এসো রূপকথার গল্প শুনি লেখক : এনামুল করীম ইমাম | Esho Rupkothar Golpo Shuni By Enamul Korim Imam

এসো রূপকথার গল্প শুনি (pdf download no available)
লেখক : এনামুল করীম ইমাম
প্রকাশনী : দারুত তিবইয়ান
বিষয় : শিশু কিশোরদের বই
পৃষ্ঠা : 112
ভাষা : বাংলা

সাপ্লায়ার জানিয়েছেন এই পণ্যটি 28 February প্রকাশিত হতে পারে। প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পণ্যটি পেতে আগেই অর্ডার করে রাখুন ।
Image

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.....
রূপকথার গল্প। কথাটি শুনেই আমরা যা বুঝি—রূপকথার গল্প মানেই রাজা-রানী আর রাজকন্যা, রাজকুমারদের মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত গল্প। আর সাথে রাক্ষস-ডাইনীর গল্প। রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পক্ষিরাজ এ করে রাজ কুমারের আগমন। যে গল্পে নেই কোনো শিক্ষা-নৈতিকতা।কিন্তু রূপকথার গল্পের মাধ্যমেও যে আমরা ইসলামের নান্দনিকতা শিখতে পারি; তা আমরা ক’জন অনুভব করি! মনেই হয় না এমনটি হতে পারে!কিন্তু হ্যাঁ, হতে পারে। লেখক খুবই সুন্দর ও সহজ-সাবলীল উপস্থাপনায় সেটিই তুলে ধরেছেন এ বইয়ে। রূপকথার মজাদার গল্পে গল্পে শিখবো ইসলামের নান্দনিকতা-নৈতিকতা।
 (গল্প ১)   আমেরিকান রাজকন্যা...
আমেরিকার রাজকন্যার মনে ভীষণ অহংকার। যার তার সাথে বড়াই করে বেড়ায় সে। করবে না কেন? তার আব্বুর অনেক টাকা আছে। আর তা হলো ভিনদেশি রাজকন্যা । সেখানেও সম্পদের অভাব নেই তার।

রূপের কথা কি আর বলব! তার হাসিতে যেন মুক্তা ঝরে। দাঁতগুলো হীরের মতো

চকচকে। ঠোঁট দুটো ঠিক গোলাপের মতো। কথায় বেজে উঠে বাঁশির সুর। তাই রাজকন্যা

অহংকার করে বেড়ায়। বড় বড় চোখ দুটো বেশ টানাটানা। হরিণীকে হার মানায় তার

সৌন্দর্য। এ যেন সবুজ বাগানে ফুটন্ত এক গোলাপ।

একদিন তার দেখা হলো বাংলাদেশের শাহজাদার সাথে। অহংকারী রাজকন্যা চেয়ে রইল শাহাজাদার দিকে। কী অপলক চাহনি! দৃষ্টি নামাতেই পারে না সে। অনেকক্ষণ ধরে দেখল শাহজাদাকে।

এ তো রাজকন্যার স্বপ্নের রাজকুমার। যাকে সে কামনা করেছিল এতদিন। যার জন্য অপেক্ষা করছিল রাত জেগে। শত শত দিন কেটে গিয়েছিল যার অপেক্ষায়। আজ সে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখের সামনে।

ইচ্ছে করলেই দেখা যায়। কথা বলা যায় তার সাথে। গল্প করা যায় মন খুলে। ঘুরা যায় তার হাত ধরে। তাকে পাশে পাওয়া যায় সবসময়। তার সাথে করা যায় ভাবের আদান প্রদান। কারণ, সে এখন রাজকন্যাদের বাড়িতে মেহমান হয়ে এসেছে।

বাহ! কী সুন্দর তার চেহারা। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। যেমন লম্বা, তেমন ফর্সা। শরীরের গঠনটাও বেশ চমৎকার। পোশাকও বেশ মানানসই। আসলেই সে একজন সুদর্শন পুরুষ। রাজকন্যা তাকে ভীষণ পছন্দ করল।

একদিন বিকেল বেলা। রাজকন্যা দেখা করল শাহাজাদার সাথে। দু'জনের মধ্যে অনেক কথাই হলো। একসময় রাজকন্যা বলল

—–—চল, আমরা বাগান থেকে ঘুরে আসি।

—আমি যেতে পারব না।

-কেন?

-তোমার সাথে আমার কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না।

—কারণ কী! একটু খুলে বল।

—এখনও তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়নি।

আমি এসব শুনতে চাই না। যেতেই হবে তোমাকে।

এই বলে রাজকন্যা হাত চেপে ধরল শাহজাদার। কাজটি পছন্দ হলো না তার। হাত ছাড়িয়ে নিল সে। উঠে দাঁড়াল তখনই। একটুও দেরি করল না। এক দৌড়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। পিছনে ফিরেও তাকাল না। একবারের জন্যও না।

শাহজাদা জানত হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা। মিসরের খাদ্যমন্ত্রীর স্ত্রী জুলেখা বিবি। সে তাঁকে অন্যায় কাজ করতে বলেছিল। ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাজপ্রসাদের খাসকামরায়। প্রাসাদের দরজা ছিল অনেকগুলো। সবগুলো দরজা শক্ত করে লাগানো ছিল। খোলার কোনো উপায় ছিল না ছোট্ট ইউসুফের হাতে।

না, নবি ইউসুফ বিন্দুমাত্র ভয় পেলেন না। বিচলিত হলেন না একটুও। মানলেন না কোনো বাধা। শুধু এই সংকল্প করলেন :

‘শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে, বিন্দু পরিমাণ শক্তি থাকতে তিনি পাপের কাজ করবেন না।'

‘যতক্ষণ নিঃশ্বাস চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যায়ের কােছ মাথা নত করবেন না।'

নবি ইউসুফ আলাইহিস সালাম ভরসা করলেন আল্লাহর ওপর। সাহায্য চাইলেন তাঁর কাছে। এরপর শুরু করলেন দৌড়। এক দৌড়ে চলে এলেন প্রথম দরজার কাছে। আল্লাহর গায়েবি সাহায্য এসে পড়ল তখনই। খুলে গেল সেটি। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল ইউসুফের। একে একে অতিক্রম করলেন সবকটি দরজা।

জুলেখা তাঁকে ধরবে। তাই ছুটে আসছে পেছনে পেছনে। না, ধরতে পারল না সে। পাপের কাজ থেকে বেঁচে এলেন নবি ইউসুফ। বিশ্বাস জন্মে গেল তাঁর। ইচ্ছা করলে মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকা যায়। এর জন্য দরকার :

১. আল্লাহর উপর ভরসা ও তাঁর সাহায্য।

২. আত্মবিশ্বাস এবং

৩. মন্দকাজে জড়িত না হওয়ার দৃঢ়সংকল্প।

শাহজাদা জানতেন, হজরত ইউসুফ এই তিনটি জিনিস দিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। সুতরাং তাকেও বিজয়ী হতে হবে সেভাবে। তাই রাজকন্যার রূপ, টাকা-পয়সা ও সুখ-শান্তি কোনোকিছুই তাকে বাধা দিতে পারল না।

অনেকদিন দেখা নেই শাহজাদার। পাগলের মতো হয়ে গেছে রাজকন্যা। কিছুতেই মন বসে না তার। মন ছুটে যেতে চায় তার কাছে। ভালো লাগে না তাকে ছাড়া। খাবারে স্বাদ নেই। ফুলে ঘ্রাণ নেই। পাখির গানে কোনো সুর নেই। শেষ হয়ে গেছে সবকিছু। মনে হয় সবই সাথে নিয়ে গেছে সে।

আর স্থির থাকতে পারল না রাজকন্যা। একদিন ব্যক্তিগত প্লেনে চেপে বসল সে। পাইলটকে বলল চালাও। আমি বাংলাদেশে যাব। বেচারা পাইলট! কিছুই করার নেই

তার। হুকুম হলে চলতেই হবে। দাঁড়ানো যাবে না এক মুহূর্ত। তাহলে গরদান থাকবে না।

রাজপরিবারের খেয়াল বলে কথা! এদের কাছে ন্যায় অন্যায় নেই। যা বলবে তাই হবে। আর সবাইকে তা মানতে হবে। অন্যথায় কারোর য রক্ষা নাই। যে দেশে ইসলাম থাকে না, সে দেশের রাজা আর প্রজাদের অবস্থা এমনই হয়।

রাজকন্যা এলেন বাংলাদেশে। ছুটে গেলেন রাজপ্রাসাদে। শাহজাদার পিতা-মাতা তাকে বরণ করে নিলেন। থাকতে দিলেন প্রাসাদের সবচেয়ে দামী কামরায়। সবকিছু বেশ সাজানো গোছানো। পছন্দ হলো রাজকন্যার। শাহজাদাকে তো আগেই পছন্দ করেছিল, আর দেরি করল না। বিয়ের পয়গাম পাঠালো শাহজাদাকে। সে জানে, এই প্রস্তাব কিছুতেই ফেলবে না সে। কারণ—

—সে আমেরিকান রাজকন্যা।

—তার রূপের তুলনা হয় না।

—আর টাকা-পয়সার তো অভাব নেই।

না, মুসলিম শাহজাদা আমেরিকান রাজকন্যার প্রস্তাব মানলেন না। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, তোমার সবকিছুই আমাদের পছন্দ; কিন্তু তুমি মুসলিম না। এজন্য তোমাকে আমি বউ করে ঘরে তুলতে পারি না। কারণ, মুসলিম কখনও অমুসলিমকে বিয়ে করতে পারে না। পবিত্র কুরআন মাজিদে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে :

ولا تنكحوا المشركات حتى يؤمن ولأمة مؤمنة خير من مشركة ولو أعجبتكم ولا تنكحوا المشركين حتى يؤمنوا ولعبد مؤمن خير من مشرك ولو أعجبكم أوليك يدعون إلى النار والله يدعو إلى الجنة

والمغفرة بإذنه

‘ঈমান গ্রহণ না করা পর্যন্ত কোনো মুশরিক নারীকে তোমরা বিবাহ করো না। মনে রেখ, মুসলিম ক্রীতদাসী (স্বাধীন) মুশরিক নারী অপেক্ষা উত্তম। যদিও তাদেরকে তোমাদের ভালো লাগে। মান গ্রহণ না করা পর্যন্ত তোমরা (নারীরা) কোনো মুশরিক পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না। একজন মুসলিম ক্রীতদাস একজন (স্বাধীন) মুশরিকের তুলানায় অনেক ভালো। যদিও তোমরা তাদের দেখে মুগ্ধ হও। (মুশরিক নারী-পুরুষকে বিবাহ না করার কারণ হলো,) তারা তোমাদের জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে। আর আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে তোমাদের আহ্বান করেন, জান্নাত ও ক্ষমার দিকে। [১]

রাজকন্যা বুঝে ফেলল, কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। মুসলমান কখনও কুরআন মাজিদের বাইরে যাবে না। তাই সে চিন্তা করতে লাগল, এই কুরআনের মধ্যে কী আছে তা জানা দরকার। শাহজাদাকে বলল :

‘আমাকে একটি কুরআন এনে দাও। পড়ে দেখি তাতে কী আছে?'

শাহজাদা পবিত্র কুরআন মাজিদের সুন্দর একটি কপি এনে হাজির করল রাজকন্যার সামনে। আর সে যাতে বুঝতে পারে, এজন্য তরজমা ও তাফসিরও এনে দিল। এগুলো নিয়ে রাজকন্যা চলে গেল আপন দেশে।

মাত্র তিন মাস পরে ফিরে এলো রাজকন্যা। এদিকে তার সিদ্ধান্ত জানতে উদগ্রীব হয়ে আছে শাহজাদা ও তার পরিবার। কী বলে সে? এমন মেয়েকে কি কেউ হারাতে চায়?

রাজকন্যা শাহজাদাকে ডেকে নিয়ে গেল খাস কামরায়। তবে এখন আর দুজন মুখোমুখী নেই। দুজনের মাঝে ইসলামি পর্দা। শাহজাদা বলল :

—তোমার সিদ্ধান্ত কী বল?

—আমি কুরআন পড়েছি। এর তেলাওয়াত, তরজমা ও তাফসির আমাকে মুগ্ধ করেছে।

তা হলে?

—আলহামদুলিল্লাহ! আমি ইসলাম গ্রহণ করতে চাই।

তখনই রাজ্যের বড় আলেমকে ডেকে আনা হলো। রাজকন্যা পড়ে নিলেন—

أشهد أن لا إله إلا الله، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله

‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য (মাবুদ) নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হজরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দা ও রাসুল।' এবার শাহজাদার মনে আর খুশি ধরে না। কারণ, আমেরিকান রাজকন্যাকে বিয়ে করতে

এখন আর কোনো বাধা নেই। সে হবে সুন্দরী রাজকন্যার স্বামী। রাজার একমাত্র জামাই।

একই সাথে দুই রাজ্যের রাজা। তখন তাকে আর পায় কে?

না, শাহজাদার খুশি বেশিক্ষণ রইল না। কারণ, রাজকন্যা এখন তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না। ছুটে গেল শাহজাদা। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল :

কী হলো তোমার?

—না, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।

—কেন?

—আমি পবিত্র কুরআন মাজিদ পড়ে জেনেছি, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এজন্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তা মেনে চলতে হয়। এমনকি, এতে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হয়। ইরশাদ হচ্ছে—

يا أيها الذين آمنوا ادخلوا في السلم كافة
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো। (২)

তুমি পরিপূর্ণভাবে ইসলাম মেনে চল না। এজন্য আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। ভুল বুঝতে পারল শাহজাদা। তখনই তাওবা করল সে। ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করার দৃঢ় সংকল্প করল রাজকন্যার কাছে। তবে সে এত সহজে ছাড়া পাত্র নয়। তাকে পরীক্ষা করে দেখল ছয়মাস পর্যন্ত। এর মধ্যে সে নিজেও কুরআন তেলাওয়াত ও ইসলামি বিধি-বিধান ভালো করে শিখে নিল।

এরপর। একদিন দুই রাজ্যে বেজে উঠল বিয়ের গজল। দুজনের বিয়ে হলো মহাধুমধামের সঙ্গে। মেহমানদের এমন খাবার খাওয়ানো হলো, যা ইতিপূর্বে কেউই খায়নি।


(গল্প ২)  বাঘ যেভাবে মানুষ চিনেছিল
ছোট্ট একটি বন। এ বনের রাজা বাঘ। বাঘের ভয়ে সবাই থরথর করে কাঁপে। কখন কার ওপর বিপদ নেমে আসে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এজন্য সবাই সবসময় তার থেকে দূরে দূরে থাকে। বাঘ কাউকে ভয় পায় না। বাঘকে ভয় পায় সবাই।

হ্যাঁ, বাঘ একটি মাত্র প্রাণিকে ভয় পায়। আসলে এটা তেমন বড় কোনো প্রাণি না।

এমনকি, বাঘের চেয়ে অনেক ছোট। কয়েকগুণ ছোট। বাঘের বড় বড় দাঁত আছে। এই

প্রাণির অত বড় দাঁত নেই। বাঘের মতো নখরও নেই তার। তারপরও তাকে ভয় পায়

বাঘ। ভীষণ ভয় পায়। তার ভয়ে বাঘ কাঁপতে থাকে সবসময়।

একদিন বাঘ একটি সুন্দর বাচ্চা জন্ম দিল। দিনরাত বাঘ তাকে আদর করে। চোখে চোখে রাখে। এক মুহূর্তের জন্যও আড়াল হতে দেয় না। একটু এদিক সেদিক গেলেই পাগল হয়ে যায় বাঘ। বাঘ তার বাচ্চাকে আদর করে। খুব আদর করে...।

বাঘ তার বাচ্চাকে বলে :

শোনো, আমি এ বনের রাজা। তোমার যেখানে মন চায়, তুমি সেখানেই যাবে। যেখানে ইচ্ছা সেখান থেকে খাবে। যার সাথে ইচ্ছা মিশবে। যার সাথে ইচ্ছা কথা বলবে। যার সাথে মন চায় খেলবে; কিন্তু এক জায়গায় যাবে না। একজনের সাথে খেলবে না। কখনও তার দিকে তাকাবেও না।

বাচ্চা: আব্বু সে কে?

ওর কথা আর বলো না। ও ভীষণ খারাপ, জবাব দিল বাঘ।

আব্বু বল না, সে কে? আবদার করে বাঘে রছানা।

বাঘ তার ছানাকে আদর করে বলে :

‘আগে বল, তুমি তার কাছে যাবে না।'

বাচ্চা : আচ্ছা, বললাম— আমি তার কাছে যাবো না।'

বাঘ : ‘শোনো, এই পৃথিবীতে মানুষ নামের একটি প্রাণি আছে। ওরা ভীষণ ভয়ংকর। খবরদার! কখনও ওদের কাছে যাবে না।

বাচ্চা : তুমি ওদের এত ভয় পাও কেন—

‘ওদের কি ইয়া বড় দাঁত আছে?

‘লম্বা লম্বা নখর আছে?

‘ওদের কি বিশাল একটি লেজ আছে?

বাঘ : ও তুমি বুঝবে না। তোমাকে বললাম, তুমি ওদের কাছে যাবে না। তাই যাবে না। একদম ধারে কাছেও না...

বয়স হয়েছে বাঘের। এদিকে একটু একটু করে বাড়ছে তার বাচ্চার বয়স। দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে বাঘ। অপরদিকে তার বাচ্চা হচ্ছে সবল। পিতা হচ্ছে বুড়ো। আর সন্তান হচ্ছে শক্তিশালী যুবক।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবার কৌতূহলও বাড়ে। তাই বাঘের বাচ্চার কৌতুহলও

বাড়তে লাগল দিন দিন। সে মানুষ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। একদিন বাঘ বলল, 'আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে একটু রাত হতে পারে। তুমি খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আমার জন্য দেরি করবে না।'

বাঘের বাচ্চা মনে করল, এই তো আমার সুযোগ। এ সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যায় না। আমাকে যে মানুষ দেখতে যেতে হবে। আজই যেতে হবে। আমাকে বাইরে বেরুতে হবেই হবে।

আব্বু নিষেধ করেছে তো কী হয়েছে? আব্বু বুড়ো হয়ে গেছেন। সবকিছু বোঝেন না। আমার এখন শক্তি হয়েছে। এখন ওসব বাধা-টাধা মানার সময় কি আমার আছে?

আর আমার শরীরে যেই শক্তি। আমার সামনে তো দাঁড়াতেই পারবে না কেউ। যেই আসুক, আমি তাকে পরাজিত করেই ছাড়ব। সুতরাং আমার আবার ভয় কীসের?

পিতার অবাধ্য হয়ে বাঘের বাচ্চা বেরিয়ে পড়ল। মানুষ দেখার জন্য তার আর তর সয় না। আসলে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি সবার কৌতুহল একটু বেশিই থাকে।

বাঘের বাচ্চা এখন বাইরে। ঘুরছে পথে পথে। মানুষ দেখার জন্য। সে জঙ্গলের বাইরে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াল। তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি চার পা ওয়ালা প্রাণি। বাহ! অনেক সুন্দর ওর লেজটা। আকার-আকৃতিতে বেশ বড় না হলেও চেহারা দেখতে খুবই চমৎকার। বাহ! কপালে কী সুন্দর একটি ফোটা। গায়ের রঙটা কী সুন্দর। একেবারে লাল টকটকে।

বাঘের বাচ্চা এগিয়ে গেল তার কাছে। বেশ খাতির জমিয়ে বলল :

—কী হে ভাই, ভালো তো!

-ভালো! আর বলো না ভাই, ভালো থাকি কেমন করে?

—কেন কী হয়েছে তোমার?

—আর বলো না। খাটতে খাটতে মরলাম। এই দেখ তো :

‘আমার পিঠে কত্তো বড় দুটি বোঝা।'

‘মুখের মধ্যে লোহার লাগাম।

‘পায়ের নিচে লাগিয়ে রাখা হয়েছে লোহার পাত।

—আচ্ছা, কে লাগিয়েছে এগুলো?

—সে আর বলো না। আমার পিঠে চড়ে বসে আরাম করতে থাকে। আমি দৌড়াই। দৌড় একটু কম হলেই শুরু হয় মার। আমার পিঠে পড়তে থাকে চাবুকের ঘা। পা দিয়ে আঘাত করা হয় আমার পেটের মাঝে।

—আসলেই তুমি অনেক কষ্টে আছ ভাই।

—সে শুনে লাভ নেই। যুদ্ধের সময়ও দরকার পড়ে আমাকে। আমার পিঠে চড়ে ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করে বেড়ায়। অথচ আমার কী অযত্ন-অবহেলা! মহান আল্লাহ তাআলা আমার কথা পবিত্র কুরআনেও বলেছেন।

—কী বলেছেন?

‘তোমাদের আরোহণ এবং শোভার জন্য তিনি (আল্লাহ তাআলা) ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন।'

—কে তোমাকে কষ্ট দেয়, এরা কারা?

—ওদের কথা শুনে তুমি কী করবে?

বলো না, আমার শুনতে খুব ইচ্ছা করছে।

—তাহলে শোনো, এরা হলো মানুষ।

বাঘের বাচ্চা কী করবে, তা ভেবেই পেল না। তারপরও এগিয়ে যেতে লাগল সামনের দিকে। এখন বেশ ভয় চলে এসেছে তার মনে। তারপরও সে যেতে লাগল সামনের দিকে।

বাঘের বাচ্চা এবার মনে হয়, মানুষ দেখেই ফেলেছে। এমন ভাব নিয়ে ধেয়ে গেল একটি প্রাণির দিকে। এর পেট অনেক বড়। গলা বিশাল লম্বা। মনে হয় গলা দিয়ে আকাশটাকে ছুয়ে ফেলবে। আর পিঠে বিশাল বোঝা। মনে হয়, যেন পুরো পৃথিবীটাকেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও।

বাঘের বাচ্চা দৌড়ে গেল তার দিকে। কাছে এসে বলল :

—ভাই! আপনি মনে হয়...

—আমি কী? আমি তো বোঝা বয়ে বেড়াই।

—আমি দুধ দেই। সেই দুধ ওরা খায়।

—আমার গোস্ত দিয়ে ওরা জিহ্বার স্বাদ মিটায়।

—আমার চামড়া দিয়ে ওরা দামী দামী আসবাব তৈরি করে। এমনকি, পায়ের জুতা বানিয়েও পায়ে দেয়।

—তাহলে আপনার নামটা কী?

—নাম দিয়ে কাম কী?

বলুন না, শুনতে মন চাচ্ছে।

—আমার নাম উট। আমাকে বলা হয় মরুভূমির জাহাজ।

ভাই! তুমি যখন এসেই পড়েছ, একটা গল্প বলি : একদিন প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ উটটির পেট একেবারে পিঠের সাথে লাগা ছিল। এ অবস্থা দেখে তিনি বললেন—

‘তোমরা এই জন্তুর ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো। তোমরা তার ওপর উত্তম পন্থায় আরোহণ করো। আর তাকে ভালোমতো ছেড়ে রাখো। (অর্থাৎ আরোহণের আগে ও পরে তাকে ভালোভাবে খাবার পানি সরবরাহ করো।)

—আমি তো মনে করেছিলাম, আপনি মনে হয় মানুষ।

—নারে ভাই! আমি মানুষ না।

কী আর বলব, মানুষ আমাকে চালায়। আমি মানুষের হুকুমের গোলাম। আমাকে দিয়ে ইচ্ছামতো কাজ করায়। আবার মন চাইলে জবাই করে খেয়েও ফেলে। আমাকে মানুষ বলো না।

বাঘের বাচ্চার মানুষ দেখার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। এত বড় প্রাণি উট। তাকে যে এভাবে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়, সে কত বড়? সেটা দেখা প্রয়োজন। এই উপলব্ধি নিয়ে বাঘের বাচ্চা চলতে লাগল সামনের দিকে। আজ তাকে মানুষ দেখতেই হবে।

নড়াচড়া করছে বিশাল একটি গাছ। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, গাছটি নিয়ে একটি প্রাণি খেলা করছে।

‘তার শরীর বিশাল একটি ঘরের মতো।

‘পিছনের লেজটা অবশ্য ছোট। কিন্তু সামনের দিকেও একটি লেজ আছে। একে বলা হয় শুঁড়।

‘কান দুটো যেন বিরাটাকারের দুটি কুলা।'

বাঘের বাচ্চা এগিয়ে গেল তার দিকে। বলল, আমি বনের রাজা বাঘের ছেলে। আমি মানুষ দেখতে এসেছি। আপনি মনে হয় মানুষ?

—আমি মানুষ হতে যাব কেন, আমি হলাম হাতি।

—তাহলে মানুষ কে? আমি মানুষ কোথায় খুঁজে পাব?

—কী করবে তুমি মানুষ দিয়ে?

—আমি মানুষ দেখব। আমার মানুষ দেখার খুব ইচ্ছা। আপনি বলুন না, মানুষ কোথায় পাওয়া যায়?

—মানুষ দেখে কোনো লাভ নেই। দেখো, আমি হলাম সবচেয়ে বড় প্রাণি। মানুষ আমাকে চালায়। মানুষ খায় ফল। আমাকে খেতে দেয় গাছ।

এই দেখো, আমি কত্তো বড় একটি গাছ তুলে এনেছি। এই গাছ দিয়ে তৈরি হবে দামী দামী ফার্নিচার। তাতে কি আর আমি আরাম করে ঘুমাব? তাতে আরাম করবে ঐ মানুষ। আর আমি পড়ে থাকব ঐ কাদা-মাটির মধ্যে।

এরপরও কি তুমি মানুষ দেখতে চাও?

—না, চা-ই না; কিন্তু...

—কোনো কিন্তু নয়। তুমি দয়া করে মানুষের কাছেও ঘেষবে না। মানুষ বড় ভয়ংকর।

—মানুষ কি আসলেই ভয়ংকর?

— না, তাদের ভয়ংকরও বলা যায় না। কারণ, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সম্মান দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বলেছেন—

‘আমি আদম সন্তানকে (মানুষ) মর্যাদা দান করেছি। আমি তাদেরকে জলে-স্থলে চলাচলের জন্য বাহন দান করেছি। তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি। আর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর।'

—তাহলে তো এই মানুষকে দেখতেই হয়।

—দেখতে চাইলে যাও, তবে...

—আপনি যাই বলেন, আমি মানুষ দেখতে যাবই।

জঙ্গলের পাশেই ছোট্ট একটি ঘর। এখানেই থাকেন আবদুল করীম। তার ছেলে সাইফুল্লাহ। বয়স ১২ বছর। আবদুল করীম জঙ্গলে কাঠ কেটে চাল ডাল কিনে আনে। অনেক কষ্টে তাদের সংসার চলে।

সাইফুল্লাহ হিফযুল কুরআন শেষ করেছে। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ভর্তি হয়েছে দীনি প্রতিষ্ঠানে। অনেক বড় মানুষ হতে হবে তাকে। হতে হবে সৎ শিক্ষিত ও জ্ঞানী-গুণী। এই তার আশা। তার স্বপ্ন।

সাইফুল্লাহ দেখে তার পিতা অনেক কষ্ট করেন। তাই সে পিতাকে সাহায্য করে ছুটির দিনগুলোতে। পিতার সাথে জঙ্গলে কাঠ কাটে। অথবা পিতার খাবার নিয়ে যায়। বোঝা বহনে পিতাকে সাহায্য করে। কাঠ বহনের গাড়িটাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়।

আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমার দিন। মাদরাসা বন্ধ। আবদুল করীমের শরীরটাও ভালো না। সাইফুল্লাহ পিতাকে বলল—

‘আজ আপনি বাড়িতে বিশ্রাম করুন। আমি জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে নিয়ে আসি।' আবদুল করীম প্রথমে রাজি হয়নি; কিন্তু শরীর বেশি খারাপ হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছে।

সাইফুল্লাহ এখন জঙ্গলে। কাঠ কাটছিল আপন মনে। এমন সময় তার সামনে উপস্থিত হলো বাঘের বাচ্চা।

বাঘের বাচ্চা : আচ্ছা, ভাই! তুমি কি মানুষ চিনো?

সাইফুল্লাহ : হ্যাঁ, চিনি। ভালো করেই চিনি।

বাঘের বাচ্চা : আমাকে মানুষ দেখিয়ে দিতে পারবে?

সাইফুল্লাহ : পারব, অবশ্যই পারব। কেন পারব না!

বাঘের বাচ্চা : আচ্ছা, তাহলে আমাকে একজন মানুষ দেখিয়ে দাও।

সাইফুল্লাহ : দেখ, দেখ। ভালো করে দেখ।

বাঘের বাচ্চা : কোথায় মানুষ? কোথায়...?

সাইফুল্লাহ : এই যে মানুষ। আমি-ই তো একজন মানুষ।

বাঘের বাচ্চা : সত্যই বলছ, তুমি মানুষ!

সাইফুল্লাহ হ্যাঁ, আমি মানুষ। আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ।

বাঘের বাচ্চা : (তাচ্ছিল্যের সাথে) এই তাহলে মানুষ! এই পুঁচকে প্রাণিকেই মানুষ বলা হয়? এই শক্তি-সামর্থ্যহীন প্রাণিই তাহলে মানুষ?

সাইফুল্লাহ : কেন, মানুষ দেখে পছন্দ হচ্ছে না?

বাঘের বাচ্চা : পছন্দ হওয়ার মতো কী আছে তোমাদের মধ্যে? আমি বুঝি না, আমার পিতা কেন তোমাদের এত ভয় পায়? আসলে তার জ্ঞান-বুদ্ধি কিচ্ছু নেই।

সাইফুল্লাহ : তুমি তো পিতার ভুল ধরছ! গুরুজনের ভুল ধরা মহাঅন্যায়।

বাঘের বাচ্চা : রাখ, তোমার ন্যায়-অন্যায়। শুধুই কি আমার পিতা! তার দলে আছে—

দ্রুতগামী ঘোড়া।

মরুভূমির জাহাজ খ্যাত উট এবং

সবচেয়ে বড় প্রাণি হাতি। এরা সবাই মানুষকে ভয় পায়।

💕 আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন। 
We Respect Every Author Hardwork - boipaw.com™

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ