অবাধ্যতার ইতিহাস লেখক : ডা. শামসুল আরেফীন | Obaddhotar Itihash By Dr. Shamsul Arefin

অবাধ্যতার ইতিহাস (pdf download no available right now)
লেখক : ডা. শামসুল আরেফীন
প্রকাশনী : সমকালীন প্রকাশন
বিষয় : ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য
পৃষ্ঠা : 256
ভাষা : বাংলা।
Image

যেভাবে আর যে কারণে ধ্বংস হয়েছে পূর্বের অনেক সভ্যতা, যেভাবে মানুষকে বরণ করতে হয়েছিলো আল্লাহর অনিবার্য আযাব—তার আদ্যোপান্ত জানতেই ‘অবাধ্যতার ইতিহাস’ বইটি। মোটকথা, কীভাবে আমরা ইউরোপীয় চিন্তাগুলোকে গ্রহণ করে আমাদের দ্বীন ছেড়ে দিয়েছি। তার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে।

শুরুর আগে

একদিন হঠাৎ ব্যাপারটা খুব ভাবাল আমায়। যেমন ধরেন, জ্ঞান হবার পর থেকে দেখে আসছি ৫ বছরের জন্য একজন দেশের ‘রাজা' হয়, পরের ৫ বছরে আবার আরেকজন হয় ভোটে জিতে। ধরে নিয়েছিলাম, এটাই স্বাভাবিক ও শ্রেষ্ঠতম প্রক্রিয়া, যেন এটাই হবার, এটাই হয়, এটা ছাড়া আর কিছু হবার নেই। এমনি করে ঈদের দিন সেলামি পেতাম কচকচে নতুন নোট, তা দিয়ে আইসক্রিমট্রিম কেনা চলত। যেন এটাই অনাদি কাল থেকে চলে আসা সিস্টেম, অলঙ্ঘ্য, অপরিবর্তনীয়। এই বিশেষ সুন্দর কাগজটা দিলেই দোকান থেকে অনেক কিছু পাওয়া যায়। শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে বিটিভিতে শুরু হতো পূর্ণদৈর্ঘ্য ‘বাংলা ছায়াছবি’। অধিকাংশ সিনেমাতেই থাকত একটা আদালতের দৃশ্য। কাঠগড়া, কাঠের হাতুড়ি, অর্ডার অর্ডার... দুজন উকিল ঝগড়াঝাঁটি করে ‘অবজেকশন মিলর্ড'। বিচার-সালিশের এই চিত্রটাই যেন চিরন্তন, এটা ছাড়া আর কিছু যেন হতেই পারে না।

এই যে আমাদের চারপাশে যে সিস্টেমটা আমরা দেখি, সবকিছুই একটা বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটা তো চিরটাকাল এমন ছিল না। কোত্থেকে এলো এই বিশেষ অলঙ্ঘ্য পদ্ধতিগুলো, যাদেরকে কোনো প্রশ্ন করা যায় না। যাদেরকে ছাড়া অন্যকিছু কল্পনা করা যায় না। আবার যেমন ধরেন, আমরা যে কাঠামোর ভেতরে চিন্তা করি, ঠিক-বেঠিক হিসেব করি, যা কিছুকে আমরা কাণ্ডজ্ঞান মনে করি; এগুলো এলো কোত্থেকে? যেমন: ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছি—লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। বড় হতে হতে জানলাম, সবাই স্কুলে পড়ে না, অনেকে মাদরাসায় পড়ে, তারাও অনেক পড়াশোনা করে; কিন্তু তাদের নিজের গাড়িঘোড়া 

থাকে না। ভেবে দেখলাম, একটা ছেলে যা পারে, একটা মেয়ে তা পারে না। আবার মেয়েরা যা পারে, ছেলে হয়ে আমি তা পারি না; কিন্তু আমাকে কেউ জোর করে বিশ্বাস করাতে চাইছে : একটা ছেলে যা যা পারে, মেয়েও তা পারে। মীনা কার্টুন ইত্যাদি দিয়ে এই কথাটাকে কেউ কাণ্ডজ্ঞান হিসেবে আমার ভেতর প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

কেজি ক্লাসে ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়লাম, সালাত পড়তে হয় দিনে ৫ বার। কিন্তু আশেপাশে বেশিরভাগ মানুষই পড়ছে না। আরো বড় হয়ে বুঝলাম ‘সালাত না পড়লে কী হবে, আমার ঈমান কিন্তু ঠিকই আছে।' ২৬ বছর বয়সের আগে ধর্মকর্ম নিয়ে ভাবার ফুরসত মেলেনি। অনেকের তো শেষ বেলায়ও মেলে না, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। কুরআনের অনুবাদ পড়তে গিয়ে দেখলাম, অনেক কিছুই আমার চেনা দুনিয়ার সাথে মিলছে না। দুনিয়ার যে সিস্টেমটার সাথে আমি বড় হয়েছি; যা যা ধ্রুবসত্য হিসেবে জেনে, আধুনিক-ভালো-শ্রেষ্ঠ জেনে, কাণ্ডজ্ঞান হিসেবে বিনা প্রশ্নে মেনে এসেছি, তার অনেক কিছুর সাথেই কুরআন মিলছে না। কুরআন যা বলছে, তা কেউ মানছে না। পাটিগণিতে সুদকষার অঙ্ক করানোর সময়ই বাবা বলে দিয়েছিলেন ‘সুদ কী’, ‘সুদ ইসলামে হারাম' ইত্যাদি। তাহলে আমি করছি কেন এই অঙ্ক? তাহলে কেন তোমরা ব্যাংকে টাকা রাখছো সবাই? কোনো ক্লাসের বাংলা বইয়ে বেগম রোকেয়ার একটা প্রবন্ধ ছিল : ‘পুরুষ যখন পৃথিবী-সূর্যের দূরত্ব মাপে, আমরা নারীরা তখন বালিশের ওয়ারের দৈর্ঘ্য মাপি। শকটের (গাড়ির) এক চাকা ছোট, আরেক ঢাকা বড় হলে সে শকট চলবে কী করে?'

ঠিকই তো, অর্ধেক জনসংখ্যা ঘরে ‘পড়ে থাকলে’ জাতি কীভাবে উন্নত হবে?

ঠিকই তো, ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠিত হয় না, বাংলাদেশের স্বাধীনতাই তার প্রমাণ।

ঠিকই তো, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।

ঠিকই তো, মুদ্রা তো কাগজেরই হয়। আন্তর্জাতিক লেনদেন তো ডলারেই হয়, ডলারেই হতে হয়।

ঠিকই তো, কুরআনের যে আইন (হাত কাটা, পাথর ছুড়ে হত্যা, বেত্রাঘাত), এগুলো আজকের যুগে ‘চলে না’। ‘অচল, বর্বর, অমানবিক'।

ঠিকই তো, জীবন তো একটাই। কাল হো না হো 


এরকম বহু ‘ঠিকই তো’-রা এসে ভিড় করে কুরআন আর আপনার মাঝে, আল্লাহ আর আপনার মাঝে। কারা কীভাবে কখন এই ‘ঠিকই তো’-গুলোকে সেট করে দিলো আমাদের মনে। ২০০১ সালেও সমকামিতাকে আমরা শতভাগ ছেলেই ঘৃণা করতাম আমাদের আবাসিক স্কুলটাতে, কেউ ধরা খেলে পুরো ব্যাচ মিলে ট্রায়ালে তোলা হতো তাকে। আজ ২০ বছরের মাথায় শুনছি অনেকেই একে স্বাভাবিক মনে করছে, পক্ষে ওকালতি করছে, বরং একে খারাপ ভাবাটাই নাকি মানসিক সমস্যা। তার মানে আমাদের ‘ঠিকই তো’-র স্কেল বদলায়। গতকাল যা ঠিক, আজ তা ঠিক না। আবার গতকাল যা ঠিক ছিল না, আজ সেটাই ঠিক।

সুতরাং, মানুষের চিন্তার ইতিহাস আমাদের জানতে হবে। কীভাবে মানুষের চিন্তাগুলো বদলে গেল, এটা না জানলে ‘আজকের আমাদেরকে আমরা চিনতে পারব না। আজকে আমাদের চিন্তাগত যে অবস্থান, সেটা প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিম? আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে নির্মিত? নাকি অন্য কারো অভিজ্ঞতাকে আমি আমার জন্য ধ্রুব হিসেবে মেনে নিয়েছি, যদিও আমার অভিজ্ঞতাটা ছিল ভিন্ন? আমার চিন্তার ছকটা কি আমাদের বেছে নেওয়া, নাকি কারো চাপিয়ে দেওয়া?

সামনে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাঠক পেতে থাকবেন। পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকবেন। আমি কে? আমি এমন কেন? আমি এমন করেই ভাবি কেন? কেন অন্যরকম করে ভাবি না? আমি কি স্বাধীনভাবে ভাবি, না কেউ আমার ভাবনার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে? ইউরোপ সেই ১৬শ শতক থেকে পুরো দুনিয়া শাসন করে আসছে, আজও করছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই নেটিভদের আইন-বিচার অর্থনীতি-শিক্ষাকে তারা নিজেদের সুবিধার্থে সাজিয়ে নিয়েছে, যেকোনো শাসক তাই করবে। নিজস্ব একটা বিশেষ পরিস্থিতির অভিজ্ঞতায় ইউরোপ একটা বিশেষ চিন্তাধারা গ্রহণ করেছে, যাকে তারা নাম দিয়েছে ‘সভ্যতা’ বা ‘আধুনিকতা’। এটাকে একটা স্ব-আরোপিত দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে যে, এই সভ্যতা তাকে পৌঁছে দিতে হবে সারা দুনিয়ায়— সভ্যতার দায় (White Man's Burden ) । তাই ইউরোপের নিজস্ব অভিজ্ঞতাপ্রসূত আইডিয়াগুলো উপনিবেশ আমলে আমাদেরকে তারা মেনে নিতে পদ্ধতিগতভাবে বাধ্য করেছে, যদিও তাদের অভিজ্ঞতা আর আমাদের অভিজ্ঞতা এক নয়। সুতরাং, আমরা চিন্তা-কাঠামোর ক্ষেত্রে ইউরোপের অনুসারী বা উত্তরাধিকারী। ইউরোপের মতো করেই আমরা চিন্তা করি, তাদের মতো করে চিন্তা করাকে আধুনিকতা বা প্রগতি মনে করি, তাদের সমস্যার সমাধানকে নিজের সমস্যারও সমাধান মনে করি।

ইউরোপীয় স্কেলে সবকিছু মাপতে শিখেছি আমরা, আমাদের বাবারা, তাদের বাবারা, কিন্তু কুরআন-হাদিস-ফিকহের ঠিক-বেঠিক, নৈতিকতা, আইন, সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় স্কেলে ঠিক যায় না। তাইলে সমাধানটা আসলে কী?

কেউ ইসলামকে ত্যাগ করে (নাস্তিক ইসলামবিদ্বেষী) কেউ ইউরোপীয় খাপে যেটুকু আঁটে সেটুকু রাখার পক্ষে, বাকিটুকু ছেঁটে ফেলার পক্ষে (মডার্নিস্ট রিডাকশনিস্ট মুসলিম)

আবার কেউ ইউরোপের মনরক্ষা করে ইসলামকে পুনর্ব্যাখ্যা করার পক্ষে (মডারেট মুসলিম)

প্রথমটি তো ইসলাম থেকেই খারিজ, পরের দুটোও প্রকৃত ইসলাম নয়; বরং ইসলামের অপভ্রংশ। বহু মুসলিম সন্তান ইসলামের চিরন্তন অবস্থান ত্যাগ করে, এই ৩টিতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। তিনটা অবস্থানেরই গোড়া এক জায়গায় : ইউরোপীয় মাপকাঠিকে ধ্রুব মেনে নেওয়া। এজন্য ইউরোপকে চিনলে নিজেকে চেনা যাবে। প্রতিটি মুসলিমের প্রয়োজন ইউরোপকে চেনা, ইউরোপের চিন্তার ইতিহাস জেনে নিজেকে প্রশ্ন করা। ইউরোপ, তুমি কার? আর আমি কার?


ধর্ম কী?

হাজার বছর ধরে খ্রিষ্টধর্মের সাথে ইউরোপের সংসার। ধর্ম বলতে ইউরোপ তাই বোঝে খ্রিষ্টবাদকে আর মধ্যপ্রাচ্য বোঝে ইসলাম। ধর্ম নিয়ে ইউরোপের অভিজ্ঞতা আর মধ্যপ্রাচ্যের অভিজ্ঞতা পুরো ১৮০ ডিগ্রি উলটো। আমরা খুব সংক্ষেপে একটু বোঝার চেষ্টা করব কেন তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন।

খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাস

কথা ছিল খ্রিষ্টধর্ম কেবল বনি ইসরাইলের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে; কিন্তু 'যীশুর জীবদ্দশায় যীশুবিরোধী' একজন ইহুদি পণ্ডিত, যার নাম ছিল Saul, সে নিজের রোমান নাম রাখল Paul. সে ছিল রোমান রাজদরবারে ‘নাগরিক’ (citizen) পদমর্যাদার, এইজন্য রোমান নাম। ঈসা-নবির শোকাচ্ছন্ন সঙ্গীসাথিদের কাছে সে হুট করে উদয় হয়ে জানাল, তার সাথে ঈসা আলাইহিস সালামের মরণোত্তর দেখা হয়েছে। ঈসা তাকে বলেছেন, অ-ইহুদিদের মাঝেও সত্যধর্মের দাওয়াহর কাজ করতে। অথচ ঈসা-নবি কিন্তু বারবার সতর্ক করে বলে গেছেন—

These twelve Jesus sent out with the following instructions: Do not go onto the road of the Gentiles or enter any town of the Samaritans. Go rather to the lost sheep of Israel. [Matthew 10:5-7]
এই বারো জনকে যীশু এই নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন : অ-ইহুদিদের (জেন্টাইল) রাস্তায় যেয়ো না কিংবা সামারিটান (ইহুদিদের এক গ্রুপ)-দের কোনো শহরে প্রবেশ কোরো না; বরং ইসরাইলের হারানো ভেড়াদের (নবি ইসহাকের পথভ্রষ্ট সন্তানদের) কাছে যাও। (মানে কেবল ইহুদি ডায়াস্পোরাগুলোতে দাওয়াহ করতে বলেছেন) (১)

Then Jesus said to the woman, "I was sent only to help God's lost sheep – the people of Israel." [Matthew 15: 24]

(এক অ-ইহুদি নারী এসেছিল সাহায্যের জন্য) তখন যীশু নারীটিকে বললেন : আমি কেবল ঈশ্বরের হারানো ভেড়াদের সাহায্য করার জন্য প্রেরিত হয়েছি— ইসরাইলের বংশধরদের প্রতি (বনি ইসরাইল)।

সেসময় বনি ইসরাইলের ১২টি গোত্র সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এজন্যই ইসরাইলের (নবি ইয়াকুবের আরেক নাম) পরিবারের হারানো সন্তান বলে সম্বোধন করা হয়েছে বারবার। পারস্য সম্রাট নেবুচাদ নেজার (বুখতনাসর) খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৭ সালে জেরুসালেম লুট করে বাইতুল মাকদিস জ্বালিয়ে দেয়, সকল তাওরাত পুড়িয়ে দেয়, ইহুদি গোত্রগুলোকে দাস বানিয়ে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়। পরে ‘ইহুদিদের ঈশ্বরে বিশ্বাসী পারস্যরাজ মহান সাইরাস (অনেক ঐতিহাসিক এই ব্যক্তিকেই কুরআনে বর্ণিত যুলকারনাইন মনে করেন) তাদেরকে মুক্তি দেন, বাইতুল মাকদিস পুনর্নির্মাণ করেন। তবে ব্যাবিলন থেকে সব ইহুদি গোত্র ফিলিস্তিনে ফিরে আসেনি। অনেকে পারস্যেই থেকে যায়, কেউ এদিকপানে সরে এসে আফগান, এমনকি দক্ষিণ ভারতেও চলে আসে বলে জানা যায়। এ ছাড়া ইউরোপের বড় বড় শহরে ইহুদিরা ছড়িয়ে পড়ে ( Jewish Diaspora)। মোদ্দাকথা, ঈসা আলাইহিস সালাম বিশ্বনবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন বনি ইসরাইলের নবি। এজন্য হাওয়ারিগণকেও

[১] জেন্টাইল অ-ইহুদিদেরকে জেন্টা বলা হয়। সামারিটান (শমরীয়): এরা হল বনি ইসরাইলেরই এক গ্রুপ ছিল, যাদেরকে গ্রেপ্তার করে ব্যাবিলনে দাস বানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়নি। এদের দাবি, এরাই মূসা আলাইহিস সালামের মূল শরিয়তের উপরে রয়েছে। আর ব্যাবিলন ফেরত ইহুদিদের কাছে মূল তাওরাত নেই, Ezra একটা বিকৃত তাওরাত গছিয়ে দিয়েছে এদের কাছে।

[২] ঈসা আলাইহিস সালামের সহচর ও সঙ্গীদের হাওয়ারি বলা হয়।


তাদের দাওয়াতি মিশন স্পষ্ট করে দিয়েছেন : শুধু ইহুদি বসতিগুলোয় যাবে তোমরা, অ-ইহুদিদের বসতি তো দূরে থাক, ওদের রাস্তায়ও যাবে না। যেহেতু আমার দাওয়াত অ-ইহুদিদের জন্য নয়।

কিন্তু এই স্বঘোষিত শিষ্য ও ‘সাবেক শত্রু’ পল৷ ঈসা-নবির দাওয়াহর মধ্যে কিছু সংস্কার আনল, যার মধ্যে প্রধান হলো ঈসা আলাইহিস সালামকে ইহুদিদের নবি থেকে বিশ্বনবি ঘোষণা। পিটারা হলেন ‘ইহুদির প্রতি প্রেরিত' (apostle to the jews) আর পল নিজেকে ঘোষণা করল ‘অ-ইহুদিদের প্রতি প্রেরিত' (apostle to the gentiles), যেটা করার কথা ছিল না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পল কিন্তু ঈসা আলাইহিস সালামের জীবদ্দশায় শিষ্য ছিল না, তীব্র শত্রু ছিল; কিন্তু এখন তাকে সরাসরি শিষ্যদের সমান মনে করা হয়। অ-ইহুদিদের দাওয়াহ করার ক্ষেত্রে পল তাওরাতের আইনকে শিথিলভাবে উপস্থাপন করত, ক্ষেত্রবিশেষে ‘অপ্রয়োজনীয়' হিসেবে। এই মন ধরেন— খতনা করার দরক নেই, মদ্যপান চলবে, শনিবার পালনের দরকার নেই, শুকর খাওয়ার নিষেধ নেই ইত্যাদি।

বস্তুবাদী মূর্তিপূজক রোমানরা পলের খ্রিষ্টীয় আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পেয়ে আকৃষ্ট হয়। তখন একটা প্রশ্ন ওঠে : অ-ইহুদিদের খ্রিষ্টান হতে হলে আগে ইহুদি হতে হবে কি না, খৎনা, শনিবার পালন, খাবারে বাছবিচার এগুলো করতে হবে কি না। ৪৯ সালে জেরুসালেমে apostolic council-এ সিদ্ধান্ত হয়, মুশরিকরা ইহুদি না হয়েই খ্রিষ্টান হতে পারবে। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে পিটার আর পলের মাঝে বিবাদও হয়, কারণ পিটার তাওরাতের শারিয়া মানা বাধ্যতামূলক মনে করতেন,

[১] পল বা পৌল ছিল একজন খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক। তার পূর্বের নাম ছিল শৌল। জন্ম আনুমানিক ৫ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু ৬৪ বা ৬৭ খ্রিস্টাব্দ। কিলিকিয়ার তার্য শহরে তার জন্ম, এই শহরেই সে বড় হয়। শিক্ষক গমলিয়েলের কাছে সে ইহুদিধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করে। পল প্রথম জীবনে ছিল খ্রিষ্টধর্মবিদ্বেষী ও খ্রিষ্টানদের প্রতি অত্যাচারী একজন ইহুদি। পরবর্তী সময়ে সে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং তাতে নানারকম বিকৃতি ও পরিবর্তন শারয়ি সম্পাদক ঘটিয়ে মানুষের মাঝে তা প্রচার করতে শুরু করে।—

[২] পিটারের আসল নাম ছিল সিমন (গ্রিক Elpov) বা সিমেওন (গ্রিক: Eupe@v)। পরবর্তীকালে তাকে কেফা বা পেট্রস (গ্রিক : THérpoc) নাম দেওয়া হয়। জন্ম আনুমানিক ৩০ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু আনুমানিক ৬৪ থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তিনি ছিলেন ঈসা আলাইহিস সালামের ১২ জন প্রেরিতের একজন এবং প্রারম্ভিক মণ্ডলীর নেতাদের অন্যতম। তাকে সাধারণত রোমের প্রথম বিশপ এবং আন্তিয়খিয়ার প্রথম কুলপিতা মানা হয়। প্রাচীন খ্রিষ্টীয় সমস্ত সম্প্রদায় পিটারকে একজন প্রধান সন্ত এবং রোমীয় খ্রিস্টমণ্ডলি ও আন্তিয়খিয়ার খ্রিষ্টমগুলির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করে থাকে। —শারয়ি সম্পাদক ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষা অনুযায়ী। শেষমেশ এভাবে সমাধা হয়, কেউ কারো কাজে নাক গলাবে না। এভাবে খ্রিষ্টানরা দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল—

আলফা খ্রিষ্টান : ‘ইহুদীয়-খ্রিষ্টান’ [পিটারের অনুসারী অর্থাৎ ঈসা আ. এর আসল অনুসারী মুসলিম] বিটা খ্রিষ্টান : ‘অ-ইহুদি খ্রিষ্টান' [পলের অনুসারী বা বর্তমান খ্রিষ্টান]

১৩৫ সালের পর থেকে বিটা-খ্রিষ্টানরা হয়ে গেল মূলধারা। আর ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারী সেসময়কার প্রকৃত মুসলিমরা হয়ে গেল বাতিল ফিরকা। পিটারের অনুসারী খ্রিষ্টানরা এখন টিকে আছে ইহুদি ধর্মের একটা বাতিল ফিরকা হিসেবে, যাদের নাম ‘নাযারিন’। আমাদের মুসলিমদের মতোই তাদের আকিদা এমন—

আল্লাহ একক।

ঈসা আলাইহিস সালাম সত্য নবি ও মাসিহ।

« তিনি কুমারী মারিয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভজাত, অলৌকিকভাবে তার জন্ম।

তাওরাতের বিধান অবশ্যপালনীয়। তবে কিছু নিজেরা যোগ করে নেয়— নিরামিষ ভোজন, স্বেচ্ছা-দারিদ্র্য, ধৌতকরণ প্রথা (ওযু টাইপ), প্রাণী কুরবানি না দেওয়া।

সেন্ট পলকে মুরতাদ মনে করা।

খ্রিষ্টান বলতে এখন থেকে আমরা বিটা-খ্রিষ্টান বা সেন্টপলের অনুসারীদের বুঝব। তাওরাতের বিধান থেকে দূরে সরে গেলেও খ্রিষ্টীয় ন্যায়-নৈতিকতা, মৃত্যু পরবর্তী জীবন ও আধ্যাত্মিকতা ভোগবাদী রোমানদেরকে উন্নত চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতার স্বাদ পাইয়ে দেয়। মূলত তাওরাতের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ সম্পর্কিত বিধান বাদ দিলেও ব্যক্তিগত চরিত্র-আধ্যাত্মিকতা এসবে পলীয় খ্রিষ্টবাদ খুব জোর দিয়েছিল। রাষ্ট্রের আনুগত্যের নীরস আচার-পার্বণ থেকে ধর্মের আনুগত্যের বর্ষণ তাদের আকৃষ্ট থাকে। আবার রোমান মুশরিক সংস্কৃতির নানান দিকও খ্রিষ্টবাদে ধুমসে প্রবেশ করে: ২৫ ডিসেম্বর পালন (ছিল সূর্যদেব অ্যাপোলোর জন্মদিন, হয়ে গেল খ্রিষ্টের জন্মদিন), ঈসা আলাইহিস সালামের ওপর প্রভুত্ব আরোপ, আল্লাহর পুত্র মনে করা (রোমান পুরাণের কনসেপ্ট), মূর্তি তৈরি, শনিবারের বদলে রবিবার (SUN-day) বিশ্রাম দিবস — ইত্যাদি তাদের প্যাগান চিন্তাচেতনার সাথে সামঞ্জস্য .....


রাখার জন্য অনুমোদিত হয়। অনেকটা শিয়াবাদের ভেতর পারসি ধর্মের উপাদান ঢুকে পড়ার মতো।

ইসলামের ভিতরও যেকোনো বাতিল ফেরকা দেখবেন অলৌকিক কিচ্ছা-কাহিনী, স্বপ্ন, পির-ফকিরের কেরামতির দলিলে প্রতিষ্ঠা পায়। তেমনি সেন্ট পলের প্রচারিত খ্রিষ্টবাদ প্রতিষ্ঠিতই ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের অলৌকিক জন্ম, অলৌকিক কার্যক্রম এবং আধ্যাত্মিক জগতের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই অলৌকিক এসব বিষয় প্রকৃতির নিয়মনীতি ও যুক্তির বিপরীত হয়ে থাকে। ফলে প্রকৃতিবিজ্ঞান ও যুক্তিপ্রয়োগের সাথে খ্রিষ্টবাদের মৌলিক বিরোধ। আমরা দেখব সেন্ট পল প্রচার করছেন—

জ্ঞানীরা কোথায়? লেখকরা কোথায়? এ যুগের দার্শনিকরা কোথায় গেল? ঈশ্বর কি দুনিয়াবি জ্ঞানকে আহাম্মকি বানাননি? [১ কোরিন্থিয়ান ১ : ২০]

ধর্মতাত্ত্বিক Tertullianº) বললেন : খ্রিষ্টবাদ প্রাকৃতিক যুক্তির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণই নয় কেবল, বরং সরাসরি বিরুদ্ধে। ধর্মজ্ঞান যুক্তির বিরুদ্ধে এবং যুক্তির ঊর্ধ্বে। তিনি সরাসরি ঘোষণা করেন : credo quia absurdum est (অযৌক্তিক বলেই আমি এটা বিশ্বাস করি) [২] আজকের অনেক বোদ্ধা মুসলিমকেও এ কথা বলতে শুনবেন: ধর্ম হল বিশ্বাসের বিষয়, ধর্মে বিজ্ঞানের কোনো স্থান নেই। এর কারণ হল, ধর্ম বলতে ‘পলীয় খৃষ্টধর্ম’-কেই ইউরোপ চিনেছে এবং সারা দুনিয়াকে চিনিয়েছে। ধর্ম যে যৌক্তিক হতে পারে, ধর্মের ‘পার্থিব’ অংশটুকু যে মানবজ্ঞানে ধরা দিতে পারে, এটা ইউরোপের কল্পনাতেই নেই।

বৈরাগ্যবাদ

গ্রিক সভ্যতায় একটা সময় স্টোয়িকবাদ (stoicism) নামক বৈরাগ্যবাদ চর্চা হতো, যা রোমানদের হয়ে খ্রিষ্টধর্মে স্থান পায়। বলা হলো : অপবিত্র পৃথিবীতে মানুষ পদস্থলিত হয়েছে আদম আলাইহিস সালামের আদিপাপের কারণে, যা লেপ্টে আছে প্রতিটি মানুষের গায়ে। সেই পাপ থেকে মুক্তি পেতে ও খ্রিষ্টের প্রিয়পাত্র হতে হলে এই নশ্বর ঘৃণ্য দুনিয়ার চাহিদা, ভোগকে অবদমন করতে হবে। দুনিয়ার সম্পর্ক-সম্পদ ত্যাগ করে মঠবাসী জীবন বেছে নিতে হবে, সারাজীবন যাজক-নানরা বিয়ে করতে

[১] মৃত্যু : ২৪০ খ্রিস্টাব্দ

[2] James Swindal, Faith and Reason, The Internet Encyclopedia of Philosophy ( TEP)

পারবে না। পানি ব্যবহার ত্যাগ, লাগাতার উপবাস, নিজেকে নানাভাবে অকারণ কষ্ট দেওয়া, মানবিক চাহিদাকে বঞ্চিত করা, আত্মীয়দের বঞ্চিত করে চার্চের নামে সম্পদ লিখে দেওয়া ইত্যাদির মধ্যে স্বর্গ তালাশ করতে হবে। কেন আজ ইউরোপ ধর্মকে শত্রু হিসেবে দেখে, সেটা বুঝতে হলে আমাদের এই ইতিহাসগুলো জানতে হবে। William Edward Leckey তার History of European Morals গ্রন্থে সেসময়কার বৈরাগ্যচর্চার চলমান যে পদ্ধতিগুলো আমাদের জানাচ্ছেন—

৩০ বছর যাবৎ দিনে ১টি রুটি খেয়ে কাটানো গর্তে বসবাস ও প্রতিদিনের খাবার ৫টি ডুমুর

বছরে একবার চুল কাটা, ময়লা কাপড় পরা

ইচ্ছে করে মাছিকে দেহে কামড়ানোর সুযোগ দেওয়া

শরীরে ৮০ পাউন্ড, ১৫০ পাউন্ড সবসময় লোহা বহন করা

৩ বছর শুকনো ইঁদারার ভেতর বসবাস

৪০ দিন ৪০ রাত কাঁটাঝোপে অবস্থান

৪০ বছর বিছানায় গা না লাগিয়ে ঘুমানো

এক সপ্তাহ যাবৎ কিচ্ছু না খাওয়া, না ঘুমোনো

পানি স্পর্শ না করা। পানি ছোঁয়া, পা ধোয়া, হাত ধোয়াকে পাপ মনে করা। শরীরে এমনভাবে রশি বেঁধে রাখা যাতে শরীর কেটে পোকা ধরে যায়।

১ বছর যাবৎ দাঁড়িয়ে থাকা

পরিবারের সাথে আর কোনোদিন দেখা না করা

চোখ ঝাপসা না হওয়া অব্দি উপোস করা

এই আত্মা-বস্তুর পৃথকীকরণ আর অবতারবাদের গ্রিক দর্শন আর রোমান সমাজের প্রথা-পার্বণ মিলে খ্রিষ্টধর্মকে যে জগাখিচুড়ি বানাল, তার সাথে ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এই আজগুবি দুনিয়াত্যাগ মানবিকভাবে অসম্ভব প্রতিভাত হলো। ফলে সমাজে একটা অংশ অতিভোগবাদী হতে থাকল, তাও আবার চার্চের কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিরাও এর মধ্যে। একদিকে গির্জা-মঠে মায়া-প্রেম চাহিদার পৈশাচিক অবদমন। আরেকদিকে শহরে পাপাচারের জোয়ার। এই অসম্ভব জীবন স্বয়ং পাদরিদের পক্ষেই বজায় রাখা সম্ভব হতো না। সেন্ট বার্নার্ড বলেছিলেন :


গির্জাকে যদি সম্মানজনক বিয়ে থেকে বঞ্চিত করা হয়, তবে তাকে অবৈধ পত্নী গ্রহণ, নিকটাত্মীয়দের সাথে যৌনসম্পর্ক এবং অন্যান্য সব অপবিত্রতা ও পাপাচারের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।।।

তার এ কথা যাজকেরা কানেই তোলেনি। ঠিকই মঠগুলো হয়ে ওঠে গোপন কিন্তু অবাধ যৌনতার লীলাভূমি। কুমারী নারীদের সাথে সহাবস্থান ও সম্পদের অবাধ প্রবাহ স্বয়ং মঠাধ্যক্ষদেরও ইন্দ্রিয়পূজার দিকে ঠেলে দেয়। কোনো সেইন্ট ধরা খেলে পোপের পক্ষ থেকে এর শাস্তি ছিল বড়জোর অন্য মঠে বদলি বা বাধ্যতামূলক অবসর। ফলে সাধারণ জনগণ ও রাজক্ষমতার কাছে যাজকদের মর্যাদা কমতে থাকে। ঘৃণা এমন তীব্র হয় যে, ‘মঠবাসী' পরিণত হয় গালিতে ii) |

অর্থনৈতিক অত্যাচার

রোমান ক্যাথলিক চার্চ গড়ে তোলে যাজকতন্ত্র, যার শীর্ষে পোপ। পোপ নিয়োগ দিতেন দেশে দেশে প্রধান আর্চবিশপ। আর্চবিশপের অধীনে অন্যান্য চার্চ বা মঠে বিশপ নিয়োগ হতো। এই চার্চতন্ত্র ছিল রাজা-জমিদারদের পাশাপাশি আরেক প্যারালাল ব্যবস্থা। এরা কিছু কর আদায় করত, শাসনকার্যে হস্তক্ষেপ করত। টাইথ, অ্যানেট ইত্যাদি বিভিন্ন নামে নানা প্রকার ধর্মীয় কর আদার করা হতো রাজা ও বিশপদের থেকে। ক্রমেই বেড়ে চলছিল এই দাবি। পোপের কোষাগারকে বলা হতো 'unbottomed sack of Rome', রোমের অতলান্ত থলে।

যাজকশ্রেণির জীবনযাত্রা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিজাতদের চেয়েও ভোগবাদী ছিল। জার্মানির এক-তৃতীয়াংশ ও ফ্রান্সের এক-পঞ্চমাংশ সম্পদের মালিক ছিল চার্চ, কিন্তু পার্লামেন্টের প্রকিউরার জেনারেল ১৫০২ সালে হিসেব করে দেখান, ফ্রান্সের তিন-চতুর্থাংশের মালিক চার্চ। ইতালির এক-তৃতীয়াংশ ভূমির মালিক চার্চ কী একটা বিতিকিচ্ছি অবস্থা। একদিকে দুনিয়াত্যাগের ডাক, অন্যদিকে নিজেরাই দুনিয়ার মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। শুধু কি তাই? পোপ নিজেই বিশাল এক এলাকা সরাসরি শাসন করত, যাকে বলা হতো Papal State,

[1] H.E. Lea, An historical sketch of sacerdotal celibacy page:331

[২] ইরেসমাস (১৫০২ খ্রিস্টাব্দ)-এর সূত্রে Cambridge Modern History.

[৩] Will Durant, The Story of Civilization, page 17



রাজ্যশক্তির সাথে দ্বন্দ্ব

এরা কেবল ধর্মীয় বিষয়েই নয়, রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করত। দেশের রাজাকে পোপের অনুমোদন নিতে হতো। শুরু থেকেই চার্চ চাইছিল বিভিন্ন খ্রিষ্টান দেশের রাজা-জমিদারদের ওপর প্রভাব খাটাতে। আবার ওদিকে উলটো রাজারাও নানান ধর্মীয় বিষয়-আশয়ে প্রভাব খাটাতে চাইছিল।

রোমান সম্রাট ৪র্থ হেনরির নিযুক্ত বিশপকে বহিষ্কার করেন পোপ ৭ম গ্রেগরি। সম্রাট পোপকে সরিয়ে দিতে চান, উলটো পোপই সম্রাটকে ১০৭৬ সালে ধর্ম থেকে বহিষ্কার ঘোষণা করে। সম্রাট তাওবা করে ফেরত আসেন। ১০৮০ সালে পোপ আবার তাকে বহিষ্কার করেন। ১০৮৪ সালে সম্রাটই পোপকে সরিয়ে দেন। কী একটা নাটক, চিন্তা করেন।

■ বিশপ ও মঠাধ্যক্ষদের নিয়োগ নিয়ে জার্মান সম্রাট ও পোপের মধ্যে ৫০ বছর ধরে চলা বিবাদ শেষ হয় ১১২২ সালে Concordat of Worms-এর দ্বারা।

আর্চবিশপ নিয়োগ দেওয়া নিয়ে ইংল্যান্ডে রাজা জন ও পোপের মাঝে দ্বন্দ্ব।

৭ বছর ইংল্যান্ডকে ধর্মীয়ভাবে বয়কটে (interdict) রাখা হয়। ১২১৫ সালে

ম্যাগনাকার্টা দলিলের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে চার্চ-রাষ্ট্র সম্পর্ক সীমিত করা হয়।

■ পোপ বোনিফেস দাবি করে বসেন : নাজাতের জন্য প্রত্যেককে রোমান চার্চের অধীনতা স্বীকার করতে হবে। আধ্যাত্মিক প্রধানের পাশাপাশি পোপ পার্থিব বিষয়াদিরও প্রধান। এ নিয়ে ফ্রান্সের রাজা ৪র্থ ফিলিপের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শেষে ফিলিপ ১৩০৩ সালে পোপকে বহিষ্কার ও গ্রেপ্তার করে।

সাধারণ পাবলিকের কথাটা চিন্তা করুন। ধরুন আমাদের দেশেই সরকারের সাথে আলিম-ওলামার সংঘাতের সময় আমরা কী পরিমাণ ইনসিকিউরিটিতে ভুগি। ইউরোপীয়রা শতাব্দীর পর শতাব্দী এভাবে ভুগেছে।

জুলুমের নৈতিক অনুমোদন

এতো গেল একটা দিক। রাজার রাজত্ব ও জমিদারের জমিদারির পেছনে চার্চের নৈতিক অনুমোদন থাকত এবং লাগত। সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুর্ভোগ পোহাতে হতো। কোনো দণ্ড নয়, কেবল টর্চার করার জন্য কীসব যন্ত্র তৈরি


করা হয়েছিল, দেখুন। অবশ্য অধিকাংশই সহ্য না করতে পেরে মরেই যেত বলে মনে হয়। দুর্বল হৃদয়ের লোকদের দেখার দরকার নেই।

Iron Maiden একটা শলাকাযুক্ত আলমারির মতো। ভেতরে লোক ঢুকিয়ে পাল্লা লাগিয়ে দিলেই এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যেত।

Scold's Bridle মাথায় পরিয়ে মুখরা নারীকে বাজারে ঘোরানো হতো। Breast Ripper দিয়ে নারীদের স্তন ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হতো।

Heretic's Fork লাগিয়ে থুতনি গলা দুদিকেই ঢুকে যাবে ঘুমে মাথা ঝুঁকে এলেই।

Wooden horse-এর ওপর বসিয়ে ঘোড়াকে লাফালে লিঙ্গ যোনি-অণ্ডকোষ ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত।

Spanish Boot-এর প্যাঁচ কষে পা থেঁতলে নীল করে দেওয়া হতো। ১

ক্যাথলিক চার্চের ধর্মীয় আদালতের নাম ছিল Inquisition. অ-ক্যাথলিক খ্রিষ্টান থেকে নিয়ে মুসলিম-ইহুদি, জোয়ান অব আর্ক থেকে নিয়ে নাইট-টেম্পলারদের বিচারের নামে নির্যাতন, হত্যার মচ্ছব চলে কয়েক শতাব্দীজুড়ে। ডাইনি-নিধনের (witch-hunt) নামে ১৪৫০-১৭৫০ পর্যন্ত তিনশত বছরে ৫-৭ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, যাদের ৮০% ছিল নারী। ২০০ বছরে শুধু স্প্যানিশ ইনকুইজিশনে হত্যা করা হয় ৩২ হাজার মানুষ, শাস্তি-নির্যাতন করা হয় ৩ লক্ষ জনকে|| অন্যান্য দেশ তো বাদই রইল।

ক্রুসেড

এরপর ধরুন, ক্যাথলিক চার্চের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধনে ২০০ বছরের মাঝে ১০টা ক্রুসেড ইউরোপ লড়েছে মুসলিম সভ্যতার বিরুদ্ধে। যা খোদ ইউরোপের জন্যই অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। ক্রুসেডের নামে একটা ব্যাপক সামাজিক অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। কখনো মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে একের

[1] www.medievalwarfare.info

[2] Don Juan Antonio Llorente, a historian and bishop. who became commissary of the Holy Office (Inquisition) in 1789 William D. Rubinstein, Genocide [Routledge, 2004), 34


পর এক পরাজয়, কখনো আরেক ফিরকার খ্রিষ্টানদের সাথে যুদ্ধ ও লুটতরাজ, কখনো শিশুদের নিয়ে বাহিনী গঠন (শিশুদের ক্রুসেড ১২১২)। সালগুলো দেখুন। একই প্রজন্ম দুটো-তিনটে করে ক্রুসেড পেয়েছে কোনো কোনো বার

সাল

ফলাফল

১ম ক্রুসেড

১০৯৫-১০৯৯

২য় ক্রুসেড

১১৪৭-১১৪৯

৩য় ক্রুসেড

১১৮৯-১১৯২

খ্রিষ্টানদের জেরুসালেম পুনরুদ্ধার অভিযান, ব্যর্থ

৪র্থ ক্রুসেড

১২০৩-১২০৪

মুসলিমদের সাথে নয়, বাইজান্টাইন রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল দখল ও লুটতরাজ করল ক্যাথলিকরা।

৫ম ক্রুসেড

১২১৬-১২২১

খ্রিষ্টানদের মিশর আক্রমণ এবং মুসলিম বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ

৬ষ্ঠ ক্রুসেড

১২২৮-১২২৯

এক চুক্তিতে ১০ বছরের জন্য জেরুসালেম খ্রিষ্টানদের শাসনে, চুক্তির মেয়াদ শেষে | মুসলিমরা পুনর্দখল করে নেয়

৭ম ক্রুসেড

১২৩৯-১২৪১

| খ্রিষ্টান কর্তৃক জেরুসালেম আংশিক দখল, | ১২৪৪ সালে আবার তা মুসলিম বাহিনীর দখলে

৮ম ক্রুসেড

| ১২৪৯-১২৫০

মিসরের বিরুদ্ধে, খ্রিষ্টানরা পরাজিত

৯ম ক্রুসেড

১২৮৯

১০ম ও শেষ ক্রুসেড

মুসলিমরা পরাজিত

নুরুদ্দিন জঙ্গি রাহিমাহুল্লাহর হাতে খ্রিষ্টান | বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়।

১২৯০-১২৯১

ক্রুসেডার রাষ্ট্র ত্রিপোলি দখল করে মুসলিমরা

নৌবহর পাঠানো হয় শেষ ক্রুসেডার রাষ্ট্রগুলো রক্ষার জন্য। শেষ খ্রিষ্টান রাষ্ট্র Acre দখল করে মুসলিমরা।

একেকটা যুদ্ধ মানে ব্যাপক প্রস্তুতি, কৃষক-শিল্পীদের সেনাদলে রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং, যুদ্ধব্যয়ের জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ, সেই ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি থেকে মধ্যপ্রাচ্য অব্দি আসা। দশ-বিশ বছর পরপরই যুদ্ধের ডাক, পরাজয়ের পর পরাজয়। সহ্যের তো আসলেই একটা সীমা আছে, ভাই।



দর্শন-বিজ্ঞানের বিরোধিতা

ঠিক যেমন খ্রিষ্টবাদ মানব-চাহিদার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, একইভাবে দাঁড়িয়ে গেল প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিরুদ্ধেও। বাইবেলের ওল্ড-নিউ কোনোটাই মূল চেহারায় নেই। এটা এদের ভাষাশৈলী থেকেই বোঝা যায়। কুরআন যেমন আদেশ-নির্দেশসূচক ভাষারীতিতে। আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন, 'হে মানবজাতি, এটা করো, ওটা করো না, হে নবি আপনি বলুন।' বর্তমান বাইবেলে (পুরাতন ও নতুন) বাচনভঙ্গি বর্ণনামূলক, যেন কেউ বিবরণ দিচ্ছে, গল্প শোনাচ্ছে। অতঃপর সদাপ্রভু বললেন...' কিংবা ‘খোদাবন্দ ঈসা মসিহ পাহাড়ে উঠলেন।' ওহির সমকক্ষ তো নয়ই। হাদিসের ইকুইভ্যালেন্টও না।

যেমন ধরুন, কুরআন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে বের হতে দেরি, সাহাবিদের লিখে নিতে দেরি নেই। পড়ালেখা-জানা সাহাবিদের এক দলই ছিল ‘কাতিবুল ওয়াহি’ (ওহি লেখক)। তাদের কেউ না কেউ সর্বদা নবিজির সাথে থাকতেন। ওহি নাযিল হওয়ামাত্র তারা মুখস্থও করে নিতেন এবং লিখেও ফেলতেন। যে বছর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করেন, সেই বছরই এক যুদ্ধে (ইয়ামামা) ৭০ জন সাহাবি শহিদ হলেন, যারা প্রত্যেকে পুরো কুরআন মুখস্থ করেছিলেন। আরো জীবিত তো ছিলেন বহু। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি প্রজন্মে লক্ষ লক্ষ মানুষ ৩০ পারা কুরআন পুরোটা মুখস্থ করে রেখেছে। শুধু লেখা হলে কিছু কিছু হারিয়ে যেত, শুধু মুখস্থ হলেও হারিয়ে যেত, বিকৃত হয়ে যেত। দুটোই একসাথে হয়েছে, ফলে এখন যে কুরআন আমরা পড়ি, তা হুবহু সেই কুরআন, যা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে বেরিয়েছে আর সাহাবিরা লিখেছেন। এই যুদ্ধের পর আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু আর দেরি করেননি, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর পরামর্শে পুরো কুরআন একটা বই আকারে লিখিয়ে নেন, হাফিযদের মুখস্থের সাথে মিলিয়ে, অর্থাৎ নবিজির মৃত্যুর ঠিক পরের বছরই। পরবর্তী সময়ে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু সেটাকে ৭টা কপি করে নানান প্রদেশে পাঠান, সেই কপিগুলোর ২/৩টা আজও আছে। মানে সবচেয়ে প্রাচীন কপি নবিজির ওফাতের ১৫ বছরের মাঝে লেখা। আর এই ১৫ বছরের মাঝে মূল একটা কমপ্লিট কপি তো ছিলই, সাথে ছিল হাজারো হাফিয সাহাবি-তাবিয়ি।

বিপরীতে কট্টর ইহুদিদের দাবি মতে তাওরাত নাযিল হয়েছে ১৩১২ খ্রিষ্টপূর্ব পরের ৪০ বছরব্যাপী লিপিবদ্ধ হয়। কম কট্টরদের মতে, কয়েক শতাব্দী ধরে লেখা হয়, লেখকও বেশ কয়েকজন; কিন্তু বর্তমানে প্রাপ্ত তাওরাতটি ৪৫০-৩৫০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়ে রচিত। ৫৮৭ খ্রিষ্টপূর্ব সালে পারস্য সম্রাট নেবুচাদ নেজার জেরুসালেম লুট করে ধুলোয় মিশিয়ে দেন, বাইতুল মাকদিস পুড়িয়ে দেন, ইহুদিদের দাস বানিয়ে ব্যাবিলনে নিয়ে যান। তাওরাত হারিয়ে যায়। ৪৮৭ খ্রিষ্টপূর্ব সালে Ezra (ঊযায়ের আলাইহিস সালাম) তাদেরকে জেরুসালেমে আবার নিয়ে আসেন এবং বর্তমান তাওরাত দিয়ে বলেন, এটাই মুসা-নবির তাওরাত [১]। মোদ্দাকথা, ওল্ড টেস্টামেন্ট ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন গ্রন্থ। এর লিখন-সংরক্ষণ-ধ্বংস-পুনরাবিষ্কার মিলিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই তাওরাত সেই মুসা আলাইহিস সালামের মুখনিঃসৃত ওহি কি না।

আবার ধরুন নিউ টেস্টামেন্ট। একটা বিরাট অংশ তো শিষ্যদের লেখা চিঠিপত্র। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো ওহি নয়, যা নবিদের ওপর নাযিল হয়। পুরো নিউ টেস্টামেন্টের সবচেয়ে প্রাচীন কপি (চিঠিগুলোসহ) ৩৬৭ সালের। ৪টা গসপেল মূলত যীশুর জীবনী, যেমন আমাদের নবিজির সিরাহ, কিন্তু পার্থক্য হলো, আমাদের নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাহও সরাসরি তার সাহাবিদের বর্ণিত। কিন্তু ৪টা গসপেল-লেখকের কেউই ঈসা-নবির সাহাবি (হাওয়ারি) নয়। New Oxford Annotated Bible জানাচ্ছে—

[১] এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, ঊষাইর আলাইহিস সালাম তো নবি ছিলেন। তাহলে তিনি যখন তাওরাতের কপি দিয়ে বললেন, এটাই মুসা আলাইহিস সালামের ওপর নাযিলকৃত তাওরাত, তাহলে তো তার কথা বিশ্বাস করতেই হবে। কারণ তিনি ছিলেন নবি, আর নবিগণ কখনো মিথ্যা বলেন না। তাদের কথা ও কাজে থাকে সরাসরি আল্লাহর সাহায্য-সমর্থন। তাই নবি উযাইর আলাইহিস সালাম বর্তমান তাওরাতকে অবিকৃত তাওরাত বলে অভিহিত করায় প্রমাণ হলো যে, এটাই সে তাওরাত, যা মুসা আলাইহিস সালামের ওপর নাযিল হয়েছিল

এটার উত্তরে আমরা বলতে পারি, উযাইর আলাইহিস সালাম নবি কি না, সে ব্যাপারে মতানৈক্য আছে। নিঃসন্দেহে তিনি ইহুদিদের মধ্যে অত্যন্ত নেককার ও বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তার নবি হওয়ার বিষয়টি অকাট্য নয়। সহিহ সনদে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমার জানা নেই যে, উযাইর নবি কি না।' [সুনানু আবি দাউদ : ৪৬৭৪] অতএব, তার নবি হওয়ার বিষয়টি যেহেতু সুনিশ্চিত নয়, তাই মুসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত প্রমাণিত বিশুদ্ধ সনদ ছাড়া শুধু তার কথার ওপর নির্ভর করে তাওরাতের বিশুদ্ধতা যাচাই করা সম্ভব নয়। অতএব, বর্তমানের তাওরাত এন্থটি মুসা আলাইহিস সালামের ওপর নাযিলকৃত সেই অবিকৃত তাওরাত কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে। মোটকথা, অকাট্যভাবে কেউ বর্তমানের তাওরাতকে মুসা আলাইহিস সালামের ওপর নাযিলকৃত প্রকৃত তাওরাত বলে প্রমাণ করতে পারবে না।— শারয়ি সম্পাদক

আরো পড়তে অথবা দেখতে - অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন। We Respect Every Author Hardwork - boipaw

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ