বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর সকল গল্প ও উপন্যাস সমগ্র pdf | Bibhutibhushan Bandyopadhyay Books Archive

          আমি কেমন করে লেখক হলাম!

আমি কেমন করে লেখক হলাম , এ আমার জীবনের , আমার নিজের কাছেই , একটা অদ্ভুত ঘটনা । অবশ্য হয়তো একথা ঠিক , নিজের জীবনের অতি তুচ্ছতম অভিজ্ঞতাও নিজের কাছে অতি অপূর্ব । তা যদি না হত , তবে লেখক জাতটারই সৃষ্টি হত না । নিজের অভিজ্ঞতাতে এরা মুগ্ধ হয়ে যায় আকাশ প্রতিদিনের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে কত কল্পনাকে রচনা করছে যুগে যুগে — তারই তলে কত শত শতাব্দী ধরে মানুষ নানা তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজের দিন কাটিয়ে চলেছে ; মাননুষের জন্ম - মৃত্যু আশা - নৈরাশ্য , হর্ষ - বিবাদ , ঋতুর পরিবর্তন , বনপষ্পের আবির্ভাব ও তিরোভাব —
Image

কত ছোট বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে পৃথিবীতে — কে এসব দেখে , এসব দেখে মুগ্ধ হয় ? এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাদের চোখে কল্পনা সব সময়েই মোহঅঞ্জন মাখিয়ে দিয়ে রেখেছে । অতি সাধারণ পাথীর অতি সাধারণ সরেও তাদের মনে আনন্দের ঢেউ তোলে , অস্তদিগন্তের রক্তমেঘপ স্বপ্ন জাগায় , আবার হয়ত তারা অতি দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে । এরাই হয় লেখক , কবি , সাহিত্যিক । এরা জীবনের সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক । এক যগের দঃখবেদনা আশা আনন্দ অন্য যুগে পৌঁছে দিয়ে যায় । আমার জীবনের সেই অভিজ্ঞতা তাই চিরদিনই আমার কাছে অভিনব , অমূল্য , দুর্লভ হয়ে রইল । যে ঘটনা আমার জীবনের স্রোতকে সম্পূর্ণ অন্য দিকে বাঁক ফিরিয়ে দিয়েছে — আমার জীবনে তার মূল্য অনেকখানি । 

১৯২২ সাল । বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি নিয়ে ডায়মণ্ডহারবার লাইনে একটা পাপ্পী গ্রামের হাইস্কুলে মাস্টারি চাকুরি নিয়ে গেলাম আষাঢ় মাসে । বর্ষাকাল , নতুন জায়গায় গিয়েছি । অপরিচিতের মহলে নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বোধ করছি । বৈঠকখানা ঘরের সামনে ছোট্ট একট , ঢাকা বারান্দাতে একলা বসে সামনে সদর রাস্তার দিকে চেয়ে আছি , এমন সময় একটি ষোল - সতের বছর বয়সের ছেলেকে একখানা বই হাতে যেতে দেখে তাকে ডাকলাম কাছে । আমার উদ্দেশ্য , তার হাতে কি বই দেখব এবং যদি সম্ভব হয় পড়বার জন্যে চেয়ে নেব একদিনের জন্যে । বইখানা দেখেছিলাম , একখানা উপন্যাস । তার কাছে চাইতে সে বললে , এ লাইব্রেরির বই , 

💕একনজরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্ম থেকে মৃত্যু

লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙালি ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক।
জন্ম তারিখ : ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪; কাঁচড়াপাড়া
মৃত্যু তারিখ : ১ নভেম্বর ১৯৫০; ঘাটশিলা
প্রাপ্ত পুরস্কার : রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫১)
উল্লেখযোগ্য কাজ: চাঁদের পাহাড়; আদর্শ হিন্দু হোটেল; আরণ্যক; ইছামতী; দেবযান ; পথের পাঁচালী

আজ ফেরত দেওয়ার দিন । আপনাকে তো দিতে পারছি নে , তবে লাইব্রেরি থেকে বই বদলে এনে দেব এখন । —-লাইব্রেরি আছে এখানে ? —বেশ ভাল লাইব্রেরি , অনেক বই । দ্ , আনা চাঁদা । —আচ্ছা চাঁদা দেব , আমায় বই এনে দিও । ছোকরা চলে গেল এবং ফেরবার পথে আমাকে একখানা বই দিয়েও গেল । আমি তাকে বললম — তোমার নামটি কি হে ? সে বললে — আমার নাম পাঁচ , গোপাল চক্রবর্তী , কিন্তু এ গ্রামে আমাকে সবাই বালক কবি বলে জানে । আমি একটু অবাক হয়ে বললাম - বালক - কবি বলে কেন ? কবিতাটবিতা লেখ নাকি ? ছেলেটি উৎসাহের সঙ্গে বললে - লিখি বই কি । না লিখলে কি আমাকে বালক কবি নাম দিয়েছে ? আচ্ছা কাল এনে দেখাব আপনাকে । পরদিন সে সকাল বেলাতেই এসে হাজির হল । সঙ্গে একখানা ছাপানো গ্রাম্য মাসিক পত্রিকা গোছের । 


আমাকে দেখিয়ে বললে — এই দেখন , এই কাগজখানা আমাদের গাঁ থেকে বেরোয় । এর নাম ' বিশ্ব ' । এই দেখুন প্রথমেই ' মানুষ ' বলে কবিতাটি আমার । এই আমার নাম ছাপার অক্ষরে লেখা আছে কবিতার ওপরে বলেই ছোকরা সগর্বে কাগজ খানা আমার নাকের কাছে ধরে নিজের নামটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে । হ্যাঁ সত্যিই— লেখা আছে বটে , কবি পাঁচগোপাল চক্রবর্তী । তাহলে তো নিতান্ত মিথ্যা বলে নি দেখছি । কবিতাটি সে - ই আমায় পড়ে শোনালে । বিশ্বের মধ্যে মানুষের স্থান খুব বড়– ইত্যাদি কথা নানা ছাঁদে তার মধ্যে বলা হয়েছে । অবশ্য কাগজখানা দেখে আমার খুব ভক্তি হল না । স্টেশনের কাছে একটা ছোট প্রেস আছে এখানে , সেই প্রেসেই ছাপানো— অতি পাতলা জিল - জিলে কাগজ । পত্রিকাথানিকে ‘ মাসিক ' ' পাক্ষিক ' ইত্যাদি না বলে ‘ ঐকিক ’ বললেই এর স্বরূপ ঠিক বোঝানো হয় । 

অর্থাৎ যে শ্রেণীর পত্রিকা গ্রামের উৎসাহী লেখা - বাতিকগ্রস্ত ছেলে - ছোকরার দল চাঁদা তুলে একটিবার মাত্র বার করে , কিন্তু পরের বারে উৎসাহ মন্দীভূত হওয়ার দরুন আশানূরূপ চাঁদা না ওঠাতে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় — এ সেই শ্রেণীর পত্রিকা । তব , আমার ঈর্ষা না হয়ে পারল না । আমি লিখি না বা লেখার কথা কখনও চিন্তাও করি না । অথচ এতটুকু ছেলে — এর নাম দিব্যি ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে গেল । এর ওপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হল , মনে ভাবলাম , বেশ ছোকরা তো ! অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে কেমন কবিতা লিখেছে ! সাহিত্যের সমঝদারিত্ব তার মধ্যে ছিল তা আমি জানি । তখনকার আমলের একজন বিশেষ লেখকের বই না থাকলে পল্লীগ্রামের কোন লাইব্রেরি চলত না । সেই লেখকের এক একখানা বই - এর তিন চার কপি পর্যন্ত রাখতে হত কোন কোন বড় লাইব্রেরিতে । ছেলেটি বলত— ওসব ট্র্যাশ - ট্র্যাশ ! দেখবেন ওসব টিকবে না । এক একদিন পাঁচ , গোপাল আমাকে নিয়ে গ্রামের মাঠে বেড়াতে যেত । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চোখও তার বেশ ছিল- মাঝে মাঝে মুখে মুখে কবিতা তৈরী করে আমাকে শোনাত ।

 অনেকগুলো কবিতা হলে পর একটা কবিতার বই ছাপাবে এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করত । সেই সময় কলকাতার কোনও ' পাবলিশিং হাউস ' ছয় - আনা গ্রন্থাবলী প্রকাশ শুরু করে দিল তার প্রথম বই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথের বইখানি স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে পাঁচগোপাল আমায় এনে দিয়ে বললে— “ এ বই নিতে ভিড় নেই । নতুন এসেছে , এক - আধজন নিয়েছিল , কাল ফেরত দিয়ে গিয়েছে , কিন্তু দেখন গে যান অমকের বই - এর জন্যে বি যে মারামারি । ডিটেকটিভ উপন্যাস না রাখলে লাইব্রেরি উঠে যাবে । কেউ চাঁদা দেবে না । " পরের মাসে আর একখানি বই বেরুল ।
 
 সেখানা আমার কাছে নিয়ে এসে সে বললে— “ আমি একটা কথা ভাবছি , আসন আপনাতে আমাতে এই রকম উপন্যাস সিরিজ বের করা যাক । খুব বিক্রি হবে , আর একটা নামও থেকে যাবে । আপনি যদি ভরসা দেন , আমি উঠে পড়ে লাগি । " আমি বিস্ময়ের সরে বললাম “ তুমি আর আমি দুজনে মিলে বই - এর কারবার করব , এ কখনও সম্ভব ? এ ব্যবসার আমরা কিই বা জানি ? তা ছাড়া , বই লিখবেই বা কে ? এতে লেখকদের পারিশ্রমিক দিতে হবে , সে পয়সাই বা দেবে কে ? " সে হেসে বললে- “ বাঃ তা কেন , বই লিখবেন আপনি , আমিও দু, -একখানা লিখব ।


পরকে টাকা দিতে যাব কেন । ” বাংলা সাহিত্যকে ভালবাসতাম বটে , কিন্তু নিজে কলম ধরে বই লিখব এ ছিল সম্পূর্ণ দূরাশা আমার কাছে । অবিশ্যি পাঠ্যাবস্থায় অন্য অনেক ছাত্রের মত কলেজ ম্যাগাজিনে দ্দু - একটা প্রবন্ধ , এক - আধটা কবিতা যে না লিখেছি তা নয় , বা প্রতিবেশীর অনুরোধে , বিবাহের প্রীতি - উপহারে কবিতা যে দ - পাঁচটা না লিখেছিলাম তাও নয় – কিন্তু নে কে না লিখে থাকে ? সুতরাং আমি তাকে বললাম— “ লেখা কি ছেলেখেলা হে যে কলম নিয়ে বসলেই হল ? ওসব খামখেয়ালি ছাড় । আমি কখনও লিখিনি , লিখতে পারবও না । তুমি হয়ত পারবে আমার দ্বারা ওসব হবে না । ” সে বললে— “ খূব হবে । আপনি যখন বি - এ পাস , তখন আপনার কাছে এমন কিছু , কঠিন হবে না । 

একটা , চেষ্টা করুন তাহলেই হয়ে যাবে । ” তখন বয়েস অল্প , বুদ্ধি সদ্ধি পাকে নি , তব্দও আমার মনে হল , বি - এ পাস তো অনেকেই করে , তাদের মধ্যে সকলেই লেখক হয় না কেন ? অথচ বি - এ পাস করা লোকদের ওপর পাঁচগোপালের এই অহেতুক শ্রদ্ধা ভেঙে দিতেও মন চাইল না । এ নিয়ে কোনও তর্ক ' আমি আর তার সঙ্গে করি নি । কিন্তু করলেই ভাল হত , কারণ এর ফল হয়ে দাঁড়াল বিপরীত । দিন দশেক পরে একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি সেখানে নোটিশ বোর্ডে , দেওয়ালের গায়ে , নারকেল গাছের গাড়িতে সর্বত্র ছাপানো কাগজ টাঙানো — তাতে লেখা আছে , —– বাহির হইল ! বাহির হইল !! বাহির হইল !!! এক টাকা মূল্যের গ্রন্থমালার প্রথম উপন্যাস । 

লেখকের নামের স্থানে আমার নাম দেখলাম । আমার তো চক্ষুস্থির । এ নিশ্চয় সেই পাঁচ , গোপালের কীর্তি । এমন ছেলেমানুষি সে করে বসবে জানলে কি তার সঙ্গে মিশি ! বিপদের ওপর বিপদ , স্কুলে ঢুকতেই শিক্ষক ছাত্রবৃন্দ সবাই জিজ্ঞেস করে— “ আপনি লেখক তা তো এতদিন জানতাম না মশাই ? বেশ বেশ ! তা বইখানা কি বেরিয়েছে নাকি ? আমাদের একবার দেখিয়ে যাবেন । ” হেডমাস্টার ডেকে বললেন , তাঁর স্কুল লাইব্রেরিতে একখানা বই দিতে হবে । সকলের নানারূপ সকৌতূহল প্রশ্ন এড়িয়ে চলি সারাদিন কবে থেকে আমি লিখছি , আর আর কি বই আছে , ইত্যাদি । স্কুলের ছুটির পরে বাইরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি । এমন বিপদেও মানুষ পড়ে ! তাকে খাঁজে বার করলাম বাসায় এসে ।


 দস্তুরমত তিরস্কার করলাম তাকে , এ তার কি কাণ্ড ! কথার কথা একবার একটা হয়েছিল বলে একেবারে নাম ছাপিয়ে এরকমভাবে বার করে , লোকে কি ভাবে ! সে নির্বাক হয়ে দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বললে— “ তাতে কি হয়েছে ? আপনি তো এক রকম রাজিই হয়েছেন লিখতে । লিখুন না কেন ! ” আমি বললাম- “ বেশ ছেলে বটে তুমি ! কোথায় কি তার ঠিক নেই , তুমি নাম ছাপিয়ে দিলে কি বলে , আর দিলে দিলে একেবারে স্কুলের দেওয়ালে , নোটিশ বোর্ডে— সর্বত ছড়িয়ে দিয়েছ , এ কেমন কাণ্ড ? নামই বা পেলে কোথায় ? কে তোমাকে বলেছিল ও নামে আমি কিছু কিছু লিখেছি বা লিখব ? " যাক — পাঁচগোপাল তো চলে গেল হাসতে হাসতে । এদিকে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে সকলের প্রশ্নে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে হল- বই বেরচ্ছে কবে ? কত দেরি আছে আর বই বেরবার ? –মহামশকিলে পড়ে গেলাম । 
 
সে যা ছেলেমানুষি করে ফেলেছে তার আর চারা নেই । আমি এখন নিজের মান বজায় রাখি কেমন করে ? লোকের অত্যাচারের চোটে তো অস্থির হয়ে পড়তে হয়েছে । সাতপাঁচ ভেবে একদিন স্থির করলাম — এক কাজ করা যাক । সে এক টাকা সিরিজের বই কোনদিনই বের করতে পারবে না । ওর টাকা কোথায় যে বই ছাপাবে ? বরং আমি একখানা খাতায় যা হয় একটা কিছু লিখে রাখি - লোকে যদি চায় , খাতাখানা দেখিয়ে বলা যাবে , আমার তো লেখাই রয়েছে , ছাপা না হলে আমি কি করব । কিন্তু লিখি কি ? জীবনে কখনও গল্প লিখি নি , কি করে লিখতে হয় তাও জানা নেই । 

কি ভাবে প্লট যোগাড় করে , কি কৌশলে তা থেকে গল্প ফাঁদে - কে বলে দেবে ? প্লটই বা পাই কোথায় ? আকাশ - পাতাল ভাবি প্রতিদিন কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি নে । গল্প লেখার চেষ্টা কোনদিন করি নি । পাঠ্যাবস্থায় সারেন বাঁড়জ্যে ও বিপিন পালের বক্তৃতা শনে সাধ হত , লেখক হতে পারি আর না পারি , একজন বড় বক্তা হতে হবেই । কিন্তু লেখক হবার কোন আগ্রহই কোনদিন ছিল না , সে চেষ্টাও করি নি । কাজেই প্রথমে মুশকিলে পড়ে গেলাম । সাতপাঁচ ভেবে প্লট সংগ্রহ আর করতে পারি না কিছুতেই । মন তখন বিশ্লেষণমূখী অভিব্যক্তির পথ খুঁজে পায় নি । সব কিছুতেই সন্দেহ , সব কিছুতেই ভয় 

অবশেষে একদিন এক ঘটনা থেকে মনে একটা ছোট গল্পের উপাদান দানা বাঁধল । সেই পল্লীগ্রামের একটি ছায়াবহল নিভৃত পথ দিয়ে শরতের পরিপূর্ণ আলো ও অজস্র বিহঙ্গকাকলীর মধ্যে প্রতিদিন স্কুলে যাই , আর একটি গ্রাম্য বধূকে দেখি পথিপার্শ্বের একটি পুকুর থেকে জল নিয়ে কলসী কক্ষে প্রতিদিন স্নান করে ফেরেন । প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় — কিন্তু দেখা ওই পর্যন্ত । তাঁর পরিচয় আমার অজ্ঞাত এবং বোধ হয় অজ্ঞাত বলেই একটি রহস্যময়ী মূর্তিতে তিনি আমার মানসপটে একটা সাময়িক রেখা অঙ্কিত করেছিলেন ।


মনে মনে ভাবলাম এই প্রতিদিনের দেখা অথচ সম্পূর্ণ অপরিচিত বন্ধুটিকে কেন্দ্র করে একটি গল্প আরম্ভ করা যাক তো , কি হয় দেখি ! গল্প শেষ করে সেই গ্রামের দু - এক জনকে পড়ে শোনালাম — পাঁচকেও । কেউ বলে ভাল হয়েছে , কেউ বললে মন্দ হয় নি । আমার একটি বন্ধুকে কলকাতা থেকে নিমন্ত্রণ করে গল্পটি শানিয়ে দিলাম । সেও বললে ভাল হয়েছে । আমি তখন একেবারে কাঁচা লেখক ; নিজের ক্ষমতার ওপর কোন বিশ্বাস আদৌ জন্মায় নি । যে আত্মপ্রত্যয় লেখকের একটি বড় পাজি , আমি তখন তা থেকে বহ , দূরে , সাতরাং অপরের মতামতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে উপায় কি । আমার কলকাতার বন্ধুটির সমঝদারিত্বের ওপর আমার শ্রদ্ধা ছিল— তার মত শহনে খুশি হলাম । 

পাড়াগাঁয়ে স্কুলমাস্টারি করি । কলকাতার কোন সাহিত্যিক বা পত্রিকা সম্পাদককেই চিনি না — সত্তরাং লেখা ছাপানো সম্বন্ধে আমায় একপ্রকার হতাশ হতে হল । এইভাবে পূজার অবকাশ এসে গেল , ছুটিতে দেশে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে এলাম । পূনরায় ফিরে এসে কাগজপত্রের মধ্যে থেকে আমার সেই লেখাটি একদিন বার করে ভাবলাম , আজ এটি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখা যাক । ঘরেতে ঘুরতে একটা পত্রিকা আপিসের সামনে এসে পড়া গেল । আমার মত অজ্ঞাত অখ্যাত নতুন লেখকের রচনা তারা ছাপবে এ দূরাশা আমার ছিল না , তব , সাহস করে গিয়ে ঢঢুকে পড়লাম । 

দেখা যাক না কি হয় , কেউ খেয়ে তো ফেলবে না , না হয় লেখা না - ই ছাপবে । ঘরে ঢুকেই একটি ছোট টেবিলের সামনে যাঁকে কর্মরত দেখলাম , তাঁকে নমস্কার করে ভয়ে ভয়ে বলি— “ একটা লেখা এনেছিলাম— " ; ভদ্রলোক মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন , “ আর কোথাও আপনার লেখা কি বেরিয়েছিল ? আচ্ছা রেখে যান , মনোনীত না হলে ফেরত যাবে । ঠিকানাটা রেখে যাবেন । ”


লেখা দিয়ে এসে স্কুলের সহকর্মী ও গ্রামের আলাপী বন্ধুদের বলি— “ লেখাটা নিয়ে বলেছে শীগগির ছাপবে । ” পি পি ডাকঘরে গিয়ে বলে এলাম , আমার নামে যদি কেপোস্ট গে৷ছের কিছু আসে , তবে আমাকে স্কুলে বিলি যেন না করা হয় । কারণ লেখা ফেরত এসেছে এটা তাহলে জানাজানি হয়ে যাবে সহকর্মী ও ছাত্রদের মধ্যে । দিন গনি , একদিন সত্যিই ডাকপিওন স্কুলে আমায় বললে আপনার নামে একটা বকপোস্ট এসেছে , কিন্তু গিয়ে নিয়ে আসবেন । আমার মুখে বিবর্ণ হয়ে গেল । নবজাত রচনার প্রতি অপরিসীম দরদ যাঁরা অনুভব করেছেন তাঁরা বুঝবেন আমার দুঃখ । 

এতদিনের আকাশকুসম চয়ন তবে ব্যর্থ হল , লেখা ফেরত দিয়েছে ! " 2 কিন্তু পরদিন ডাকঘর থেকে বকপোস্ট নিয়ে দেখি যে , আমার রচনাই বটে , কিন্তু তার সঙ্গে পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের একটি চিঠি । তাতে লেখা আছে , রচনাটি তাঁরা মনোনীত করেছেন , তবে সামান্য একটু - আধট , অদল - বদলের জন্যে ফেরত পাঠানো হল , সেটুকু করে আমি যেন লেখাটি তাঁদের ফেরত পাঠাই , সামনের মাসে ওটা ছাপা হবে । অপূর্ব আনন্দ আর দিগজয়ীর গর্ব নিয়ে ডাকঘর থেকে ফিরি । সগর্বে নিয়ে গিয়ে চিঠিখানা দেখাতেই সবাই বললেন— “ কার , সঙ্গে আপনার আলাপ আছে বুঝি ওখানে ? 

— আজকাল আলাপ না থাকলে কিছু হবার জো - টি নেই । সব খোশামোদ , জানেনই তো । ” তাঁদের আমি কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না , যাঁর হাতে লেখা দিয়ে এসেছিলাম , তাঁর নাম পর্যন্ত আমার জানা নেই ! তার পর সে গ্রামের এমন কোনও লোক রইল না , যে আমার চিঠিখানা একবার দেখলে । কারও সঙ্গে দেখা হলে পথে তাকে আটকাই এবং সম্পূর্ণ অকারণে চিঠিখানা আমার পকেট থেকে বেরিয়ে আসে এবং বিপন্ন মুখে তাকে বলি — তাই তো , ওরা আবার একখানা চিঠি দিয়েছে , একটা লেখা চায় — সময়ই বা তেমন কই ! হায় ! 

সে সব লেখকজীবনের প্রথম দিনগুলি ! সে আনন্দ , সে উৎসাহ , ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার বিস্ময় আজও স্মরণে আছে  , ভুলি নি । নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যে যে গৌরব এবং আত্মপ্রসাদ নিহিত , লেখকজীবনের বড় পরস্কার সবচেয়ে তাই - ই । স্বচ্ছ সরল ভাবান , ভূতির যে বাণীরূপ কবি ও কথাশিল্পী তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে যান —তা সার্থক হয় তখনই , যখন পাঠক সেই ভাব নিজের মধ্যে অনূভব করেন । এইজন্য লেখক ও পাঠকের সহানুভূতি ভিন্ন কখনও কোন রচনাই সার্থকতা লাভ করতে পারে না । বালক - কবির নিকট অমি কৃতজ্ঞ । সে - ই একরকম জোর করে আমাকে সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে নামিয়েছিল । পাঁচ , গোপালের সঙ্গে মাঝে দেখা হয়েছিল । সে এখন চব্বিশ পরগণার কাছে কি একটা গ্রামের উচ্চ প্রাথমিক পাঠশালায় হেডমাস্টার । এখনও সে কবিতা লেখে । 

জুন ১৯৪৪ – বেতারে পঠিত ।

Bibhutibhushan Bandyopadhyay Golpo Somogro PDF

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ