঙ্কা খুবই বেশি।

সবাই সফল হতে চায়, যতক্ষণ না তাঁরা দেখে এর জন্য কী মূল্য দিতে হয়।
সূত্ৰ - অজ্ঞাত,

অনেক সংস্কৃতিই ব্যবসাকে উৎসাহিত করে না...

অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশসমূহে সাধারণত ব্যবসা করার পরিবেশও ভালো থাকে। ব্যবসাবান্ধব আইন, নীতিমালা ও বিভিন্ন সুবিধার পাশাপাশি সেই পরিবেশে পাওয়া যায় উন্নত মন-মানসিকতার বিনিয়োগকারী, যারা আপনার ব্যবসায় তুলনামূলক সহজ শর্তে টাকা বিনিয়োগ করতে উৎসাহী থাকবেন। পেশাদারিত্ব ও ব্যবসায়িক জ্ঞানে এগিয়ে থাকা সেখানকার বিনিয়োগকারীরা অধিকতর ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত থাকায় বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। অন্যদিকে আপনি ব্যবসা করতে গিয়ে যদি সবকিছু হারিয়ে পথে বসেন, তবে আপনার দুঃসময়ে বেকার ভাতা নিয়েও প্রস্তুত আছে সেই দেশের সরকার। 

সেখানে আছে সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা; সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেখানে বৃদ্ধ হয়ে গেলে রাষ্ট্র আপনার ভালোমন্দের খেয়াল রাখবে। তাই উন্নত বিশ্বে নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করা এবং জীবন নিয়ে পরীক্ষা করাটা অনেক সহজ ও তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ। মোটের উপর মেধার প্রাচুর্যের পাশাপাশি এইসব কারণেও উন্নত বিশ্বে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির হার অনেক বেশি।

এখন আসুন আমাদের দৃষ্টি নিয়ে আসি তুলনামূলক অনুন্নত অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলোর দিকে। বাংলাদেশের কথাই চিন্তা করি, এখানে সবাই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। উন্নত বিশ্বের যেই সুবিধাগুলোর কথা উপরে বললাম তার প্রায় কিছুই এখানে নেই। থাকলেও তা এতই অপ্রতুল যে প্রায় না থাকারই শামিল। কেউ যদি ব্যবসা করতে গিয়ে সব হারিয়ে পথে বসেন, তাকে সাহায্য করার মানুষের বড়ই অভাব। হাতে থাকা সামান্য সম্পদ নিয়ে মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে সরকার এতই ব্যতিব্যস্ত যে কোথায় কে ব্যবসা করতে গিয়ে ফেঁসে গিয়ে কষ্টে আছেন, তা আলাদা করে দেখার সময় তাদের নেই। 

ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেয়ে মাটিতে বসে পড়লে (আর তার সাথে নিজে হাল ছেড়ে দিয়ে অন্যের উপর ভরসা করে বসে থাকলে) সমাজের একটা বোঝায় পরিণত হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। সমাজে তখন সম্মান ও সচ্ছলতার সাথে বেঁচে থাকাই কঠিন। ব্যবসা করে নিজের উন্নতি ঘটাতে পারলে তা যেকোনো চাকরির চেয়ে ভালো হয়, এই কথাটা হয়তো আমরা সবাই বিশ্বাস করি। তবে ব্যবসা করার মূল শর্ত হচ্ছে, ঝুঁকি নিতে হয়, প্রতিটি পর্যায়ে কষ্ট করতে হয়। এরপর ব্যবসা আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকলে আপনার জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু করে এবং ফলশ্রুতিতে সময়ের সাথে নিজের জীবনটাকে আরেকটু ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। তবে উন্নয়নশীল দেশে একজন গড়পড়তা মানুষকে মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্যই এত বেশি সংগ্রাম করতে হয়, যে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করা অনেকের জন্যই বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। তাই পরিবারের কেউ যখন চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার চিন্তা করে বা সিদ্ধান্ত নিতে যায়, তা দেখে আশেপাশের অনেকেই বিচলিত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সবাই মিলে তাকে যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করার চেষ্টাও করে। 

হয়তো কেউ কেউ মনে করেন, “ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেলে তো ওকে চালানোর দায়িত্ব আমার উপরে এসে পড়বে!” কেউ হয়তো সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েও এই কষ্টের পথে পা না বাড়ানোর উপদেশ দেন। তো যাই হোক, আপনি বাংলাদেশ থাকেন আর দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশে থাকেন, চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ার আগে অবশ্যই আপনার পরিবারের সাথে কথা বলে নিন। বিশেষ করে তাদের মতামত নিন যারা আপনার উপার্জনের উপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল (অথবা যাদের উপার্জনের উপর আপনার জীবনমান এখনো নির্ভরশীল); যেমন আপনার নিকটতম পরিবারের সদস্য। আপনার উপর নির্ভরশীল হোক বা না হোক, সম্ভব হলে আপনার বাবা-মায়ের পরামর্শ নিন এবং তাদের আশীর্বাদ নিয়ে ব্যবসা শুরু করুন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কেননা, ব্যবসা শুরু করার পর যে কঠিন সময় আসবে, তা বেশ শক্তভাবেই আপনার সাথে আপনার পরিবারের সদস্যদেরকেও নাড়া দিয়ে যাবে এবং তাদের জীবনমানেও এর প্রভাব পড়বে।

আপনার পরিবার ও কাছের মানুষদেরকে সামনের কঠিন দিন সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দিতে হবে। আপনার পক্ষ থেকে তাদেরকে এটা বোঝাতে হবে, আজকে জীবন খুব স্বাভাবিক মনে হলেও আগামীকাল তা আগের মতো নাও থাকতে পারে। যেমন ধরুন, আপনি পরিবার নিয়ে মাসে বা দুই সপ্তাহে একবার রেস্টুরেন্টে খাওয়ার রীতি চালু করেছেন। সেক্ষেত্রে আপনার স্ত্রী-সন্তানকে বোঝাতে হবে যে রেস্টুরেন্টে খাওয়া আর আগের মতো হবে না; আর হলেও সম্ভবত আরেকটু ছোট রেস্টুরেন্টে কম জাঁকজমকপূর্ণ খাবার হবে। হয়তো আপনার সন্তানকে যেই স্কুলে ভর্তি করার ইচ্ছা ছিল, খুব তাড়াতাড়ি সেই আশা আর পূর্ণ হবে না। এই পর্যায়ে আপনার পরিবারের সমর্থন আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

আপনার পরিবারের সদস্যরা এই ব্যাপারে যদি আপনাকে সহায়তা না করে এবং আপনার পাশে না থাকে, সেটা আপনার জন্য অত্যাধিক চ্যালেঞ্জিং হবে। একে তো ব্যবসার চাপ, তা সামলে ঘরে ফিরেই আপনি পড়বেন আরেক চাপে। প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে আপনাকে বার বার বলা হবে আপনি যেন আবার চাকরিতে ফিরে যান। উদ্যোক্তা হিসাবে আপনি হয়ে পড়বেন বড়ই একা, আপনার দুঃখ বোঝার মতো আর কেউ পাশে থাকবে না। তবে, আপনার কপাল যদি খুব ভালো হয় এবং আপনি আপনার পরিবারের কাছের মানুষদের মানসিক সহায়তা পেয়েও যান; তারপরেও আপনার অন্যান্য পরিচিত মানুষেরা আপনাকে কিন্তু ঠিকই পাগল বলবে। অনেকে আপনার আড়ালে ঠিকই বলবে... “মাস শেষে এমন সুন্দর বেতনের চাকরিটা ছেড়ে শেষ পর্যন্ত কিনা...!!!”

উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে একজন উদ্যোক্তার জীবন বেছে নিতে হলে আপনাকে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে, অন্তত কিছু  সময়ের জন্য হলেও। আপনার সিদ্ধান্তকে অনেকেই বাঁকা চোখে দেখবে। আপনাকে ধরেই নিতে হবে যে আপনি যে কত বড় বোকা বা পাগল তা নিয়ে আপনার সামনে বা পিছনে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। কপালগুণে আপনি যদি একজন অবিবাহিত পুরুষ হয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চিত ধরে নিন যে আপনার কপালে খারাপি আরেকটু বেশি আছে; কেননা আপনার হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষজন একজন চালচুলোহীন উদ্যোক্তার (আপনি নিজেকে যতই ভালো ভবিষ্যতের অধিকারী মনে করেন না কেন) চেয়ে ভালো জায়গায় চাকরি করছে সেই ধরনের পাত্রকেই দাম দিবেন বেশি!

উদ্যোক্তাদেরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভুল বোঝার সম্মুখীন হতে ইচ্ছুক হতে হবে

জেফ বেজোস
মার্কিন উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, এবং বাণিজ্যিক মহাকাশচারী। আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা
এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান।

নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন......

ধৈর্যশীলতা এবং চিন্তাভাবনায় পরিপক্কতা একটি বিশেষ গুণ যা সব মানুষের সমানভাবে থাকে না। এই দুই গুণের অভাবে মানুষ অনেক সময় হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তিতে সমস্যায় পড়ে। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনি নিজের উন্নতি চাইবেন এবং এই উন্নতি আপনি যত দ্রুত সম্ভব অর্জন করতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে তা করার আগে পারিপার্শ্বিক এবং নিজের ব্যক্তিগত অবস্থা বুঝে নেয়াটা খুবই জরুরি।

চারপাশে এত সফল উদ্যোক্তার কথা শুনে আর ইদানীংকার উদ্যোক্তাগিরির ফেরিওয়ালাদের ফাঁকা বুলিতে উৎসাহিত হয়ে (যাদের অনেকেই কিন্তু নিজেরা উদ্যোক্তা নন এবং উদ্যোক্তা হওয়ার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাও তাঁদের নেই) চাকরি ছেড়ে বা পড়ালেখা শেষ করেই উদ্যোক্তা হয়ে যাবার চিন্তা অনেকে করে থাকেন। তাদের যথাযথ সম্মানের সাথে জানাতে চাই, অন্যান্য কাজের মতো উদ্যোক্তা হতেও পরিকল্পনা করতে হয়; বরং একটু বেশি করেই করতে হয়। এই পরিকল্পনা পর্যায়ে আপনার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে হবে, কেন আপনি নিজের ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন? আপনি কি সত্যি সত্যি মনে করেন আপনার সাফল্য ব্যবসার ভিতরে লুকিয়ে আছে? নাকি আপনি স্রোতে গা ভাসাতে চাচ্ছেন? 'কুল' হতে চাচ্ছেন? সবাই এখন উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলে, তাই উদ্যোক্তা না হলে তো এখন জাতে ওঠা হবে না, এই চিন্তা আপনার মনের গহীনে ঘুরছে না তো? সবাই বলে উদ্যোক্তা হলেই সব সমস্যার সমাধান, উদ্যোক্তা হলেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, এমন মানসিকতায় আপনার মন আচ্ছাদিত নয় তো?

মনে রাখবেন, চাকরিতে ঢুকেই চট করে যেমন বড়কর্তা হওয়া যায় না, তেমনি ব্যবসা শুরু করেই তাৎক্ষণিক সফলতা আসে না। চাকরিতে পদোন্নতি পেতে যেমন অনেক ধৈর্য ধরে পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হয়; ব্যবসাতেও একইভাবে কাজ করতে হয়। উপরন্তু ব্যবসায় ঝুঁকির পরিমাণ অনেক বেশি। তাই ‘উদ্যোক্তা হবো’ বা ‘ব্যবসা করবো? এই চিন্তা করার আগে নিজের কাছে নিজে আগে পরিষ্কার হয়ে নিন কেন আপনি ব্যবসা করতে চান। আপনি কি ব্যবসা করতে চান চাকরি করতে ভালো লাগে না শুধু এই কারণে? নাকি আপনি বিশ্বাস করেন যে চাকরিতে আপনি আপনার প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ করতে পারছেন না?

যদি শুধু চাকরি করতে ভালো লাগে না ধরনের উত্তর হয়, তাহলে আমার পরামর্শ, ব্যবসা করতে নামার আগে আরও দুই একটি চাকরি বদল করে দেখুন। এমনও হতে পারে, আপনার সমস্যা আসলে সাধারণ অর্থে চাকরি করতে নয়, আসলে সমস্যা হচ্ছিলো আপনার বর্তমান কাজের ধরন, পরিবেশ, বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে মানিয়ে নিতে। সেক্ষেত্রে আপনার সমস্যার আপাত সমাধান ব্যবসা করার চেয়ে অনেক সহজ। ব্যবসা তখনই করতে নামবেন যখন আপনি নিশ্চিত যে আপনি কোনো ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ ছাড়া সত্যিই কেবল ব্যবসা করতে চান।

শখের বশে এবং অন্যের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবসা শুরু করলে সেই ব্যবসার বাধা বিপত্তি কাটিয়ে ওঠা অনেকের পক্ষেই খুব দুঃসাধ্য হবে, তা আমি এখনই বলে দিতে পারি।

সবসময় প্রশ্ন করুন আপনি কি চান, আপনার মূল্য নিয়ে কখনোই প্রশ্ন করবেন না।
ব্রেন্ডন বুর্চার্ড
নিউইয়র্ক টাইমস সর্বাধিক বিক্রিত লেখক, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হাই পারফরম্যান্স কোচ


জোরদার পরিকল্পনা করুন.....

একটা কথা মনে রাখবেন, উদ্যোক্তা হওয়া খুব সহজ; যেটা খুব কঠিন সেটা হলো একজন ‘সফল’ উদ্যোক্তা হওয়া। আপনি চাইলেই চাকরি ছেড়ে নিজে একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে তার সিইও (চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) বনে যেতে পারেন। আশা করি ভালোই বুঝতে পারছেন যে একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সিইও হয়ে আপনি বেশিদূর যেতে পারবেন না। তাই চাকরিতে একটু খারাপ সময় এলেই যাদের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, বিশেষভাবে তাদেরকে বলছি, ব্যবসা করবো এই চিন্তা করে হুট করে চাকরি ছেড়ে দিবেন না। বরং কিসের ব্যবসা করবেন, বাজারে সেটার চাহিদা কেমন, আপনি সেই ব্যবসার কতটুকু বোঝেন, এই ধরনের অনেক ব্যাপার আগে থেকে বিবেচনা করে নিবেন।

সম্ভব হলে চাকরিতে থাকা অবস্থায় খুব ছোট পরিসরে ব্যবসাটা করে দেখতে হবে যে আসলেই এই ব্যবসা চলবে কি না, অথবা আপনি চালাতে পারবেন কি না। আপনাকে এটা করতে হবে অফিস আওয়ার শেষে বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। এই কাজটা ঠিকমতো করতে পারলে আপনি বুঝবেন আসলেই এখানে ব্যবসা আছে কি না। একই সাথে সেই ব্যবসা চালানোর ক্ষমতা আপনার আছে কিনা সেটা ঠিকঠাক বুঝে ব্যবসায় নামলে চাকরিরত অবস্থাতেই কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছরের কাজ এগিয়ে ফেলবেন। হুট করে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নেমে গেলে এই কাজটাই আপনাকে বিনা বেতনে উলটো নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে করতে হবে।

অনেক ব্যবসা আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ সরল প্রকৃতির মনে হয়। মনে হয় এই ব্যবসায় হাত দিলেই শুধু লাভ আর লাভ। একটি পণ্য বা সেবা তৈরির কাঁচামালের খরচ আর তার বাজার খুচরা মূল্যের পার্থক্য কত, এইটুকু হিসাব করেই অল্প সময়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লাভের আশায় অনেকেই মহা উৎসাহে কোনো ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা চিন্তা করে ফেলেন। তবে একটা ব্যবসা চালাতে যে আনুষঙ্গিক খরচ আছে এবং উৎপাদিত পণ্য বা সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেও যে খরচ আছে, তা শুরুতে অনেকেরই মাথায় আসে না। বেশিরভাগ সময় যে জায়গাটাতে একজন হবু উদ্যোক্তা ভুল করেন তা হলো একটা ব্যবসা চালু করে তাকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে আসলে কত টাকা এবং সময় লাগতে পারে তা না বুঝে ‘ব্যবসা করতে নেমে যাওয়া।

একটা ব্যবসাকে টেকসই এবং লাভজনক করতে হলে ব্যবসাটাকে একটি যন্ত্রের মতো করে তৈরি করতে হবে। এর আসল উদ্দেশ্য হবে এমন একটি প্রক্রিয়াভিত্তিক (প্রসেস বেইজড) প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যা ব্যক্তি নির্ভর হবে না, বরং প্রক্রিয়া ব্যক্তিকে পরিচালিত করবে। প্রতিষ্ঠানকে এই পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলে উদ্যোক্তাকে আর ব্যক্তিগতভাবে সবকিছু খুঁটিনাটি নজরদারির মধ্যে রাখতে হয় না। প্রতিষ্ঠানটি এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজে ও দক্ষতার সাথে সবচেয়ে বেশি লাভ অর্জন করতে সমর্থ হয়, যা থেকে একটি টেকসই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরির বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

যথাযথ পরিকল্পনা করতে ব্যর্থ হলে আপনার ব্যবসাকে টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এবং খরচ দুটোই অনেক বেড়ে যাবে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনেক বড় হয়ে গেলেও আদতে তা রয়ে যাবে ব্যক্তিনির্ভর এবং কখনোই টেকসই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে না। বাংলাদেশে এমন ভূরি ভূরি প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দেওয়া যাবে যেখানে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেও প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে অতিমাত্রায় ব্যক্তিনির্ভর। বিশেষ এক বা একাধিক ব্যক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক সমীকরণ থেকে সরিয়ে ফেললেই সেই আপাত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়তে কয়েক বছরও লাগবে না।

যাহোক, যথাযথ পরিকল্পনা করে চাকরিতে থাকা অবস্থাতেই ব্যবসার টেস্ট রান করতে হবে এ কথা আগেই বলেছি। তবে এই টেস্ট রান করতে গিয়ে আবার যদি মনের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেন যে ব্যবসার আয় আপনার চাকরির আয়ের কাছাকাছি না হওয়া পর্যন্ত আপনি চাকরি করে যাবেন, তাহলে জীবনেও আপনার ব্যবসা দাঁড়াবে না।

কারণটা একটু বুঝিয়ে বলি। একটা স্মার্ট প্রতিষ্ঠান তখনই একটা পদে কর্মী নিয়োগের চিন্তা করে যখন সে সত্যিই বোঝে যে এই কাজ করার জন্য একজন পূর্ণকালীন কর্মীর প্রয়োজন। একজন মানুষকে সেই পদে তখনই নিয়োগ দেওয়া হয় যখন প্রতিষ্ঠান হিসেব কষে বুঝতে পারে এই পদে একজন কর্মীর সারাদিন করার মতো কাজ আছে। আপনি যদি সেরকম স্মার্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাহলে ধরে নিতে হবে যে দিনের সবচেয়ে উৎপাদনশীল সময়টা আপনি আপনার চাকরির পিছনেই ব্যয় করবেন। অফিসে কাজের পরে এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজ করে একটা ব্যবসাকে দাঁড় করিয়ে সেখান থেকে আপনি আপনার পূর্ণকালীন চাকরির সমান আয় করে ফেলবেন, তা ভাবাটা একটু অতি আশাবাদী হয়ে যায় বৈকি।

তাই, টেস্ট রানের পরে আপনার ব্যবসার একটা পর্যালোচনা করুন। যদি আপনি দেখেন যে ব্যবসার শুরুটা মোটামুটি ভালো হয়েছে এবং ব্যবসা চলার ধরন দেখে আপনার ভিতরে এই বিশ্বাস জন্মায় যে এর পেছনে সময় দিলে তা আপনাকে আপনার চাকরির চেয়ে বেশি মানসিক শান্তি বা আয় বা দুটোই দিতে পারবে, তাহলে সাহস করে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করতেই পারেন।

মোদ্দাকথা হলো, আপনাকে বুঝতে হবে কোন কাজটাতে সময় দিলে আপনি বিনিময়ে বেশি পাবেন, যাকে ইংরেজিতে বলে রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট। যে কাজে সময় দিলে বেশি ফেরত পাবেন, সেই কাজে সময় ব্যয় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ভালোভাবে বিশ্লেষণ করার পরে যদি আপনার ভিতরে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় যে চাকরি চালিয়ে যাওয়ার বিপরীতে ব্যবসায় সময় দিলে ভবিষ্যতে আপনার লাভ (টাকায় বা মর্যাদায় বা মানসিক প্রশান্তিতে যেভাবেই হোক) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি; কেবল তখনই চাকরি ছাড়ার চিন্তা করুন। অযথা তাড়াহুড়া করতে যাবেন না, বরং যথাযথ পরিকল্পনা করে গুছিয়ে নিয়ে সময় ও সুযোগ বুঝে চাকরি ছাড়ুন।

আমি আমার উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম বছর নষ্ট করেছি কেবল যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে। ভিন্নভাবে বললে একে ‘নষ্ট’ না বলে বলতে পারি ‘উদ্যোক্তা হওয়ার প্রাথমিক শিক্ষার দাম' আমি প্রথম এক বছর জুড়ে দিয়েছি। ওই সময়ে আমি বুঝতে শিখেছি উদ্যোক্তা হওয়া কতটা কঠিন। এও বুঝেছি যে এখানে কষ্ট করে লড়াই চালিয়ে যাওয়া হার মেনে নেওয়ার চেয়ে অনেক কঠিন। ব্যবসা করার চেষ্টা শুরু করার পরের এক বছর শুধু গিয়েছে বুঝতে যে আসলে আমি কী চাই। একথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে, যথাযথ পরিকল্পনা করে মাঠে নামলে প্রথম পাঁচ বছরে যা অর্জন করেছি তা হয়তো দুই বা তিন বছরেই অর্জন করা সম্ভব হতো। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রায় পাঁচ বছর চলে যাওয়ার পরেও মনে করি আমি প্রতিদিনই নতুন কিছু না কিছু শিখছি। ব্যবসায় প্রতিটি নতুন অধ্যায়ে পৌঁছানোর সাথে সাথে আমি সেখান থেকে এমন কিছু শিক্ষা পাই যা এর আগে কখনো পাইনি।

আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন। We Respect Every Author Hardwork -boipaw™

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ