ইতিহাসের খলনায়ক - লেখক : ইমরান রাইহান | Itihasher Kholnayok By Imran Raihan

ইতিহাসের খলনায়ক (pdf download free no available)
লেখক : ইমরান রাইহান
প্রকাশনী : আরিশ প্রকাশন
বিষয় : ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
পৃষ্ঠা : 176, কভার : হার্ড কভার
ভাষা : বাংলা।
Image

ইতিহাস আসলে মুদ্রার মতো। যার দুটি পিঠ রয়েছে। একদিক থেকে অন্যদিকটা সরাসরি দেখা যায় না। ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানেন, ইতিহাসের এক পিঠে আলো থাকলে অন্যদিকে থাকে অন্ধকার। এক প্রান্তে সত্য ও সাম্য থাকলে অপর প্রান্তে থাকে মিথ্যা ও অন্যায়। এক পক্ষে নায়ক থাকলে প্রতিপক্ষে থাকে খলনায়ক। ইসলামের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠি, ধর্ম, বর্ণ ও মতবাদের উত্থান ও পতনের সাথে জড়িয়ে আছে সময়ের শ্রেষ্ঠ নায়ক ও নিকৃষ্ট খলনায়কদের উপাখ্যান। একজন মুসলমান হিসেবে, মুসলিম পাঠক হিসেবে, ইসলামী ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু পাঠক হিসেবে আমরা আমাদের নায়কদের জানি। চিনি। তাদের শৌর্যবীর্য, বীরত্ব, দুঃসাহসিকতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিবেদনের ইতিহাস আমাদের কমবেশি জানা আছে। পড়া আছে। কিন্তু আমরা কি আমাদের ইতিহাসের খলনায়কদের জানি? ইতিহাসের মোড় পাল্টে দেয়া, মুসলিম সভ্যতার আকাশে কালো মেঘ ডেকে আনা ক’জন খলনায়কের সাথে আমাদের পরিচয় আছে? জানাশোনা আছে?
শত্রু না চিনলে আর শত্রুতার রূপরেখা না ধরতে পারলে বিপদ আছে। 

যুগে যুগে এ ধরনের উদাসীনতার চরম মূল্য দিয়েছে মুসলিম জাতি। হারাতে হয়েছে ঈমান। বেহাত হয়েছে হাজরে আসওয়াদ। রক্তাক্ত হয়েছে বাগদাদ। নিষ্পেষিত হয়েছে মিসরের বিস্তীর্ণ জনপদ। কারা ছিল সেসব অপকর্মের খলনায়ক? উত্তর জানতে পড়তে হবে ‘ইতিহাসের খলনায়ক’।
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ইসলামী ইতিহাসপ্রেমী ‘ইমরান রাইহানের’ জাদুকরী কলমের ছোঁয়ায় বহুবার মুগ্ধ হয়েছে পাঠকমহল। ‘ইতিহাসের খলনায়ক’ তাতে যোগ করবে ভিন্নরকম এক মাত্রা। ইনশাআল্লাহ।
আসওয়াদ আনাসি
আসওয়াদ আনাসির জন্ম ইয়ামানের খুব্বান নামে একটি গ্রামে। এটি ছিল নাজরানের নিকটবর্তী একটি এলাকা। তার মূল নাম আবহালাহ ইবনু কাব। সব সময় মাথা ও চেহারা ঢেকে রাখত বলে তাকে জুল খিমারও বলা হয়। তার চেহারা ছিল প্রচণ্ড কালো, এজন্যই মূলত তার নাম হয় আল আসওয়াদ। আনাস গোত্রের সদস্য বলে তার নামের সাথে আনাসি শব্দ যুক্ত হয়। সে বসবাস করত ইয়ামানে। এ জন্য সে নিজের উপাধি দেয় রাহমানুল ইয়ামান। শারীরিকভাবে সে প্রচণ্ড শক্তিশালী ছিল। অবলীলায় যেকোনো মানুষকে মল্লযুদ্ধে হারাত সে। 

জাহিলি যুগের অন্য অনেকের মতো সেও জাদুবিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী ছিল। লোকজনকে সে জাদুর ভেলকি দিয়ে নিজের প্রতি মুগ্ধ করত। ~ আসওয়াদ আনাসির একটা গাধা ছিল। এই গাধাকে সে আনা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করেছিল। সে যদি গাধাকে বলত তাকে সিজদা করতে তাহলে গাধা তাই করত। মাঝে মাঝে সে গাধাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বলত, তখন গাধা এমনটাই করত। এসব খেল দেখিয়ে আসওয়াদ আনাসি তার ভক্তদের মুগ্ধ করত। এ জন্য কেউ কেউ তার নাম দেয় জুল হিমার বা গাধাওয়ালা।

এ ধরনের ভেলকিবাজ ও জাদুকরদের কিছু অনুসারী জুটে যায়। আসওয়াদ আনাসির ক্ষেত্রেও তাই হলো। লোকজন তাকে ভক্তি করে অলৌকিক ক্ষমতার

[৬] [9] আসরুল খিলাফাতির রাশিদাহ, ৩৬৪। ফুতুহুল বুলদান, ১/১২৫।

অধিকারী মনে করত। নিজের অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ার ফলে আসওয়াদ আনাসির আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সে ভাবতে থাকে এখন যেকোনো দাবি করলেই ভক্তরা তা মেনে নিবে। বিদায় হজ্ব থেকে ফিরে আসার পর যখন নবিজির অসুস্থতার সংবাদ ছড়িয়ে যায়। তখন আসওয়াদ আনাসি নিজেকে নবি দাবি করে। আসওয়াদ আনাসি দাবি করে তার কাছে অহি নিয়ে দুজন ফিরিশতা আগমন করে। অবশ্য সে নবি দাবি করলেও কখনো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতকে অস্বীকার করেনি। সে ছিল খুবই নিকৃষ্ট স্বভাবের একজন মানুষ। এমন কোনো অপরাধ ছিল না, যা করতে সে প্রস্তুত ছিল না। সে নিয়মিত মদ পান করে মাতাল হতো। অপবিত্রতা থেকে কখনো পবিত্র হতো না। দিনের পর দিন গোসল ছাড়াই কাটিয়ে দিত| []

আনাস গোত্রের অনেকেই আসওয়াদ আনাসিকে নবি হিসেবে মেনে নেয়। নেতৃত্বের লোভে মাজহিয গোত্রের অনেকেও তার দলে ভিড়ে যায়। প্রাথমিক সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে আসওয়াদ আনাসি এবার অন্যান্য গোত্রের কাছে দাবি জানায় তাকে নবি হিসেবে মেনে নিতে। নাজরানের লোকজন আসওয়াদ আনাসিকে নাজরান যেতে বলে। সে নাজরান গেলে সেখানকার বাসিন্দারা তাকে নবি মেনে নিয়ে মুরতাদ হয়ে যায়। ইতিপূর্বে তারা মুসলমান হয়েছিল কিন্তু সেটা মন থেকে ছিল না। মূলত ইসলামের বিজয়াভিযান দেখে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। এই উদ্বিগ্নতা থেকেই তারা বাহ্যিক ইসলাম গ্রহণ করে। 

আসওয়াদ আনাসির নবুওতের দাবি তাদের সামনে ইসলাম ত্যাগের একটি সুযোগ তৈরি করে। তারা এই সুযোগ লুফে নেয়। নাজরানের আশপাশে বসবাসরত বেশকিছু গোত্রের লোকজন আসওয়াদ আনাসিকে নবি মেনে নেয়। নিজের অনুসারীদের লক্ষ্য করে আসওয়াদ আনাসি চিন্তা করে পার্শ্ববর্তী সানআ শহর দখল করে নেবে। তখন সানআ শাসন করেছিলেন শাহর ইবনু বাজান। তিনি মুসলমান ছিলেন। আসওয়াদ আনাসি আচমকা তার বাহিনী নিয়ে সানআ আক্রমণ করেন এবং শাহর ইবনু বাজানকে পরাজিত করেন। শাহর ইবনু বাজান যুদ্ধের ময়দানেই শহীদ হন। আসওয়াদ আনাসি সানআ দখল করে নেয়। ১১

[৮] আল বাদউ ওয়াত তারিখ, ৫/১৫৪। [৯] তারিখুর রিদ্দাহ, ১৫১।

সানআ দখলের পর আসওয়াদ সেখানকার মুসলিম বাসিন্দাদের ধর্মত্যাগে বাধ্য করে। যারা ধর্মের উপর অটল থাকতেন তাদেরকে নির্মম নির্যাতন করত সে। একবার আন নুমান নামে একজন বন্দি মুসলমানের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে তাকে হত্যা করা হয়। বাধ্য হয়ে সেখানকার অনেক মুসলমান নিজেদের ধর্ম পরিচয় লুকিয়ে রাখে। মুসলমানদের অনেকে আসওয়াদ আনাসির বিষয়টি জানিয়ে মদিনায় পত্র লিখে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে জানতে পেরে মুসলমানদের নির্দেশ দেন, তারা যেন আসওয়াদ আনাসির সাথে লড়াই করে এবং তার অনুসারী মুরতাদদের আক্রমণ করে। ১০।

নবিজি আসওয়াদ আনাসিকে দমনের নির্দেশ দিয়ে বেশ ক'জন সাহাবিকে প্রেরণ করেন। কিছু বর্ণনা থেকে প্রমাণ মেলে মুআয ইবনু জাবাল (রা) নবিজির এমন একটি নির্দেশনা পেয়েছিলেন। আবু মুসা আশআরি ও তাহির ইবনু আবু হালা (রা) ও এমন নির্দেশ পেয়েছিলেন। মুআয ইবনু জাবাল (রা) বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হন। তিনি বিভিন্ন গোত্রের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলেন। তার অক্লান্ত চেষ্টার ফলে ইয়ামানের মুসলমানদের সবগুলো জনপদ আসওয়াদ আনাসির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। মুসলমানরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেন আসওয়াদ আনাসিকে হত্যা করতে হবে। কারণ, তাকে হত্যা করে ফেললে তার অনুসারীরা এমনিতেই হারিয়ে যাবে। তখন তাদের সাথে আর লড়তে হবে না। বা লড়লেও খুব সহজেই তাদেরকে পরাজিত করা যাবে। সিদ্ধান্ত হয় আসওয়াদ আনাসিকে গোপনে হত্যা করার চেষ্টা চালানো হবে যেন দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ থেকে বাঁচা যায়।

সে সময় আসওয়াদ আনাসির একজন স্ত্রী ছিলেন সানআর সাবেক শাসক শাহর ইবনু বাজানের স্ত্রী। তার নাম ছিল আজাদ। শাহরকে হত্যার পর আসওয়াদ আনাসি জোরপূর্বক তাকে বিবাহ করে। তবে মহিলা মনেপ্রাণে মুসলমান ছিলেন এবং আসওয়াদ আনাসিকে ঘৃণা করতেন। তারিখুত তাবারির একটি বর্ণনায় আছে আজাদ দুনিয়ায় আসওয়াদের মতো এতটা ঘৃণা আর কাউকে করতেন না। ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত কারণে আসওয়াদ আনাসির প্রতি ছিল তার তীব্র ক্ষোভ। মনে মনে

[১০] তারিখুত তাবারি, ৪/৪৯।

তিনি আসওয়াদ আনাসিকে হত্যা করতে প্রস্তুত ছিলেন। আসওয়াদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া মুসলিমরা এই কথা জানতেন। তারা গোপনে আজাদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন এবং তাকে উদ্বুদ্ধ করেন আসওয়াদ আনাসিকে হত্যা করতে। আজাদ নিজে আসওয়াদকে হত্যা না করলেও তিনি তার ঘরে প্রবেশের কৌশল বলে দেন মুসলমানদের। তার দেয়া তথ্য অনুসারে এক রাতে মুসলমানরা আসওয়াদ আনাসির ঘরে প্রবেশ করে এবং ফাইরুজ দাইলামি নামে এক ব্যক্তি আসওয়াদ আনাসির ঘরে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করেন। ১৯৪

আসওয়াদকে হত্যা করার পর তার কর্তিত মাথা এনে তার অনুসারীদের সামনে রাখা হয়। তাদের মাঝে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে একেকজন একেকদিকে পালিয়ে যায়। ইতিমধ্যে সংবাদ আসে নবিজি ইন্তেকাল করেছেন। ১৯ আসওয়াদ আনাসির মৃত্যুর বিস্তারিত বিবরণ লিখে আবু বকর (রা) এর কাছে পাঠানো হয়। খিলাফতের একদম শুরুর দিকে আবু বকর (রা) আসওয়াদ আনাসির মৃত্যু সংবাদ পান।

নবুওতের দাবির পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আসওয়াদ আনাসি মাত্র চার মাস বেঁচেছিল। ১০। এর মধ্যেই সে কুফুরি ও গোমরাহির পথ খুলে যায়, যা হাজারো মানুষকে জাহান্নামের পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। আসওয়াদ আনাসির পতনের পর তার অনুসারীদের কেউ কেউ ইসলামি খিলাফাতের বিরুদ্ধে লড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আবু বকর (রা) এর একের পর এক দূরদর্শী পদক্ষেপ তাদের সকল প্রচেষ্টা পণ্ড করে দেয়। কাইস ইবনু মাকশুহ নামে এক ব্যক্তি আসওয়াদ আনাসির মৃত্যুর পর তার অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালায়। সে অল্প সময়ের মধ্যে অনেককে একত্র করে সানআর একাংশে নিজের আস্তানা গাড়ে। আবু বকর (রা) তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পেরে তাহির ইবনু আবি হালা ও মাসরুক আল আককিকে নির্দেশ দেন তারা যেন কাইসকে দমন করেন। এই দুজন একটি বাহিনী গঠন করে কাইসের মুখোমুখি হন। তীব্র যুদ্ধে কাইস পরাজিত

[১১] সুওয়ারুম মিন জিহাদিস সাহাবাহ, ২১১-২১৮।

[১২] বেশকিছু বর্ণনা থেকে জানা যায় নবিজির ইন্তেকালের এক দিন বা এক রাত আগে আসওয়াদ আনাসিকে হত্যা করা হয়। দেখুন, তারিখুত তাবারি, ৩/১৯৮। [১৩] তারিখুত তাবারি, ৩/২৪০।

হয়। এক পর্যায়ে সে সানআ শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর আর আসওয়াদ আনাসির অনুসারীরা কোথাও মাথাচাড়া দিতে পারেনি। তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কোনো রকম প্রাণ রক্ষা করে। অনেকে আবার ইসলাম গ্রহণ করে।


মুসাইলামাতুল কাজ্জাব

নবিজির ইন্তেকালের পর পর যে কয়টি ফিতনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল মুসলিম বিশ্বকে তার একটি ছিল রিদ্দাহ বা ধর্মত্যাগের ফিতনা, যার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল মুসাইলামা কাজ্জাবের হাতে। মুসাইলামার জন্ম জাহিলি যুগে, ইয়ামামা অঞ্চলের বনু হানিফা গোত্রে। যুবক বয়সে সে বিভিন্ন এলাকা সফর করে। এ সময় ভাগ্য গণনা, জাদুবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়গুলো রপ্ত করে সে। সাধারণত অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখানোর প্রতি ঝোঁক ছিল তার। প্রায়ই লোকজনকে মুগ্ধ করতে সে পাখির ডানা ভাঙা খেলা দেখাতো।

এই খেলার জন্য একটি পাখি ধরে আনা হতো। তারপর জাদুর মাধ্যমে মুসাইলামা দর্শকদের চোখে বিভ্রম সৃষ্টি করত। ফলে দর্শকরা দেখত পাখির ডানা ভেঙে গেছে। আবার একটু পরে দেখা যেত পাখির ডানা আগের মতোই আছে। দর্শকরা এতে খুবই অবাক হতো। তারা ভাবত মুসাইলামা নিজের ক্ষমতাবলে পাখির ডানা ভেঙে আবার জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে। মূলত এসবই ছিল জাদুর খেল।

এসব জাদুর খেল দেখিয়ে মুসাইলামা বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইয়ামামাতে লোকজন তাকে আর রহমান নামে চিনত তখন। খ্যাতি ও প্রসিদ্ধির নানা বিপদ আছে। অনেক সময় খ্যাতি মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। মুসাইলামার ক্ষেত্রেও তাই হলো। মুসাইলামা নিজের খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে নবুওতের দাবি করে বসে। নবুওত প্রমাণের জন্য দেখাতে থাকে জাদুর খেল। অল্পদিনে তার কিছু অনুসারী জুটে যায়। ইয়ামামার লোকজন তখনো স্থির কোনো ধর্ম বিশ্বাস লালন করত না, ফলে মুসাইলামার জন্য নিজের মতবাদ প্রচার করা সহজ হয়। বেশ কিছু বর্ণনা থেকে জানা যায়, মুসাইলামার নবুওতের দাবি প্রচারের সময় নবিজি মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তিনিও তখন নবুওত লাভ করেছেন। মক্কার আশপাশে তার নবুওতের সংবাদও ছড়িয়ে পড়ে। মুসাইলামার কানেও এই সংবাদ আসে। বিষয়টি যাচাই করতে নিজের দুই সহচরকে মক্কায় পাঠায় সে। দুই সহচর মক্কায় এসে কুরআনের কিছু আয়াত শুনে যায়। মুসাইলামা তাদের কাছে এসব আয়াত শুনে কিছু পরিবর্তন করে তা নিজের উপর অবতীর্ণ অহি বলে দাবি করে তার অনুসারীদের কাছে।

ইসলাম গ্রহণের আগে আমর ইবনুল আস একবার ইয়ামামা যান, সেখানে তিনি মুসাইলামার কীর্তিকলাপ শুনেন। কৌতূহল থেকে তিনি মুসাইলামার উপর অবতীর্ণ কিছু কালাম শুনতে চান। মুসাইলামার অনুসারীরা তাকে কিছু জিনিস পড়ে শোনায়। শুনে তিনি মন্তব্য করেন, আল্লাহর কসম আমি জানি এই লোক মিথ্যা দাবি করছে। ইবনু কাসীর রহিমাহুল্লাহ এই ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, এ থেকে বুঝা যায় মুসাইলামার সেসকল বানোয়াট কথাবার্তার মান এতই খারাপ ছিল যে, আমর ইবনুল আস সে সময় অমুসলিম ও নবিজির শত্রু হওয়া সত্ত্বেও তার কথা অবিশ্বাস করেছিলেন। ১

নবম হিজরির মধ্যে পুরো আরব উপত্যকায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বনু হানিফা গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল নবিজির সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে। এই দলে মুসাইলামাও ছিল। নবিজি তাদের সাথে সাক্ষাতের সময় নবিজির হাতে একটি খেজুরের ডাল ছিল। এ সময় মুসাইলামা তাকে নবুওতের স্থলাভিষিক্ত করার অনুরোধ করে। তখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুরের ডালের দিকে ইশারা করে বলেন,

لو سألتني هذا القضيب ما أعطيتكه، وإنّي لأراك الذي أريث فيه ما أريث، وهذا ثابت بن قيس، وسيجيبك عنّي

[১৪] আল বাদউ ওয়াত তারিখ, ১/৭১। [১৫] তাফসিরে ইবনু কাসীর, ৪/৫৪৭।


তুমি যদি এই শুকনো খেজুরের ডালটিও চাও তাহলে আমি তাও দেবো না। স্বপ্নে আমাকে যেমন দেখানো হয়েছে আমি তোমাকে ঠিক তেমনই দেখেছি। এরপর নবিজি সেখানে উপস্থিত সাহাবি সাবিত ইবনু কায়সের দিকে ইশারা করে বলেন, সে আমার পক্ষ থেকে তোমার জবাব দেবে। এরপর নবিজি সেখান থেকে চলে যান। ১৬।

মদিনা থেকে ফেরার আগে নবিজি প্রতিনিধিদলের জন্য ভাতা নির্ধারন করেছিলেন। মুসাইলামার জন্য ভাতা নির্ধারনের সময় তিনি বলেন, সেই তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট নয়। এর অর্থ ছিল, নবিজি প্রতিনিধিদলের সবাইকে নিকৃষ্ট বলছিলেন।

মদিনা থেকে ফিরে গিয়ে মুসাইলামা জোরেশোরে নবুওতের দাবি করতে থাকে। এর আগে তার দাবি অনুসারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার সে সর্বত্র নিজের মতবাদ প্রচার করতে থাকে। সে নিজেকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওতে অংশীদার দাবি করে। বিশেষ করে নবিজির ভাতা নির্ধারনের সময়কার বক্তব্যকে সে নিজের পক্ষে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে। অথচ এই কথা কোনোভাবেই তার পক্ষে হতে পারে না।

তবু বনু হানিফার লোকদের মধ্যে গোত্রপ্রীতি ছিল প্রবল। তারা চাইত কুরাইশের পরিবর্তে তাদের মধ্য থেকেই কেউ নবি হোক। এ জন্য তাদের বেশিরভাগ মুসাইলামাকে নবি মেনে নেয়। ইসলামের সত্যতা তাদের সামনে স্পষ্ট হওয়ার পরেও শুধু গোত্রপ্রীতির কারণেই তারা এমন সিদ্ধান্ত নেয়। মুসাইলামা নিজের নবুওতের প্রমাণ দিতে একের পর এক কাব্যিক কথাবার্তা বানিয়ে এগুলোকে অহি হিসেবে প্রচার করে। নিজের মনমতো নানা আইন কানুন বানাতে থাকে। মুসাইলামার বানানো বেশকিছু কথাবার্তা ইতিহাসের বইপত্রে সংরক্ষিত আছে। তার দাবি ছিল এই কথাবার্তাগুলো তার উপর অবতীর্ণ হয়েছে। এগুলো বেশিরভাগই ছিল হাস্যকর ও নির্বুদ্ধিতার স্মারক। তার কথিত একটি অহিতে দেখা যায় একটি ব্যাঙের জীবনী তুলে ধরা হয়েছে। যদিও সে নিজেকে নবি দাবি করত কিন্তু সাহিত্য সমালোচকরা তার কথিত আসমানি বার্তাগুলো বিশ্লেষণ করে তাকে একজন তৃতীয় শ্রেণির কবি বলেছেন। কাজি আবু বকর বাকিল্লানি

[১৬] বুখারি, ৪৩৭৮। মুসলিম, ২২৭৩।


বলেন, ইতিহাসগ্রন্থে মুসাইলামার কিছু আবোল-তাবোল কথাবার্তা স্থান পেলেও তা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পাঠ উপযোগী নয়। এগুলো কেবল হাসির খোরাক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। আশ্চর্য বিষয় হলো এসব কথাবার্তা দিয়েই সে বিশাল সংখ্যক মানুষকে বিপথগামী করেছিল। এ থেকে বোঝা যায় পৃথিবীতে কত বোকা ও অজ্ঞ মানুষ রয়েছে। মূলত মুসাইলামার এসব দূর্বলতা তার স্বজাতির কাছেও স্পষ্ট ছিল, কিন্তু গোত্রপ্রীতির কারণে তারা তাকে ত্যাগ করেনি।

দশম হিজরিতে ইন্তেকালের আগে নবিজি কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। সে সময় মুসাইলামা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। তার দুঃসাহস এতটাই বেড়ে যায় যে, সে নবিজির কাছে একটি পত্র পাঠিয়ে নিজেকে নবুওতের অংশীদার দাবি করে। আমর ইবনু যারুদ হানাফি নামে এক ব্যক্তি মুসালাইমার পক্ষে চিঠিটি লেখে, যা ইবনুন নাওয়াহা নামে আরেকজন মদিনায় নিয়ে আসে। চিঠির বক্তব্য ছিল,

'এই চিঠি আল্লাহর রাসুল মুসাইলামার পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদের নিকট। পর সমাচার, নবুওতের বিষয়ে আমাকে আপনার অংশীদার করা হয়েছে। সুতরাং রাজত্বের অর্ধেক থাকবে আমার অধীনে, অর্ধেক কুরাইশের অধীনে, কিন্তু কুরাইশ তো ন্যায়বিচার করছে না।

নবিজি এই পত্র পাঠ করে মুসাইলামার দূত ইবনুন নাওয়াহাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই বিষয়ে তোমরা কী বলো, সে জবাব দেয়, মুসাইলামা যা বলে আমরা তা বলি। নবিজি তখন বলেছিলেন,

أما والله لولا أنّ الرسل لا تقتل لضربت أعناقكما আল্লাহর কসম, যদি দূত হত্যার বিধান থাকত, তাহলে আমি তোমাদের হত্যা করতাম। ১৮।

এরপর নবিজি জবাবি পত্র লেখার নির্দশ দেন উবাই ইবনু কাব্য (রা) কে। সেই পত্রের ভাষ্য ছিল,

'পরম দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহর নামে। আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে

[১৭] ইজাযুল কোরআন, ১৫৬। [১৮] সুনানু আবি দাউদ, ২৭৬১, সহিহ।

মিথ্যুক মুসাইলামার প্রতি। যে হিদায়াত অবলম্বন করে তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। রাজত্বের মূল মালিক আল্লাহ তাআলা, নিজের বান্দাদের মধ্যে যাকে চান তাকে তিনি তা দান করেন। পরকালের শুভ পরিণতি শুধু মুত্তাকীদের জন্যই নির্ধারিত।

নবিজি এই পত্র নিয়ে হাবিব ইবনু যায়েদ (রা)-কে ইয়ামামা পাঠান। যদিও নবিজি মুসাইলামার দূতকে হত্যা করেননি, কিন্তু মুসাইলামার কাছ থেকেও একই আচরণ আশা করার উপায় ছিল না। এটা জানা কথা, এই যাত্রা কঠিন হতে পারে। মুসাইলামা ক্ষিপ্ত হয়ে নবিজির দূতকে কোনো শাস্তিও দিতে পারে। তবে হাবিব ইবনু যায়দ (রা) এসব নিয়ে মাথা ঘামালেন না। নবিজির আদেশ রক্ষাই তার সামনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি নবিজির পত্র নিয়ে উপস্থিত হলেন মুসাইলামার দরবারে। পত্র পাঠ করে মুসাইলামা জিজ্ঞেস করে, তুমি কি সাক্ষী দাও, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল? হাবিব (রা) জবাব দিলেন, হ্যা। মুসাইলামা জিজ্ঞেস করে, তুমি কি সাক্ষী দাও, আমি আল্লাহর রাসুল? হাবিব (রা) বলেন, আমি বধির, তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না। মুসাইলামা এই প্রশ্ন কয়েকবার করে। হাবিব (রা) একই জবাব দেন। এতে মুসাইলামা প্রচণ্ড খেপে যায়।

জল্লাদকে ডেকে সে নির্দেশ দেয়, হাবিব (রা) যদি আবারও তার প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান তাহলে তার শরীরের একটি একটি করে অঙ্গ কেটে ফেলতে। জল্লাদ ধারালো তরবারি নিয়ে আসে। মুসাইলামা আগের প্রশ্ন আবার করে। হাবিব (রা) আবারও এড়িয়ে যান। এবার জল্লাদ তার একটি একটি করে অঙ্গ কাটতে থাকে। এ অবস্থায় হাবিব (রা) ইন্তেকাল করেন, কিন্তু ইন্তেকালের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিজের আকিদা বিশ্বাসে দৃঢ় ছিলেন।

মুসাইলামার গল্প বলতে গেলে আসে রাজ্জাল ইবনু উনফুয়ার নামও। সে ছিল বনু হানিফার আরেক উচ্ছৃঙ্খল সদস্য। স্বভাব চরিত্রের কুটিলতায় সে সম্ভবত মুসাইলামাকেও হার মানিয়েছিল। রাজ্জালের শুরুটা কিন্তু ছিল ঈর্ষনীয়। সে মদিনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে এবং কুরআনের বেশ কিছু আয়াত মুখস্থ করে। এ সময় সে মুসলিম সমাজে নিজেকে আস্থাবান করে তোলে। নবিজি তাকে নির্দেশ দেন ইয়ামামা গিয়ে মানুষের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতে, এবং তাদেরকে মুসাইলামার অনুসরণ থেকে বিরত রাখতে। রাজ্জাল এই দায়িত্ব নিয়ে ইয়ামামা এসেই সুর বদলে ফেলে। সে সবাইকে বলে বেড়ায় মদিনা থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী নিয়ে এসেছি। তিনি মুসাইলামাকে নিজের নবুওতের অংশীদার মেনে নিয়েছেন। এই নিকৃষ্ট মিথ্যাচারের ফলে নতুন করে অনেকে মুসাইলামার অনুসারী হয়। ১৯৪

তবে ধর্মত্যাগের এই রমরমা অবস্থাতেও অনেকে নিজের ঈমান আকিদার উপর অটল ছিলেন। এমন একজন ছিলেন সুমামাহ (রা)। তিনি বনু হানিফা গোত্রের একজন সর্দার ছিলেন। মুসাইলামার বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে কথা বলতেন। মুসাইলামার অনুসারীদের তিরস্কার করে তিনি বলতেন, তোমাদের দুর্ভোগ হোক বনু হানিফার লোকজন। আমি যা বলি তা শোনো, তাহলে হয়তো হিদায়াত পাবে। আমাকে অনুসরণ কর, আমি তোমাদের ব্যাপারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব। জেনে রাখ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসুল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মুসাইলামা মিথ্যুক এতেও কোনো সন্দেহ নেই। তার কথা শুনে ধোঁকা খেয়ো না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবি, তার পরে আর কোনো নবি নেই। ২০

সুমামাহর ঈমানদীপ্ত বক্তব্য শুনে তার অধীনস্থ অনেকে তাকে অনুসরণ করে। তারা বলে, আমরা আপনার সাথে আছি। সত্য জানার জন্য আমরা আপনাকে চাই। সুমামাহ তার অনুসারীদের নিয়ে পরে মুসাইলামার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।

এমনই আরেকজন মুমিন ছিলেন মামার ইবনু কিলাব রুন্মানি। তিনি সুমামাহর প্রতিবেশী ছিলেন। তিনিও মুসাইলামার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করেন। রিদ্দাহর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আবু বকর (রা) এমন অনেককে পুরস্কৃত করেছিলেন যারা বনু হানিফার সদস্য হয়েও মুসাইলামার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। এসব থেকে বুঝা যায় বনু হানিফার সবাই মুসাইলামার পক্ষ নেয়নি। সেখানে স্বল্পসংখ্যক দৃঢ়চেতা ঈমানদারও ছিলেন।

[১৯] তারিখুত তাবারি, ৩/৩৮৩। [২০] হুরুবুর রিদ্দাহ, ১১৭।

[২১] আস সাবিনা আলাল ইসলাম, ৫২।

[২২] প্রাগুক্ত, ৫৮।

নবিজির কাছে মুসাইলামার পত্র এসেছিল নবিজির মৃত্যুশয্যায়, ফলে সে সময় নবিজি তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। আবু বকর (রা) যখন খলিফা হন তখন তিনি এসব ফিতনার মূলোৎপাটনের সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় আরও কয়েকজন মিথ্যা নবুওতের দাবি করেছিল। এদের মধ্যে আসওয়াদ আনাসি, তুলাইহা আসাদি ও মালিক ইবনু নুওয়াইরাহ উল্লেখযোগ্য। আবু বকর (রা) প্রথমে তাদেরকে দমন করতে খালিদ (রা)-কে সেনাবাহিনী সহ পাঠান। খালিদ (রা) একের পর এক যুদ্ধে এসব ফিতনা দমন করে কিছুটা থিতু হন। আবু বকর (রা) এক পত্রে তাকে বিজয়ের অভিনন্দন জানান, এবং তার বীরত্ব, সাহস ও যুদ্ধকৌশলের প্রশংসা করেন। এরপর তিনি বলেন,

এবার তুমি ইয়ামামার দিকে যাও। তোমার সঙ্গী মুসলমানদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। ভয় করবে শুধু আল্লাহকে, তার কোনো শরিক নেই। এবার তুমি বনু হানিফার দিকে যাও। মনে রাখবে তাদের এলাকা অনেক বিস্তৃত। তারা সবাই তোমার শত্রু। যুদ্ধের ময়দানে তোমার ডানে বামে প্রহরী নিযুক্ত করবে। প্রবীণ ও বৃদ্ধ মুহাজিরদের থেকে পরামর্শ নেবে। তাদের মধ্যে হত্যার বিভীষিকা ছড়িয়ে দাও। যুদ্ধবন্দিদের হত্যা করো। আমার আদেশের অন্যথা করবে না।

খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা) পত্র পাঠ করে তাতে চুমু খেয়ে বলেন, আমি শুনলাম এবং পালন করার নিয়ত করলাম।

খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তার বাহিনী নিয়ে ইয়ামামার দিকে অগ্রসর হন। একই সময়ে আবু বকর (রা) হযরত খালিদ (রা)-এর সাহায্যে একটি বিশাল বাহিনী পাঠান। এই বাহিনীর কাজ ছিল খালিদের বাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যেকোন ধরনের আক্রমণ ঠেকিয়ে দেয়া। ইয়ামামার পথে খালিদ (রা) অনেকগুলো মুরতাদ সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হন। তিনি তাদের সবার সাথে লড়াই করেন। প্রতিটি গোত্র নির্মম পরাজয় বরণ করেন। যুদ্ধশেষে এসব গোত্রের বেশিরভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়, তবে কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করার কারণে নিরাপত্তা পায়।

ইয়ামামার পথে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা) বেশকিছু যুদ্ধে জড়ালেও তিনি অনর্থক সময় নষ্ট করেননি। তার মূল টার্গেট ছিল দ্রুত ইয়ামামা পৌঁছে মুসাইলামাকে দমন করা। মুসাইলামা কানে পৌঁছে যায় খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এর আগমনের সংবাদ। সে তার বাহিনী নিয়ে ইয়ামামার প্রান্তসীমায় আকরিবা নামক এলাকায় শিবির স্থাপন করে। এসময় সে তার সেনাদের যুদ্ধের জন্য উজ্জীবিত করতে থাকে। সে তাদেরকে কল্পিত স্বর্গের কথা বলে এবং নানা ধরনের মিথ্যা আশ্বাস দেয়। মুসাইলামা ডান বাহিনীর সেনাপতি ছিল মুরতাদ রাজ্জাল। ডান বাহিনীর দায়িত্ব ছিল মুহকাম ইবনু তুফাইল।

এদিকে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা) ইকরিমা (রা) ও শুরাহবিল (রা) এর সাথে মিলিত হন। তারপর তারা সম্মিলিতভাবে ইয়ামামার দিকে অগ্রসর হন। ইয়ামামার প্রবেশের আগে তারা বনু হানিফার ৪০ জন অশ্বারোহীর সন্ধান পান। খালিদ (রা) কৌশলে তাদেরকে বন্দি করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা সবাই মুসাইলামাকে নবি মেনে নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে। খালিদ (রা) তখন তাদের সবাইকে হত্যা করেন। অবশ্য এক বর্ণনা থেকে জানা যায় তিনি দলনেতা কে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

মুসাইলামা সৈন্য-সংখ্যা প্রচুর ছিল, অস্ত্রশস্ত্র কমতি ছিল না। তবে তাদের মনোবল তখন কিছুটা দুর্বল ছিল। কারণ, তারা ভালো করেই জানত যুদ্ধ শুরু হলে বাহির থেকে তারা কোনো সাহায্য পাবে না। অপরদিকে মুসলিম বাহিনী মদিনা থেকে নিয়মিত সাহায্য পাবে। ইয়ামামার বিস্তৃত এলাকার বাইরে পুরো এলাকায় মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে যুদ্ধে পরাজিত হলে তারা পালিয়ে কোথাও যেতেও পারবে না। এই বিষয়গুলো চিন্তা করে মুসাইলামার সেনাদের মনোবল কিছুটা ভেঙে পড়েছিল। মুসাইলামা বিষয়টি টের পেয়ে নানাভাবে তাদেরকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে।

মুসলিম সেনারা ছিলেন জিহাদের চেতনায় উজ্জীবিত, তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল শাহাদাত অৰ্জন৷ তাদের মনে কোনো ভয়, দ্বিধা কিংবা সংশয় ছিল না। তারা বিশ্বাস করতেন এই যুদ্ধে তারা অবশ্যই বিজয়ী হবেন। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করবেন। তারা বনু হানিফার মতো গোত্র প্রেমের কারণে লড়াই করেছিলেন না, বরং তাদের লড়াইয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন৷ যুদ্ধ শুরুর আগে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা) শেষবারের মতো মুসাইলামার সেনাপতিদের সাথে পত্র যোগাযোগ করেন। এসব পত্রে তিনি তাদেরকে ইসলামে ফিরে আসতে আহ্ববান করেন। মূলত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাদের মনোবল ভেঙে ফেলা। এ সময় সুমামাহ (রা) এর সাথে খালিদ (রা) এর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সুমামাহ তার গোত্রকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালান। তিনি স্বজাতির মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য বলেন, এবারের যুদ্ধে তোমাদের মোকাবেলা করতে আসছে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা)। তাকে বলা হয় আল্লাহর তরবারি। তোমরা একটু চিন্তা করে দেখো এখন তোমাদের কি করা উচিত। তোমরা কি আসলেই তার সাথে লড়াই করে পারবে। সুমামাহর এসব বক্তব্যে অনেকের মনোবল ভেঙে যায়। যারা দোদুল্যমান ছিল তারা ইসলামে ফিরে আসে।

এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা)-এর বাহিনী মুসাইলামার বাহিনীর মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ শুরুর আগে মুসাইলামা তার বাহিনীর উদ্দেশে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়। সেখানে সে বলে, আজ তোমাদের মর্যাদা রক্ষার দিন। আজ তোমরা হেরে গেলে তোমাদের মহিলাদের বন্দি করা হবে। শত্রুরা তাদেরকে বিবাহ করবে। সুতরাং তোমরা বংশ মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াই করো এবং নিজেদের স্ত্রীদের রক্ষা করো।

যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে দুই বাহিনী একে অপরের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কায় মুসাইলামার বাহিনী এগিয়ে যায় এমনকি বনু হানিফার অনেক সেনা খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা) এর তাবু পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তবে এটি ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। মুসলমানরা দ্রুত পালটা আঘাত হানেন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন মুসাইলামার বাহিনীর উপর। এ দিনের যুদ্ধে সাহাবিরা অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন৷ সাবিত ইবনু কায়স সাহসিকতার সাথে লড়াই করে শহীদ হন। আবু হুজাইফা নামে একজন একাই শত্রুবাহিনীর রক্ষণব্যুহ ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি শহীদ হন।

তীব্র যুদ্ধে মুসাইলামা অনুভব করে ক্রমেই তার সেনারা পিছু হটছে। তাদের মনোবল ভেঙে পড়ছে। পরিস্থিতি অনুভব করে সে তার সেনাদের নিয়ে প্রাচীরবেষ্টিত একটি বাগানে প্রবেশ করে। পরে এই বাগান প্রসিদ্ধ হয়েছিল মৃত্যুর বাগিচা নামে। মুসাইলামার সেনারা এই বাগানে প্রবেশ করে ফটক আটকে দেয়। বাহ্যত মুসলমানদের বাগানে প্রবেশ করার আর কোন পথ রইল না। বাধ্য হয়ে মুসলমানরা বাগানকে চারদিক থেকে অবরোধ করে।


এই যুদ্ধের সময় মুসলিম শিবিরে অবস্থান করছিলেন সাহসী সাহাবি বারা ইবনু মালিক। তিনি মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা আমাকে উঁচু করে বাগানের মধ্যে ফেলে দাও। আমি একা বাগানে প্রবেশ করে ফটক খুলে দেবো। কার্যত এটি ছিল একটি দুঃসাহসী পরিকল্পনা, যেখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল শতভাগ। হাজার হাজার শত্রু সৈন্য পরিবেষ্টিত বাগানে একা প্রবেশ করার পরিণাম কল্পনা করলে যে কেউ শিউরে উঠতে বাধ্য। শুরুর দিকে মুসলিম সেনারা বারা ইবনু মালিক এর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু তিনি নিজের দাবিতে অটল থাকেন। বারবার তিনি মুসলিম সেনাদেরকে অনুরোধ করেন তাকে যেন বাগানের ভেতরে পাঠানো হয়।

মুসলিম সেনারা বারা ইবনু মালিক কে উপরে তুলে ধরে, তিনি লাফিয়ে বাগানের ভেতরে প্রবেশ করেন। মুসাইলামার সৈন্যরা কিছু বুঝে উঠার আগেই বারা ইবনু মালিক বাগানের ভেতরে প্রবেশ করেন। অস্বাভাবিক দ্রুততায় তিনি ফটকের দিকে ছুটে যান এবং ফটক খুলে দেন। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো বাগানের ভেতরে প্রবেশ করে মুসলিম সেনারা। মুসাইলামার সৈন্যদের তখন আর কিছুই করার ছিল না। তারা হতাশ চোখে দেখছিল পিলপিল করে বাগানে প্রবেশ করছে তাদের মৃত্যুদূতা

মুসলিম সেনারা বাগানে প্রবেশ করেই মুসাইলামার সেনাদের কচুকাটা করতে থাকে। মুসাইলামা কোনোমতে পালিয়ে একটি ভগ্ন দেয়ালের পাশে আশ্রয় নেয়। তার মুখ দিয়ে তখন ফেনা বের হচ্ছিল। চেহারায় ফুটে উঠেছিল যুদ্ধের ক্লান্তি। সে বুঝতে পারছিল এই যুদ্ধে জয়ের কোনো আশা নেই। আপাতত কোনোভাবে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। কিন্তু কীভাবে পালাবে তা নিয়ে ভাবছিল সে। ইতিমধ্যে ওয়াহশি ইবনুল হারব (রা) তাকে দেখে ফেলেন। ওয়াহশি একজন দক্ষ বর্শা নিক্ষেপকারী ছিলেন। তিনি দূর থেকে বর্শা নিক্ষেপ করলে তা মুসাইলামার দেহ ভেদ করে পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। তবে শারীরিকভাবে শক্তিশালী মুসাইলামা তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। এ অবস্থা দেখে সিমাক ইবনু খারাশা দ্রুত সামনে এগিয়ে তরবারি দিয়ে মুসাইলামার উপর আঘাত হানেন। মুসাইলামা মাটি পড়ে যায়। তখনই মৃত্যু ঘটে তার। এ দৃশ্য দেখে মুসাইলামার অনুসারী এক মহিলা চিৎকার করে বলতে থাকে, হায় মুমিনদের নেতা, তাকে এক সামান্য ক্রীতদাস হত্যা করেছে।

মুসাইলামার মৃত্যুতে তার অনুসারীদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। তারা আর লড়তে পারছিল না। মুসাইলামার অন্তত দশ হাজার সেনা মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। এ জন্য পরে এই বাগানের নাম দেয়া হয় মৃত্যুর বাগিচা। মুসলমানদের মধ্যে নিহতের সংখ্যা ছিল ৫/৬০০। তবে শহীদদের অনেকেই ছিলেন শীর্ষ সাহাবি।

পুরো বাগানের নিয়ন্ত্রণ আসার পর খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা) নিজে মুসাইলামার লাশ শনাক্ত করেন। সে সময় তিনি মুসাইলামার বন্দি এক অনুসারীকে লক্ষ্য করে বলেন এই ব্যক্তির জন্য তোমরা আজ লাঞ্ছিত হলে।

মুসাইলামার পরাজয়ের সংবাদ পৌঁছে যায় মদিনায়। শুকরিয়া আদায় করেন খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা)। তবে এ যুদ্ধে মুসলমানদের বেশ মূল্য চুকাতে হয়েছিল। এই যুদ্ধে শহীদ হন সাবিত ইবনু কাইস ইবনু শাম্মাস, যায়েদ ইবনু খাত্তাব, মাআন ইবনু আদি আল বালওয়াবি, আবদুল্লাহ ইবনু সুহাইল ইবনু আমর, আবু দুজানা সিমাক ইবনু খারাসাহ, আবাদ ইবনু বিশর ইবনু ওরাকাশ আল আনসারি, তুফাইল ইবনু আমর দাউসি আজদি প্রমুখ সাহাবিগণ। বিশেষ করে এই যুদ্ধে অনেক হাফেজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেন যে কারণে কুরআন সংকলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।


আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন। We Respect Every Author Hardwork-boipaw ™

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ