মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের ইতিহাস - Muslimder Parossho Bijoyer Itihas - Enamul Karim Imam Books

মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের ইতিহাস (pdf link short) ⤵️
লেখক : এনামুল করীম ইমাম
প্রকাশনী : মুহাম্মদ পাবলিকেশন
বিষয় : ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
সম্পাদক : মাহদি হাসান, মুহাম্মদ পাবলিকেশন সম্পাদনা পর্ষদ
পৃষ্ঠা : 256, কভার : পেপার ব্যাক
ভাষা : বাংলা
Image

মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের ইতিহাস এর বর্ণনা.....
আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের ইতিহাস কোনটি?

তাহলে আমি নির্দ্বিধায় বলবো-

‘পারস্য বিজয়।’

—মুসলিম দার্শনিক ও কবি আল্লামা ইকবাল

পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া যে সকল ঘটনা ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করেছে, মুসলিমদের পারস্য বিজয় তন্মধ্যে অন্যতম। এ বিজয়ের মাধ্যমে সমগ্র ইরাক অঞ্চলের ওপর মুসলিমদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পারস্য ও রোম বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন—

وَلَيَفْتَحَنَّ كُنُوزَ كِسْرَى بْنِ هُرْمُزَ

‘এরাই (আমার সাহাবিরা) একদিন পারস্য সম্রাট কিসরা ইবনে হুরমুজের ধনভান্ডার জয় করবে।’

কীভাবে, কখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ভাবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন হয়েছিল; ‘মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের ইতিহাস’ তারই গ্রন্থিত রূপ।

মহান আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল পাঠিয়েছেন। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটিই ছিল বাস্তবতার দাবি। আমাদের প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সুমহান ধারার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ও রাসুল। নবি-রাসুল প্রেরণের সাধারণ উদ্দেশ্য দাওয়াত ও হিদায়াত। তবে এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন মানবজাতির জন্য বিশেষ আশীর্বাদ ও উপহার। আল কুরআনের ঘোষণা—

وما أرسلناك إلا رحمة للعالمين

আমি আপনাকে কেবল রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি। [সূরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭]

এজন্য নবিজি রহমত ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন সর্বক্ষণ। পৃথিবীর বুকে তিনি শান্তিপূর্ণ একটি পরিবেশ কামনা করতেন। এ কারণে তিনি সবসময়—

শত কষ্টেও ক্রুদ্ধ ও কঠোর হতেন না।

কঠোরতার বিপরীতে কোমল আচরণ করতেন।

অত্যাচারের বিপরীতে ভালোবাসা দিতেন।

গালির পরিবর্তে করতেন সুমধুর ব্যবহার।

তিনি কারো ওপর রাগ হতেন না। আর কষ্ট দেওয়ার কথা তো কল্পনাই করা যায় না। অপরাধীকে ক্ষমা করা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস যার জীবন্ত সাক্ষী। দেখতে চান? চলুন, তাহলে ঘুরে আসি তায়েফ (১) থেকে। নিজ চোখে দেখে আসি ঐতিহাসিক ক্ষমার অপূর্ব দৃশ্যাবলি—

[১] মক্কা থেকে ৪০ মাইল দূরে অবস্থিত সবুজ-সতেজ ও শস্য-শ্যামল একটি শহরের নাম তায়েফ। কুরাইশদের

পর আরবের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্প্রদায় ছিল বনু সাকিফ গোত্র। তারা এ তায়েফেই বাস করতো। (মুজামুল

বিপদ আসে দলবেঁধে। চাচা আবু তালিব” ইনতিকাল করেছেন। এর মাত্র তিন, পাঁচ কিংবা আরও কিছুদিন পর, তবে ঐ বছরই ইনতিকাল করেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা।[] নবিজির প্রাণের প্রিয়তমা। ভীষণভাবে ব্যথিত হলেন তিনি। কাফেররা দেখল, এই তো সুযোগ। মানসিকভাবে শেষ করতে হবে তাঁকে।

যেই ভাবা সেই কাজ। নবিজির সঙ্গে মারাত্মক অশোভনীয় আচরণ শুরু করে দেয় ওরা। আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায় ওদের হিংস্রতা। এমনকি, কখনও কখনও তাঁর মাথার ওপর মাটি পর্যন্ত ছুড়ে মেরেছে ঐ বদমাশরা। একদিন এমনই একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ধুলোবালিতে মলিন হয়ে যায় নবিজির মাথা ও পবিত্র শরীর।

আরবের কুরাইশ বংশ ছিল ভীষণ শক্তিশালী। তাহলে তাদের পরে কে? হ্যাঁ, তৎকালীন আরবে কুরাইশদের পরে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী ছিল তায়েফের বনু সাকিফ গোত্র। নবিজি ভাবলেন, তায়েফবাসী হয়তো মহান আল্লাহর দিকে ফিরবে। এগিয়ে আসবে তাঁর দ্বীনের সাহায্যে।

এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করলেন নবিজি। তাঁর পালক পুত্র ও বিশিষ্ট সাহাবি ছিলেন জায়েদ ইবনু হারিসা রাদিয়াল্লাহু আনহু। নবুয়তের দশম বছর ২৬ অথবা ২৭ শাওয়াল নবিজি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন তায়েফ সফরে। বনু সাকিফে তিন ব্যক্তি ছিলেন খুবই সম্মানী : আবদে ইয়ালিল, মাসউদ ও হাবিব।

এ তিনজন ছিলেন সহোদর। এদের পিতার নাম আমর ইবনু উমায়ের ইবনু আউফ। তাদের একজন বিবাহ করেন কুরাইশদের বনু জুমাহ গোত্রের এক মহিলাকে। সেই সূত্রে নবিজি তাদের আত্মীয়ও ছিলেন। যাহোক, তায়েফ গিয়ে তিনি এ তিনজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। দাওয়াত দিলেন আল্লাহ তাআলার পথে। দ্বীনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানালেন তাদের।

সবকিছুর মালিক আল্লাহ। ইসলামের সুমহান এই দাওয়াত কবুল করলো না ওরা। উলটো তাঁর সঙ্গে করলো খুবই রূঢ় আচরণ। মারাত্মক ধৃষ্টতা দেখালো ইসলামের বিরুদ্ধে। ঐ সময় কিছু গোলাম-বাঁদি ছিল ভীষণ মূর্খ-অসভ্য। ওদেরকে তাঁর পেছনে লেলিয়ে দিল ওরা।

বুলদান লি-হামাবি: ৪/৮-১২) সারাওয়াত পর্বতমালার অন্তর্ভুক্ত হেজাজ পর্বত রেঞ্জের চূড়ায় এ শহরটি সমতলভূমি থেকে ১৮৭৯ মিটার (৬১৩৫ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত। একে সরকারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানীও বলা হয়।

[২] আবু তালিবের মূল নাম ছিল 'ইমরান'। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৮৫ বছর।—সিরাতুন নবি [আল্লামা শিবলি নুমানি] : ২৪৯; তারিখুল ইসলাম [শাহ আকবার খান নজিবাবাদি] : ১/১২০। [৩] মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। নবিজির বয়স তখন ৫০ বছর। —সিরাতে ইবনু হিশাম : ১/৪১৫-১৬; তালকিছ ফুহুমি আহলিল আসার ০৭; রাহমাতুল্লিল আলামিন

[ সুলাইমান সালমান মানসুরপুরি] : ২/১৬৪; তারিখুল ইসলাম [শাহ আকবার খান নজিবাবাদি] : ১/১২২।

অসভ্য-মূৰ্খগুলো ছুটতে লাগলো রাহমাতুল্লিল আলামিনের পেছনে পেছনে। নানা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ, চিৎকার-চেঁচামেচি ও শোরগোল করে উদ্ভট পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে লাগলো শয়তানের দল। হতভাগাদের হাততালি, হইহই রইরই, বিকট হাসি ও অট্টনিনাদে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো সারা পথ। এভাবে তাঁর পেছনে জমা হয়ে গেল বহু লোক।

লেলিয়ে দেওয়া পাষণ্ডদের এ দলটি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নিক্ষেপ করতে লাগলো ইট-পাটকেল। যদ্দরুন তাঁর পা মোবারকের নলা জখম হলো এবং সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। যেই পা এই আসমান-জমিনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, সেই পা আল্লাহর শত্রু ও ইসলামের দুশমনদের হাতে আহত, ক্ষত-বিক্ষত। আহ্!

একজন আদ্দাস

পথে ছিল কুরাইশ বংশের দুই ভাই উতবা ও শায়বার] একটি বাগান। কোনো দিশা না পেয়ে নবিজি ঢুকে পড়লেন ঐ বাগানে। তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল লেলিয়ে দেওয়া ঐ পাষণ্ডগুলো।

উতবার দাস আদ্দাস নাসরানি ঐ বাগান দেখাশোনা করতেন। তিনি নবিজিকে আঙুর দিলেন রেকাবি ভরে। নবিজি খুশি হলেন, খাওয়া শুরু করলেন ‘বিসমিল্লাহ' বলে। আদ্দাস বললেন

—আপনি যা বললেন, তা তো এদেশের মানুষ বলে না।

—তুমি কোন দেশের লোক?

—আমি খ্রিষ্টান। আমার বাড়ি নিনুয়া

—তাহলে তুমি তো আমার ভাই ইউনুস আলাইহিস সালামের দেশের লোক।

—আপনি তা কীভাবে জানলেন?

—তিনিও নবি ছিলেন। সুতরাং তিনি আমার ভাই।

এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আদ্দাস ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাত-পা ও শির মোবারকে চুমু খেলেন। বাগানের মালিক উতবা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো

[৪] সিরাতে ইবনু হিশাম: ১/৪১৯; জাদুল মাআদ : ২/৪৬; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ: ২/৫৭৬; সিরাতুন নবি [আল্লামা শিবলি নুমানি] : ২৫০; তারিখুল ইসলাম [শাহ আকবার খান নজিবাবাদি] : ১/১২২। [৫] উতবা ও শায়বার পিতার নাম রবিয়া। কাফির হলেও এরা উদার মনের ছিলেন। বদর যুদ্ধে উত্তরা হামজা ও শায়বা আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে নিহত হয়। [৬] নিনুয়া বর্তমান ইরাকের মসুল শহরের নিকটে অবস্থিত।

তুমি এমনটি করলে কেন?

আদ্দাস রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তর দিলেন—

বর্তমান যুগে সমগ্র বিশ্বে তাঁর চেয়ে ভালো আর কোনো মানুষ নেই। আপনারা তাঁর মর্যাদার ব্যাপারে অবগত নন। নিঃসন্দেহে তিনি আল্লাহর নবি।"]

তায়েফের এ ঘটনাটি ছিল প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম বিপদ। অবসন্ন দেহের কম্পিত হাত তখন উঠে গেল মহামহিমের দরবারে। ব্যথিত হৃদয় থেকে তখন বেরিয়ে এলো করুণ সুর। অত্যন্ত মিনতিভরে তিনি মহান আল্লাহর দরবারে দুআ করলেন—

হে আল্লাহ, একমাত্র তুমিই আমার মালিক। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই। তুমি আমাকে কাদের হাতে সমর্পণ করছো? যারা আমাকে রুক্ষ ও কর্কশ ভাষায় জর্জরিত করছে? তবে তুমি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হয়ে থাকো, তাহলে (এসব বিপদাপদে) আমার কোনো পরোয়া নেই। তোমার সন্তুষ্টিই আমার একমাত্র সম্বল। তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তোমার দরবারে ফরিয়াদ করছি।

হে আল্লাহ! তুমি শক্তি না দিলে সৎকাজ করা এবং পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। [৮]

দুআর পর আল্লাহ তাআলা প্রিয়বন্ধুর খিদমতে ‘মালাকুল জিবাল'কে (পাহাড়ের অধিকর্তা ফেরেশতা) প্রেরণ করলেন। ফেরেশতা এসে বললেন

ذلك فيما شئت، إن شئت أن أطبق عليهم الأخشبين؟

এ ব্যাপারে আপনার আদেশ কী? আপনি যদি চান, তাহলে আখশাবাইন

পাহাড় দুটিকে চাপা দেবো ( ওদের পিষে ফেলবো)।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন—

بل أرجو أن يخرج الله من أصلابهم من يعبد الله وحده، لا يشرك به

[৭] সিরাতে ইবনু হিশাম : ১/৪১৯; জাদুল মাআদ : ২/৪৬; মুখতাসার সিরাতুর রাসুল : ১৪১; রাহমাতুল্লিল আলামিন [সালমান সুলায়মান মনসুরপুরি] : ১/৭১। [৮] তারিখুল উমাম ওয়াল মুলক : ২/২৩০; আস-সিরাতুল হালাবিয়্যা : ১/৩৫৪।

(না, তা হয় না;) বরং আমি চাই, (এরা বেঁচে থাকুক।) মহান আল্লাহ এদের থেকে এমন লোক সৃষ্টি করে দেবেন, যাঁরা এক আল্লাহর ইবাদত করবে। তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরিক করবে না।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগ সংবরণ করেছেন, এর হাজারও প্রমাণ

আমরা পাই হাদিস শরিফে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন—

‘একবার প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে বসেছিলেন। তখন জনৈক বেদুইন এসে মসজিদের মধ্যে পেশাব করতে লাগলো। সাহাবায়ে কিরাম তাকে বারণ করে বলতে লাগলেন, “থামো, থামো'। এ কথা শুনে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন—

لا تزرموه دعوه، ثم دعاه، فقال : إن هذا المسجد لا يصلح لشيء من القذر والبول - إنما هو لقراءة القرآن، وذكر الله، والصلاة.

তাকে বাধা দিয়ো না, পেশাব করতে দাও। এর পর লোকটিকে ডেকে বললেন, দেখো, এই মসজিদগুলো পেশাব-পায়খানা বা ময়লা-আবর্জনা ফেলার জায়গা নয়। এগুলো পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর জিকির ও নামাজ আদায়ের জায়গা। (১০)

শুধু এতটুকু বলেই ছেড়ে দিলেন। আর কিছু বললেন না। আমরা দেখতে পেলাম অপূর্ব

ক্ষমার একটি দৃশ্য।

উহুদ যুদ্ধে প্রথমদিকে মুসলিমদের পাল্লাই ভারী ছিল। এর পর ভুল বোঝাবুঝির কারণে তাদের ওপর নেমে আসে আকস্মিক বিপদ। এ সময় কাফেররা বলতে থাকে—‘এই তো সুযোগ। এবার মুহাম্মাদকে হত্যা করতে না পারলে, আর তাঁকে কিছু করা যাবে না। এজন্য ওরা বারবার তাঁর ওপর আক্রমণ করতে থাকে। নবিজি তাদের আক্রমণ ঠেকিয়ে আত্মরক্ষা করে যান।'

এসময় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর তির, তরবারি ও বর্শার আঘাত আসতে থাকে চারদিক থেকে। এ যেন আঘাতের বৃষ্টি। তিনি বললেন—

কে আছো, আমার জন্য জীবন দিতে পারবে?

তখন জিয়াদ ইবনুস সাকান রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি আছি। এই বলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর ওপর। তাঁর সঙ্গে আরো পাঁচজন (মতান্তরে ছয়জন) আনসার

[৯] সহিহুল বুখারি, হাদিস নং : ৩২৩১ (১/৪৫৮); সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৭৯৫ (২/১০৯)।

[১০] সহিহ ইবনু খুযাইমা, হাদিস নং : ২৯৩।

সাহাবি লড়াই করতে লাগলেন। তাঁরা নবিজির সামনেই জীবন বিলিয়ে দিয়ে জান্নাতের পথে রওনা হলেন।[১] নবিজির পা মোবারকের ওপর শহিদ হন জিয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু।

তির, তরবারি ও বর্শার আঘাত বৃষ্টির মতো আসতে থাকে চারদিক থেকে। তখন আবু দুজানা রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের পিঠকে নবিজির জন্য ঢাল বানিয়ে দেন। সব আঘাত নিজের পিঠে নিতে থাকেন। এতে তাঁর পিঠ চালুনির মতো ঝাঁজরা হয়ে যায়। তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের হাত দিয়ে তির, তরবারি ও বর্শার আঘাত ঠেকাতে থাকেন। এতে তাঁর একটি হাত কেটে পড়ে যায়।

আবু তালহা আনসারি রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন বিখ্যাত তিরন্দাজ। তিনি কাফেরদের ওপর বৃষ্টির মতো তির নিক্ষেপ করতে থাকেন। ভেঙে যায় তার অনেকগুলো ধনুক। একটি ঢাল ধরে তিনি নবিজিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। নবিজি মাথা বের করলে তিনি বলেন—

হে আল্লাহর রাসুল! আপনি মাথা বের করবেন না। তির আমার বুকে লাগুক। আপনি সুস্থ থাকুন। সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু নবিজির কাছে বসে তির ছুড়তে থাকেন।

তিনি বলেন—

يا سعد ارم فداك أبي وأمي সাদ! তুমি তির ছুড়তে থাকো। আমার পিতামাতা তোমার প্রতি কুরবান হোক।"

এরপরও রক্ষা হলো না। কাফেরদের নামকরা এক বীরের নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবনু কামআ। সে ভিড় ঠেলে চলে আসে নবিজির কাছে। তরবারি দিয়ে আঘাত করে নবিজির মুখে। লোহার দুটি কড়া ঢুকে যায় তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে। নবিজির নিচের পার্টির সামনের ডান পাশের একটি দাঁত ভেঙে যায় উতবা ইবনু ওয়াক্কাসের আঘাতে। রহমতের নবির শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। [১৩]

কাফেরদের এমন নির্মম ব্যবহার ও নিষ্ঠুর আঘাত দেখে রহমতের নবি ভয় পেয়ে যান। কারণ, এর জন্য হয়তো তাদের ওপর আল্লাহর গজব নাজিল হতে পারে। অস্থির হয়ে তিনি দুআ করেন রাব্বুল আলামিনের কাছে—

[১১] সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩১৪৯।

[১২] সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৪০৫৯।

[১৩] সিরাতুন নবি [আল্লামা শিবলি নুমানি] : ৩৭৯-৩৮০।

اللهم اغفر لقومي فإنهم لا يعلمون

হে আল্লাহ! আমার জাতিকে ক্ষমা করে দিন। কারণ, তারা জানে না। (১৪)

কিন্তু আজ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীষণ রাগ হয়েছেন। এমনকি অভিশাপও দিয়ে ফেলেছেন তিনি। অথচ এ এমন একসময়, যখন নবিজির খুশি থাকার কথা। অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয় কোনোভাবেই। কারণ, হুদাইবিয়া থেকে ফিরে আসার সময় স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁকে সুসংবাদ দিয়েছেন। নাজিল হয়েছে পবিত্র আয়াতে কারিমা

إنا فتحنا لك فتحا مبينا ليغفر لك الله ما تقدم من ذنبك وما تأخر ويتم نعمته عليك ويهديك صراطا مستقيما وينصرك الله نصرا

নিশ্চয় আমি আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি, যাতে আল্লাহ আপনার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিসমূহ মার্জনা করে দেন। আপনার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন। আপনাকে সহজ-সরল পথে পরিচালিত করেন এবং আপনাকে দান করেন বলিষ্ঠ সাহায্য। [সুরা আল-ফাতাহ, আয়াত: ১-৩]

মহান আল্লাহ যখন হুদায়বিয়ার এই সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় বলে ঘোষণা দেন, তখন সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন—

হে আল্লাহর রাসুল! এটি কি আমাদের বিজয়?

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন—

হ্যাঁ, এটি আমাদের জন্য মহাবিজয়।

আসলেই এ সন্ধিচুক্তিটি ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ও ইসলামের সর্বব্যাপী বিজয়ের মূলভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। সাহাবায়ে কিরাম এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, হুদায়বিয়ার সন্ধি ছিল মহাবিজয় এবং আল্লাহ তাআলার গৌরবময় অনুগ্রহ। কারণ, এ সন্ধি উন্মোচন করে দিয়েছিল মক্কা বিজয়ের দ্বার। এ সন্ধিচুক্তিই প্রমাণিত হয়েছিল ইসলামের দিগন্ত বিস্তৃত প্রচার-প্রসারের একটি বিশেষ উপকরণ হিসেবে।

[১৪] সহিহুল বুখারি, হাদিস নং ৩৪৭৭।

ইসলাম সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করেছিল উন্নত আদর্শের ভিত্তি। একমাত্র ইসলাম ধর্মের কারণেই সাহাবায়ে কিরাম উত্তম চারিত্রিক গুণাবলির শীর্ষচূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। কুরাইশ ও অন্যান্য শত্রুভাবাপন্ন গোত্রসমূহ ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারেনি। কারণ, সবসময় ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকার ফলে তারা ধীর স্থিরভাবে ইসলামের সু-উজ্জ্বল শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কোনো সঠিক ধারণা নিতে পারতো না।

বিজয় অর্জন করে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হুদায়বিয়া থেকে ফিরছিলেন, তখন আরও নাজিল হয়—

المؤمنين إذ يبايعونك تحت الشجرة فعلم ما في عن الله قلوبهم فأنزل السكينة عليهم وأثابهم فتحا قريبا ومغانم كثيرة لقد رضي يأخذونها وكان الله عزيزا حكيما .

আল্লাহ ঈমানদারদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তাঁরা গাছের নিচে আপনার হাতে বাইআত করেছে। আল্লাহ অবগত ছিলেন, যা তাদের মনের মধ্যে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাজিল করেছেন এবং তাদেরকে অত্যাসন্ন বিজয় (এর সুসংবাদ) দান করেছেন। আর অনেক গনিমতের মাল দান করেছেন, যা তারা অচিরেই হস্তগত করবে। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও সর্বোত্তম কুশলী। [সুরা আল-ফাতাহ, আয়াত: ১৮-১৯]

এ আয়াতে কারিমায় মহাবিজয় ও পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তাআলা তাঁদের দুটি জিনিস দান করেছেন—

১. যুদ্ধলব্ধ বিপুল সম্পদ।

২. অত্যাসন্ন বিজয়।

এটি ছিল খায়বার(১০] বিজয়ের পূর্বাভাস। খায়বার বিজয়ের মাধ্যমে এ দুটি বিষয় ভালোভাবেই আয়ত্তে এসেছিল।

এত কিছুর পরও প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারাত্মক ক্রুদ্ধ। ভীষণ রাগান্বিত তিনি।

[১৫] খায়বার : মদিনা থেকে উত্তর পশ্চিম কোনে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি অঞ্চলের নাম। এ স্থানটি ছিল খুবই উর্বর ও সবুজ-শ্যামল। বনু নাজির গোত্রের ইহুদিরা মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। এখানে বসেই তারা করছিল ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এখানে শক্তিশালী অনেকগুলো দুর্গ স্থাপন করেছিল।

কেন এত রাগ তাঁর?

অথচ তিনি হলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন। সমগ্র বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। সুতরাং বিনা কারণে তিনি রাগতে পারেন না। তাহলে আমরা চলে যাবো কারণ খুঁজতে। আমরা এখন ষষ্ঠ হিজরির পবিত্র মদিনাতুর রাসুলে।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছিলেন সমগ্র বিশ্বের জন্য। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বার্তা বহনকারী রাসুল ও বিশ্ব মানবতার জন্য রহমতের মূর্ত প্রতীকরূপে। সুতরাং তাঁকে সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছেই মহাসত্যের আহ্বান পৌঁছাতে হবে। সঠিক ও সুন্দরভাবে। অবশ্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব আল্লাহ তাআলার।

দৃষ্টি জগ্রোস পর্বতমালায়

সুতরাং স্বস্তি নেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনে। দৃষ্টি চষে বেড়াচ্ছে পারস্য উপসাগরের উপকূল ঘেঁষে। যার উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণ বরাবর সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে জগ্রোস পর্বতমালা। [১] এই পর্বতমালার পাদদেশ থেকে পূর্ব দিকে ভারতীয় প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত ইরানি মালভূমি। ভৌগোলিকভাবে ত্রিকোণাকৃতির এই অঞ্চল ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত পরিচিত ছিল পারস্য নামে, যা আজকের দিনে পরিচিতি লাভ করেছে ইরান নামে। এই অঞ্চলেই তখন প্রতিষ্ঠিত ছিল ইতিহাস বিখ্যাত পারস্য সাম্রাজ্য।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন এদিকে আটকে থাকার কারণ অনেক। যেমন—

পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যতগুলো বৃহৎ এবং প্রভাবশালী সাম্রাজ্যের নাম পাওয়া যায়, এর মধ্যে পারস্য সাম্রাজ্যের নাম একদম উপরের দিকেই রাখা হয়।

এ সাম্রাজ্যই পৃথিবীর প্রথম পরাশক্তি।

[১৬] জগ্ৰোস পর্বতমালা : পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের একটি পর্বতমালা। উপত্যকা ও সমভূমি দ্বারা বিচ্ছিন্ন অনেকগুলি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণি নিয়ে গঠিত এই পর্বতমালার অনেকগুলি পর্বত। ৩০০০ মিটারেরও বেশি উঁচু। কিছু কিছু পর্বতশৃঙ্গ সবসময় তুষারাবৃত থাকে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ শৃঙ্গটির নাম জার্দ কুহ, যার উচ্চতা ৪.৫৪৭ মিটার। দেনা ২য় সর্বোচ্চ পর্বত (উচ্চতা ৪,৩৫৯ মিটার)। পর্বতমালার অভ্যন্তরে অনেক উর্বর উপত্যকা অবস্থিত এবং এগুলিতে কৃষি ও পশুপালন জীবিকা উপার্জনের অন্যতম উপায়। জগ্রোস পর্বতমালাটি প্রায় ১,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি ইরানের উত্তর-পশ্চিমে শুরু হয়ে মোটামুটি ইরানের পশ্চিম সীমান্ত ধরে ইরানীয় মালভূমির সমগ্র পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দৈর্ঘ্য বরাবর প্রসারিত হয়েছে এবং হরমুজ প্রণালিতে এসে শেষ হয়েছে। কেৰ্মান প্রদেশের হিজর নামের স্তূপ পর্বতমালা এবং জাবাল বারেজ পর্বতশ্রেণি জাগ্রোসের পূর্ব সীমানা নির্ধারণ করেছে।

ভৌগোলিক অবস্থান, উন্নত শাসনব্যবস্থা, শিল্প-সংস্কৃতি, স্থাপত্যকলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ের কোনো কিছুরই অভাব ছিল না এখানে! কিন্তু মানবতাহীন বিশ্বে সবকিছুই ছিল নিঃশেষ হওয়ার পথে।

মহান আল্লাহ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেবল আরব ভূখণ্ডের জন্যই প্রেরণ করেননি; বরং বিশ্বজয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রেরণ করেছিলেন তাঁকে। তাঁর টার্গেটের বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে ইরশাদ হচ্ছে

وما أرسلناك إلا كافة للناس بشيرا ونذيرا

আমি তো আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী

হিসেবে প্রেরণ করেছি। [সুরা সাবা, আয়াত ২৮।]

সুতরাং এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। তাছাড়া প্রথম থেকেই মক্কার মুশরিক, কুরাইশ কাফের ও অন্যান্য আরব গোত্রসমূহের উৎপাত ছিল মারাত্মক। ফলে এতদিন তিনি এদের অত্যাচার ও তার প্রতিরোধ কাজে মনোসংযোগ নিবদ্ধ রেখেছিলেন। কাজেই আরবের বাইরে খেয়াল করার সুযোগ পাননি; কিন্তু যখন কুরাইশদের সঙ্গে হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন হলো, তখন তিনি অনেকটা স্বস্তি লাভ করলেন।

আল্লাহ তাআলা এ সন্ধিকে প্রকাশ্য বিজয় বলে ঘোষণা করেছেন। এই প্রকাশ্য বিজয়ের এটিও অন্যতম একটি অর্থ। এতে সুগভীর হলো নবিজির আশ্বস্তি। তিনি বুঝতে পারলেন, দীর্ঘ সাধনার সাফল্য প্রাপ্তির সময় নিকটবর্তী। এখন আরবের বাইরে দ্বীন ইসলাম প্রচারের সময় হয়েছে।

ষষ্ঠ হিজরির জিলহজ মাসে নবিজি হুদাইবিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। এ মাসেই সংঘটিত হয় গাবা অভিযান। এ অভিযানের তিন দিন পর সপ্তম হিজরির প্রারম্ভে তিনি খায়বার যুদ্ধে যাত্রা করেন। খুব সম্ভব যে তিন দিন তিনি মদিনায় ছিলেন, এর কোনো একদিনেই তিনি বহির্বিশ্বে দূত প্রেরণ করতে মনস্থ করেন।

কিন্তু এ কাজ মোটেও সহজ ছিল না তাঁর জন্য। এর সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত ছিলেন তিনি। যেমন :

যে দেশে দূত প্রেরণ করা হবে সেখানকার ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষ সম্পর্কে দূতেরা অজ্ঞ।

সেখানে গিয়ে তারা রাজা-বাদশাহকে তাদের পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম

গ্রহণের দাওয়াত দেবেন।

সুতরাং এটি নিঃসন্দেহ যে, এই দৌত্যকার্য ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে যারা যাবে, তারা হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসতে নাও পারে।

তাই একদিন প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে সমবেত করলেন। হামদ ও সানার পর পাঠ করলেন কালিমায়ে শাহাদত। এরপর বললেন

‘আমি সমগ্র বিশ্বের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর বার্তা বাহক-রাসুল ও রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছি। দেখো, আমি তোমাদের কিছু লোককে আজমি বা অনারব বাদশাদের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরা ঈসা আলাইহিস সালামের সৈন্যদের মতো মতবিরোধে লিপ্ত হয়ো না। যাও, আমার পক্ষ থেকে তোমরা সত্যের আহ্বান ছড়িয়ে দাও।'

সাহাবায়ে কিরাম জবাব দিলেন—

‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা আপনার ইচ্ছা পূরণ করবো। যেখানে ইচ্ছা, আপনি আমাদের পাঠিয়ে দিন।'

ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত—একথা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো করেই জানতেন। তাই সত্যের আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়ার মানসে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। মহাসত্যের যে অমূল্য সওগাত নিয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন, তা সীমাবদ্ধ থাকার জন্য নয়; বরং তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য। বিষয়টি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে লাগলেন তিনি। [১]

আশ্বস্ত হয়ে বিশ্রাম নেবেন, এমন একটি মুহূর্ত নেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে। এ শ্রেষ্ঠ উপহার তাঁকে জনে জনে পৌঁছে দিতে হবে। একে পরিবেশন করতে হবে সৃষ্টির প্রতিটি সদস্যের সামনে। তাই তিনি সাদর আহ্বান-লিপি দিকে দিকে পাঠিয়ে দিতে মনস্থ করলেন।

তৎকালীন বিশ্বে প্রসিদ্ধ রাজশক্তি ছিল ছয়টি

১. ইউরোপে রোম সাম্রাজ্য (The Holy Roman Empire )

২. এশিয়ার পারস্য সাম্রাজ্য।

৩. আফ্রিকার হাবশা সাম্রাজ্য।

[১৭] সিরাতুন নবি [আল্লামা শিবলি নুমানি]: ৪৬২।

৪. মিশরের আজিজ মুকাওকিস।[৮]

৫. ইয়ামামার সরদার এবং

৬. সিরিয়ার গাসসানি শাসনকর্তাও ছিল বেশ প্রভাবশালী (১৯)

তাই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের সবার কাছে একই দিনে, একই সময়ে ইসলামের আহ্বানপত্রসহ ছয়জন দূত প্রেরণ করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য যে ছয়জন মহান ব্যক্তি দূত হিসেবে প্রেরিত হন, তাঁরা হলেন—

১. দিহইয়া কালবি রাদিয়াল্লাহু আনহু

: রোম সম্রাট কায়সার।

২. আবদুল্লাহ ইবনু হুজাফাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু :

পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ।

৩. হাতিব ইবনু আবি বালতাআ রাদিয়াল্লাহু আনহু

আজিজ মিসর।

৪. আমর ইবনু উমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু

৫. সালিত ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু

৬. শুজা ইবনু ওহাব রাদিয়াল্লাহু আনহু

: হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশি।

: ইয়ামামার সরদারগণ।

: গাসসানি শাসক হারিস (২০]

অজানার পথে

:

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু হুজাফাহ আস সাহমি আল কুরাইশি রাদিয়াল্লাহু আনহু। সাহসী ও বীরযোদ্ধা হিসেবে তার খ্যাতি ছিল আরবজুড়ে। চালাক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন সর্বমহলে। প্রাথমিক যুগেই ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি।

আবদুল্লাহ ইবনু হুজাফার দাদার নাম কায়স ইবনু আদিইয়্যা। তার মাতা ছিলেন হারসানের কন্যা, ইনি ছিলেন বানুল হারিস ইবনু আবদ মানাত গোত্রের লোক। আবু হুজাফাহ তার ডাকনাম বা উপনাম (কুনিয়াত)। তিনি দুবার হিজরতের সৌভাগ্য অর্জনকারী সাহাবি। কারণ, ভাই কায়স ইবনু হুজাফাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিয়ে দ্বিতীয় কাফেলার সঙ্গে প্রথমে তিনি হাবশায় হিজরত করেন। এরপর হিজরত করেন পবিত্র শহর মদিনাতুর রাসুলে।

[১৮] মিসরের শাসনকর্তা মুকাওকিস রোম সম্রাটের অধীনে ছিলেন; কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। এজন্য তাকে স্বাধীন শাসকের মতোই মনে করা হতো। [১৯] সিরাতুন নবি [আল্লামা শিবলি নুমানি]: ৪৬৩।

[২০] ফাতহুল বারি : ১/১৩১; সিরাতুন নবি [আল্লামা শিবলি নুমানি] : 864


তাঁর আরেক ভাই খুনায়স ইবনু হুজাফাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা উম্মুল মুমিনিন হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার পূর্বতন স্বামী। একমাত্র বদর যুদ্ধ ছাড়া তিনি সব যুদ্ধেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন।

আবদুল্লাহ ইবনু হুজাফাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু পারস্য সম্রাটের কাছে একটি পত্র নিয়ে যাবেন। এ পত্র প্রেরিত হয়েছে বিশ্বমানবতার মহান নেতা প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে। এজন্য তিনি সফরের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। বাহন ঠিকঠাক করলেন চলার জন্য। অন্যান্য পাথেয় নিয়ে নিলেন প্রয়োজন মতো। সবশেষে বিদায় নিলেন স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন থেকে। তিনি বের হলেন—

অজানার পথে...

আল্লাহ তাআলার রাস্তায়...

পথ ভীষণ কঠিন। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আপন গন্তব্যের দিকে অবিরাম ছুটে চলেছেন আবদুল্লাহ ইবনু হুজাফাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। মারাত্মক উঁচু-নিচু ভূমি। বিচিত্র এক পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন তিনি। দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা এবং অসহ্য যন্ত্রণা। এ পথে আছে সবই। তারপরও এই কঠিন থেকে কঠিনতম ভয়াবহ থেকে ভয়াবহ, মারাত্মক হতে আরো মারাত্মক সফরে ক্লান্তিহীন পথে ছুটে চলছেন তিনি। দুর্বার গতিতে।

বিচিত্র পথের ভয়ানক এ সফর। আবদুল্লাহ ইবনু হুজাফাহ একাকী চলছেন এ সফরে। তিনি তো সম্পূর্ণ একা। না, তিনি একা নন। আরো একজন আছেন তাঁর সঙ্গে। যিনি তাঁকে দেখছেন। পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁর সব কর্মকাণ্ড।

কে তিনি?

তিনি হলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আমাদের সৃষ্টিকর্তা। আমাদের লালন পালনকারী। আমাদের ভালা-মন্দ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী। আল্লাহ তাআলা হয়তো তাঁর বান্দার এ কষ্ট দেখে মুচকি হাসছেন। হয়তো তাঁর আশেপাশের ফেরেশতাদের লক্ষ করে টিপ্পনী কেটে বলছেন—“কী হে ফেরেশতারা! আমার এ বান্দাকে দেখছো? কীভাবে আমার দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে! মৃত্যুর কোনো পরোয়া করছে না। কোনো বাধাই তাঁকে দমাতে পারছে না। সে এগিয়ে চলছে তো চলছেই। সামনের দিকে, শুধুই সামনের দিকে। কারণ, সে নিশ্চিত জানে—

এ পথ আল্লাহর পথ।

এ পথেই আছে সবার মুক্তি।

এ পথে আছে বিজয়। সুনিশ্চিত বিজয়।

আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন।
We Respect Every Author Hardwork - boipaw.com™

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ